সাদাসিধে কথা-ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় এবং আমরণ অনশন by মুহম্মদ জাফর ইকবাল
আমি যতটুকু জানি, হার্ভার্ডকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দুপুর বেলা আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে বসে অন্যমনস্কভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, গবেষকদের আসা-যাওয়া দেখছিলাম। আমার মনটি ভালো ছিল না—আমি যখনই পৃথিবীর সেরা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি,
তখনই বুকের ভেতর একধরনের বেদনা অনুভব করি। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীরা কত ধরনের সুযোগের মাঝে লেখাপড়া করে—আমরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের কিছুই দিতে পারি না! আজকে আমার মনটা একটু বেশি খারাপ ছিল, কারণ সকালে কম্পিউটার খুলে ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের একটা ই-মেইল পেয়েছি—তারা সবাই আমরণ অনশন করছে। আমাকে বলেছে, আমি যেন কোনোভাবে তাদের পাশে দাঁড়াই। আমি হার্ভার্ডের চত্বরে বসে হাসিখুশি ছাত্রছাত্রীদের ছুটোছুটি দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, এদের সম্ভবত আমি কোনো দিন বোঝাতেও পারব না যে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে মাঝে আমরণ অনশন করতে হয়—আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও একবার করেছিল। যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সেই আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায় ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী হলের নাম দেওয়া হয়েছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, যিনি যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবি করে এই দেশের মানুষের হূদয়ের কাছাকাছি গিয়েছিলেন এবং সে কারণে যুদ্ধাপরাধীরা সেটা মেনে নিতে পারেনি এবং পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়কে সচল করার জন্য ঢাকার শহীদ মিনারে আমরণ অনশন শুরু করেছিল।
আমি আমরণ অনশন কথাটিকে খুব ভয় পাই। কারণ, আমি জানি, সেটি শুরু করার পর প্রথম দু-এক দিন ভয়ংকর ক্ষুধা পায়, তারপর ক্ষুধার অনুভূতি থাকে না, শরীর নিস্তেজ হয়ে যায় এবং যারা অনশন করে, তাদের মধ্যে একধরনের তীব্র অভিমান ও ক্ষোভের জন্ম হয় এবং তখন সবাই মিলে হঠাৎ করে সত্যিই বিশ্বাস করতে থাকে যে এই জীবন রেখে লাভ নেই। তাদের শরীর ভেঙে পড়ে এবং কারও কারও শরীরে পানির অভাব হয়ে তীব্র খিঁচুনি হতে থাকে, সেই দৃশ্যগুলো খুব ভয়ংকর। শক্ত মানুষেরা সেগুলো সহ্য করতে পারে, আমি নেহাতই দুর্বল চরিত্রের মানুষ, আমি সহ্য করতে পারি না। বিদেশের মাটিতে বসে আমি খুব ভয়ে ভয়ে খবরের কাগজগুলো দেখি—ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কেমন আছে দেখার চেষ্টা করি।
যখন এই গোলমালটি শুরু হয়, তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের কিছু ছাত্র সিলেটে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। খবরের কাগজে দেখেছি, সেখানে গোলমাল হচ্ছে এবং তারা তখন আমার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছে। কোনো একটা বিচিত্র কারণে তাদের ধারণা হয়েছিল, তাদের নিজস্ব একটি বিষয়ে আমি নাক গলালেই সমস্যার একটি সমাধান হবে। আমি তাদের খুব স্পষ্টভাবে বলেছিলাম, এই দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত, সবাই নিজেদের নিয়মকানুন দিয়ে চলে। আমি ভিন্ন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কোনোভাবেই অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব একটি ব্যাপারে নাক গলাতে পারি না। আমি কখনোই এটা করিনি, করার কোনো সুযোগ নেই, অধিকার নেই। আমি ছাত্রদের বলেছিলাম, তাদেরকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টার নিষ্পত্তি করতে হবে। ছাত্ররা বেশ হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছিল।
