সহজিয়া কড়চা-‘মূর্খের অশেষ বুদ্ধি’ ও নিৎশের দর্শন by সৈয়দ আবুল মকসুদ
যার বুকে বল নাই অর্থাৎ নৈতিক সাহস নাই, হাতে-পায়ে জোর নাই, মাথায় প্রখর বুদ্ধি নাই—তার একমাত্র সম্বল মুখ। পক্ষাঘাতগ্রস্ত ছাড়া, যে কেউ মুখের সদ্ব্যবহার করতে পারে। শত্রু হোক, প্রতিপক্ষ হোক, অপছন্দের মানুষ হোক—তার নিন্দা করা বা তার সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা সাজিয়ে দশ কথা বলা পৃথিবীর সহজতম কাজগুলোর একটি।
আমার বাবা কোনো এক সংস্কৃত শাস্ত্রে একটি শ্লোক দেখতে পেয়েছিলেন। কথাটি তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। শুধু কাজের লোকদের নয়, অন্য কাউকেও উল্টাপাল্টা কাজ করতে দেখলে ওই প্রবচনটি প্রায়ই বলতেন। শ্লোকটির বাংলা তর্জমা: ‘মূর্খের অশেষ বুদ্ধি’। এর বিশিষ্টার্থ হলো: যার বুদ্ধি কম, সে কী করবে না করবে, তা ঠাওর করতে পারে না। নানা রকম বুদ্ধি আঁটে। কিন্তু যে বুদ্ধিমান, সে একটি বুদ্ধি প্রয়োগ করেই কাজ সারতে পারে।
জগতে যত জটিল বিষয় আছে, তার মধ্যে রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার কাজটি অতি জটিল। প্রখর বুদ্ধিমান ছাড়া ওই ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন অসম্ভব। মোটা বুদ্ধির মানুষ মূর্খেরই শামিল। তারা নানা রকম অশুভ বুদ্ধির আশ্রয় নিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত অন্যের বিপদ শুধু নয়—নিজেদের বিপর্যয়ও ডেকে আনে। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব জীবনের গভীরতম বিষয়গুলো অতি সহজ-সরল ভাষায় শিষ্যদের বোঝাতেন। কোথাও পড়েছি, তিনি তাঁর শিষ্যদের বলছেন, ‘বুদ্ধিমান হও, চালাক হয়ো না।’ জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই অসাধু না হওয়ার তাগিদ তো দিতেনই। তাঁর বিখ্যাত উক্তি: সাধু সেজো না, সাধু হও।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎশে বলেছেন, ক্ষমতা প্রয়োগের ইচ্ছা মানুষের আদিমতম প্রবৃত্তি। তাঁর দর্শনের মূল কথা—মানুষের মূল আকাঙ্ক্ষা হলো 'The will to power'। খুব বেশি রাজনৈতিক ক্ষমতাপ্রত্যাশীদের ক্ষেত্রেই কথাটা বেশি প্রযোজ্য। নিৎশের দর্শন ছিল হিটলারের খুব পছন্দ, একসময় ন্যাশনাল সোশ্যালিস্টদের রাষ্ট্রীয় দর্শনে পরিণত হয়েছিল নিৎশের তত্ত্ব।
বড় বড় রাষ্ট্র নেতার কথা বাদ দিলেও সবচেয়ে ছোট মানুষের মধ্যেও দেখা যায় ক্ষমতা প্রয়োগের স্পৃহা। সেসব পদ এখন নেই, উঠে গেছে। ছোটবেলায় আমি দেখেছি, গ্রামে একজন পেয়াদারও কী প্রতাপ। কারণ, সে তার খুঁটির জোরে দুর্বল যে কাউকে যখন-তখন ধরে আনতে পারে। তার ক্ষমতার উৎস তার প্রভু।
