বাংলাদেশে গণহত্যা' প্রবন্ধ থেকে-২৫ মার্চের সেই কালরাত
স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম ক্রমশ এক সফল মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হয় ২৫/২৬ মার্চে নিরস্ত্র জনতার ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ সামরিক বর্বরতার ক্ষেত্রে সর্বকালের দৃষ্টান্তকে ম্লান করে ফেললেও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই আক্রমণ ছিল দুর্বল এবং মূলত আত্মঘাতী।
পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের অধিবাসীদের মধ্যে তুলনাহীন ভীতির সঞ্চার করে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আনুগত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। কিন্তু ঢাকার বুকে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড শুরু করায় এবং বিশেষ করে রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানায় 'ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস' (ইপিআর)-এর সদর দফতরে পাকিস্তানি বাহিনীর ঢালাও আক্রমণ চালানোর প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঢাকার বাইরে ঘটনা মোড় নেয় অভাবনীয় বিদ্রোহের পথে।
ঢাকার রাজারবাগ ও পিলখানায় এবং চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বাহিনী যথাক্রমে বাঙালি পুলিশ, ইপিআর এবং 'ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট' (ইবিআর)-এর সৈন্যদের পাইকারিভাবে হত্যা করতে শুরু করেছে_ এই সংবাদ দ্রুত সারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি অংশ আত্মরক্ষা ও দেশাত্মবোধের মিলিত তাগিদে, উচ্চতর রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারও আহ্বান ও সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করেই বিদ্রোহ শুরু করে।
অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, বেপরোয়া গোলাগুলি ও অগি্নসংযোগের মুখে রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সশস্ত্র বাহিনীর বিদ্রোহী বাঙালিরা তো বটেই, বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষও নিরাপত্তার সন্ধানে শহর থেকে গ্রামে এবং গ্রাম থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে শুরু করে, প্রথমে হাজারের অঙ্কে, পরে লাখের_ বিরামহীন, বিরতিহীন। এমনিভাবে পাকিস্তানের আঞ্চলিক বিরোধ ও গৃহযুদ্ধের সঙ্গে ভারত ক্রমশ জড়িত হয়ে পড়ে এই ভীতসন্ত্রস্ত শরণার্থীদের জোয়ারে। ১৪০০ মাইল স্থল সীমান্তবিশিষ্ট কোনো অঞ্চলের ওপর যে ইন্দোনেশীয় সেনাবাহিনীর পরীক্ষিত 'সমাধান' চাপিয়ে দেওয়া যায় না, এ উপলব্ধি টিক্কা খানের পরিকল্পনায় ছিল মর্মান্তিকভাবেই অনুপস্থিত। পূর্ব বাংলার এই অনন্য ভূরাজনৈতিক অবস্থানের জন্য একদিকে যেমন পাকিস্তানি আক্রমণ ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়, অন্যদিকে আক্রান্ত পূর্ববঙ্গবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম ক্রমশ এক সফল মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়।
