চারদিক-‘মুক্তিযোদ্ধারা বছর বছর বাড়ে না, কমে’ by পাভেল ইসলাম
স্বাধীনতা দিবস সামনে রেখে কিছুদিন আগে একটি অনুষ্ঠান নির্মাণের লক্ষ্যে মুক্তিযোদ্ধা মো. নূরুল ইসলামের সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছিল। অনুষ্ঠানটির নাম ‘অগ্রজ’। যাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছিল, সম্পর্কে তিনি আমার বাবা। অতি সাধারণ একজন মানুষ, কিন্তু অসাধারণ এক যোদ্ধা। যখন জানতে পারলাম,
বাবাকে নিয়ে ক্যামেরার সামনে আমাদের কিছু বলতে হবে, তখন সবার মধ্যে একটা অস্বস্তি শুরু হলো। কী বলব? কী বলা উচিত? মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে বাবাকে নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি, তিনি খুব সৎমানুষ, জীবনে কখনো ঘুষ খাননি বা দেননি—এসব গৎবাঁধা কথা ছাড়া কী বলার আছে আমার? কিন্তু আমি যে এসব বলতে চাই না! তাহলে বলবটা কী?
শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করে মানুষ মরে না, মানুষ আসলে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেই মরে। আমার বাবা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এবং তার পরবর্তী সময়গুলোতে বেশ কয়েকবার মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। প্রতিবার যুদ্ধের সেই ভয়াবহ ঘটনাগুলো বলতে গিয়ে বাবার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়, তিনি কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে ওঠেন। কোত্থেকে যেন একধরনের শক্তি সঞ্চারিত হতে থাকে তাঁর সমস্ত শরীরে, সেই শক্তি তখন আমি আমার রক্তে অনুভব করি। আমি চোখের সামনে দীর্ঘ সময় ধরে লক্ষ করছি, একজন সাহসী যোদ্ধা দিনে দিনে শরীরের দিক থেকে কেমন বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। যে মানুষটা এক দিন যুদ্ধের ময়দানে বীরদর্পে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছেন, সেই মানুষটাই আজ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন, বুড়িয়ে যাচ্ছেন।
২০০৬ সালের ২৫ মার্চ ছিল শনিবার। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে অনুরোধ করলাম আমার বাবাকে নিয়ে ‘ছুটির দিনে’র প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করতে। সব শুনে তিনি বললেন, ‘আমার কোনো আপত্তি নেই।’ শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে জাহীদ রেজা নূর বাবাকে নিয়ে ‘ছুটির দিনে’র মূল রচনাটি লিখলেন। তাতে ছিল, ‘একদিকে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, অন্যদিকে পুলিশের ছোট্ট একটা দল। যাঁদের সম্বল বলতে শুধু পুরোনো আমলের থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর সামান্য গোলাবারুদ। তার পরও ২৫ মার্চের রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কিছু সাহসী মানুষ সিদ্ধান্ত নিলেন, লড়বেন তাঁরা। সেদিন রাতে প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো অসাধারণ সাহস দেখিয়েছিলেন যে গুটিকয় পুলিশ সদস্য, তাঁদেরই একজন অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার মো. নূরুল ইসলাম।’
অন্য সব বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে সম্মান দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে তা দেখা যায়নি। পুলিশ বাহিনীর কোনো যোদ্ধাকে এককভাবে খেতাব দেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পর ২০১১ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে ‘স্বাধীনতা পদক’ দেওয়া হয়েছে। এই খবর জেনে আমার বাবা যথারীতি বেশ উত্তেজিত। পদক প্রদান অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, ওই তালিকায় তাঁর নাম নেই। কী অদ্ভুত, আশ্চর্য! অনেক চিৎকার করার পর তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হলো। কিছুদিন পর পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেই সব বীর যোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হলো, অথচ তালিকায় নাম নেই বাবার। আবার চিৎকার, আবার অন্তর্ভুক্তি। এবার ঘোষণা এল, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারিভাবে রেশন দেওয়া হবে। সে-ও প্রায় ছয় মাস ধরে ঝুলে আছে। হবে, হচ্ছে বলে আজও হয়নি। বাবার উৎকণ্ঠা, চূড়ান্ত তালিকায় তাঁর নাম থাকবে তো! কারণ, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও দলাদলি হচ্ছে কিনা! তাতেই যত ভয়। প্রতিবছর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে একটি প্যারেড অনুষ্ঠান হয়। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ প্রশাসনের সবাই থাকেন সেখানে। একটি বুলেটিনও প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কোথাও এই জীবিত যোদ্ধার জন্য কোনো পাতা বরাদ্দ থাকে না। তথ্য ও মিডিয়া সেল নামে পুলিশের একটি শাখা আছে, যাঁরা এসব নিয়ে কাজ করেন। গবেষণা করেন কি না, কে জানে! যদি গবেষণাই হতো, তবে এসব কেন হচ্ছে? মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে নাম প্রকাশ, মুক্তিযোদ্ধা সনদ সবই আছে মো. নূরুল ইসলামের। তিনি একজন ১০০ ভাগ খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা। এই মানুষটি ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পরিচিত ২৫ মার্চের সেই রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অবস্থিত অস্ত্রাগার ভবনের ওপরে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। সত্যিই সেদিন কী ঘটেছিল, তাঁর মতো করে বলার লোক খুব কমই জীবিত আছেন। বিস্মিত হতে হয় যখন শুনি, সেই মানুষটিকে এখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রবেশ করতে গেলে অনুমতির প্রয়োজন হয়। যে পুলিশ সদস্য ২৫ মার্চের প্রথম প্রতিরোধকারীদের একজন, যিনি নয় মাস যুদ্ধ শেষে পুনরায় চাকরিতে যোগ দিয়ে ন্যায় ও নিষ্ঠার সঙ্গে ২০০৩ সাল পর্যন্ত রাজারবাগ পুলিশ লাইনেই দায়িত্ব পালন করেছেন, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বাংলাদেশ পুলিশ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও বাংলাদেশ পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতিতে নিঃস্বার্থভাবে অবদান রেখেছেন, পুলিশ বাহিনীর একজন প্রতিনিধি হিসেবে যিনি বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত গান গেয়ে মানুষকে বিনোদন দিয়েছেন, তাঁর প্রতি পুলিশ প্রশাসনের এত উদাসীনতা কেন? একজন রণক্লান্ত বয়োবৃদ্ধ সৈনিকের এই যুদ্ধ আমরা প্রত্যক্ষ করতে চাই না। এই যুদ্ধ আমাদের কাম্য নয়। আজ থেকে ২০-৩০ বছর পরের কথাটা একবার ভাবুন তো! কোথায় পাবেন তাঁদের সম্মান দেওয়ার জন্য? আমার বাবা দুঃখ করে প্রায়ই একটা কথা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা বছর বছর বাড়ে না, কমে।’
পাভেল ইসলাম
শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করে মানুষ মরে না, মানুষ আসলে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেই মরে। আমার বাবা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এবং তার পরবর্তী সময়গুলোতে বেশ কয়েকবার মরতে মরতে বেঁচে গেছেন। প্রতিবার যুদ্ধের সেই ভয়াবহ ঘটনাগুলো বলতে গিয়ে বাবার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়, তিনি কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে ওঠেন। কোত্থেকে যেন একধরনের শক্তি সঞ্চারিত হতে থাকে তাঁর সমস্ত শরীরে, সেই শক্তি তখন আমি আমার রক্তে অনুভব করি। আমি চোখের সামনে দীর্ঘ সময় ধরে লক্ষ করছি, একজন সাহসী যোদ্ধা দিনে দিনে শরীরের দিক থেকে কেমন বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। যে মানুষটা এক দিন যুদ্ধের ময়দানে বীরদর্পে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছেন, সেই মানুষটাই আজ নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন, বুড়িয়ে যাচ্ছেন।
২০০৬ সালের ২৫ মার্চ ছিল শনিবার। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানকে অনুরোধ করলাম আমার বাবাকে নিয়ে ‘ছুটির দিনে’র প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করতে। সব শুনে তিনি বললেন, ‘আমার কোনো আপত্তি নেই।’ শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে জাহীদ রেজা নূর বাবাকে নিয়ে ‘ছুটির দিনে’র মূল রচনাটি লিখলেন। তাতে ছিল, ‘একদিকে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, অন্যদিকে পুলিশের ছোট্ট একটা দল। যাঁদের সম্বল বলতে শুধু পুরোনো আমলের থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর সামান্য গোলাবারুদ। তার পরও ২৫ মার্চের রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কিছু সাহসী মানুষ সিদ্ধান্ত নিলেন, লড়বেন তাঁরা। সেদিন রাতে প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো অসাধারণ সাহস দেখিয়েছিলেন যে গুটিকয় পুলিশ সদস্য, তাঁদেরই একজন অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার মো. নূরুল ইসলাম।’
