বিশ্ব প্রাণবৈচিত্র্য দিবস-বন মহামূল্যবান ধন, একে রক্ষা করতে হবে by ফরিদা আখতার
আজ ২২ মে বিশ্ব প্রাণবৈচিত্র্য দিবস। দিনটি যেকোনো পরিবেশবাদীর জন্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এর সঙ্গে প্রাণবৈচিত্র্য সনদ (CBD) অনুমোদনের সম্পর্ক রয়েছে। আমি প্রথমেই একটু দুঃখ প্রকাশ করছি যে অন্য দিনগুলো যেভাবে পালিত হয়, এ দিনটি সরকারের কর্মসূচিতে এখনো গুরুত্ব পায়নি। আমাদের পরিবেশ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে বেশ উদাসীন।
দিনটির ব্যাপারে অনেক কিছুই বলার আছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (UNEP) এবং প্রাণবৈচিত্র্য সনদের সচিবালয় যৌথভাবে প্রতিবছর প্রতিপাদ্য ঠিক করে এবং যারা দিবসটি পালন করে তারা সেভাবেই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এবার বনের বৈচিত্র্যের কথা বলা হয়েছে। বলা যেতে পারে, প্রাকৃতিক বন, যেখানে যে পরিবেশে যে গাছপালা ও লতাগুল্ম হওয়ার কথা, এর সংমিশ্রণের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করার কাজ এখানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। আর গাছ লাগানোর অর্থ দাঁড়িয়েছে বিদেশি গাছ, কিংবা বাণিজ্যিক কারণে গাছ লাগানো। মানুষের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি, ওষুধের উৎস, ঘরবাড়ির সরঞ্জাম—সবই প্রাকৃতিক বন থেকে আসে, তা আমরা যেন ভুলে গেছি।
এবার জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি এবং প্রাণবৈচিত্র্য সনদের সচিবালয় বিশ্ব প্রাণবৈচিত্র্য দিবস উপলক্ষে যে পুস্তিকাটি বের করেছে, আমি সেখান থেকে কিছু তথ্য পাঠকের জন্য তুলে ধরছি। পুস্তিকাটির নাম Forest Diversity: Earth’s Living Treasure। এখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের খাদ্য, ওষুধ, বস্ত্র, ঘরবাড়ির সরঞ্জামের জোগান দেওয়া, মাটির ক্ষয় রোধ করা, জলবায়ু ও আবহাওয়ার ভারসাম্য ঠিক রাখা, পরিষ্কার পানি সরবরাহ করা, এমনকি আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করা—সবই এই বনের মধ্য থেকে আসে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, বন ধ্বংসের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে এবং ভয়াবহ পর্যায়ে এসে গেছে। বন ধ্বংসের সঙ্গে কার্বন নির্গমনের মাত্রা আরও বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে; সঙ্গে সব ধরনের প্রাণবৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের টনক কিছুটা মনে হয় নড়েছে। তাই তারা ২০১১ সালকে আন্তর্জাতিক বন বছর ঘোষণা দিয়েছে।
বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই পুস্তিকায় দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর ৩১ শতাংশ (৪ বিলিয়ন হেক্টর) ভূমি বনের অধীনে রয়েছে। মাত্র পাঁচটি দেশে, যেমন—চীন, রাশিয়া, কানাডা, আমেরিকা ও ব্রাজিলে বিশ্বের ৫৩ শতাংশ বন রয়েছে। প্রায় ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মানুষ (১৬০ কোটি) জীবন-জীবিকার জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল এবং ৩০ কোটি মানুষ বনেই থাকে। উন্নয়নশীল দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ বন থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে। বিশ্বের পরিষ্কার পানির প্রায় ৭৫ শতাংশ বনের পানির রক্ষণাগার থেকে আসে এবং উন্নয়নশীল দেশের বড় বড় শহরে খাওয়ার পানি শোধন করে দেয়।