আমাদের বাংলাঘরে একজন চৌকিদার ও একজন দফাদার রাতে শুতেন। দিনের বেলায় দেখতাম, তাদের কী দাপট! ঘুষ তখনো ছিল। পেয়াদা-চৌকিদার-দফাদার পর্যায়েও ছিল। কেউ কলাটা-মুলাটা দিয়ে তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিত। আমি নিজের চোখে কখনো তা দেখেছি এবং এখনো মনে আছে।
লম্বা-চওড়া গোছের এক দফাদার ছিলেন আমার প্রতি খুবই স্নেহপ্রবণ। আমার সব আবদার তিনি রক্ষা করতেন। বঙ্গীয় কংগ্রেসের বিখ্যাত নেতা ও তেওতার জমিদার কিরণশঙ্কর রায়দের ছিল বিরাট বাগান। গোলাপ, গন্ধরাজ, টগর, কামিনী, স্বর্ণচাপা, কাঁঠালিচাপা, নাগেশ্বর, কুন্দ শুধু নয়, নানা রকম দেশি-বিদেশি ফুলগাছ ও ঝোপজাতীয় ফুল এবং সুদৃশ্য গাছ সারা বাড়িতে। ‘রাজবাড়িতে’ ফুল আনতে যেতাম। একদিন ফুল নিয়ে আসছি, দফাদার সঙ্গে। নদীর তীর দিয়ে যখন আসি, এক নিকেরি দৌড়ে এসে তাঁকে একটি বড় ইলিশ মাছ দিল। তারপর সে কাতর হয়ে বলল, ‘আমার জামাই আমার মেয়েরে খালি মারধর করে। তারে একটা শিক্ষা দিয়া দিবেন।’
এক হাতে মাছ, আরেক হাতে ফুলের সাজি নিয়ে আসতে আসতে দফাদার দেখতে পান অভিযুক্ত জামাই বাবাকে। সে যাচ্ছিল নদীতে জেলেদের কাছে এক আঁটি লাকড়ি বিক্রি করতে। দফাদার আমাকে বললেন, ‘মিয়া ভাই, একটু খাড়াও। পাইয়া গেছি।’ ত্বরিতগতিতে লাকড়ি বহনকারীর কাছে গিয়ে তাকে ধমক দিলেন, ‘খাড়া, ওইখানে। তুই বউ মারোস। শিক্ষা দিতেছি।’ বলেই ওর লাকড়ি দিয়েই ওকে কয়েক ঘাই দিলেন। সেদিন না বুঝলেও বহু পরে ভেবে দেখেছি ইলিশ মাছের উপকারিতা।
অন্য জাতির কথা জানি না, বাঙালির কথা জানি যে, তারা নিৎশের দর্শন না পড়েই গ্রহণ করেছে এবং রপ্ত করছে। ক্ষমতা প্রয়োগের ইচ্ছা তার প্রবল এবং প্রত্যেকে প্রতিদিন তা করছেও। বহু অফিসে যান, দেখবেন পিয়ন থেকে প্রাইভেট সেক্রেটারির পর্যন্ত সীমাহীন দাপট। তাদের ওপরে যারা, তাদের ক্ষমতা দেখানোর আকাঙ্ক্ষা অফুরন্ত। রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে পারিবারিক জীবন পর্যন্ত এই অবস্থা। ক্ষমতা প্রদর্শনের এই অবস্থাকে বাংলা ভাষায় বলে—ক্ষমতার অপব্যবহার। ক্ষমতার রাজনীতিতে এটা খুব বেশি।
সাতচল্লিশের পরে মুসলিম লীগ খেলাফতে পাকিস্তানি হয়েছিল। খেলাফতে পাকিস্তানি হলো খোলাফায়ে রাশেদিনের আধুনিক ও উগ্র সংস্করণ। লীগের নেতাদের হুকুম ছাড়া পাকিস্তানে গাবগাছের হলুদ পাতাটিও মাটিতে পড়তে সাহস পেত না।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে দাঁড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। লীগের নেতারা চাইতেন, ওই আসনটি তাঁদের পছন্দের কেউ দখল করুক এবং ভাসানী রাজনীতি থেকে বিদায় নিন। তাঁরা অফিসারদের বললেন, মওলানার বিরুদ্ধে একটা মামলা ঠুকে দিতে এই অভিযোগে যে, তাঁর নির্বাচন ‘ত্রুটিপূর্ণ’ ছিল। ভাসানী এখনকার আল্লামা ও মুফতিদের চেয়ে বিদ্যায় কম থাকলেও, তাঁর আক্কেল-বুদ্ধি ছিল লীগ নেতাদের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি। তিনি ময়মনসিংহের ডিএমকে বললেন, ‘পাকিস্তানের জন্ম হইছে মাত্র কয়েক সপ্তাহ, এখনো আকিকা হয় নাই, ঝামেলায় যাওয়ার দরকার নাই, আমি নিজেই এই আসন ছাইড়া দিলাম। যে কয়দিন বাঁচা আছি, আল্লারে ডাইকাই কাটাইয়া দিব।’