এরপর আমি খবরের কাগজে তাদের খবর পেয়েছি। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গোলমালের কারণে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়া এই দেশের খুব পরিচিত একটা ঘটনা। কিন্তু ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটি ঘটেছে, সেটি খুবই বিচিত্র একটি ঘটনা—বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত পড়াশোনা করছে, শুধু একটি বিভাগকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে এবং তারা তাদের দাবি আদায় করার জন্য নানা ধরনের আন্দোলন করে যাচ্ছে। বিষয়টি আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়-সুলভ মনে হয়নি। আমি নিজে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রদের তাণ্ডব কোন পর্যায়ে যেতে পারে, আমি সেটা দেখে অভ্যস্ত। আমাদের লাইব্রেরির নিচতলায় কাচের দেয়ালে ঘেরা একটি কম্পিউটার ল্যাব আছে, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা ইন্টারনেট ব্রাউজ করে। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ মারামারি করে একদিন আমাদের সেই ল্যাবটি ভেঙে চুরমার করে দিল—আমার এত মন খারাপ হয়েছিল যে আমি সেটা কোনো দিন দেখতেও যাইনি। এ ধরনের অনেক ঘটনার কথা বলা যাবে, অনেক রক্তপাতের কথা বলা যাবে, কিন্তু তার পরেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দিনের জন্যও ক্লাস বন্ধ থাকেনি। এর সবকিছু সম্ভব হয়েছে একটিমাত্র কারণে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কখনোই ছাত্রদের নিজেদের প্রতিপক্ষ ভাবেননি। তাদেরকে অর্বাচীন ভেবেছেন, দায়িত্বহীন ভেবেছেন, অপরিপক্ব বালখিল্য ভেবেছেন কিন্তু কথা বলার অযোগ্য শত্রুগোষ্ঠী ভাবেননি। তাই কখনোই তাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ হয়নি এবং এমন কোনো সমস্যার জন্ম হয়নি, যেটা কথা বলে সমাধান করা যায়নি।
আমার মনে হয়েছে, ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুটি ভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে এবং একদল অন্য দলকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে। যে সমস্যাটি কথা বলে বা আলোচনা করে সমাধান করা যেত, সেটি সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম প্রক্রিয়ায়—যেটাকে সাদা কথায় বলা হয় আমরণ অনশন। কম বয়সী আবেগপ্রবণ ছেলেমেয়েরা যদি হঠাৎ করে এ অনশন কঠিনভাবে গ্রহণ করে ফেলে, সেখান থেকে বের হওয়ার সহজ কোনো রাস্তা আমার জানা নেই।
যে বিষয়টি নিয়ে সবকিছুর সূত্রপাত, আমি সেটা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই, এ দেশের মানুষের এগুলো একটু জানা প্রয়োজন। আমি যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই, তখন আমাকে যে বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তার নাম ছিল ইলেকট্রনিকস ও কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ। কয়েক বছর পর সব ছাত্রছাত্রী একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এল—তারা আমাকে জানাল, তাদের খুব ইচ্ছে বিভাগটিকে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পরিবর্তন করে এর নাম করা হোক কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং। কেন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ করতে হবে, তার পক্ষে তারা নানা ধরনের কারণ দেখিয়েছিল। এত দিন পরে আমার সেগুলো মনে নেই, শুধু একজন ছাত্রের ঠাট্টা করে বলা কথাটি মনে আছে, সে মুখ কাঁচুমাচু করে বলেছিল, স্যার, ইঞ্জিনিয়ার না হলে মেয়ের বাবারা বিয়ে দিতে চায় না!