বন বিভাগের ২০০১ সালের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ দেশের মোট ভূমির প্রায় ১৮ শতাংশ। বন বিভাগ দেশের ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ বা ১ দশমিক ৫২ মিলিয়ন হেক্টর ভূমি নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি বন, সমতল বন, সুন্দরবন, উপকূলে তৈরি করা বন এবং চা ও রাবার বাগানে সৃষ্ট বন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত বিদেশি সাহায্য নিয়ে যে বন সৃষ্টি করা হয়েছে, এর ফলে প্রাকৃতিক বনের অধিকাংশ বিলীন হয়ে গেছে। এর জায়গায় তৈরি করা হয়েছে ‘লাগানো বন’ আকাশিয়া, ইউক্যালিপটাস, পাইন, রাবার ইত্যাদি বিদেশি প্রজাতি দিয়ে (ফিলিপ গাইন: বন, বন বিনাশ ও বনবাসীর জীবনসংগ্রাম, ২০০৪)। এখানে বিদেশি প্রজাতি বলতে শুধু অন্য দেশ থেকে আনা গাছ বোঝানো হচ্ছে না, এখানে বোঝানো হয়েছে, এক পরিবেশের গাছ অন্য পরিবেশে বিজাতীয় অর্থে। আমরা যখন টাঙ্গাইল হয়ে যমুনা সেতু দিয়ে সিরাজগঞ্জ এবং উত্তরবঙ্গের দিকে যাই, তখন রাস্তার দুই পাশে যেসব আকাশিয়া, ইউক্যালিপটাস গাছ দেখা যায়। এসব গাছ সেই এলাকার পরিবেশের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। অথচ সরকার ও এনজিওগুলোর সহযোগিতায় এগুলো লাগানো হয়েছে। এসব গাছ পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানের সৌন্দর্যের ওপর কালিমা লেপে দিয়েছে।
কৃষির সম্প্রসারণকেও বন ধ্বংসের কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু এই কৃষি সাধারণ খাদ্য উৎপাদনের কৃষি নয়। আজকাল তামাক চাষকেও কৃষির ক্যাশ ক্রপ নাম দিয়ে কৃষি পরিসংখ্যানে দেখানো হয়। অথচ তামাক চাষ সরাসরি বন ধ্বংসের জন্য দায়ী। এ কথা পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা মন্ত্রণালয় থেকে স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে না এবং কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। উবিনীগের গবেষণা থেকে তামাক চাষের এলাকা বান্দরবানের লামা-আলীকদমে পাতা পোড়ানোর জন্য ব্যবহূত তন্দুর ও জ্বালানি কাঠের হিসাব দিচ্ছি। তামাকের সবুজ পাতা যখন পোড়ানোর জন্য তন্দুরে দেওয়া হয়, তখন এটাকে লোড বলে। প্রতি লোডে ছোট সাইজের তন্দুরে ৪৫০টি স্টিক দেওয়া হয়। স্টিক হচ্ছে, লম্বা কাঠির ওপর সবুজ তামাকপাতা সুতলি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া। বড় সাইজের তন্দুরে ৫০০ স্টিক দেওয়া হয়। প্রতি স্টিকে ৪০টি করে পাতা থাকে। একটি তন্দুরে প্রতি মৌসুমে দুই একর জমির পাতা পোড়ানো যায়। প্রতি লোডে তামাক পোড়াতে সময় লাগে ৬০ থেকে ৭২ ঘণ্টা। এ সময় তন্দুরের ভেতরে একটানা আগুন জ্বলতে থাকে এবং ক্রমাগতভাবে কাঠ দিতে হয়। প্রতি লোডে তামাক পোড়ানোর জন্য ৩০ থেকে ৩৫ মণ লাকড়ি লাগে। এক একর জমির পাতা চার লোডে পোড়াতে হয়। প্রতি মৌসুমে তন্দুরপ্রতি ২৪০ মণ লাকড়ি লাগে। এই লাকড়ি জোগাতে গিয়ে মাঝারি সাইজের ৯৬০টি গাছ কাটতে হয়। একটি এলাকায় যদি ৫০ থেকে ৮০টি তন্দুর থাকে, তাহলে হিসাব করে দেখলে মাথা ঘুরে যায়—প্রায় ১২ হাজার থেকে ১৯ হাজার ২০০ গাছ প্রতি মৌসুমে কাটা হচ্ছে!
