শেয়ারবাজার-কেন পরিচয়পত্র কেন টিআইএন by আবু আহমেদ
শেয়ারবাজারের এখন ঘোর দুর্দিন। বিনিয়োগকারী নেই বললেই চলে। অতি সাহসী কিছু লোক যা-ও কয়েক দিন আগে শেয়ার কিনেছিলেন, তাঁরাও আজ ক্ষতির সম্মুখীন। অব্যাহত দরপতনে সবাই যে ক্ষতির সম্মুখীন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এবারের দরপতনে যাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁরা হলেন সেই খুদে বিনিয়োগকারী,
যাঁরা লাইন দিয়ে প্রাইমারি শেয়ারের জন্য দরখাস্ত দিতেন এবং যাঁদের একটা অংশ আবার সেকেন্ডারি বাজারেও তৎপর ছিলেন। তাঁরা সংখ্যায় ৩৪ লাখ। আর শেয়ারবাজার যখন সুনামির আঘাতে বিধ্বস্ত হতে লাগল, তখন তাঁদের কেউ কেউ রাস্তায় ক্ষোভ প্রকাশ করতে চেয়েছেন। এতেও মনে হয়, কর্তৃপক্ষ দারুণ নাখোশ। ক্ষোভ-প্রতিবাদ যেখানে গণতান্ত্রিক সমাজের স্বীকৃত বিষয়, সেখানে পুঁজি হারানো এসব শিক্ষিত লোকের ওই কাজগুলোকে সরকার গর্হিত কাজ বলে মনে করে কেন জানি না। যে সময় বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়েছিল, ওই সময় শেয়ারবাজারের অবস্থা বর্তমানের তুলনায় অনেক ভালো ছিল। তখন তাঁরা মনে করেছিলেন, এই তো শেয়ারবাজার অনেক পড়ে গেছে, আর বুঝি পড়ার সুযোগ নেই। তাই তাঁদেরই কেউ কেউ আবার ক্রেতা সেজেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন, তাঁদের সেই আশাও দুরাশা।
অন্য যেসব কারণে শেয়ারবাজার আরও পড়তে পারে, সেই সব কারণ তাঁরা পড়তে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই তাঁদের আশাকে পরাজিত করে শেয়ারবাজার আরও পড়ল। বাজার কিছুদিন ওপরে থাকার মূলে সরকারের কিছু আশ্বাসবাণীও কাজ করেছে। মনে হচ্ছিল, সরকার শেয়ারবাজারকে আর পড়তে দেবে না।
অন্যদিকে বেশ ঘটা করে বাংলাদেশ ফান্ড এল বাজারকে ‘ঠেক’ দেওয়ার জন্য। অন্তত প্রথম বিনিয়োগকারীরা তাই মনে করেছিলেন। কিন্তু এই চাহিদাও বাজারটিকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে অক্ষম হলো না। বরং বলা যায়, পাঁচ হাজার ৫০০ থেকে ছয় হাজার সূচকের মধ্যে বাংলাদেশ ফান্ড আদৌ বিনিয়োগ করেছে কি না। করলেও মনে হয় যৎসামান্য। সবাই বসে আছেন বাজার আরও কত বাড়তে পারে, তা দেখার জন্য। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় অবশ্যই শেয়ারবাজার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে সামগ্রিক অর্থনীতিও। আর সরকারের রাজনৈতিক ক্ষতির দিকটা নাই বা বললাম। এটা ঠিক, শেয়ারবাজার পড়তে পড়তে একপর্যায়ে গিয়ে থেমে যাবে। কিন্তু সেই দিনের জন্য কি রেগুলেটর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বসে থাকা উচিত হবে? তাহলে জনস্বার্থে পলিসি সাপোর্টের বিষয়গুলোর ব্যাপারে কে কী বলবেন? শেয়ারবাজার ওঠার সময়ও যেমন যুক্তি মানেনি, আজকে পড়ার সময়ও যুক্তি মানছে না। তবে এভাবে পড়ার পক্ষেও অনেক লোক আছেন। তাঁদের কথা হলো, এই পড়াও বাজারেরই অংশ। যাক, এসব নিয়ে অনেক কথা আছে। সেসব নিয়ে অনেক অনেক বিতর্ক হতে পারে। আমি পাবলিক ইন্টারেস্ট বা জনস্বার্থের ব্যাপারকে ভেবে দেখতে বলব। সত্যি কথা বলতে কি, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি সাপোর্ট ছাড়া শেয়ারবাজারকে পতনের অবস্থা থেকে ফেরানোর কোনো পথ দেখছি না। অন্যদিকে আগামী বাজেটেও দেয় প্রণোদনাগুলো অব্যাহত রাখতে হবে। যাঁরা এটা বলেন সুদের হার, তারল্য প্রবাহ, মুদ্রাবাজারের সঙ্গে শেয়ারবাজারের সম্পর্ক নেই, তাঁরা ভুলের মধ্যে আছেন। তাঁদের জ্ঞানের ঘাটতি আছে।
যাক, অন্য কথায় আসি। শেয়ারবাজারের লোকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হওয়ার কারণে সরকার মনে হয় যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে। তাই রাস্তায় কে এলেন বিনিয়োগকারী, কে নকল বিনিয়োগকারী সেজে গণ্ডগোল করতে গেছেন, সে জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিনিয়োগকারীদের জন্য পরিচয়পত্র, ট্যাক্স আর শনাক্তকরণের জন্য স্টক এক্সচেঞ্জে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের চিন্তা করছে। তবে এই চিন্তাও যে একটা ভুল চিন্তা, সেটা অন্যরা না বুঝলেও শেয়ারবাজারের লোকদের বোঝা উচিত। ৩৪ লাখ বিনিয়োগকারীকে কীভাবে কথিত আইডি কার্ড দেওয়া হবে? এই কার্ডের কাজই বা কী? ওই কার্ড গলায় ঝুলিয়ে, নাকি পকেটে করে নিয়ে চলতে হবে?
