বেটা পাকা চোরবেশে সাধু অতিশয় by শেখ রোকন

চারপাশে যখন নদীর মৃত্যুঘণ্টাধ্বনী; আশা-জাগানিয়া খবর এসেছে পাবনা থেকে। দখল, দূষণ, ভরাটের শিকার হয়ে স্রোত হারানো ইছামতি নদী নাব্যতা ফিরে পেয়েছে। সেখান থেকে সমকালের নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, নদীটি এখন পানিতে টইটম্বুর। ময়লা-আর্বজনা সব ভেসে গেছে, নেই কোনো দুর্গন্ধ।

অথচ দু'দিন আগেও ইছামতিকে নদী বলে চেনা যেত না; যেন পৌর বর্জ্য নিষ্কাষণের বড়সড় নালা। পরিণত হয়েছিল মশার খামারে। মাত্র গত ফেব্রুয়ারিতে একজন নদীপ্রেমী, কোথাও গেলে নদীর পাড়ে ছবি তোলা যার দীর্ঘদিনের পছন্দ, ইছামতি দেখতে গিয়ে বেড়ানো দূরে থাক তিষ্টাতে পারেননি। চার দশক পর সে মৃত ও গলিত গাঙে জোয়ার এসেছে!
শোনা যায়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় মানবীয় সব প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হয়, তখন খোদ প্রকৃতিই এগিয়ে আসে। ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে বা তৈরি করে নতুন নিয়ম। প্রকৃতির প্রকৃষ্ট কন্যা নদীর ক্ষেত্রে এমন ধারণা আরও প্রতিষ্ঠিত। চলার পথে কৃত্রিম বাধা এলে সাময়িকভাবে দমে গেলেও পরে কোনো না কোনোভাবে ফের নিজের মতো পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। না হয় ভাঙন ও ভরাটের মতো বিরূপ প্রভাব দেখা দেয়। কল্যাণ রুদ্রের মতো নদী বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরে 'আশঙ্কা' করে আসছেন, ফারাক্কা ব্যারেজের কারণে ওই দৈত্যকায় স্থাপনা এড়িয়ে যে কোনো সময় নতুন পথ খুঁজে নিতে পারে গঙ্গা। বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে বাঁচতে বাঁধ ভেঙে ফেলার দৃষ্টান্তও এখন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তৈরি হচ্ছে। কল্যাণ রুদ্রই লিখেছিলেন, নদী হচ্ছে সাপের মতো। মাথা চেপে ধরলে লেজ আছড়িয়ে সবাইকে নাকাল করে দেয়।
ইছামতির প্রাণ ফিরে পাওয়ার কৃতিত্ব অবশ্য না প্রকৃতির, না নদীর নিজের। বড় বড় গয়না নৌকা চলা ইছামতির মুখে_ যেখানে পদ্মা থেকে নদীটির উৎপত্তি হয়েছে, শিলাইদহ থেকে শাহজাদপুর যাতায়াতের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি বজরা যেখান দিয়ে পদ্মা থেকে ইছামতিতে প্রবেশ করত_ ১৯৭২ সালে স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। ফলে প্রবাহ বন্ধ হয়ে খোদ ইছামতিরই ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছিল। প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছিল খোদ স্লুইস গেটটিও।
অবশ্য গত চার দশকে ইছামতির প্রাণ ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও কম হয়নি। খরচ হয়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ। সমকালের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই দীর্ঘ সময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ওই নদী খননে আড়াইশ' কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ফলাফল? নৈবচ নৈবচ।
বিভিন্ন প্রকল্প ও প্রচেষ্টা যেখানে ব্যর্থ হয়েছে, নাম না জানা এক চোর সাফল্য দেখিয়েছেন। নদী নিয়ে নানা প্রকল্পেও চুরি-চামাড়ি হয় বটে; ইছামতিতে বান ডাকানোর ক্ষেত্রে যার অবদান রয়েছে তিনি সাধুবেশে চোর নন। চোর মানে চোরই। তবে তার নজর যে উঁচু, সেটা স্বীকার করতে হবে। সাধারণ চোররা যেখানে গৃহস্থালি জিনিসপত্র বা গবাদিপশু হাতিয়ে সন্তুষ্ট থাকে; তিনি চুরি করেছেন স্লুইস গেটের কপাট। আর খোলা দরজা পেয়ে পদ্মার বাড়ন্ত পানি ঢুকে পড়েছে খোলা দরজা দিয়ে।
দেশের আরও নদী এভাবে স্লুইস গেটের কবলে পড়ে মরতে বসেছে। অনেক স্থানে স্লুইস গেট ভেঙে ফেলার জনদাবিও উঠেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। কিন্তু কর্তারা নদী বাঁধতে জানেন, খুলতে জানেন না। আমাদের বোধহয় দরকার পাবনার মতো আরও কিছু চোরবেশী সাধু।
skrokon@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.