২৫ মার্চের সন্ধ্যায় যখন পাকিস্তানি আক্রমণ অত্যাসন্ন, তখন শেখ মুজিব তাজউদ্দীনকে ঢাকারই শহরতলিতে আত্মগোপন করার নির্দেশ দেন, যাতে 'শিগগির তারা পুনরায় একত্রিত হতে পারেন'। তারপর একনাগাড়ে প্রায় ৩৩ ঘণ্টা গোলাগুলির বিরামহীন শব্দে তাজউদ্দীনের বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি, যে অনুমানের ভিত্তিতেই তাকে শহরতলিতে অপেক্ষা করতে বলা হয়ে থাকুক, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তরুণ সহকর্মী আমিরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ মার্চ ঢাকা ত্যাগের আগে দলের কোনো নেতৃস্থানীয় সদস্যের সঙ্গে আলাপ-পরামর্শের সুযোগ তাজউদ্দীনের ছিল না। তা সত্ত্বেও পরবর্তী লক্ষ্য ও পন্থা সম্পর্কে দুটি সিদ্ধান্ত নিতে তাদের কোনো বিলম্ব ঘটেনি : ১. পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক আঘাতের মাধ্যমে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার হাত থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হলো সশস্ত্র প্রতিরোধ তথা মুক্তির লড়াই; ২. এই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকে সংগঠিত করার প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ হিসেবে ভারত ও অন্যান্য সহানুভূতিশীল মহলের সাহায্য-সহযোগিতা লাভের জন্য অবিলম্বে সচেষ্ট হওয়া। প্রথমে আত্মরক্ষা, তারপর প্রস্তুতি এবং সব শেষে পাল্টা আঘাতের পর্যায়ক্রমিক লক্ষ্য স্থির করে তাজউদ্দীন ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে গিয়ে হাজির হন ৩০ মার্চের সন্ধ্যায়। বাংলাদেশে তখন বিদ্রোহের আগুন। বিদ্রোহী সিপাহিদের পাশে প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিয়েছে দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা। স্বাধীনতার জন্য সারাদেশ একতাবদ্ধ।
সূত্র : ২য় অধ্যায়, মূলধারা '৭১, মঈদুল হাসান (সংক্ষেপিত)
অপারেশন সার্চলাইট
২৫ মার্চ সন্ধ্যার পরপরই সারা শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ইয়াহিয়া খান চলে গেছে এবং তখন আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা রাস্তায় রাস্তায় হালকা প্রতিবন্ধক বসানো শুরু করে, কিন্তু এসব প্রতিবন্ধক পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাচলে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি। যেসব স্বেচ্ছাসেবক রাস্তায় প্রতিবন্ধক স্থাপন করছিল তারাই পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা প্রথম আক্রান্ত হয়। যদিও অপারেশন রাত ১১টায় শুরু হওয়ার কথা, পাকিস্তানি সৈন্যরা সাড়ে ১১টায় ঢাকা সেনানিবাস থেকে বের হয়। কারণ পাকিস্তানি ফিল্ড কমান্ডার চাইছিল যে, বাঙালি সৈন্যরা যাতে প্রতিক্রিয়া দেখানোর কোনো সুযোগ না পায়। সেনাবাহিনীকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য ৬ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী আক্রমণ শুরু করার আগেই দ্রুততার সঙ্গে ঢাকা শহরের সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
১০ম বাঙালি রেজিমেন্টকে সেনানিবাসে সহজেই নিরস্ত্র এবং পরে নিশ্চিহ্ন করা হয়। ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্টকে ঢাকার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এবং শহরের উত্তরাংশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়। মেজর বেলাল এবং লে. কর্নেল জেডএ খানের সঙ্গে নিযুক্ত কমান্ডো বাহিনী অপারেশনের শুরুতে সহজেই শেখ মুজিবুর রহমানকে ধরতে সক্ষম হয়।