মওলানা আল্লাহকে ডাকতেন মনে মনে ও অবসরমতো। কিন্তু মুখ দিয়ে জোরে ডাক দিলেন জনগণকে। বললেন, লীগের নেতাদের জুলুম চাই না, গণতন্ত্র চাই, জনগণের শাসন চাই। তিনিও মুসলিম লীগেরই নেতা ছিলেন। বললেন, ‘ওই লীগের কাজ শেষ, এখন জনগণের মুসলিম লীগ চাই, আসেন, আমরা আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করি।’ দুই বছরের মধ্যে জন্ম নিল আওয়ামী লীগ।
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ক্ষমতাসীনেরা একেক সময় একেক অস্ত্র ব্যবহার করে। পাকিস্তান সরকারের হাতে ছিল ভারত-অস্ত্র, অর্থাৎ যে ভারতের দালাল, সে পাকিস্তানের দুশমন। ভাসানীকে তাঁরা মনে করতেন ‘ভারতের লেলিয়ে দেওয়া কুকুর’। সত্তর বছর বয়স্ক দাড়িটুপিঅলা মানুষকে ‘কুকুর’ বলতে পারে কে? ইস্কান্দার মির্জা পেরেছিলেন।
বাংলার দুই জনপ্রিয় নেতা ভাসানী ও মুজিবকে ভারতের দালাল প্রমাণের জন্য চব্বিশ বছরব্যাপী চক্রান্ত হয়েছে। পাকিস্তানি শাসক ও গোয়েন্দাদের ওপর বিধাতা সেই চক্রান্ত করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ভাসানী তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি, শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদক। বুদ্ধিহীন লীগপন্থী গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নিজেরাই মওলানার নামে পণ্ডিত নেহরুর কাছে এক টেলিগ্রাম পাঠান গুলিস্তান টিঅ্যান্ডটি অফিস থেকে। তারপর সেই টেলিগ্রামের রসিদ দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা হয় যে ভাসানী ও তাঁর সমর্থকেরা ভারতের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করছেন।
ষাটের দশকে ছয় দফাপন্থী প্রায় সব নেতা ও ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির হিন্দু নেতাদের কোনো রকম কারণ ছাড়াই জেলে ঢোকানো হয়েছিল। মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আমেনা বেগম ছাড়া আওয়ামী লীগের কেউ বাইরে ছিলেন না। কিন্তু মোনায়েম খান তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি আশা করলেন, দলের মূল নেতাকে, যিনি বাঙালির অধিকারের কথা বলেন, তাকে ফাঁসিতে ঝোলাবেন। সেদিন আমি আমার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে কুষ্টিয়ার মিরপুর রেলস্টেশনের উঁচু জায়গায় বসে ছিলাম সন্ধ্যাবেলা। রেডিওর খবরে বলা হলো, শেখ মুজিব ভারতের সামরিক সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করছেন। কয়েকজন সামরিক-বেসামরিক অফিসারের বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ আনা হয়েছিল কয়েক দিন আগে। তখন এক নম্বর আসামি শেখ মুজিব।