আমার ছাত্রদের বিয়ের জন্য নয়, তাদের বক্তব্যের কারণে আমি বিষয়টি বিবেচনা করেছিলাম, সিলেবাসটি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের কাছে মতামতের জন্য পাঠিয়েছিলাম। তারা মতামত দিয়েছিলেন, সেই মতামতের ভিত্তিতে সিলেবাসের পরিবর্তন করা হয়েছিল। আমি বিষয়টি তখন একাডেমিক কাউন্সিলে নিয়ে গিয়েছিলাম। একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যরা সেটা আলোচনা করে, আমার বিভাগটির নাম পরিবর্তন করে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করে দিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক ছাড়াই ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধরনের যুক্তি দেওয়া যেত—কেউ দেয়নি। এই বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা পাস করে এ দেশে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।
শুধু আমাদের বিভাগ নয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও অনেকগুলো বিভাগের নাম এভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রতিবারই একাডেমিক কাউন্সিল সেটা করে দিয়েছে শুধু ছাত্রছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্তের সন্তানেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে যখন চাকরির বাজারে ঢুকবে, তখন শুধু একটা নামের পরিবর্তনের জন্য যদি তাদের সামনে বিশাল একটা সুযোগ চলে আসে, তাহলে কেন সেটি করা হবে না? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ যে বিভাগের নামের পরিবর্তন হয়েছে, সেটি হচ্ছে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং টি টেকনোলজি—ঠিক যে পরিবর্তনের জন্য ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করে যাচ্ছে, হুবহু এই পরিবর্তনটি কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে করা হয়েছে।
এ কথাটি কেউ অস্বীকার করবে না যে একটি বিভাগের কী নাম হবে, সেটি কখনোই কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের আবদার শুনে ঠিক করা হবে না। কিন্তু এ কথাটিও মেনে নিতে হবে, তাদের কথাগুলো কাউকে না কাউকে শুনতে হবে। যদি তাদের কথায় যুক্তি থাকে, তাহলে সেটা বিবেচনা করার সৎসাহস থাকতে হবে। ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা পুরোপুরি তাদের ব্যাপার। তাদের সিলেবাসে যেটা আছে, সেটা দিয়ে তারা হয়তো আসলেই ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি পেতে পারে না। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি দিতে হলে কী কী পরিবর্তন আনতে হবে এবং সেই পরিবর্তন এনে ছাত্রছাত্রীদের বাড়তি এক-দুই সেমিস্টার রেখে নতুন কোর্স পড়িয়ে নতুন ডিগ্রি দেওয়া এমন কিছু অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিক ঘটনা নয়। অন্তত আমি জোর গলায় বলতে পারি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব সতর্কভাবে এবং সাফল্যের সঙ্গে এটা একাধিকবার করা হয়েছে।
আমি বুঝতে পারছি, ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে—এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক কিছু হতে পারে না। আমি নিজে একজন শিক্ষক। আমি জানি, তাদের হুমকি-ধমকি দিয়ে, শাস্তি দিয়ে, ভয়ভীতি দেখিয়ে যেটুকু অর্জন করা সম্ভব, তার থেকে শত গুণ বেশি অর্জন করা সম্ভব, তাদের কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় একটি-দুটি কথা বলে। আমি খুব আশা করে আছি, শিক্ষকদের কেউ না কেউ তাদের কাছে গিয়ে তাদের কথা শুনবেন, মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে তাদের সঙ্গে একটু কথা বলবেন। সমস্যাটির সমাধান করবেন।
কথা বলে সমাধান করা যায় না—এ রকম কোনো সমস্যা পৃথিবীতে আছে বলে আমার জানা নেই।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
আমি আমরণ অনশন কথাটিকে খুব ভয় পাই। কারণ, আমি জানি, সেটি শুরু করার পর প্রথম দু-এক দিন ভয়ংকর ক্ষুধা পায়, তারপর ক্ষুধার অনুভূতি থাকে না, শরীর নিস্তেজ হয়ে যায় এবং যারা অনশন করে, তাদের মধ্যে একধরনের তীব্র অভিমান ও ক্ষোভের জন্ম হয় এবং তখন সবাই মিলে হঠাৎ করে সত্যিই বিশ্বাস করতে থাকে যে এই জীবন রেখে লাভ নেই। তাদের শরীর ভেঙে পড়ে এবং কারও কারও শরীরে পানির অভাব হয়ে তীব্র খিঁচুনি হতে থাকে, সেই দৃশ্যগুলো খুব ভয়ংকর। শক্ত মানুষেরা সেগুলো সহ্য করতে পারে, আমি নেহাতই দুর্বল চরিত্রের মানুষ, আমি সহ্য করতে পারি না। বিদেশের মাটিতে বসে আমি খুব ভয়ে ভয়ে খবরের কাগজগুলো দেখি—ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কেমন আছে দেখার চেষ্টা করি।