২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ইপিআর সদর দফতরে অবস্থিত বেশিরভাগ নিরস্ত্র এবং অসংগঠিত ইপিআর সৈন্যকে আক্রমণ করে। সারা রাত যুদ্ধ করার পর পরাজিত ও পরাভূত করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানি বাহিনী কোনো বাধা ছাড়াই সহজে মিরপুরে অবস্থানরত ইপিআর বাহিনীকে গ্রেফতার এবং রাষ্ট্রপতি ভবন ও গভর্নর হাউস দখল করে নিতে সক্ষম হয়, কিন্তু অনেকে পালাতে সক্ষম হয় এবং অনেকে মারা পড়ে।
১৮তম ও ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অনিয়মিত বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আক্রমণ চালায়, আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাধা প্রদানের চেষ্টাকে পরাভূত করে, ছাত্রনিবাসে অবস্থানরত নিরস্ত্র ছাত্রদের হত্যা করে, বেশ কিছু অধ্যাপককেও হত্যা করে এবং তারপর ২৬ মার্চ সকালের দিকে হিন্দু এলাকা এবং পুরান ঢাকা আক্রমণের জন্য গমন করে। রাজারবাগে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, কিন্তু ধীরে ধীরে পরাজিত হয় এবং যারা বেঁচে ছিল তাদের বেশিরভাগ ধরা পড়ে অথবা এদিক-সেদিক পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা অপারেশনের সময় জনগণের নিরাপত্তাকে তুচ্ছ করে যথেচ্ছভাবে কামান এবং সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে। ভোরের মধ্যে শহর দখলে চলে আসে এবং শহরব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়। বেঁচে যাওয়া পুলিশ এবং ইপিআর সেনারা শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়, কেউ কেউ বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে জিঞ্জিরায় চলে যায়।
সূত্র : উইকিপিডিয়ার 'অপারেশন সার্চলাইট' ভুক্তি থেকে
২৫ মার্চ কালরাতের বেতার কথোপকথন
টিক্কা খান পাকিস্তানি সৈন্যদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে বেতারে তাণ্ডবলীলা পরিচালনা করে। সেই বেতার কথোপকথন কয়েকজন দুঃসাহসী বাঙালি রেকর্ড করেছিলেন। ১৩ মের হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডসহ অনেক পত্রিকায় তার প্রতিলিপি প্রকাশিত হয়। সেখান থেকেই কিছু অংশ :
কন্ট্রোল : হ্যালো ৯৯-লাইনে থাকো... নতুন কোনো খবর নেই। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এখনও যুদ্ধ চলছে। ওভার।
থেকে ৭৭ : ৮৮-র কাছ থেকে শেষ খবর... সে বেশ এগোচ্ছে। কিন্তু সেখানে বহু বাড়ি রয়েছে। ফলে তাকে একটা একটা করে ধূলিসাৎ করতে হচ্ছে... ওভার।
প্রতি ৭৭ : তাকে বলো যে, তার বড় ভাইরা (আর্টিলারি বাহিনী) সত্বরই তার কাছে যাবে, সুতরাং বাড়িগুলো ধূলিসাৎ করার জন্য তাদের ব্যবহার করা যাবে। এবারে অন্যদিকে, আমার মনে হয় লিয়াকত ও ইকবাল (লিয়াকত হল ও ইকবাল হল) এখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আমি কি ঠিক বলছি? ওভার।
থেকে ৭৭ : কাজ শেষ করার রিপোর্ট এখনও পাইনি, তবে এ দুটোর ব্যাপারে তারা খুবই খুশি। ওভার।
থেকে কন্ট্রোল : খুবই খুশির খবর। ওভার।
প্রতি ৭৭ : দ্বিতীয়ত রাস্তার সেই সব বাধা সম্পর্কে ঘোষণা করতেই হবে। রাস্তায় বাধা তৈরি করতে কাউকে দেখা গেলে তাকে সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হবে। ১নং, ২নং কোনো এলাকায় রোড বল্গক তৈরি করলে সেই এলাকার অধিবাসীদের শাস্তি দেওয়া হবে এবং তাদের দায়ী করা হবে এবং ধ্বংস করে দেওয়া হবে... ওভার।
