রাজনীতি-গণতন্ত্র এবং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি by এম হাফিজউদ্দিন খান
রোববার জাতীয় সংসদের যে অধিবেশনটি শুরু হয়েছে, সেটি নানা কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই অধিবেশনে ২০১১-১২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ ও অনুমোদিত হবে। দ্বিতীয়ত, এ অধিবেশনে সংবিধান সংশোধনের বিল উত্থাপনের সম্ভাবনা আছে। এসব ক্ষেত্রে দেশবাসী আশা করে,
বিরোধী দল সক্রিয় ভূমিকা রাখবে এবং সরকারি দলও তাদের যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য আমলে নেবে। সরকার যদি জনগণের ওপর অযৌক্তিক করের বোঝা চাপায়, বিরোধী দল তার প্রতিবাদ করবে। বাজেটের প্রতিটি খাত সম্পর্কে তারা নিজেদের বক্তব্য সংসদের মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরবে। প্রয়োজনে তারা ছাঁটাই প্রস্তাব আনবে।
কিন্তু অধিবেশনে যোগদানের ব্যাপারে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যেসব শর্ত আরোপ করা হয়েছে, তা অযৌক্তিক ও অগণতান্ত্রিক। বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বললেন, বিরোধীদলীয় নেত্রীর নামে দায়ের করা চারটি মামলা প্রত্যাহার করলেই তাঁরা সংসদে যাবেন। আরেক নেতা বললেন, মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি মেনে নিলে তাঁরা সংসদে যাবেন।
সংসদে বিরোধী দলের যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব শর্ত হতে পারে না। সংসদে যাওয়া তাদের আইনি অধিকার ও নৈতিক দায়িত্ব। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের নির্বাচন করেছে সেখানে কথা বলার জন্য, সংসদ অধিবেশন মাসের পর মাস বর্জন করার জন্য নয়। সরকারের যেকোনো কাজের সমালোচনা তারা করতে পারে। বিকল্প কর্মসূচিও জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে। সেগুলোর উপযুক্ত স্থান জাতীয় সংসদ। বিরোধী দল মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে দলীয় অবস্থান ব্যাখ্যা করছে। সেসব বক্তব্যও বিরোধী দল সংসদে গিয়ে বলতে পারে।
শনিবার রাতে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে স্পিকার আবদুল হামিদের বক্তব্য শুনেছিলাম। তিনি প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলকে সহনশীল আচরণ করার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, বাড়াবাড়ি করলে আবারও এক-এগারোর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তাঁর এই আশঙ্কা অমূলক নয়। স্পিকার বলেছেন, এক-এগারোর ঘটনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোও কিছুটা দায়ী। আমরা বলব, তিনি রেখে-ঢেকে বলেছেন। প্রকৃত সত্য হলো, এক-এগারোর অঘটনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো পুরোপুরি দায়ী।
গণতন্ত্রের মূল কথা হলো সমঝোতা ও সহনশীলতা। গণতন্ত্রের স্বার্থে অনেক সময় আপসও করতে হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির সঙ্গে আপস করবে। বরং গণতান্ত্রিক আদর্শ সমুন্নত রাখতে সরকারি ও বিরোধী দল একযোগে কাজ করবে—সেটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারি ও বিরোধী দলের দৃষ্টিভঙ্গিটা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য হবে দেশ ও জনগণের উন্নয়ন। সে ক্ষেত্রে বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তার অনুপস্থিতি প্রকট। সরকারি দল যদি গায়ের জোরে সবকিছু করতে চায় এবং বিরোধী দল যদি সংসদেই না যায়, তাহলে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি কী করে হবে?
