ভারতীয় রাজনীতি-বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষয় by কুলদীপ নায়ার
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার সর্বশেষ নির্বাচনে ভারতের সবচেয়ে বড় খবর হলো সাম্যবাদের বিপর্যয়। অনেকে মনে করেন, যে আদর্শ উপযোগিতা হারিয়েছে, সেটি না থাকাই ভালো। আসলে ১৯৯১ সালে ভেঙে পড়া সোভিয়েত ইউনিয়নের ধ্বংসস্তূপের নিচে কবর হয়েছে সাম্যবাদের।
কিন্তু ভারতে পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালা—এই দুই রাজ্য সেসব অগ্রাহ্য করে স্তালিনের দর্শন আঁকড়ে ধরে থেকেছে, এমনকি তাদের পলিটব্যুরোতে রেখেছে স্তালিনের বিশাল ছবি। পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টদের পতন হলো অপমানজনকভাবে, তাদের দল বিধানসভার ২৯৪টি আসনের মধ্যে পেয়েছে মাত্র ৬৩টি। সে তুলনায় কেরালায় কমিউনিস্টদের অবস্থা ভালো, তারা ওই রাজ্য বিধানসভার ১৪০টি আসনের মধ্যে ৬৮টিতে জিতেছে। এর পেছনে কেরালায় কাজ করেছে মূলত মুখ্যমন্ত্রী ভি এস অচ্যুতানন্দনের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, যিনি আদর্শের বুলি কপচান না।
অবশ্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে পৃথিবীর উপকার হয়নি। রাশিয়া যখন পাশ্চাত্যের পথ বেছে নিয়েছে, ভারতের কমিউনিস্টরা তখন মনে করছে, তারা যে পথে চলছে, সেটাই সেরা পথ। ক্ষয়ে যাওয়া আদর্শটি এখনো তাদের কাছে পবিত্র। তারা দেখতে পায় না, তাদের এজেন্ডা মাওবাদীদের হাতে কীভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, যে মাওবাদীরা নিজেদের বার্তা প্রচারে বন্দুক ব্যবহার করেছে, জবরদস্তির আশ্রয় নিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট সরকারের পক্ষে সাম্যবাদী আদর্শ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব ছিল না। কারণ, তাদের নেতারা দাম্ভিক, মন্ত্রীরা নির্বিকার এবং তাদের কর্মীরা আইনকানুনের ধার ধারেন না। ৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে সরকার পরিচালনা করেছে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সবাদী) বা সিপিএম। তাদের এমন এক অদ্ভুত ধারণা ছিল, লাল ঝান্ডা উড়িয়ে আর স্লোগান দিয়েই তারা সব সময় জনগণের সমর্থন পাবে। জনগণের সঙ্গে যে সিপিএমের বিচ্ছেদ ঘটে গেছে, তা দলটির নেতা-কর্মীরা উপলব্ধি করতে পারেননি। বিগত লোকসভা নির্বাচনে দলটির ভরাডুবির মধ্য দিয়েই তা দেয়াললিখনের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
কেরালায় যা হচ্ছে, তা আরও খারাপ। সাম্যবাদী আদর্শের যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, এখন তার জায়গা করে নিচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। সেখানে হিন্দু আর খ্রিষ্টানরা ভোট দিয়েছে কংগ্রেস দলকে, আর মুসলমানরা ভোট দিয়েছে বিজয়ী ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে। মুসলমানরা ২৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতেছে ২০টি। রাজ্যটির রাজনীতিতে এই প্রথমবারের মতো ধর্মীয় ভাবাবেগের এমন প্রকোপ লক্ষ করা যাচ্ছে, যদিও বিজেপির হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো পরাজিত হয়েছে।
আমার মনে হয় না, সেই পুরোনো লেনিন-স্তালিনবাদী পন্থায় কমিউনিস্টরা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে তাদের ফিরে যেতে হবে, তাদের মধ্যেই নিজেদের ভিত্তির প্রসার ঘটাতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের নতুন মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর জোট ২২৬টি আসনে বিজয়ী হয়েছে, তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নৈতিক দিকটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আপসহীন সংগ্রামী নেত্রী হিসেবে তিনি একটা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে পারেন বটে, কিন্তু সেটির খোলনলচে বদলে নতুন করে গড়ে তোলা তাঁর পক্ষে বেশ কঠিন হতে পারে। প্রশাসন, পুলিশ ও সরকারের অন্যান্য সংস্থাকে এমনভাবে সংস্কার করতে হবে, যেন তারা নিবেদিতপ্রাণে জনগণের সেবায় নিয়োজিত হয়, যেন তারা মন্ত্রী-কমিসারদের সেবায় ব্যবহূত না হয়, যেমনটা হয়েছে বাম