প্রতি ৮৮ : তোমাদের ইমাম (কমান্ডিং অফিসার) কি বলেছে যে, তোমরা কাজ শেষ করতে প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় নেবে? ওভার।
থেকে ৮৮ : ইমাম এখন ২৬ নম্বরের সঙ্গে। যদি তোমাদের আর কোনো প্রকার সাহায্য লাগে তাহলে তাকে তোমরা জানাতে পার। বাক্সারদের (বাড়ি ধূলিসাৎ করার স্কোয়াড) সম্পর্কে বলছি, তারা তাদের ঘাঁটি থেকে যাত্রা করেছে এবং সকাল হওয়ার আগেই তোমাদের সামনের বাধা ধূলিসাৎ করার কাজে দ্রুত তারা তোমাদের সাহায্য করতে পারবে। ওভার।
সূত্র : 'রক্তাক্ত বাংলা' বইয়ের অন্তর্ভুক্ত জাফর সাদেক লিখিত 'বাংলাদেশে গণহত্যা' প্রবন্ধ থেকে
ঢাকার রাজারবাগ ও পিলখানায় এবং চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বাহিনী যথাক্রমে বাঙালি পুলিশ, ইপিআর এবং 'ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট' (ইবিআর)-এর সৈন্যদের পাইকারিভাবে হত্যা করতে শুরু করেছে_ এই সংবাদ দ্রুত সারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি অংশ আত্মরক্ষা ও দেশাত্মবোধের মিলিত তাগিদে, উচ্চতর রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারও আহ্বান ও সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করেই বিদ্রোহ শুরু করে।
অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড, বেপরোয়া গোলাগুলি ও অগি্নসংযোগের মুখে রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সশস্ত্র বাহিনীর বিদ্রোহী বাঙালিরা তো বটেই, বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষও নিরাপত্তার সন্ধানে শহর থেকে গ্রামে এবং গ্রাম থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে শুরু করে, প্রথমে হাজারের অঙ্কে, পরে লাখের_ বিরামহীন, বিরতিহীন। এমনিভাবে পাকিস্তানের আঞ্চলিক বিরোধ ও গৃহযুদ্ধের সঙ্গে ভারত ক্রমশ জড়িত হয়ে পড়ে এই ভীতসন্ত্রস্ত শরণার্থীদের জোয়ারে। ১৪০০ মাইল স্থল সীমান্তবিশিষ্ট কোনো অঞ্চলের ওপর যে ইন্দোনেশীয় সেনাবাহিনীর পরীক্ষিত 'সমাধান' চাপিয়ে দেওয়া যায় না, এ উপলব্ধি টিক্কা খানের পরিকল্পনায় ছিল মর্মান্তিকভাবেই অনুপস্থিত। পূর্ব বাংলার এই অনন্য ভূরাজনৈতিক অবস্থানের জন্য একদিকে যেমন পাকিস্তানি আক্রমণ ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়, অন্যদিকে আক্রান্ত পূর্ববঙ্গবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম ক্রমশ এক সফল মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়।
২৫ মার্চের সন্ধ্যায় যখন পাকিস্তানি আক্রমণ অত্যাসন্ন, তখন শেখ মুজিব তাজউদ্দীনকে ঢাকারই শহরতলিতে আত্মগোপন করার নির্দেশ দেন, যাতে 'শিগগির তারা পুনরায় একত্রিত হতে পারেন'। তারপর একনাগাড়ে প্রায় ৩৩ ঘণ্টা গোলাগুলির বিরামহীন শব্দে তাজউদ্দীনের বুঝে নিতে অসুবিধা হয়নি, যে অনুমানের ভিত্তিতেই তাকে শহরতলিতে অপেক্ষা করতে বলা হয়ে থাকুক, তার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। তরুণ সহকর্মী আমিরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ মার্চ ঢাকা ত্যাগের আগে দলের কোনো নেতৃস্থানীয় সদস্যের সঙ্গে আলাপ-পরামর্শের সুযোগ তাজউদ্দীনের ছিল না। তা সত্ত্বেও পরবর্তী লক্ষ্য ও পন্থা সম্পর্কে দুটি সিদ্ধান্ত নিতে তাদের কোনো বিলম্ব ঘটেনি : ১. পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সর্বাত্মক