অন্য সব বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে সম্মান দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে তা দেখা যায়নি। পুলিশ বাহিনীর কোনো যোদ্ধাকে এককভাবে খেতাব দেওয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই। মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পর ২০১১ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে ‘স্বাধীনতা পদক’ দেওয়া হয়েছে। এই খবর জেনে আমার বাবা যথারীতি বেশ উত্তেজিত। পদক প্রদান অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, ওই তালিকায় তাঁর নাম নেই। কী অদ্ভুত, আশ্চর্য! অনেক চিৎকার করার পর তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হলো। কিছুদিন পর পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেই সব বীর যোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু হলো, অথচ তালিকায় নাম নেই বাবার। আবার চিৎকার, আবার অন্তর্ভুক্তি। এবার ঘোষণা এল, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারিভাবে রেশন দেওয়া হবে। সে-ও প্রায় ছয় মাস ধরে ঝুলে আছে। হবে, হচ্ছে বলে আজও হয়নি। বাবার উৎকণ্ঠা, চূড়ান্ত তালিকায় তাঁর নাম থাকবে তো! কারণ, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও দলাদলি হচ্ছে কিনা! তাতেই যত ভয়। প্রতিবছর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে একটি প্যারেড অনুষ্ঠান হয়। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ প্রশাসনের সবাই থাকেন সেখানে। একটি বুলেটিনও প্রকাশ করা হয়। কিন্তু কোথাও এই জীবিত যোদ্ধার জন্য কোনো পাতা বরাদ্দ থাকে না। তথ্য ও মিডিয়া সেল নামে পুলিশের একটি শাখা আছে, যাঁরা এসব নিয়ে কাজ করেন। গবেষণা করেন কি না, কে জানে! যদি গবেষণাই হতো, তবে এসব কেন হচ্ছে? মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে নাম প্রকাশ, মুক্তিযোদ্ধা সনদ সবই আছে মো. নূরুল ইসলামের। তিনি একজন ১০০ ভাগ খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা। এই মানুষটি ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পরিচিত ২৫ মার্চের সেই রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অবস্থিত অস্ত্রাগার ভবনের ওপরে থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। সত্যিই সেদিন কী ঘটেছিল, তাঁর মতো করে বলার লোক খুব কমই জীবিত আছেন। বিস্মিত হতে হয় যখন শুনি, সেই মানুষটিকে এখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রবেশ করতে গেলে অনুমতির প্রয়োজন হয়। যে পুলিশ সদস্য ২৫ মার্চের প্রথম প্রতিরোধকারীদের একজন, যিনি নয় মাস যুদ্ধ শেষে পুনরায় চাকরিতে যোগ দিয়ে ন্যায় ও নিষ্ঠার সঙ্গে ২০০৩ সাল পর্যন্ত রাজারবাগ পুলিশ লাইনেই দায়িত্ব পালন করেছেন, প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বাংলাদেশ পুলিশ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও বাংলাদেশ পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতিতে নিঃস্বার্থভাবে অবদান রেখেছেন, পুলিশ বাহিনীর একজন প্রতিনিধি হিসেবে যিনি বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত গান গেয়ে মানুষকে বিনোদন দিয়েছেন, তাঁর প্রতি পুলিশ প্রশাসনের এত উদাসীনতা কেন? একজন রণক্লান্ত বয়োবৃদ্ধ সৈনিকের এই যুদ্ধ আমরা প্রত্যক্ষ করতে চাই না। এই যুদ্ধ আমাদের কাম্য নয়। আজ থেকে ২০-৩০ বছর পরের কথাটা একবার ভাবুন তো! কোথায় পাবেন তাঁদের সম্মান দেওয়ার জন্য? আমার বাবা দুঃখ করে প্রায়ই একটা কথা বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা বছর বছর বাড়ে না, কমে।’
পাভেল ইসলাম
No comments