যখন এই গোলমালটি শুরু হয়, তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের কিছু ছাত্র সিলেটে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। খবরের কাগজে দেখেছি, সেখানে গোলমাল হচ্ছে এবং তারা তখন আমার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছে। কোনো একটা বিচিত্র কারণে তাদের ধারণা হয়েছিল, তাদের নিজস্ব একটি বিষয়ে আমি নাক গলালেই সমস্যার একটি সমাধান হবে। আমি তাদের খুব স্পষ্টভাবে বলেছিলাম, এই দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত, সবাই নিজেদের নিয়মকানুন দিয়ে চলে। আমি ভিন্ন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কোনোভাবেই অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব একটি ব্যাপারে নাক গলাতে পারি না। আমি কখনোই এটা করিনি, করার কোনো সুযোগ নেই, অধিকার নেই। আমি ছাত্রদের বলেছিলাম, তাদেরকে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়ে তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টার নিষ্পত্তি করতে হবে। ছাত্ররা বেশ হতাশ হয়ে ফিরে গিয়েছিল।
এরপর আমি খবরের কাগজে তাদের খবর পেয়েছি। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের গোলমালের কারণে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়া এই দেশের খুব পরিচিত একটা ঘটনা। কিন্তু ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটি ঘটেছে, সেটি খুবই বিচিত্র একটি ঘটনা—বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত পড়াশোনা করছে, শুধু একটি বিভাগকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে এবং তারা তাদের দাবি আদায় করার জন্য নানা ধরনের আন্দোলন করে যাচ্ছে। বিষয়টি আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়-সুলভ মনে হয়নি। আমি নিজে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্রদের তাণ্ডব কোন পর্যায়ে যেতে পারে, আমি সেটা দেখে অভ্যস্ত। আমাদের লাইব্রেরির নিচতলায় কাচের দেয়ালে ঘেরা একটি কম্পিউটার ল্যাব আছে, যেখানে ছাত্রছাত্রীরা ইন্টারনেট ব্রাউজ করে। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ মারামারি করে একদিন আমাদের সেই ল্যাবটি ভেঙে চুরমার করে দিল—আমার এত মন খারাপ হয়েছিল যে আমি সেটা কোনো দিন দেখতেও যাইনি। এ ধরনের অনেক ঘটনার কথা বলা যাবে, অনেক রক্তপাতের কথা বলা যাবে, কিন্তু তার পরেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দিনের জন্যও ক্লাস বন্ধ থাকেনি। এর সবকিছু সম্ভব হয়েছে একটিমাত্র কারণে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কখনোই ছাত্রদের নিজেদের প্রতিপক্ষ ভাবেননি। তাদেরকে অর্বাচীন ভেবেছেন, দায়িত্বহীন ভেবেছেন, অপরিপক্ব বালখিল্য ভেবেছেন কিন্তু কথা বলার অযোগ্য শত্রুগোষ্ঠী ভাবেননি। তাই কখনোই তাদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ হয়নি এবং এমন কোনো সমস্যার জন্ম হয়নি, যেটা কথা বলে সমাধান করা যায়নি।
আমার মনে হয়েছে, ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুটি ভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে আছে এবং একদল অন্য দলকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে। যে সমস্যাটি কথা বলে বা আলোচনা করে সমাধান করা যেত, সেটি সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম প্রক্রিয়ায়—যেটাকে সাদা কথায় বলা হয় আমরণ অনশন। কম বয়সী আবেগপ্রবণ ছেলেমেয়েরা যদি হঠাৎ করে এ অনশন কঠিনভাবে গ্রহণ করে ফেলে, সেখান থেকে বের হওয়ার সহজ কোনো রাস্তা আমার জানা নেই।
যে বিষয়টি নিয়ে সবকিছুর সূত্রপাত, আমি সেটা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই, এ দেশের মানুষের এগুলো একটু জানা প্রয়োজন। আমি যখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই, তখন আমাকে যে বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তার নাম ছিল ইলেকট্রনিকস ও কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ। কয়েক বছর পর সব ছাত্রছাত্রী একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এল—তারা আমাকে জানাল, তাদের খুব ইচ্ছে বিভাগটিকে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পরিবর্তন করে এর নাম করা হোক কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং। কেন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ করতে হবে, তার পক্ষে তারা নানা ধরনের কারণ দেখিয়েছিল। এত দিন পরে আমার সেগুলো মনে নেই, শুধু একজন ছাত্রের ঠাট্টা করে বলা কথাটি মনে আছে, সে মুখ কাঁচুমাচু করে বলেছিল, স্যার, ইঞ্জিনিয়ার না হলে মেয়ের বাবারা বিয়ে দিতে চায় না!