পত্রপত্রিকায় বন ধ্বংসের কথা খুব বেশি লেখা না হলেও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, যা ভয়াবহ। যেমন, চলনবিলের ১৪টি উপজেলার ইটভাটায় বাঁশের মোথা পোড়ানো হচ্ছে দেদার (যুগান্তর, ২০ মার্চ ২০১১)। মধুপুরের বনের শাল কাঠ প্রতি রাতে ভ্যানগাড়িতে করে ইটের ভাটায় যাচ্ছে এবং ট্রাকে করে গজারি কাঠ যাচ্ছে শহরে (আমার দেশ, ৭ মার্চ ২০১০)। সীতাকুণ্ডে ২০০৯ সালে এক বছরে ৩০ হাজারের বেশি গাছ নিধন করে ১২টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড করা হয়েছে (ইত্তেফাক, ৪ ডিসেম্বর ২০০৯)। এই কয়েকটি প্রতিবেদন থেকে বোঝা যাচ্ছে, শুধু বাণিজ্যিক কারণেই নির্মমভাবে বৃক্ষ নিধন চলছে, অথচ আমাদের বন বিভাগ ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কোনো ভ্রুক্ষেপ করছে না।
এখনো সময় আছে। এই পুরো বছরটি বন রক্ষার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই সরকার যদি কাজ করতে চায়, অবশ্যই সুযোগ আছে। আশা করি, তামাক চাষ বন্ধ করা, ইটের ভাটায় কাঠের ব্যবহার বন্ধ করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে বন রক্ষা এবং একই সঙ্গে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার কাজ করা হবে। ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস, আর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের জন্য নেওয়া পদক্ষেপের সঙ্গে এই দিনগুলোর সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই এখন থেকেই আমাদের সক্রিয় হতে হবে।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
এবার জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি এবং প্রাণবৈচিত্র্য সনদের সচিবালয় বিশ্ব প্রাণবৈচিত্র্য দিবস উপলক্ষে যে পুস্তিকাটি বের করেছে, আমি সেখান থেকে কিছু তথ্য পাঠকের জন্য তুলে ধরছি। পুস্তিকাটির নাম Forest Diversity: Earth’s Living Treasure। এখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের খাদ্য, ওষুধ, বস্ত্র, ঘরবাড়ির সরঞ্জামের জোগান দেওয়া, মাটির ক্ষয় রোধ করা, জলবায়ু ও আবহাওয়ার ভারসাম্য ঠিক রাখা, পরিষ্কার পানি সরবরাহ করা, এমনকি আমাদের শিল্প-সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করা—সবই এই বনের মধ্য থেকে আসে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, বন ধ্বংসের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে এবং ভয়াবহ পর্যায়ে এসে গেছে। বন ধ্বংসের সঙ্গে কার্বন নির্গমনের মাত্রা আরও বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে; সঙ্গে সব ধরনের প্রাণবৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের টনক কিছুটা মনে হয় নড়েছে। তাই তারা ২০১১ সালকে আন্তর্জাতিক বন বছর ঘোষণা দিয়েছে।
বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই পুস্তিকায় দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর ৩১ শতাংশ (৪ বিলিয়ন হেক্টর) ভূমি বনের অধীনে রয়েছে। মাত্র পাঁচটি দেশে, যেমন—চীন, রাশিয়া, কানাডা, আমেরিকা ও ব্রাজিলে বিশ্বের ৫৩ শতাংশ বন রয়েছে। প্রায় ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মানুষ (১৬০ কোটি) জীবন-জীবিকার জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল এবং ৩০ কোটি মানুষ বনেই থাকে। উন্নয়নশীল দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ বন থেকে ওষুধ সংগ্রহ করে। বিশ্বের পরিষ্কার পানির প্রায় ৭৫ শতাংশ বনের পানির রক্ষণাগার থেকে আসে এবং উন্নয়নশীল দেশের বড় বড় শহরে খাওয়ার পানি শোধন করে দেয়।