সরকারের সময়। জনগণের আনুগত্য না করে দলের নেতাদের আনুগত্য করলে জনপ্রশাসন ধ্বংস হয়। বাম সরকারের সময় সেটাই হয়েছে। কিন্তু সঠিক আনুগত্যের বোধটি আবার জাগানো যায়, কারণ মানুষের আচরণে মূলগতভাবে কিছু নৈতিক বিবেচনা থেকেই যায়। এ মুহূর্তে সেসব বিবেচনা নিষ্প্রভ। ন্যায় ও অন্যায়, নৈতিক ও অনৈতিকের মধ্যকার ভেদরেখা মুছে গেছে, সেটা আবার ফিরিয়ে আনাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এ শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যই নয়, জয়ললিতার জন্যও প্রযোজ্য, যিনি তামিলনাড়ুতে পরিবার-কাম-সরকারকে ধসিয়ে দিয়েছেন। ২৩৪ আসনের মধ্যে ২০৩টিতে বিজয়ী হয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, তাঁর বিজয় নেতিবাচক নয়, বরং ইতিবাচক।
কিন্তু জয়ললিতা শুরু করেছেন ভুলভাবে। মনে হচ্ছে, তিনি শাসক দল কংগ্রেসের সঙ্গে একটা রফা করতে যাচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ‘হিসাববহির্ভূত সম্পদের’ মামলা বিচারাধীন রয়েছে; মামলাটি তদন্ত করছে সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই)। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সিবিআইয়ের অবস্থান জয়ললিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে তিনি এ মামলা সামাল দেবেন? জয়ললিতা নির্বাচনে জেতার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী তাঁকে টেলিফোন করেছিলেন, এতেই সব বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু জয়ললিতাকে মনে রাখতে হবে, তামিলনাড়ুর জনগণ কংগ্রেসকে ভীষণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, দলটির আসনসংখ্যা ৩৪ থেকে নামিয়েছে পাঁচে। এখন তাঁর এজেন্ডার শীর্ষে থাকা উচিত দুর্নীতি দমন।
আসলে টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির ফল ভোগ করতে না হলে নির্বাচনে ডিএমকের ভরাডুবি হতো না। মনমোহন সরকারের সামনে সমস্যা হলো, লোকসভায় দলটির আসন আছে ১৯টি। তবে জয়ললিতার ১১টি আসন সেই ঘাটতি কিছুটা পূরণ করবে। একটা পর্যায়ে হয় কংগ্রেস ডিএমকেকে বাদ দেবে, নয়তো ডিএমকে নিজের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবে।
আসামে কংগ্রেসের বিজয় প্রত্যাশিত ছিল। মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ যখন আলোচনার জন্য ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্টের (উলফা) নেতাদের গুয়াহাটি নিয়ে এসেছিলেন, তখনই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে তাঁর দৃষ্টি আসামের বিধানসভার নির্বাচনের দিকে। আসামের জনগণের কাছে উলফার জন্য এখনো কিছু আবেগ রয়েছে। গতবারের নির্বাচনে কংগ্রেস সেখানে জিতেছিল ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত বাঙালিদের সহায়তায়। মুখ্যমন্ত্রী এবার তাদের নিরাপদে রেখেছেন এবং তাঁর বিজয়ের ফলে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগগুলো চাপা পড়ে গেছে। ভালো হয়, যদি দুই শক্তির মধ্যে একটা স্থায়ী সমঝোতা হয় এবং উলফা যেমনটি চায়, আসামের স্বতন্ত্র পরিচয় অক্ষুণ্ন রেখে ভারতীয় সংবিধানের মধ্যে মিলেমিশে বসবাস করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কংগ্রেসকে বুঝতে হবে, রাজনৈতিক সমস্যার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সমাধান, সামরিক সমাধান নয়।
নির্বাচনের উত্তেজনা যখন থিতিয়ে আসবে, ভারতের সব কটি প্রধান রাজনৈতিক দল—কংগ্রেস, বিজেপি ও কমিউনিস্টরা— উপলব্ধি করবে যে তাদের পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। আঞ্চলিক দলগুলো সেই জায়গার দখল নিতে যাচ্ছে, যেখান থেকে তারা নির্ধারণ করে দেবে কোন সর্বভারতীয় দলটি নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকবে। এর অর্থ, কেন্দ্রে দীর্ঘ সময়ে জন্য আসবে কোয়ালিশন সরকার। এতে খারাপ কিছু নেই, যদি ফেডারেল-ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা রাখা হয় এবং যদি সমঝোতার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে পরস্পরের প্রতি খিস্তিখেউড় করে, তাতে আশাবাদী হওয়া যায় না। তারা এ ব্যবস্থার ভাবমূর্তি এতটাই নষ্ট করেছে যে তাদের নিজেদের গ্রহণযোগ্যতাই শূন্যের কোঠায় ঠেকেছে।
একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, ভারতের রাজনীতি থেকে নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। সামনে অনেক বছর ধরে কেন্দ্রে, এমনকি রাজ্যগুলোতেও কোয়ালিশন সরকারের আমল পার করতে হবে এই জাতিকে। দুঃখজনক দর-কষাকষি চলবে, চলবে ব্যবসা-তাড়িত নানা শক্তির সমন্বয়। জনগণ নীরবে দেখবে। তৃতীয় একটি বিকল্পের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।
অবশ্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে পুঁজিবাদের বিকাশের ফলে পৃথিবীর উপকার হয়নি। রাশিয়া যখন পাশ্চাত্যের পথ বেছে নিয়েছে, ভারতের কমিউনিস্টরা তখন মনে করছে, তারা যে পথে চলছে, সেটাই সেরা পথ। ক্ষয়ে যাওয়া আদর্শটি এখনো তাদের কাছে পবিত্র। তারা দেখতে পায় না, তাদের এজেন্ডা মাওবাদীদের হাতে কীভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, যে মাওবাদীরা নিজেদের বার্তা প্রচারে বন্দুক ব্যবহার করেছে, জবরদস্তির আশ্রয় নিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট সরকারের পক্ষে সাম্যবাদী আদর্শ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব ছিল না। কারণ, তাদের নেতারা দাম্ভিক, মন্ত্রীরা নির্বিকার এবং তাদের কর্মীরা আইনকানুনের ধার ধারেন না। ৩৪ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে সরকার পরিচালনা করেছে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সবাদী) বা সিপিএম। তাদের এমন এক অদ্ভুত ধারণা ছিল, লাল ঝান্ডা উড়িয়ে আর স্লোগান দিয়েই তারা সব সময় জনগণের সমর্থন পাবে। জনগণের সঙ্গে যে সিপিএমের বিচ্ছেদ ঘটে গেছে, তা দলটির নেতা-কর্মীরা উপলব্ধি করতে পারেননি। বিগত লোকসভা নির্বাচনে দলটির ভরাডুবির মধ্য দিয়েই তা দেয়াললিখনের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।
কেরালায় যা হচ্ছে, তা আরও খারাপ। সাম্যবাদী আদর্শের যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, এখন তার জায়গা করে নিচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। সেখানে হিন্দু আর খ্রিষ্টানরা ভোট দিয়েছে কংগ্রেস দলকে, আর মুসলমানরা ভোট দিয়েছে বিজয়ী ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে। মুসলমানরা ২৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতেছে ২০টি। রাজ্যটির রাজনীতিতে এই প্রথমবারের মতো ধর্মীয় ভাবাবেগের এমন প্রকোপ লক্ষ করা যাচ্ছে, যদিও বিজেপির হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো পরাজিত হয়েছে।
আমার মনে হয় না, সেই পুরোনো লেনিন-স্তালিনবাদী পন্থায় কমিউনিস্টরা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে। তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে তাদের ফিরে যেতে হবে, তাদের মধ্যেই নিজেদের ভিত্তির প্রসার ঘটাতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের নতুন মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর জোট ২২৬টি আসনে বিজয়ী হয়েছে, তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নৈতিক দিকটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আপসহীন সংগ্রামী নেত্রী হিসেবে তিনি একটা ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে পারেন বটে, কিন্তু সেটির খোলনলচে বদলে নতুন করে গড়ে তোলা তাঁর পক্ষে বেশ কঠিন হতে পারে। প্রশাসন, পুলিশ ও সরকারের অন্যান্য সংস্থাকে এমনভাবে সংস্কার করতে হবে, যেন তারা নিবেদিতপ্রাণে জনগণের সেবায় নিয়োজিত হয়, যেন তারা মন্ত্রী-কমিসারদের সেবায় ব্যবহূত না হয়, যেমনটা হয়েছে বাম সরকারের সময়। জনগণের আনুগত্য না করে দলের নেতাদের আনুগত্য করলে জনপ্রশাসন ধ্বংস হয়। বাম সরকারের সময় সেটাই হয়েছে। কিন্তু সঠিক আনুগত্যের বোধটি আবার জাগানো যায়, কারণ মানুষের আচরণে মূলগতভাবে কিছু নৈতিক বিবেচনা থেকেই যায়। এ মুহূর্তে সেসব বিবেচনা নিষ্প্রভ। ন্যায় ও অন্যায়, নৈতিক ও অনৈতিকের মধ্যকার ভেদরেখা মুছে গেছে, সেটা আবার ফিরিয়ে আনাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এ শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্যই নয়, জয়ললিতার জন্যও প্রযোজ্য, যিনি তামিলনাড়ুতে পরিবার-কাম-সরকারকে ধসিয়ে দিয়েছেন। ২৩৪ আসনের মধ্যে ২০৩টিতে বিজয়ী হয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন, তাঁর বিজয় নেতিবাচক নয়, বরং ইতিবাচক।