আমার ছাত্রদের বিয়ের জন্য নয়, তাদের বক্তব্যের কারণে আমি বিষয়টি বিবেচনা করেছিলাম, সিলেবাসটি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের কাছে মতামতের জন্য পাঠিয়েছিলাম। তারা মতামত দিয়েছিলেন, সেই মতামতের ভিত্তিতে সিলেবাসের পরিবর্তন করা হয়েছিল। আমি বিষয়টি তখন একাডেমিক কাউন্সিলে নিয়ে গিয়েছিলাম। একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যরা সেটা আলোচনা করে, আমার বিভাগটির নাম পরিবর্তন করে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করে দিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষক ছাড়াই ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধরনের যুক্তি দেওয়া যেত—কেউ দেয়নি। এই বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা পাস করে এ দেশে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।
শুধু আমাদের বিভাগ নয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও অনেকগুলো বিভাগের নাম এভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রতিবারই একাডেমিক কাউন্সিল সেটা করে দিয়েছে শুধু ছাত্রছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্তের সন্তানেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে যখন চাকরির বাজারে ঢুকবে, তখন শুধু একটা নামের পরিবর্তনের জন্য যদি তাদের সামনে বিশাল একটা সুযোগ চলে আসে, তাহলে কেন সেটি করা হবে না? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ যে বিভাগের নামের পরিবর্তন হয়েছে, সেটি হচ্ছে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং টি টেকনোলজি—ঠিক যে পরিবর্তনের জন্য ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করে যাচ্ছে, হুবহু এই পরিবর্তনটি কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে করা হয়েছে।
এ কথাটি কেউ অস্বীকার করবে না যে একটি বিভাগের কী নাম হবে, সেটি কখনোই কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের আবদার শুনে ঠিক করা হবে না। কিন্তু এ কথাটিও মেনে নিতে হবে, তাদের কথাগুলো কাউকে না কাউকে শুনতে হবে। যদি তাদের কথায় যুক্তি থাকে, তাহলে সেটা বিবেচনা করার সৎসাহস থাকতে হবে। ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা পুরোপুরি তাদের ব্যাপার। তাদের সিলেবাসে যেটা আছে, সেটা দিয়ে তারা হয়তো আসলেই ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি পেতে পারে না। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি দিতে হলে কী কী পরিবর্তন আনতে হবে এবং সেই পরিবর্তন এনে ছাত্রছাত্রীদের বাড়তি এক-দুই সেমিস্টার রেখে নতুন কোর্স পড়িয়ে নতুন ডিগ্রি দেওয়া এমন কিছু অস্বাভাবিক বা অযৌক্তিক ঘটনা নয়। অন্তত আমি জোর গলায় বলতে পারি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব সতর্কভাবে এবং সাফল্যের সঙ্গে এটা একাধিকবার করা হয়েছে।
আমি বুঝতে পারছি, ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছে—এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক কিছু হতে পারে না। আমি নিজে একজন শিক্ষক। আমি জানি, তাদের হুমকি-ধমকি দিয়ে, শাস্তি দিয়ে, ভয়ভীতি দেখিয়ে যেটুকু অর্জন করা সম্ভব, তার থেকে শত গুণ বেশি অর্জন করা সম্ভব, তাদের কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় একটি-দুটি কথা বলে। আমি খুব আশা করে আছি, শিক্ষকদের কেউ না কেউ তাদের কাছে গিয়ে তাদের কথা শুনবেন, মমতা আর ভালোবাসা দিয়ে তাদের সঙ্গে একটু কথা বলবেন। সমস্যাটির সমাধান করবেন।
কথা বলে সমাধান করা যায় না—এ রকম কোনো সমস্যা পৃথিবীতে আছে বলে আমার জানা নেই।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments