নতুন ব্যাংক-প্রশ্নটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, সদিচ্ছা ও সুশাসনের by মনজুর আহমেদ
২০১১ সালের প্রথম ভাগে বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন ও ভিজিলেন্স বিভাগ থেকে একটি ব্যাখ্যা তলব করা হয়। এই বিভাগ অনুসন্ধানে পায় এক্সিম ব্যাংক থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের ঋণ বিতরণের পর তাঁর চেকগুলো সরাসরি শেয়ারের বিও
হিসাবে গিয়ে জমা হয়েছে। শিল্পের নামে এই ঋণগুলো দেওয়া হয়েছিল। এ পর্যায়ে পাঁচটি অনিয়মের দায়ে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে শুধু ব্যাখ্যা চায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে প্রথম আলো নিজস্ব অনুসন্ধান করে। দেখা যায়, ঋণ নেওয়া দুটি কোম্পানির মালিকেরা তৃতীয় কোম্পানিতে নজরুল ইসলাম মজুমদারের ব্যবসায়িক অংশীদার (প্রথম আলো, ৬ এপ্রিল ২০১১)। আর সর্বশেষ তথ্য হচ্ছে, এই ঋণ সমন্বয়ের (বড় ছাড় দিয়ে) বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সময় বেঁধে দিয়েছিল, তাও করেনি ব্যাংকটি।
এর আগে ২০০৯ সালে প্রিমিয়ার ব্যাংকের শীর্ষ পদে দুটি নিয়োগে বড় ধরনের অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীর স্বার্থরক্ষায় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু, অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে তা প্রত্যাহারও করে নেওয়া হয়। প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান হচ্ছেন বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সাংসদ এইচ বি এম ইকবাল। এই ব্যাংকটিতে একসঙ্গে সাবেক তিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিভিন্নভাবে যুক্ত হয়েছিলেন এবং এখনো একাধিক জন রয়েছেন। আরও মজার ব্যাপার হলো অনিয়মের দায়ে চাকরিচ্যুত দুজন এমডি ব্যাংকটির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থেকেছেন। এর আবার একজন আরেক ব্যাংক থেকে চাকরিচ্যুত ছিলেন। অপরজন একই ব্যাংকে এমডি ছিলেন। এর আগে ২০০৫ সালে ব্যাংকটি তাদের প্রাথমিক শেয়ার ছাড়া নিয়ে ‘লঙ্কাকাণ্ড’ করেছিল। এই ঘটনায় ব্যাংকের চেয়ারম্যানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এলেও শেষমেশ এর দায়ে কেবল এমডির চাকরি যায়।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তাদের একটা বড় অংশ রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের বিরুদ্ধে বড়-ছোট কোনো অভিযোগই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংক খাতের এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। আরও স্পষ্ট করে বললে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা একেবারেই কমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার আইনি অধিকারের মধ্যে থেকেও শাসন প্রয়োগে এক প্রকার অক্ষম হয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ আগেও কম ছিল। এখন তা আরও হাত ছাড়া হয়েছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর বিষয়ে একবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সরকারের কাছে লিখিত অভিযোগ এনেছিল, পরিচালকেরা দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ করছে। পরবর্তী সময়ে অর্থমন্ত্রী একটা সমঝোতা বৈককের আয়োজনও করেন। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া পরিচালকেরা উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হন, সে খবর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশও হয়। অবশ্য রাজনৈতিক এসব পরিচালকেরা গভর্নরকে ভালো মানুষ এবং তাদের লোক বলে অভিহিতও করেন।
২০০৯ সালে দেশের শেয়ারবাজারে উত্থানের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। অথচ ২০০৯ সালের মধ্য ভাগেই বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক সময়ে আবিষ্কার করেছিল যে ব্যাংকগুলো আইন ভেঙে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ধরে রাখছে। কিন্তু শেয়ারবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
এসব ঘটনার বর্ণনা এ জন্যই যে দেশে নতুন করে আরও বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মহা আয়োজন চলছে। আইনি ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের হলেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগ বাড়িয়ে ২০১২ অর্থবছরের বাজেট পাসের দিন সংসদে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এরপর শুরু হয়ে যায় তোড়জোড়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণার আগেই তাঁর সঙ্গে দেখা করে অভিমত দিয়েছিল নতুন ব্যাংক এখন দেওয়া যাবে না। পর্ষদ দেশজ উৎপাদন, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ, বৈদেশিক বাণিজ্য, আমানত ও ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, লাভজনক, জিডিপিতে খাতভিত্তিক অবদান ইত্যাকার বিবেচনা এবং সম-আয়তনের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এখনই ব্যাংকের সংখ্যা ও শাখা বেশি বলে মত দেয়। এগুলো হলো অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ।
কিন্তু যে বিষয়টি পর্ষদ এখনো আলোচনায় আনেনি বা বিবেচনাতে নেয়নি, তা হলো, সুশাসন বা গুড গর্ভনেন্স। বর্তমান সময়ে ব্যাংক খাতের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি প্রযোজ্য হয়ে পড়েছে। ওপরের বর্ণনার মতো ভূরি ভূরি উদাহরণ দৈনন্দিন সাংবাদিকতার কাজে আমাদের জানার মধ্যে রয়েছে।
উল্লিখিত ঘটনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক তার শাসন আরোপ করতে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ গোষ্ঠীগত ও রাজনৈতিক প্রভাব। এই যে ব্যাংকগুলোতে বড় ধরনের অনিয়ম আবিষ্কার হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই পরিদর্শন বা তদারকিতে, তাতে কী লাভ হলো যদি না ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বলাবাহুল্য, এসব ব্যাংকের সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যোগ না থাকলে ভিন্ন ঘটনা ঘটত। বাংলাদেশ ব্যাংক যে ব্যবস্থা নিতে পারেনি তার কারণ এসব ব্যাংকের উদ্যোক্তারা ক্ষমতাসীন দলেরই হোমরাচোমরা। বর্তমানে ৩০টি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সিংহ ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনীতিবিদদের আধিপত্য রয়েছে। সেখানেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আটকে পড়েছে। আর নতুন যে প্রস্তাবিত ব্যাংকগুলোর নাম, উদ্যোক্তাদের নাম সংবাদপত্রে আসছে, তারা আরও বড় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে দেশকে নয় বছর শাসন করা একজন সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি রয়েছেন। আছেন সরকারি দলের সাবেক মন্ত্রী, সাংসদ, মন্ত্রীপত্নী, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নিকটাত্মীয়। প্রাথমিকভাবে বাছাই হওয়া ১৬টি প্রস্তাবিত ব্যাংকের প্রত্যেকটির সঙ্গে রয়েছেন এঁরা। প্রশ্ন হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনই রাজনীতিকদের প্রভাবে কুপোকাত। তাহলে এই যে বিপুল সংখ্যক ও শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিকদের নতুন ব্যাংক আসলে তার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্বের কী হবে?
এ প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন, তা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা প্রয়োগের কৌশলগত দিকও অর্জনে ব্যর্থতা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি কোনো আইনি ক্ষমতা প্রয়োগের সিদ্ধান্তটি নেওয়ার আগে অর্থমন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় বসে থাকে, তা হলে তো আইনি ক্ষমতা থাকলেও কোনো লাভ হবে না। এমন উদাহরণ দেওয়া যাবে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বসে থাকে। আবার সরকারের শীর্ষ মহলে বিষয়টি তুলে ধরার সক্ষমতা এবং তা বুঝিয়ে সরকারের কাছ থেকে আদায় করার মধ্যে কৌশলগত দিকও রয়েছে। নতুন ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কি এসব বিষয় বিবেচনা করে দেখবে?
মনজুর আহমেদ: সাংবাদিক।
এ বিষয়ে প্রথম আলো নিজস্ব অনুসন্ধান করে। দেখা যায়, ঋণ নেওয়া দুটি কোম্পানির মালিকেরা তৃতীয় কোম্পানিতে নজরুল ইসলাম মজুমদারের ব্যবসায়িক অংশীদার (প্রথম আলো, ৬ এপ্রিল ২০১১)। আর সর্বশেষ তথ্য হচ্ছে, এই ঋণ সমন্বয়ের (বড় ছাড় দিয়ে) বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সময় বেঁধে দিয়েছিল, তাও করেনি ব্যাংকটি।
এর আগে ২০০৯ সালে প্রিমিয়ার ব্যাংকের শীর্ষ পদে দুটি নিয়োগে বড় ধরনের অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীর স্বার্থরক্ষায় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে একজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু, অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে তা প্রত্যাহারও করে নেওয়া হয়। প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান হচ্ছেন বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সাংসদ এইচ বি এম ইকবাল। এই ব্যাংকটিতে একসঙ্গে সাবেক তিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বিভিন্নভাবে যুক্ত হয়েছিলেন এবং এখনো একাধিক জন রয়েছেন। আরও মজার ব্যাপার হলো অনিয়মের দায়ে চাকরিচ্যুত দুজন এমডি ব্যাংকটির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থেকেছেন। এর আবার একজন আরেক ব্যাংক থেকে চাকরিচ্যুত ছিলেন। অপরজন একই ব্যাংকে এমডি ছিলেন। এর আগে ২০০৫ সালে ব্যাংকটি তাদের প্রাথমিক শেয়ার ছাড়া নিয়ে ‘লঙ্কাকাণ্ড’ করেছিল। এই ঘটনায় ব্যাংকের চেয়ারম্যানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এলেও শেষমেশ এর দায়ে কেবল এমডির চাকরি যায়।
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তাদের একটা বড় অংশ রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের বিরুদ্ধে বড়-ছোট কোনো অভিযোগই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে পারেনি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংক খাতের এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। আরও স্পষ্ট করে বললে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা একেবারেই কমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার আইনি অধিকারের মধ্যে থেকেও শাসন প্রয়োগে এক প্রকার অক্ষম হয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ আগেও কম ছিল। এখন তা আরও হাত ছাড়া হয়েছে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর বিষয়ে একবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সরকারের কাছে লিখিত অভিযোগ এনেছিল, পরিচালকেরা দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ করছে। পরবর্তী সময়ে অর্থমন্ত্রী একটা সমঝোতা বৈককের আয়োজনও করেন। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া পরিচালকেরা উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ওপর চড়াও হন, সে খবর প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশও হয়। অবশ্য রাজনৈতিক এসব পরিচালকেরা গভর্নরকে ভালো মানুষ এবং তাদের লোক বলে অভিহিতও করেন।