আঘাতের মাধ্যমে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার হাত থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হলো সশস্ত্র প্রতিরোধ তথা মুক্তির লড়াই; ২. এই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকে সংগঠিত করার প্রাথমিক ও অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ হিসেবে ভারত ও অন্যান্য সহানুভূতিশীল মহলের সাহায্য-সহযোগিতা লাভের জন্য অবিলম্বে সচেষ্ট হওয়া। প্রথমে আত্মরক্ষা, তারপর প্রস্তুতি এবং সব শেষে পাল্টা আঘাতের পর্যায়ক্রমিক লক্ষ্য স্থির করে তাজউদ্দীন ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে গিয়ে হাজির হন ৩০ মার্চের সন্ধ্যায়। বাংলাদেশে তখন বিদ্রোহের আগুন। বিদ্রোহী সিপাহিদের পাশে প্রতিরোধ সংগ্রামে যোগ দিয়েছে দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা। স্বাধীনতার জন্য সারাদেশ একতাবদ্ধ।
সূত্র : ২য় অধ্যায়, মূলধারা '৭১, মঈদুল হাসান (সংক্ষেপিত)
অপারেশন সার্চলাইট
২৫ মার্চ সন্ধ্যার পরপরই সারা শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ইয়াহিয়া খান চলে গেছে এবং তখন আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা রাস্তায় রাস্তায় হালকা প্রতিবন্ধক বসানো শুরু করে, কিন্তু এসব প্রতিবন্ধক পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাচলে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি। যেসব স্বেচ্ছাসেবক রাস্তায় প্রতিবন্ধক স্থাপন করছিল তারাই পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা প্রথম আক্রান্ত হয়। যদিও অপারেশন রাত ১১টায় শুরু হওয়ার কথা, পাকিস্তানি সৈন্যরা সাড়ে ১১টায় ঢাকা সেনানিবাস থেকে বের হয়। কারণ পাকিস্তানি ফিল্ড কমান্ডার চাইছিল যে, বাঙালি সৈন্যরা যাতে প্রতিক্রিয়া দেখানোর কোনো সুযোগ না পায়। সেনাবাহিনীকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য ৬ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী আক্রমণ শুরু করার আগেই দ্রুততার সঙ্গে ঢাকা শহরের সব যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
১০ম বাঙালি রেজিমেন্টকে সেনানিবাসে সহজেই নিরস্ত্র এবং পরে নিশ্চিহ্ন করা হয়। ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্টকে ঢাকার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এবং শহরের উত্তরাংশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়। মেজর বেলাল এবং লে. কর্নেল জেডএ খানের সঙ্গে নিযুক্ত কমান্ডো বাহিনী অপারেশনের শুরুতে সহজেই শেখ মুজিবুর রহমানকে ধরতে সক্ষম হয়।
২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ইপিআর সদর দফতরে অবস্থিত বেশিরভাগ নিরস্ত্র এবং অসংগঠিত ইপিআর সৈন্যকে আক্রমণ করে। সারা রাত যুদ্ধ করার পর পরাজিত ও পরাভূত করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানি বাহিনী কোনো বাধা ছাড়াই সহজে মিরপুরে অবস্থানরত ইপিআর বাহিনীকে গ্রেফতার এবং রাষ্ট্রপতি ভবন ও গভর্নর হাউস দখল করে নিতে সক্ষম হয়, কিন্তু অনেকে পালাতে সক্ষম হয় এবং অনেকে মারা পড়ে।