কিন্তু জয়ললিতা শুরু করেছেন ভুলভাবে। মনে হচ্ছে, তিনি শাসক দল কংগ্রেসের সঙ্গে একটা রফা করতে যাচ্ছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ‘হিসাববহির্ভূত সম্পদের’ মামলা বিচারাধীন রয়েছে; মামলাটি তদন্ত করছে সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই)। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সিবিআইয়ের অবস্থান জয়ললিতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে তিনি এ মামলা সামাল দেবেন? জয়ললিতা নির্বাচনে জেতার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী তাঁকে টেলিফোন করেছিলেন, এতেই সব বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু জয়ললিতাকে মনে রাখতে হবে, তামিলনাড়ুর জনগণ কংগ্রেসকে ভীষণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, দলটির আসনসংখ্যা ৩৪ থেকে নামিয়েছে পাঁচে। এখন তাঁর এজেন্ডার শীর্ষে থাকা উচিত দুর্নীতি দমন।
আসলে টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির ফল ভোগ করতে না হলে নির্বাচনে ডিএমকের ভরাডুবি হতো না। মনমোহন সরকারের সামনে সমস্যা হলো, লোকসভায় দলটির আসন আছে ১৯টি। তবে জয়ললিতার ১১টি আসন সেই ঘাটতি কিছুটা পূরণ করবে। একটা পর্যায়ে হয় কংগ্রেস ডিএমকেকে বাদ দেবে, নয়তো ডিএমকে নিজের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবে।
আসামে কংগ্রেসের বিজয় প্রত্যাশিত ছিল। মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ যখন আলোচনার জন্য ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্টের (উলফা) নেতাদের গুয়াহাটি নিয়ে এসেছিলেন, তখনই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে তাঁর দৃষ্টি আসামের বিধানসভার নির্বাচনের দিকে। আসামের জনগণের কাছে উলফার জন্য এখনো কিছু আবেগ রয়েছে। গতবারের নির্বাচনে কংগ্রেস সেখানে জিতেছিল ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত বাঙালিদের সহায়তায়। মুখ্যমন্ত্রী এবার তাদের নিরাপদে রেখেছেন এবং তাঁর বিজয়ের ফলে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগগুলো চাপা পড়ে গেছে। ভালো হয়, যদি দুই শক্তির মধ্যে একটা স্থায়ী সমঝোতা হয় এবং উলফা যেমনটি চায়, আসামের স্বতন্ত্র পরিচয় অক্ষুণ্ন রেখে ভারতীয় সংবিধানের মধ্যে মিলেমিশে বসবাস করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কংগ্রেসকে বুঝতে হবে, রাজনৈতিক সমস্যার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সমাধান, সামরিক সমাধান নয়।
নির্বাচনের উত্তেজনা যখন থিতিয়ে আসবে, ভারতের সব কটি প্রধান রাজনৈতিক দল—কংগ্রেস, বিজেপি ও কমিউনিস্টরা— উপলব্ধি করবে যে তাদের পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। আঞ্চলিক দলগুলো সেই জায়গার দখল নিতে যাচ্ছে, যেখান থেকে তারা নির্ধারণ করে দেবে কোন সর্বভারতীয় দলটি নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকবে। এর অর্থ, কেন্দ্রে দীর্ঘ সময়ে জন্য আসবে কোয়ালিশন সরকার। এতে খারাপ কিছু নেই, যদি ফেডারেল-ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধা রাখা হয় এবং যদি সমঝোতার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে পরস্পরের প্রতি খিস্তিখেউড় করে, তাতে আশাবাদী হওয়া যায় না। তারা এ ব্যবস্থার ভাবমূর্তি এতটাই নষ্ট করেছে যে তাদের নিজেদের গ্রহণযোগ্যতাই শূন্যের কোঠায় ঠেকেছে।
একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, ভারতের রাজনীতি থেকে নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া হয়েছে। সামনে অনেক বছর ধরে কেন্দ্রে, এমনকি রাজ্যগুলোতেও কোয়ালিশন সরকারের আমল পার করতে হবে এই জাতিকে। দুঃখজনক দর-কষাকষি চলবে, চলবে ব্যবসা-তাড়িত নানা শক্তির সমন্বয়। জনগণ নীরবে দেখবে। তৃতীয় একটি বিকল্পের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।
No comments