২০০৯ সালে দেশের শেয়ারবাজারে উত্থানের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর ভূমিকা ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। অথচ ২০০৯ সালের মধ্য ভাগেই বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক সময়ে আবিষ্কার করেছিল যে ব্যাংকগুলো আইন ভেঙে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ধরে রাখছে। কিন্তু শেয়ারবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক চাপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
এসব ঘটনার বর্ণনা এ জন্যই যে দেশে নতুন করে আরও বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মহা আয়োজন চলছে। আইনি ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের হলেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগ বাড়িয়ে ২০১২ অর্থবছরের বাজেট পাসের দিন সংসদে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এরপর শুরু হয়ে যায় তোড়জোড়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ অর্থমন্ত্রীর এই ঘোষণার আগেই তাঁর সঙ্গে দেখা করে অভিমত দিয়েছিল নতুন ব্যাংক এখন দেওয়া যাবে না। পর্ষদ দেশজ উৎপাদন, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ, বৈদেশিক বাণিজ্য, আমানত ও ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, লাভজনক, জিডিপিতে খাতভিত্তিক অবদান ইত্যাকার বিবেচনা এবং সম-আয়তনের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এখনই ব্যাংকের সংখ্যা ও শাখা বেশি বলে মত দেয়। এগুলো হলো অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ।
কিন্তু যে বিষয়টি পর্ষদ এখনো আলোচনায় আনেনি বা বিবেচনাতে নেয়নি, তা হলো, সুশাসন বা গুড গর্ভনেন্স। বর্তমান সময়ে ব্যাংক খাতের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি প্রযোজ্য হয়ে পড়েছে। ওপরের বর্ণনার মতো ভূরি ভূরি উদাহরণ দৈনন্দিন সাংবাদিকতার কাজে আমাদের জানার মধ্যে রয়েছে।
উল্লিখিত ঘটনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক তার শাসন আরোপ করতে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ গোষ্ঠীগত ও রাজনৈতিক প্রভাব। এই যে ব্যাংকগুলোতে বড় ধরনের অনিয়ম আবিষ্কার হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই পরিদর্শন বা তদারকিতে, তাতে কী লাভ হলো যদি না ব্যবস্থা নেওয়া যায়। বলাবাহুল্য, এসব ব্যাংকের সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যোগ না থাকলে ভিন্ন ঘটনা ঘটত। বাংলাদেশ ব্যাংক যে ব্যবস্থা নিতে পারেনি তার কারণ এসব ব্যাংকের উদ্যোক্তারা ক্ষমতাসীন দলেরই হোমরাচোমরা। বর্তমানে ৩০টি বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে সিংহ ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনীতিবিদদের আধিপত্য রয়েছে। সেখানেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক আটকে পড়েছে। আর নতুন যে প্রস্তাবিত ব্যাংকগুলোর নাম, উদ্যোক্তাদের নাম সংবাদপত্রে আসছে, তারা আরও বড় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে দেশকে নয় বছর শাসন করা একজন সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতি রয়েছেন। আছেন সরকারি দলের সাবেক মন্ত্রী, সাংসদ, মন্ত্রীপত্নী, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নিকটাত্মীয়। প্রাথমিকভাবে বাছাই হওয়া ১৬টি প্রস্তাবিত ব্যাংকের প্রত্যেকটির সঙ্গে রয়েছেন এঁরা। প্রশ্ন হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনই রাজনীতিকদের প্রভাবে কুপোকাত। তাহলে এই যে বিপুল সংখ্যক ও শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিকদের নতুন ব্যাংক আসলে তার ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্বের কী হবে?
এ প্রসঙ্গে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন, তা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা প্রয়োগের কৌশলগত দিকও অর্জনে ব্যর্থতা আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি কোনো আইনি ক্ষমতা প্রয়োগের সিদ্ধান্তটি নেওয়ার আগে অর্থমন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় বসে থাকে, তা হলে তো আইনি ক্ষমতা থাকলেও কোনো লাভ হবে না। এমন উদাহরণ দেওয়া যাবে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বসে থাকে। আবার সরকারের শীর্ষ মহলে বিষয়টি তুলে ধরার সক্ষমতা এবং তা বুঝিয়ে সরকারের কাছ থেকে আদায় করার মধ্যে কৌশলগত দিকও রয়েছে। নতুন ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কি এসব বিষয় বিবেচনা করে দেখবে?
মনজুর আহমেদ: সাংবাদিক।
No comments