এ ক্ষেত্রে উভয়কে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। যেকোনো অজুহাতে বিরোধী দলের যেমন সংসদ বর্জন করা উচিত নয়, তেমনি সরকারি দলেরও একগুঁয়েমি মনোভাব দেখানো ঠিক নয়। বিরোধী দল যেকোনো কারণে সংসদের বাইরে থাকলে তাদের সংসদে আনতে সরকারি দলের উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়া হয়। কিন্তু তেমন উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। সংসদের চলতি অধিবেশনে শুধু বাজেট পাস হচ্ছে না, সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনার কথাও বলা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। না হলে সংকট আরও বাড়বে।
নির্বাচনে একদল জয়ী হয়ে সরকার চালাবে, আরেক দল বিরোধী দলের আসনে বসবে—এটাই গণতন্ত্রের রীতি। তবে সংসদ ও গণতন্ত্র পরিচালিত হতে হবে উভয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণে। বিরোধী দল সংসদে গরহাজির থাকলে সেটি কীভাবে হবে? দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের মাধ্যমে যেকোনো জাতীয় সমস্যার জুতসই সমাধান বেরিয়ে আসতে পারে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বাজেট উত্থাপন ও আলোচনার পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন আছে। আমাদের সংসদে বাজেট উত্থাপিত হয়ে থাকে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। অথচ ৩০ জুনের মধ্যে বাজেটটি পাস হতে হবে। এই দুই-আড়াই সপ্তাহে বাজেট নিয়ে অনুপুঙ্খ আলোচনা বা বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। সাংসদেরাও বাজেটের চেয়ে এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নয়ন বা দাবি-দাওয়া নিয়ে বেশি কথা বলেন। প্রকৃতপক্ষে বাজেটের প্রতিটি বিষয়ে পুঙ্খানুপঙ্খ আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। তাতে দেশের মানুষ জানতে পারবে, বাজেটে কী আছে কী নেই। বাজেটের কোথায় সবলতা ও দুর্বলতা আছে, তারও চুলচেরা বিশ্লেষণ হতে হবে। এগুলো করবেন বিরোধী দলের সাংসদেরা। কিন্তু তারা সংসদে না গেলে একতরফা আলোচনা হবে। সবাই অর্থমন্ত্রী উত্থাপিত বাজেটের প্রশংসা করবে।
আমাদের দেশে যেভাবে বাজেট আলোচনা ও পাস হয়, সেটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বলা যায় না। পশ্চিমা দেশগুলোতে বাজেট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বড় ধরনের কাটছাঁট করেই বাজেট পাস হয়।
দুর্ভাগ্যজনক যে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এক-এগারোর পরিস্থিতি থেকে কোনো শিক্ষা নেননি। আমাদের ধারণা, তাঁরা নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। একচুল সরে আসতে রাজি নন। সরকারি দল ও বিরোধী দল এ রকম মুখোমুখি অবস্থানে থাকলে সংঘাত অনিবার্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কি থাকবে না, থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন—এ নিয়ে ইতিমধ্যে বিতর্ক উঠেছে। সেই বিতর্কের নিষ্পত্তিও হতে হবে সংসদে।
বিএনপির আমলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন, তা নিয়ে বিতর্ক ছিল। শেষ পর্যন্ত সেই বিতর্কের শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়নি। দেশ ভয়াবহ সংঘাতের দিকে যাচ্ছিল, যা এক-এগারোর পরিবর্তনকে অনিবার্য করে তোলে। এবারেও যেসব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তা নৈরাশ্যজনক। সরকার ও বিরোধী দল বিপরীত অবস্থানে। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
ইতিমধ্যে সরকারের মেয়াদ দুই বছর পাঁচ মাস চলে গেছে। হিসাবনিকাশ করার সময় এসেছে—সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করেছে, কতটা পারেনি। সরকারের প্রতি জনগণের যে বিপুল প্রত্যাশা ছিল, তার কমই পূরণ হয়েছে। যদিও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু কিছু ইতিবাচক লক্ষণ আছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো, তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি-আয় বেড়েছে। এবার প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় না ঘটায় কৃষির ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ-গ্যাসের সমস্যা থাকায় জনজীবনে দুর্ভোগ বৃদ্ধির বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না। শিল্পক্ষেত্রেও কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি।
তবে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়া। এই অবস্থায় সুস্থ রাজনীতির চর্চা কী করে হবে?
একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টকে হারিয়ে ৩৪ বছর পর তৃণমূল-কংগ্রেস জোট ক্ষমতায় এসেছে। নতুন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে কেউ অভিযোগ করেননি। নতুন মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে বামফ্রন্টের প্রথম সারির নেতারাও ছিলেন। নতুন মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। বামফ্রন্টও সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। আমাদের দেশে কি এটা ভাবা যায়! এখানে নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে বিরোধী দলের যাওয়ার নজির নেই।
গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি।
এম হাফিজউদ্দিন খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
কিন্তু অধিবেশনে যোগদানের ব্যাপারে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে যেসব শর্ত আরোপ করা হয়েছে, তা অযৌক্তিক ও অগণতান্ত্রিক। বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বললেন, বিরোধীদলীয় নেত্রীর নামে দায়ের করা চারটি মামলা প্রত্যাহার করলেই তাঁরা সংসদে যাবেন। আরেক নেতা বললেন, মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি মেনে নিলে তাঁরা সংসদে যাবেন।
সংসদে বিরোধী দলের যাওয়ার ক্ষেত্রে এসব শর্ত হতে পারে না। সংসদে যাওয়া তাদের আইনি অধিকার ও নৈতিক দায়িত্ব। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের নির্বাচন করেছে সেখানে কথা বলার জন্য, সংসদ অধিবেশন মাসের পর মাস বর্জন করার জন্য নয়। সরকারের যেকোনো কাজের সমালোচনা তারা করতে পারে। বিকল্প কর্মসূচিও জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে। সেগুলোর উপযুক্ত স্থান জাতীয় সংসদ। বিরোধী দল মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে দলীয় অবস্থান ব্যাখ্যা করছে। সেসব বক্তব্যও বিরোধী দল সংসদে গিয়ে বলতে পারে।
শনিবার রাতে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে স্পিকার আবদুল হামিদের বক্তব্য শুনেছিলাম। তিনি প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলকে সহনশীল আচরণ করার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, বাড়াবাড়ি করলে আবারও এক-এগারোর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তাঁর এই আশঙ্কা অমূলক নয়। স্পিকার বলেছেন, এক-এগারোর ঘটনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোও কিছুটা দায়ী। আমরা বলব, তিনি রেখে-ঢেকে বলেছেন। প্রকৃত সত্য হলো, এক-এগারোর অঘটনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো পুরোপুরি দায়ী।
গণতন্ত্রের মূল কথা হলো সমঝোতা ও সহনশীলতা। গণতন্ত্রের স্বার্থে অনেক সময় আপসও করতে হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির সঙ্গে আপস করবে। বরং গণতান্ত্রিক আদর্শ সমুন্নত রাখতে সরকারি ও বিরোধী দল একযোগে কাজ করবে—সেটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারি ও বিরোধী দলের দৃষ্টিভঙ্গিটা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু তাদের লক্ষ্য হবে দেশ ও জনগণের উন্নয়ন। সে ক্ষেত্রে বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তার অনুপস্থিতি প্রকট। সরকারি দল যদি গায়ের জোরে সবকিছু করতে চায় এবং বিরোধী দল যদি সংসদেই না যায়, তাহলে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি কী করে হবে?