আমি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টিরও অক্ষম কর্মী ছিলাম। ন্যাপেরও সমর্থক। আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেও সমর্থন ছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে শুনলাম, শেখ মুজিব এক নম্বর আসামি, তখন তাঁর প্রতি আমার এক গভীর মমতার সৃষ্টি হয়। দূর থেকে তাঁকে যতটুকু জানতাম, তাতে তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের অবিচল প্রবক্তা এবং একপর্যায়ে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে। তাতে ভারতের নৈতিক সমর্থন চাইবেন—‘সামরিক সাহায্য’ নয়। প্রতিপক্ষের প্রতি মিথ্যা আরোপ করতে গিয়ে আইয়ুব-মোনায়েমই যে শুধু শেষ হলেন তা-ই নয়, পাকিস্তানই শেষ হলো। অন্যদিকে ইতিহাসে স্থায়ী স্থান হলো ভাসানী-মুজিবের।
একই সঙ্গে স্বাধীন হয়ে ভারত পরিচালিত হয়েছে রাজনীতিকদের দ্বারা। পাকিস্তানে রাজনীতিকদের ধ্বংস করে সামরিক-বেসামরিক আমলা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দেশ চালানোর দায়িত্ব দেন। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সময়টুকুতে তা ছিল না—রাজনীতিকদের হাতেই ক্ষমতা ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর পাকিস্তানি ধারাটি চালু হয়। নব্বইয়ের দশক থেকে নির্বাচিত সরকারের সময়ও তা অব্যাহত থাকে।
আশির দশক থেকে সুস্থ ছাত্ররাজনীতি শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার সব দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে বড় বড় দলে জনসম্পৃক্ত নিবেদিত নেতাদের কম গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁদের দেশসেবা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। রাষ্ট্রের যেসব নীতিনির্ধারণী কাজ জননেতাদের করার কথা, তা করছেন আমলা ও তৃতীয় শ্রেণীর অপ্রধান ও অনভিজ্ঞ রাজনীতিকেরা। একেই আমরা বলতে পারি বিরাজনৈতিকীকরণ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি।
বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেছেন। সেসব দেশের নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতবিনিময় হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে তার প্রয়োজন আছে। কিন্তু লক্ষ করেছি, তাঁর সফরসঙ্গীদের মধ্যে সবাই অরাজনৈতিক ব্যক্তি ও অবসরপ্রাপ্ত আমলা। তাঁর দলে কি রাজনীতিবিদ নেই?