১৮তম ও ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অনিয়মিত বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আক্রমণ চালায়, আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাধা প্রদানের চেষ্টাকে পরাভূত করে, ছাত্রনিবাসে অবস্থানরত নিরস্ত্র ছাত্রদের হত্যা করে, বেশ কিছু অধ্যাপককেও হত্যা করে এবং তারপর ২৬ মার্চ সকালের দিকে হিন্দু এলাকা এবং পুরান ঢাকা আক্রমণের জন্য গমন করে। রাজারবাগে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, কিন্তু ধীরে ধীরে পরাজিত হয় এবং যারা বেঁচে ছিল তাদের বেশিরভাগ ধরা পড়ে অথবা এদিক-সেদিক পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা অপারেশনের সময় জনগণের নিরাপত্তাকে তুচ্ছ করে যথেচ্ছভাবে কামান এবং সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে। ভোরের মধ্যে শহর দখলে চলে আসে এবং শহরব্যাপী কারফিউ জারি করা হয়। বেঁচে যাওয়া পুলিশ এবং ইপিআর সেনারা শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়, কেউ কেউ বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে জিঞ্জিরায় চলে যায়।
সূত্র : উইকিপিডিয়ার 'অপারেশন সার্চলাইট' ভুক্তি থেকে
২৫ মার্চ কালরাতের বেতার কথোপকথন
টিক্কা খান পাকিস্তানি সৈন্যদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে বেতারে তাণ্ডবলীলা পরিচালনা করে। সেই বেতার কথোপকথন কয়েকজন দুঃসাহসী বাঙালি রেকর্ড করেছিলেন। ১৩ মের হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডসহ অনেক পত্রিকায় তার প্রতিলিপি প্রকাশিত হয়। সেখান থেকেই কিছু অংশ :
কন্ট্রোল : হ্যালো ৯৯-লাইনে থাকো... নতুন কোনো খবর নেই। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এখনও যুদ্ধ চলছে। ওভার।
থেকে ৭৭ : ৮৮-র কাছ থেকে শেষ খবর... সে বেশ এগোচ্ছে। কিন্তু সেখানে বহু বাড়ি রয়েছে। ফলে তাকে একটা একটা করে ধূলিসাৎ করতে হচ্ছে... ওভার।
প্রতি ৭৭ : তাকে বলো যে, তার বড় ভাইরা (আর্টিলারি বাহিনী) সত্বরই তার কাছে যাবে, সুতরাং বাড়িগুলো ধূলিসাৎ করার জন্য তাদের ব্যবহার করা যাবে। এবারে অন্যদিকে, আমার মনে হয় লিয়াকত ও ইকবাল (লিয়াকত হল ও ইকবাল হল) এখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আমি কি ঠিক বলছি? ওভার।
থেকে ৭৭ : কাজ শেষ করার রিপোর্ট এখনও পাইনি, তবে এ দুটোর ব্যাপারে তারা খুবই খুশি। ওভার।
থেকে কন্ট্রোল : খুবই খুশির খবর। ওভার।
প্রতি ৭৭ : দ্বিতীয়ত রাস্তার সেই সব বাধা সম্পর্কে ঘোষণা করতেই হবে। রাস্তায় বাধা তৈরি করতে কাউকে দেখা গেলে তাকে সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হবে। ১নং, ২নং কোনো এলাকায় রোড বল্গক তৈরি করলে সেই এলাকার অধিবাসীদের শাস্তি দেওয়া হবে এবং তাদের দায়ী করা হবে এবং ধ্বংস করে দেওয়া হবে... ওভার।
প্রতি ৮৮ : তোমাদের ইমাম (কমান্ডিং অফিসার) কি বলেছে যে, তোমরা কাজ শেষ করতে প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় নেবে? ওভার।
থেকে ৮৮ : ইমাম এখন ২৬ নম্বরের সঙ্গে। যদি তোমাদের আর কোনো প্রকার সাহায্য লাগে তাহলে তাকে তোমরা জানাতে পার। বাক্সারদের (বাড়ি ধূলিসাৎ করার স্কোয়াড) সম্পর্কে বলছি, তারা তাদের ঘাঁটি থেকে যাত্রা করেছে এবং সকাল হওয়ার আগেই তোমাদের সামনের বাধা ধূলিসাৎ করার কাজে দ্রুত তারা তোমাদের সাহায্য করতে পারবে। ওভার।
সূত্র : 'রক্তাক্ত বাংলা' বইয়ের অন্তর্ভুক্ত জাফর সাদেক লিখিত 'বাংলাদেশে গণহত্যা' প্রবন্ধ থেকে
No comments