বন বিভাগের ২০০১ সালের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ দেশের মোট ভূমির প্রায় ১৮ শতাংশ। বন বিভাগ দেশের ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ বা ১ দশমিক ৫২ মিলিয়ন হেক্টর ভূমি নিয়ন্ত্রণ করছে। এর মধ্যে রয়েছে পাহাড়ি বন, সমতল বন, সুন্দরবন, উপকূলে তৈরি করা বন এবং চা ও রাবার বাগানে সৃষ্ট বন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত বিদেশি সাহায্য নিয়ে যে বন সৃষ্টি করা হয়েছে, এর ফলে প্রাকৃতিক বনের অধিকাংশ বিলীন হয়ে গেছে। এর জায়গায় তৈরি করা হয়েছে ‘লাগানো বন’ আকাশিয়া, ইউক্যালিপটাস, পাইন, রাবার ইত্যাদি বিদেশি প্রজাতি দিয়ে (ফিলিপ গাইন: বন, বন বিনাশ ও বনবাসীর জীবনসংগ্রাম, ২০০৪)। এখানে বিদেশি প্রজাতি বলতে শুধু অন্য দেশ থেকে আনা গাছ বোঝানো হচ্ছে না, এখানে বোঝানো হয়েছে, এক পরিবেশের গাছ অন্য পরিবেশে বিজাতীয় অর্থে। আমরা যখন টাঙ্গাইল হয়ে যমুনা সেতু দিয়ে সিরাজগঞ্জ এবং উত্তরবঙ্গের দিকে যাই, তখন রাস্তার দুই পাশে যেসব আকাশিয়া, ইউক্যালিপটাস গাছ দেখা যায়। এসব গাছ সেই এলাকার পরিবেশের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। অথচ সরকার ও এনজিওগুলোর সহযোগিতায় এগুলো লাগানো হয়েছে। এসব গাছ পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানের সৌন্দর্যের ওপর কালিমা লেপে দিয়েছে।
কৃষির সম্প্রসারণকেও বন ধ্বংসের কারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। কিন্তু এই কৃষি সাধারণ খাদ্য উৎপাদনের কৃষি নয়। আজকাল তামাক চাষকেও কৃষির ক্যাশ ক্রপ নাম দিয়ে কৃষি পরিসংখ্যানে দেখানো হয়। অথচ তামাক চাষ সরাসরি বন ধ্বংসের জন্য দায়ী। এ কথা পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা মন্ত্রণালয় থেকে স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে না এবং কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। উবিনীগের গবেষণা থেকে তামাক চাষের এলাকা বান্দরবানের লামা-আলীকদমে পাতা পোড়ানোর জন্য ব্যবহূত তন্দুর ও জ্বালানি কাঠের হিসাব দিচ্ছি। তামাকের সবুজ পাতা যখন পোড়ানোর জন্য তন্দুরে দেওয়া হয়, তখন এটাকে লোড বলে। প্রতি লোডে ছোট সাইজের তন্দুরে ৪৫০টি স্টিক দেওয়া হয়। স্টিক হচ্ছে, লম্বা কাঠির ওপর সবুজ তামাকপাতা সুতলি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া। বড় সাইজের তন্দুরে ৫০০ স্টিক দেওয়া হয়। প্রতি স্টিকে ৪০টি করে পাতা থাকে। একটি তন্দুরে প্রতি মৌসুমে দুই একর জমির পাতা পোড়ানো যায়। প্রতি লোডে তামাক পোড়াতে সময় লাগে ৬০ থেকে ৭২ ঘণ্টা। এ সময় তন্দুরের ভেতরে একটানা আগুন জ্বলতে থাকে এবং ক্রমাগতভাবে কাঠ দিতে হয়। প্রতি লোডে তামাক পোড়ানোর জন্য ৩০ থেকে ৩৫ মণ লাকড়ি লাগে। এক একর জমির পাতা চার লোডে পোড়াতে হয়। প্রতি মৌসুমে তন্দুরপ্রতি ২৪০ মণ লাকড়ি লাগে। এই লাকড়ি জোগাতে গিয়ে মাঝারি সাইজের ৯৬০টি গাছ কাটতে হয়। একটি এলাকায় যদি ৫০ থেকে ৮০টি তন্দুর থাকে, তাহলে হিসাব করে দেখলে মাথা ঘুরে যায়—প্রায় ১২ হাজার থেকে ১৯ হাজার ২০০ গাছ প্রতি মৌসুমে কাটা হচ্ছে!
পত্রপত্রিকায় বন ধ্বংসের কথা খুব বেশি লেখা না হলেও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে, যা ভয়াবহ। যেমন, চলনবিলের ১৪টি উপজেলার ইটভাটায় বাঁশের মোথা পোড়ানো হচ্ছে দেদার (যুগান্তর, ২০ মার্চ ২০১১)। মধুপুরের বনের শাল কাঠ প্রতি রাতে ভ্যানগাড়িতে করে ইটের ভাটায় যাচ্ছে এবং ট্রাকে করে গজারি কাঠ যাচ্ছে শহরে (আমার দেশ, ৭ মার্চ ২০১০)। সীতাকুণ্ডে ২০০৯ সালে এক বছরে ৩০ হাজারের বেশি গাছ নিধন করে ১২টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড করা হয়েছে (ইত্তেফাক, ৪ ডিসেম্বর ২০০৯)। এই কয়েকটি প্রতিবেদন থেকে বোঝা যাচ্ছে, শুধু বাণিজ্যিক কারণেই নির্মমভাবে বৃক্ষ নিধন চলছে, অথচ আমাদের বন বিভাগ ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কোনো ভ্রুক্ষেপ করছে না।
এখনো সময় আছে। এই পুরো বছরটি বন রক্ষার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই সরকার যদি কাজ করতে চায়, অবশ্যই সুযোগ আছে। আশা করি, তামাক চাষ বন্ধ করা, ইটের ভাটায় কাঠের ব্যবহার বন্ধ করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে বন রক্ষা এবং একই সঙ্গে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার কাজ করা হবে। ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস, আর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের জন্য নেওয়া পদক্ষেপের সঙ্গে এই দিনগুলোর সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই এখন থেকেই আমাদের সক্রিয় হতে হবে।
ফরিদা আখতার: নারীনেত্রী, উন্নয়নকর্মী।
No comments