শেয়ারবাজার ভয়ভীতির মধ্যে চলে না। এসব উদ্ভট চিন্তা শুধু শেয়ারবাজারকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এ ধরনের একটা প্রস্তাব কী করে দেয়? অন্য বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো বিনিয়োগকারীদের জন্য ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (TIN) বাধ্যতামূলক করা। এটা শুনতে ভালো লাগে। তবে যে দেশের পুরো অর্থনীতিতে এখনো শুধু ১৭-১৮ শতাংশ লোকের TIN আছে, সে দেশে ৩৪ লাখ বিনিয়োগকারীকে হঠাৎ TIN-এর আওতায় আনার এই চিন্তা কেন? তাঁদের অনেকের করযোগ্য আয়ই নেই। অন্যদিকে আমাদের সমাজে ট্যাক্সভীতি আছে। আর সেই ভীতিটা ক্ষণে ক্ষণে শেয়ারবাজারে ছড়িয়ে পড়লে হিতে বিপরীত হবে কি না, ভেবে দেখতে বলব। শেয়ারবাজারের খুদে ৩৪ লাখ বিনিয়োগকারীকে ট্যাক্স-নেটের আওতায় আনার আগে যাঁরা শেয়ারবাজারকে লুট করলেন, তাঁরা ট্যাক্স ঠিকমতো দিচ্ছেন কি না, একবার যাচাই করে দেখুন। যে ব্যক্তি শুধু ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে মাসে তিন লাখ টাকা ব্যয় করেন, তিনি কত টাকা ট্যাক্স দেন, সে বিষয়গুলো আগে দেখুন। শেয়ারবাজারকে আপাতত সব ধরনের ট্যাক্স-জাল থেকে দূরে রাখুন। আর যদি নিয়ত করেন যে এই বাজার শুধু সমস্যা সৃষ্টি করে, এই বাজারকে কতিপয় বোঝা বানিয়ে মেরে ফেলতে হবে, তাহলে (TIN) ট্যাক্স বসান, আইডি কার্ড ইস্যু করুন, সুদের হারকে আরও বাড়িয়ে দিন, ব্যাংকগুলোকে হুকুম করুন—খবরদার শেয়ারবাজারের কোনো সহায়ক শক্তি হওয়া চলবে না। রেগুলেটর তুমি বসে থাকবে আর দু-চারটি মিটিং করো।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ।
অন্য যেসব কারণে শেয়ারবাজার আরও পড়তে পারে, সেই সব কারণ তাঁরা পড়তে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই তাঁদের আশাকে পরাজিত করে শেয়ারবাজার আরও পড়ল। বাজার কিছুদিন ওপরে থাকার মূলে সরকারের কিছু আশ্বাসবাণীও কাজ করেছে। মনে হচ্ছিল, সরকার শেয়ারবাজারকে আর পড়তে দেবে না।
অন্যদিকে বেশ ঘটা করে বাংলাদেশ ফান্ড এল বাজারকে ‘ঠেক’ দেওয়ার জন্য। অন্তত প্রথম বিনিয়োগকারীরা তাই মনে করেছিলেন। কিন্তু এই চাহিদাও বাজারটিকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করতে অক্ষম হলো না। বরং বলা যায়, পাঁচ হাজার ৫০০ থেকে ছয় হাজার সূচকের মধ্যে বাংলাদেশ ফান্ড আদৌ বিনিয়োগ করেছে কি না। করলেও মনে হয় যৎসামান্য। সবাই বসে আছেন বাজার আরও কত বাড়তে পারে, তা দেখার জন্য। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় অবশ্যই শেয়ারবাজার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে সামগ্রিক অর্থনীতিও। আর সরকারের রাজনৈতিক ক্ষতির দিকটা নাই বা বললাম। এটা ঠিক, শেয়ারবাজার পড়তে পড়তে একপর্যায়ে গিয়ে থেমে যাবে। কিন্তু সেই দিনের জন্য কি রেগুলেটর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বসে থাকা উচিত হবে? তাহলে জনস্বার্থে পলিসি সাপোর্টের বিষয়গুলোর ব্যাপারে কে কী বলবেন? শেয়ারবাজার ওঠার সময়ও যেমন যুক্তি মানেনি, আজকে পড়ার সময়ও যুক্তি মানছে না। তবে এভাবে পড়ার পক্ষেও অনেক লোক আছেন। তাঁদের কথা হলো, এই পড়াও বাজারেরই অংশ। যাক, এসব নিয়ে অনেক কথা আছে। সেসব নিয়ে অনেক অনেক বিতর্ক হতে পারে। আমি পাবলিক ইন্টারেস্ট বা জনস্বার্থের ব্যাপারকে ভেবে দেখতে বলব। সত্যি কথা বলতে কি, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি সাপোর্ট ছাড়া শেয়ারবাজারকে পতনের অবস্থা থেকে ফেরানোর কোনো পথ দেখছি না। অন্যদিকে আগামী বাজেটেও দেয় প্রণোদনাগুলো অব্যাহত রাখতে হবে। যাঁরা এটা বলেন সুদের হার, তারল্য প্রবাহ, মুদ্রাবাজারের সঙ্গে শেয়ারবাজারের সম্পর্ক নেই, তাঁরা ভুলের মধ্যে আছেন। তাঁদের জ্ঞানের ঘাটতি আছে।
যাক, অন্য কথায় আসি। শেয়ারবাজারের লোকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হওয়ার কারণে সরকার মনে হয় যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে। তাই রাস্তায় কে এলেন বিনিয়োগকারী, কে নকল বিনিয়োগকারী সেজে গণ্ডগোল করতে গেছেন, সে জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিনিয়োগকারীদের জন্য পরিচয়পত্র, ট্যাক্স আর শনাক্তকরণের জন্য স্টক এক্সচেঞ্জে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের চিন্তা করছে। তবে এই চিন্তাও যে একটা ভুল চিন্তা, সেটা অন্যরা না বুঝলেও শেয়ারবাজারের লোকদের বোঝা উচিত। ৩৪ লাখ বিনিয়োগকারীকে কীভাবে কথিত আইডি কার্ড দেওয়া হবে? এই কার্ডের কাজই বা কী? ওই কার্ড গলায় ঝুলিয়ে, নাকি পকেটে করে নিয়ে চলতে হবে?
শেয়ারবাজার ভয়ভীতির মধ্যে চলে না। এসব উদ্ভট চিন্তা শুধু শেয়ারবাজারকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এ ধরনের একটা প্রস্তাব কী করে দেয়? অন্য বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। সেটা হলো বিনিয়োগকারীদের জন্য ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (TIN) বাধ্যতামূলক করা। এটা শুনতে ভালো লাগে। তবে যে দেশের পুরো অর্থনীতিতে এখনো শুধু ১৭-১৮ শতাংশ লোকের TIN আছে, সে দেশে ৩৪ লাখ বিনিয়োগকারীকে হঠাৎ TIN-এর আওতায় আনার এই চিন্তা কেন? তাঁদের অনেকের করযোগ্য আয়ই নেই। অন্যদিকে আমাদের সমাজে ট্যাক্সভীতি আছে। আর সেই ভীতিটা ক্ষণে ক্ষণে শেয়ারবাজারে ছড়িয়ে পড়লে হিতে বিপরীত হবে কি না, ভেবে দেখতে বলব। শেয়ারবাজারের খুদে ৩৪ লাখ বিনিয়োগকারীকে ট্যাক্স-নেটের আওতায় আনার আগে যাঁরা শেয়ারবাজারকে লুট করলেন, তাঁরা ট্যাক্স ঠিকমতো দিচ্ছেন কি না, একবার যাচাই করে দেখুন। যে ব্যক্তি শুধু ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে মাসে তিন লাখ টাকা ব্যয় করেন, তিনি কত টাকা ট্যাক্স দেন, সে বিষয়গুলো আগে দেখুন। শেয়ারবাজারকে আপাতত সব ধরনের ট্যাক্স-জাল থেকে দূরে রাখুন। আর যদি নিয়ত করেন যে এই বাজার শুধু সমস্যা সৃষ্টি করে, এই বাজারকে কতিপয় বোঝা বানিয়ে মেরে ফেলতে হবে, তাহলে (TIN) ট্যাক্স বসান, আইডি কার্ড ইস্যু করুন, সুদের হারকে আরও বাড়িয়ে দিন, ব্যাংকগুলোকে হুকুম করুন—খবরদার শেয়ারবাজারের কোনো সহায়ক শক্তি হওয়া চলবে না। রেগুলেটর তুমি বসে থাকবে আর দু-চারটি মিটিং করো।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ।
No comments