মহাজোট সরকারেও বড় রাজনীতিকদের চেয়ে আমলা ও অন্যদেরই প্রাধান্য। অথচ আওয়ামী লীগে বড় জননেতার অভাব নেই। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর পাশে থাকলে এবং নীতিনির্ধারণী দায়িত্বে থাকলে সরকার ও দেশের উপকার হতো। অরাজনীতিকদের কথা ও কাজে সরকারের ক্ষতি হলে সে দায়িত্ব তাঁরা বহন করবেন না।
প্রতিপক্ষ অথবা সরকারের বিরূপ সমালোচনাকারীদের হেনস্তা করার নীতি অতি আত্মঘাতী। তাতে হিতে বিপরীত হয়। চৈনিক প্রবাদ আছে: যখন তুমি অন্যের দিকে একটি আঙুল তাক করো, আর চারটি তাক হয় তোমার দিকে। অন্যের একটা ক্ষতি করতে গেলে নিজের চার গুণ ক্ষতি হতে পারে। ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পরে কার কারণে তা হলো, সে গবেষণা কেউ করতে যায় না।
জাতি কঠিন সময় পার করছে। এই সময় প্রবীণ রাজনীতিকেরাই ভরসা—অবসরপ্রাপ্ত ও দায়দায়িত্বযুক্ত আমলারা নন। রাজনীতিকদের ভুলভ্রান্তি ও দোষত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু সুখে-দুঃখে তাঁরাই তো জনগণের সঙ্গে ছিলেন ও আছেন। আমরা যদি গণতন্ত্র চাই, তাহলে রাজনীতিকদেরই প্রাধান্য দিতে হবে—অন্যদের নয়। জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক নেতাদের বিকল্প এখনো কোনো গণতান্ত্রিক দেশে দেখা যায়নি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
জগতে যত জটিল বিষয় আছে, তার মধ্যে রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার কাজটি অতি জটিল। প্রখর বুদ্ধিমান ছাড়া ওই ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন অসম্ভব। মোটা বুদ্ধির মানুষ মূর্খেরই শামিল। তারা নানা রকম অশুভ বুদ্ধির আশ্রয় নিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত অন্যের বিপদ শুধু নয়—নিজেদের বিপর্যয়ও ডেকে আনে। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব জীবনের গভীরতম বিষয়গুলো অতি সহজ-সরল ভাষায় শিষ্যদের বোঝাতেন। কোথাও পড়েছি, তিনি তাঁর শিষ্যদের বলছেন, ‘বুদ্ধিমান হও, চালাক হয়ো না।’ জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই অসাধু না হওয়ার তাগিদ তো দিতেনই। তাঁর বিখ্যাত উক্তি: সাধু সেজো না, সাধু হও।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিৎশে বলেছেন, ক্ষমতা প্রয়োগের ইচ্ছা মানুষের আদিমতম প্রবৃত্তি। তাঁর দর্শনের মূল কথা—মানুষের মূল আকাঙ্ক্ষা হলো 'The will to power'। খুব বেশি রাজনৈতিক ক্ষমতাপ্রত্যাশীদের ক্ষেত্রেই কথাটা বেশি প্রযোজ্য। নিৎশের দর্শন ছিল হিটলারের খুব পছন্দ, একসময় ন্যাশনাল সোশ্যালিস্টদের রাষ্ট্রীয় দর্শনে পরিণত হয়েছিল নিৎশের তত্ত্ব।
বড় বড় রাষ্ট্র নেতার কথা বাদ দিলেও সবচেয়ে ছোট মানুষের মধ্যেও দেখা যায় ক্ষমতা প্রয়োগের স্পৃহা। সেসব পদ এখন নেই, উঠে গেছে। ছোটবেলায় আমি দেখেছি, গ্রামে একজন পেয়াদারও কী প্রতাপ। কারণ, সে তার খুঁটির জোরে দুর্বল যে কাউকে যখন-তখন ধরে আনতে পারে। তার ক্ষমতার উৎস তার প্রভু।