এ ক্ষেত্রে উভয়কে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। যেকোনো অজুহাতে বিরোধী দলের যেমন সংসদ বর্জন করা উচিত নয়, তেমনি সরকারি দলেরও একগুঁয়েমি মনোভাব দেখানো ঠিক নয়। বিরোধী দল যেকোনো কারণে সংসদের বাইরে থাকলে তাদের সংসদে আনতে সরকারি দলের উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়া হয়। কিন্তু তেমন উদ্যোগ লক্ষ করা যাচ্ছে না। সংসদের চলতি অধিবেশনে শুধু বাজেট পাস হচ্ছে না, সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনার কথাও বলা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় বিরোধী দলের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। না হলে সংকট আরও বাড়বে।
নির্বাচনে একদল জয়ী হয়ে সরকার চালাবে, আরেক দল বিরোধী দলের আসনে বসবে—এটাই গণতন্ত্রের রীতি। তবে সংসদ ও গণতন্ত্র পরিচালিত হতে হবে উভয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণে। বিরোধী দল সংসদে গরহাজির থাকলে সেটি কীভাবে হবে? দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের মাধ্যমে যেকোনো জাতীয় সমস্যার জুতসই সমাধান বেরিয়ে আসতে পারে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বাজেট উত্থাপন ও আলোচনার পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন আছে। আমাদের সংসদে বাজেট উত্থাপিত হয়ে থাকে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। অথচ ৩০ জুনের মধ্যে বাজেটটি পাস হতে হবে। এই দুই-আড়াই সপ্তাহে বাজেট নিয়ে অনুপুঙ্খ আলোচনা বা বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। সাংসদেরাও বাজেটের চেয়ে এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নয়ন বা দাবি-দাওয়া নিয়ে বেশি কথা বলেন। প্রকৃতপক্ষে বাজেটের প্রতিটি বিষয়ে পুঙ্খানুপঙ্খ আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। তাতে দেশের মানুষ জানতে পারবে, বাজেটে কী আছে কী নেই। বাজেটের কোথায় সবলতা ও দুর্বলতা আছে, তারও চুলচেরা বিশ্লেষণ হতে হবে। এগুলো করবেন বিরোধী দলের সাংসদেরা। কিন্তু তারা সংসদে না গেলে একতরফা আলোচনা হবে। সবাই অর্থমন্ত্রী উত্থাপিত বাজেটের প্রশংসা করবে।
আমাদের দেশে যেভাবে বাজেট আলোচনা ও পাস হয়, সেটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বলা যায় না। পশ্চিমা দেশগুলোতে বাজেট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বড় ধরনের কাটছাঁট করেই বাজেট পাস হয়।
দুর্ভাগ্যজনক যে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এক-এগারোর পরিস্থিতি থেকে কোনো শিক্ষা নেননি। আমাদের ধারণা, তাঁরা নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। একচুল সরে আসতে রাজি নন। সরকারি দল ও বিরোধী দল এ রকম মুখোমুখি অবস্থানে থাকলে সংঘাত অনিবার্য। তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কি থাকবে না, থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন—এ নিয়ে ইতিমধ্যে বিতর্ক উঠেছে। সেই বিতর্কের নিষ্পত্তিও হতে হবে সংসদে।
বিএনপির আমলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন, তা নিয়ে বিতর্ক ছিল। শেষ পর্যন্ত সেই বিতর্কের শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়নি। দেশ ভয়াবহ সংঘাতের দিকে যাচ্ছিল, যা এক-এগারোর পরিবর্তনকে অনিবার্য করে তোলে। এবারেও যেসব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তা নৈরাশ্যজনক। সরকার ও বিরোধী দল বিপরীত অবস্থানে। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
ইতিমধ্যে সরকারের মেয়াদ দুই বছর পাঁচ মাস চলে গেছে। হিসাবনিকাশ করার সময় এসেছে—সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করেছে, কতটা পারেনি। সরকারের প্রতি জনগণের যে বিপুল প্রত্যাশা ছিল, তার কমই পূরণ হয়েছে। যদিও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছু কিছু ইতিবাচক লক্ষণ আছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো, তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি-আয় বেড়েছে। এবার প্রাকৃতিক কোনো বিপর্যয় না ঘটায় কৃষির ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ-গ্যাসের সমস্যা থাকায় জনজীবনে দুর্ভোগ বৃদ্ধির বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না। শিল্পক্ষেত্রেও কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি।
তবে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়া। এই অবস্থায় সুস্থ রাজনীতির চর্চা কী করে হবে?
একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টকে হারিয়ে ৩৪ বছর পর তৃণমূল-কংগ্রেস জোট ক্ষমতায় এসেছে। নতুন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে কেউ অভিযোগ করেননি। নতুন মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে বামফ্রন্টের প্রথম সারির নেতারাও ছিলেন। নতুন মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। বামফ্রন্টও সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। আমাদের দেশে কি এটা ভাবা যায়! এখানে নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে বিরোধী দলের যাওয়ার নজির নেই।
গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি।
এম হাফিজউদ্দিন খান: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
No comments