আমাদের বাংলাঘরে একজন চৌকিদার ও একজন দফাদার রাতে শুতেন। দিনের বেলায় দেখতাম, তাদের কী দাপট! ঘুষ তখনো ছিল। পেয়াদা-চৌকিদার-দফাদার পর্যায়েও ছিল। কেউ কলাটা-মুলাটা দিয়ে তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিত। আমি নিজের চোখে কখনো তা দেখেছি এবং এখনো মনে আছে।
লম্বা-চওড়া গোছের এক দফাদার ছিলেন আমার প্রতি খুবই স্নেহপ্রবণ। আমার সব আবদার তিনি রক্ষা করতেন। বঙ্গীয় কংগ্রেসের বিখ্যাত নেতা ও তেওতার জমিদার কিরণশঙ্কর রায়দের ছিল বিরাট বাগান। গোলাপ, গন্ধরাজ, টগর, কামিনী, স্বর্ণচাপা, কাঁঠালিচাপা, নাগেশ্বর, কুন্দ শুধু নয়, নানা রকম দেশি-বিদেশি ফুলগাছ ও ঝোপজাতীয় ফুল এবং সুদৃশ্য গাছ সারা বাড়িতে। ‘রাজবাড়িতে’ ফুল আনতে যেতাম। একদিন ফুল নিয়ে আসছি, দফাদার সঙ্গে। নদীর তীর দিয়ে যখন আসি, এক নিকেরি দৌড়ে এসে তাঁকে একটি বড় ইলিশ মাছ দিল। তারপর সে কাতর হয়ে বলল, ‘আমার জামাই আমার মেয়েরে খালি মারধর করে। তারে একটা শিক্ষা দিয়া দিবেন।’
এক হাতে মাছ, আরেক হাতে ফুলের সাজি নিয়ে আসতে আসতে দফাদার দেখতে পান অভিযুক্ত জামাই বাবাকে। সে যাচ্ছিল নদীতে জেলেদের কাছে এক আঁটি লাকড়ি বিক্রি করতে। দফাদার আমাকে বললেন, ‘মিয়া ভাই, একটু খাড়াও। পাইয়া গেছি।’ ত্বরিতগতিতে লাকড়ি বহনকারীর কাছে গিয়ে তাকে ধমক দিলেন, ‘খাড়া, ওইখানে। তুই বউ মারোস। শিক্ষা দিতেছি।’ বলেই ওর লাকড়ি দিয়েই ওকে কয়েক ঘাই দিলেন। সেদিন না বুঝলেও বহু পরে ভেবে দেখেছি ইলিশ মাছের উপকারিতা।
অন্য জাতির কথা জানি না, বাঙালির কথা জানি যে, তারা নিৎশের দর্শন না পড়েই গ্রহণ করেছে এবং রপ্ত করছে। ক্ষমতা প্রয়োগের ইচ্ছা তার প্রবল এবং প্রত্যেকে প্রতিদিন তা করছেও। বহু অফিসে যান, দেখবেন পিয়ন থেকে প্রাইভেট সেক্রেটারির পর্যন্ত সীমাহীন দাপট। তাদের ওপরে যারা, তাদের ক্ষমতা দেখানোর আকাঙ্ক্ষা অফুরন্ত। রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে পারিবারিক জীবন পর্যন্ত এই অবস্থা। ক্ষমতা প্রদর্শনের এই অবস্থাকে বাংলা ভাষায় বলে—ক্ষমতার অপব্যবহার। ক্ষমতার রাজনীতিতে এটা খুব বেশি।
সাতচল্লিশের পরে মুসলিম লীগ খেলাফতে পাকিস্তানি হয়েছিল। খেলাফতে পাকিস্তানি হলো খোলাফায়ে রাশেদিনের আধুনিক ও উগ্র সংস্করণ। লীগের নেতাদের হুকুম ছাড়া পাকিস্তানে গাবগাছের হলুদ পাতাটিও মাটিতে পড়তে সাহস পেত না।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে দাঁড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। লীগের নেতারা চাইতেন, ওই আসনটি তাঁদের পছন্দের কেউ দখল করুক এবং ভাসানী রাজনীতি থেকে বিদায় নিন। তাঁরা অফিসারদের বললেন, মওলানার বিরুদ্ধে একটা মামলা ঠুকে দিতে এই অভিযোগে যে, তাঁর নির্বাচন ‘ত্রুটিপূর্ণ’ ছিল। ভাসানী এখনকার আল্লামা ও মুফতিদের চেয়ে বিদ্যায় কম থাকলেও, তাঁর আক্কেল-বুদ্ধি ছিল লীগ নেতাদের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি। তিনি ময়মনসিংহের ডিএমকে বললেন, ‘পাকিস্তানের জন্ম হইছে মাত্র কয়েক সপ্তাহ, এখনো আকিকা হয় নাই, ঝামেলায় যাওয়ার দরকার নাই, আমি নিজেই এই আসন ছাইড়া দিলাম। যে কয়দিন বাঁচা আছি, আল্লারে ডাইকাই কাটাইয়া দিব।’
মওলানা আল্লাহকে ডাকতেন মনে মনে ও অবসরমতো। কিন্তু মুখ দিয়ে জোরে ডাক দিলেন জনগণকে। বললেন, লীগের নেতাদের জুলুম চাই না, গণতন্ত্র চাই, জনগণের শাসন চাই। তিনিও মুসলিম লীগেরই নেতা ছিলেন। বললেন, ‘ওই লীগের কাজ শেষ, এখন জনগণের মুসলিম লীগ চাই, আসেন, আমরা আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করি।’ দুই বছরের মধ্যে জন্ম নিল আওয়ামী লীগ।
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ক্ষমতাসীনেরা একেক সময় একেক অস্ত্র ব্যবহার করে। পাকিস্তান সরকারের হাতে ছিল ভারত-অস্ত্র, অর্থাৎ যে ভারতের দালাল, সে পাকিস্তানের দুশমন। ভাসানীকে তাঁরা মনে করতেন ‘ভারতের লেলিয়ে দেওয়া কুকুর’। সত্তর বছর বয়স্ক দাড়িটুপিঅলা মানুষকে ‘কুকুর’ বলতে পারে কে? ইস্কান্দার মির্জা পেরেছিলেন।
বাংলার দুই জনপ্রিয় নেতা ভাসানী ও মুজিবকে ভারতের দালাল প্রমাণের জন্য চব্বিশ বছরব্যাপী চক্রান্ত হয়েছে। পাকিস্তানি শাসক ও গোয়েন্দাদের ওপর বিধাতা সেই চক্রান্ত করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ভাসানী তখন আওয়ামী লীগের সভাপতি, শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদক। বুদ্ধিহীন লীগপন্থী গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নিজেরাই মওলানার নামে পণ্ডিত নেহরুর কাছে এক টেলিগ্রাম পাঠান গুলিস্তান টিঅ্যান্ডটি অফিস থেকে। তারপর সেই টেলিগ্রামের রসিদ দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা হয় যে ভাসানী ও তাঁর সমর্থকেরা ভারতের সাহায্য নিয়ে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করছেন।
ষাটের দশকে ছয় দফাপন্থী প্রায় সব নেতা ও ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টির হিন্দু নেতাদের কোনো রকম কারণ ছাড়াই জেলে ঢোকানো হয়েছিল। মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আমেনা বেগম ছাড়া আওয়ামী লীগের কেউ বাইরে ছিলেন না। কিন্তু মোনায়েম খান তাতেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি আশা করলেন, দলের মূল নেতাকে, যিনি বাঙালির অধিকারের কথা বলেন, তাকে ফাঁসিতে ঝোলাবেন। সেদিন আমি আমার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে কুষ্টিয়ার মিরপুর রেলস্টেশনের উঁচু জায়গায় বসে ছিলাম সন্ধ্যাবেলা। রেডিওর খবরে বলা হলো, শেখ মুজিব ভারতের সামরিক সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করছেন। কয়েকজন সামরিক-বেসামরিক অফিসারের বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ আনা হয়েছিল কয়েক দিন আগে। তখন এক নম্বর আসামি শেখ মুজিব।
আমি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টিরও অক্ষম কর্মী ছিলাম। ন্যাপেরও সমর্থক। আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেও সমর্থন ছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে শুনলাম, শেখ মুজিব এক নম্বর আসামি, তখন তাঁর প্রতি আমার এক গভীর মমতার সৃষ্টি হয়। দূর থেকে তাঁকে যতটুকু জানতাম, তাতে তিনি ছিলেন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের অবিচল প্রবক্তা এবং একপর্যায়ে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে। তাতে ভারতের নৈতিক সমর্থন চাইবেন—‘সামরিক সাহায্য’ নয়। প্রতিপক্ষের প্রতি মিথ্যা আরোপ করতে গিয়ে আইয়ুব-মোনায়েমই যে শুধু শেষ হলেন তা-ই নয়, পাকিস্তানই শেষ হলো। অন্যদিকে ইতিহাসে স্থায়ী স্থান হলো ভাসানী-মুজিবের।
একই সঙ্গে স্বাধীন হয়ে ভারত পরিচালিত হয়েছে রাজনীতিকদের দ্বারা। পাকিস্তানে রাজনীতিকদের ধ্বংস করে সামরিক-বেসামরিক আমলা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দেশ চালানোর দায়িত্ব দেন। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সময়টুকুতে তা ছিল না—রাজনীতিকদের হাতেই ক্ষমতা ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর পাকিস্তানি ধারাটি চালু হয়। নব্বইয়ের দশক থেকে নির্বাচিত সরকারের সময়ও তা অব্যাহত থাকে।
আশির দশক থেকে সুস্থ ছাত্ররাজনীতি শেষ হয়ে যাওয়ায় নতুন নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার সব দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে বড় বড় দলে জনসম্পৃক্ত নিবেদিত নেতাদের কম গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁদের দেশসেবা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। রাষ্ট্রের যেসব নীতিনির্ধারণী কাজ জননেতাদের করার কথা, তা করছেন আমলা ও তৃতীয় শ্রেণীর অপ্রধান ও অনভিজ্ঞ রাজনীতিকেরা। একেই আমরা বলতে পারি বিরাজনৈতিকীকরণ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি।
বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেছেন। সেসব দেশের নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতবিনিময় হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে তার প্রয়োজন আছে। কিন্তু লক্ষ করেছি, তাঁর সফরসঙ্গীদের মধ্যে সবাই অরাজনৈতিক ব্যক্তি ও অবসরপ্রাপ্ত আমলা। তাঁর দলে কি রাজনীতিবিদ নেই?
মহাজোট সরকারেও বড় রাজনীতিকদের চেয়ে আমলা ও অন্যদেরই প্রাধান্য। অথচ আওয়ামী লীগে বড় জননেতার অভাব নেই। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর পাশে থাকলে এবং নীতিনির্ধারণী দায়িত্বে থাকলে সরকার ও দেশের উপকার হতো। অরাজনীতিকদের কথা ও কাজে সরকারের ক্ষতি হলে সে দায়িত্ব তাঁরা বহন করবেন না।
প্রতিপক্ষ অথবা সরকারের বিরূপ সমালোচনাকারীদের হেনস্তা করার নীতি অতি আত্মঘাতী। তাতে হিতে বিপরীত হয়। চৈনিক প্রবাদ আছে: যখন তুমি অন্যের দিকে একটি আঙুল তাক করো, আর চারটি তাক হয় তোমার দিকে। অন্যের একটা ক্ষতি করতে গেলে নিজের চার গুণ ক্ষতি হতে পারে। ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পরে কার কারণে তা হলো, সে গবেষণা কেউ করতে যায় না।
জাতি কঠিন সময় পার করছে। এই সময় প্রবীণ রাজনীতিকেরাই ভরসা—অবসরপ্রাপ্ত ও দায়দায়িত্বযুক্ত আমলারা নন। রাজনীতিকদের ভুলভ্রান্তি ও দোষত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু সুখে-দুঃখে তাঁরাই তো জনগণের সঙ্গে ছিলেন ও আছেন। আমরা যদি গণতন্ত্র চাই, তাহলে রাজনীতিকদেরই প্রাধান্য দিতে হবে—অন্যদের নয়। জনসম্পৃক্ত রাজনৈতিক নেতাদের বিকল্প এখনো কোনো গণতান্ত্রিক দেশে দেখা যায়নি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments