সরল গরল-অগ্নিকন্যা মমতার অগ্নিপরীক্ষা by মিজানুর রহমান খান
‘বিরোধী দল’ শব্দযুগলটি বামদের অভিধান থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। বিরোধী দলকে পদ্ধতিগতভাবে ব্যর্থ করা হলে সরকারি দলও ব্যর্থ হতে বাধ্য। সেই ব্যর্থতা সব সময় ভোটের অঙ্কে পরিমাপযোগ্য হয় না। বাংলাদেশ তার দুর্ভাগ্যজনক দৃষ্টান্ত। রাজনৈতিক ও সামাজিক অশান্তির সবচেয়ে বড় কারণ বিরোধী দলকে শাসন-প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা।
বাম-শাসনে বিরোধী দলের কোনো জায়গা ছিল না।
দিল্লিতে ২২ মে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমূল্য গাঙ্গুলির সঙ্গে কথা হলো। তিনি কার্যত বিরোধীদের সম্পর্কে বামদের নাক-উঁচু স্বভাবের কথাই আগে বললেন।
বিশ্বব্যাপী এখন প্লুরালিজমের যুগ। যুগটা কোয়ালিশনের। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে দুই-তৃতীয়াংশ যুগের পুনরুত্থান নিয়ে এখন কথা বলাও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। কেরালার বুদ্ধিদীপ্ত ভোটাররা সম্ভবত ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁরা পর পর কোনো দলকে সরকারে রাখে না। পশ্চিমবঙ্গও যদি স্থায়ীভাবে কেরালা ও কার্যকর কোয়ালিশনের যুগে প্রবেশ করে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আরও একটি দেখার বিষয়, পশ্চিমবঙ্গে ’৭৭-এ ক্ষমতাহারা হয়ে কংগ্রেস আর ফেরেনি; ফিরেছে তৃণমূল কংগ্রেসের রূপে। বামফ্রন্টে নেতৃত্ব অপরিবর্তিত। তারাই ফিরবে, নাকি তৃণমূল-বামফ্রন্ট কিংবা তৃণমূল-সিপিএম ফিরবে, সেটাও দেখার বিষয়।
আগামী সাধারণ নির্বাচন হবে ২০১৪ সালে। বিধানসভা হবে ২০১৬ সালে। মধ্যবর্তী সময়ে অনেক ঘটনা ঘটবে। বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে এখন থেকে তৃণমূল এককভাবে লড়ার প্রবণতা দেখাবে। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে তার জোট কৌশলগত; মতাদর্শগত নয়। তৃণমূলের প্রার্থীরা কেন্দ্রীয় সরকারকে তুলাধোনা করেছে আসামে। সুতরাং মমতার জন্য বড় বাহাদুরি কংগ্রেসকে তোয়াজ করে চলায় নয়। একটা রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা দেখানোর সময় ও সুযোগ এসেছে তাঁর সামনে। সেটাই তাঁর জন্য অগ্নিপরীক্ষা। এই উপমহাদেশে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়ার গড় অভিজ্ঞতা কিন্তু সুখপ্রদ নয়—জোয়ারে এসেছে, ভাটায় নেমে গেছে।
মমতার পরামর্শকেরা সব তাস খেলেছেন। অনেক কৌশলগত মোক্ষম চাল তিনি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর থলেতে সম্ভবত ঘাটতি বিরোধী দল নিয়ে। তাঁর সামনে দুটো পথ। চিরাচরিত পন্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে চলা। ধরে নেওয়া, পশ্চিমবঙ্গে শুধু নয়, বামরা আর কোথাও ফণা তুলতে পারবে না। ত্রিপুরার কথাও মনে রাখতে হবে। বামরা সেখানে সাফল্যের সঙ্গে টিকে আছে। ত্রিপুরাই এ মুহূর্তে ভারতের শেষ লাল দুর্গ।
মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এখন পর্যন্ত বিরোধী দলের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা নিয়ে কোনো বক্তব্য শুনিনি। অথচ আমি সেটাই শোনার জন্য উদ্গ্রীব ছিলাম। কারণ, পরিবর্তনের লিটমাস টেস্ট হচ্ছে এটাই। সেই পরীক্ষায় নতুন সরকার এখনো উতরায়নি। তবে আশার কারণ আছে।
সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকদের কাছে ২০০ একর জমি ফেরত দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত ঠিক ‘পরিবর্তন’বহ নয়, বরং নিজেদের নেতা-কর্মীদের নামে তথাকথিত হয়রানিমূলক মামলা তুলে নিতে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের ঘোষণা চিন্তার বিষয়। এতে অনেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মার্কা মডেলের কমিটির কথা স্মরণ করতে পারেন। পরিবর্তন চাইলে রাজবন্দী মুক্তির প্রশ্নে নির্মোহ হতে হবে। কমিটি মানে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা। বিচার বিভাগের সামনে মামলাগুলো আনুন। তাঁদেরই ফয়সালা দিতে দিন। অহেতুক যারা হয়রানির শিকার, তাদের প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ দিন। ক্ষতিপূরণ দিতে পারেন আদালতই; কোনো বিশেষজ্ঞ কমিটি পারে না। শহীদবেদি নিয়ে তৃণমূলের এত বেশি আগ্রহ দেখেছি, ভেবেছিলাম, ‘রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের’ বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মতো ঘোষণা থাকবে। তবে মামলা প্রসঙ্গ এল, খুন এল না। পশ্চিমবঙ্গে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মতো সরকারি এলিট বাহিনী নেই, কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু ঘটনা আছে। অথচ মানবাধিকার কমিশনকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে।
বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি এ পর্যন্ত আলোকপাত করেছেন তৃণমূলের উপনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়। আর তাতেই স্পষ্ট যে তৃণমূলের পরিকল্পনায় বিরোধী দল গঠন বা পুনর্গঠনের জায়গা এখনো সংকীর্ণ। পার্থ বলেন, ‘বিরোধী দলের নেতাকে আমরা বলেছি, তিনি বিরোধী দলের নেতা হিসেবে সব সময় সরকারকে গঠনমূলক পরামর্শ দিতে পারেন। আমরা তা মুখ্যমন্ত্রীকে অবহিত করব। আমরা বিরোধী দলকে যথাযথ শ্রদ্ধা দেখাব।’ উল্লেখ্য, বিরোধী দলের নেতাই শুধু মন্ত্রীর পদমর্যাদা পান। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো আলোচনার দরকার মনে করেনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। অথচ পশ্চিমবঙ্গে ২৯ বছর পর প্রথম স্পিকার বদল হচ্ছে।
মমতা এসব জায়গায় পরিবর্তন আনতে পারেন। তাঁর সেই আগ্রহটা চোখে পড়ে। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের জাদু ছিল বাম নেতাদের প্রতি মমতার নমস্কার। বিমান বসু প্রতিনমস্কার করেন। একই সোফায় প্রণব মুখার্জিকে বাঁয়ে রেখে বসে ছিলেন বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। কিন্তু তাঁদের বাক্যবিনিময় হয়নি। অনুষ্ঠান শেষ হতেই যথেষ্ট গাম্ভীর্যের সঙ্গে তাঁরা হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। বুদ্ধদেব স্বয়ং নাকি ‘আমরা’ ও ‘ওরা’ কথাটির প্রচলন করেছিলেন। সেখানে তেমন কোনো রক্তপাত কিংবা আদর্শগত ভিন্নতা না থাকলেও গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর ‘আমরা’ ও ‘ওরা’ তৈরি হতে সমস্যা হয়নি। রেলমন্ত্রী মমতার অনুষ্ঠানে বাম নেতারা আমন্ত্রিত হতেন না। রাজ্য সরকারের সর্বদলীয় বৈঠকে বিরোধী দল থেকেছে গরহাজির।
বামফ্রন্ট থেকে অপসারিত সাবেক স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় হঠাৎ অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি দেন মমতাকে। এর পরই দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যায়। সোমনাথের বাড়ি যান মমতা। বুদ্ধদেবের বাড়ি যান পার্থ। অন্যদের বাড়িতে পাঠানো হয় বিশেষ দূত। কলকাতার গণমাধ্যমের বয়ান হচ্ছে, মমতার এটা ‘মাস্টার স্ট্রোক’। এতেই বধ হয় বামরা। বামদের মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যও ‘নীরব দর্শক’ ছিলেন শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে।
কংগ্রেসের নেতা আবু নাসের খান চৌধুরী বললেন, ‘বিরোধী দল কী, তা এবারই প্রথম দেখবে রাজ্য। আমাদের ১৯টা আসন ছিল। বামদের ২০০-এর বেশি। সুতরাং আমরা ওয়াকআউট করতাম, কিন্তু তার কোনো মানে থাকত না।’
সুধাংশু জীবন গাঙ্গুলির বয়স ৯৭। তিনি রাজ্য সরকারের মুক্তিযোদ্ধাদের (ব্রিটিশবিরোধী) পেনশনবিষয়ক একটি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান। মাথায় গুলির দাগ দেখালেন। বিক্রমপুরের পাইকপাড়ায় তাঁর গ্রাম ছিল। তাঁর কথায়, দুই তরফেই ‘ইগো’ আছে। আরও কয়েকজনের কাছে বিরোধী দলের জন্য কোনো ‘পরিবর্তনের প্যাকেজ’ আছে কি না বোঝার চেষ্টা করি। সামাজিক চাহিদা অবশ্য প্রবল নয়। এদিকে নজর না দিলে মমতাকে কেউ দুষবে না।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পূর্ণদাস বাউল একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে লন্ডনের হাইড পার্কে গান গেয়েছিলেন। বললেন, মমতা বিরোধীদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাবেন না। কিন্তু তাঁকে পথ করে নিতে হবে এবং সেটাই তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জ। বাংলা চলচ্চিত্রের স্বনামধন্য নায়িকা সন্ধ্যা রায়ের কাছে মমতা নতুন সূর্য, নতুন সকাল। কালীঘাটে মমতার অনুরোধে জনতার উদ্দেশে দেওয়া সন্ধ্যার বক্তব্য শুনেছিলাম। কিন্তু বিরোধী দলের বিষয়ে তাঁর কথা, ওদেরই শান্তি বজায় রাখা উচিত।
মন্ত্রীদের মনোভঙ্গি আঁচ করতে চাই। মনে হলো না, বিরোধী দল নিয়ে তাঁদের তেমন কোনো বিশেষ প্রস্তুতি আছে। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী। তাঁর কথা, মানুষ উন্নয়ন চায়। মানুষের চাপে বিরোধী দল গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে বলেই তাঁর বিশ্বাস। বিরোধী দল যে সংখ্যালঘু, সেটা তাঁর দ্রুত মনে পড়ে। সংখ্যালঘুর উপযোগী ভূমিকাই তাঁর প্রত্যাশা। দমদমের দুঁদে বাম নেতা গৌতম দেবকে হারিয়েছেন উচ্চশিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তাঁকে বলি, দেব বলেছেন, ৩৪ দিন পর তাঁরা বিরোধী দলের ভূমিকা দেখাবে। এর মানে কী? বোধগম্য কারণেই তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। শ্রমমন্ত্রী পূর্ণান্দু বসুর কাছেও বিরোধী দল সম্পর্কে জানতে চেয়ে নতুন কিছু জানা গেল না।
বিরোধী দলকে কার্যকর অর্থে ধারণ করাই সংসদীয় গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। এ ক্ষেত্রে দুটি পথ—বিরোধী দলকে দায়িত্বহীন ও বেপরোয়াভাবে চলতে দেওয়া; অন্যটি বিরোধী দলকে ধারণ করা। লোকসভার সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতীয় সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. সুভাষ কাশ্যপের সঙ্গে আলোচনা করে মনে হলো, পরিষদীয় নেত্রী মমতা বিরোধী দলের জন্য এমন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন, যা ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য বিরাট দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে। কারণ, বিধানসভার কার্যপ্রণালি বিধি পরিবর্তনে কেন্দ্রীয় সংসদ বা সরকারের কোনো হাত নেই।
লোকসভায় ১৯৬৭ সাল থেকে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান মনোনয়ন দিয়ে আসছেন বিরোধী দলের নেতা। অথচ এটা কোনো আইন বা বিধি দ্বারা সমর্থিত নয়। ড. কাশ্যপ বলেছেন, অনেক রাজ্য এই মডেল অনুসরণ করছে। পশ্চিমবঙ্গেও এটা হচ্ছে, কিন্তু যথেষ্ট কার্যকর অর্থে নয়। দুই লাখ কোটি টাকার ঋণরাজ্যের অর্থনীতি চাঙা করতে বামদের সঙ্গে রাখার চেষ্টাই সংগত।
মমতা বিধানসভার কমিটিগুলোতে বামদের রাখতে আসনসংখ্যার প্রথাগত ঘেরাটোপ ভাঙতে পারেন।
বিরোধী দলে বাম কেমন হতে পারে, তা পশ্চিমবঙ্গের নতুন প্রজন্ম দেখেনি। হিন্দুস্তান টাইমস-এর সাবেক সহযোগী সম্পাদক অমূল্য গাঙ্গুলি অবাক করা তথ্য দিলেন। তিনি বললেন, বামরা বিরোধী দলে যখন ছিল, গোটা পাঁচ বছরই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা বয়কট করেছিল। ভারতের ইতিহাসে এটা সম্ভবত নজিরবিহীন। গাঙ্গুলি অবশ্য মনে করেন, বিরোধী বাম হয়তো মমতার জন্য অতটা হুমকি হবে না। বিরোধী দলের প্রতি বাড়াবাড়ি বা উপেক্ষা কোনোটিই তিনি করবেন না। তবে আমি বলি কি, বিরোধী দলের এই দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার লোভ সংবরণই কঠিন কাজ। ৩৪ বছরে কিচ্ছু হয়নি, সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে, শূন্য থেকে শুরু করতে হবে—এ ধরনের উক্তি করার লোভ সংবরণও কম কঠিন নয়। বাম নেতারা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে গিয়ে নিশ্চয় ঔদার্যের পরিচয় দেন। এখন বিধানসভার কমিটি-ব্যবস্থাকে যথাসাধ্য বামবান্ধব করার উদ্যোগ মমতাই নিতে পারেন। এতে সফল হলে জিত তাঁরই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
দিল্লিতে ২২ মে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমূল্য গাঙ্গুলির সঙ্গে কথা হলো। তিনি কার্যত বিরোধীদের সম্পর্কে বামদের নাক-উঁচু স্বভাবের কথাই আগে বললেন।
বিশ্বব্যাপী এখন প্লুরালিজমের যুগ। যুগটা কোয়ালিশনের। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে দুই-তৃতীয়াংশ যুগের পুনরুত্থান নিয়ে এখন কথা বলাও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। কেরালার বুদ্ধিদীপ্ত ভোটাররা সম্ভবত ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁরা পর পর কোনো দলকে সরকারে রাখে না। পশ্চিমবঙ্গও যদি স্থায়ীভাবে কেরালা ও কার্যকর কোয়ালিশনের যুগে প্রবেশ করে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আরও একটি দেখার বিষয়, পশ্চিমবঙ্গে ’৭৭-এ ক্ষমতাহারা হয়ে কংগ্রেস আর ফেরেনি; ফিরেছে তৃণমূল কংগ্রেসের রূপে। বামফ্রন্টে নেতৃত্ব অপরিবর্তিত। তারাই ফিরবে, নাকি তৃণমূল-বামফ্রন্ট কিংবা তৃণমূল-সিপিএম ফিরবে, সেটাও দেখার বিষয়।
আগামী সাধারণ নির্বাচন হবে ২০১৪ সালে। বিধানসভা হবে ২০১৬ সালে। মধ্যবর্তী সময়ে অনেক ঘটনা ঘটবে। বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে এখন থেকে তৃণমূল এককভাবে লড়ার প্রবণতা দেখাবে। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে তার জোট কৌশলগত; মতাদর্শগত নয়। তৃণমূলের প্রার্থীরা কেন্দ্রীয় সরকারকে তুলাধোনা করেছে আসামে। সুতরাং মমতার জন্য বড় বাহাদুরি কংগ্রেসকে তোয়াজ করে চলায় নয়। একটা রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা দেখানোর সময় ও সুযোগ এসেছে তাঁর সামনে। সেটাই তাঁর জন্য অগ্নিপরীক্ষা। এই উপমহাদেশে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাওয়ার গড় অভিজ্ঞতা কিন্তু সুখপ্রদ নয়—জোয়ারে এসেছে, ভাটায় নেমে গেছে।
মমতার পরামর্শকেরা সব তাস খেলেছেন। অনেক কৌশলগত মোক্ষম চাল তিনি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর থলেতে সম্ভবত ঘাটতি বিরোধী দল নিয়ে। তাঁর সামনে দুটো পথ। চিরাচরিত পন্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে চলা। ধরে নেওয়া, পশ্চিমবঙ্গে শুধু নয়, বামরা আর কোথাও ফণা তুলতে পারবে না। ত্রিপুরার কথাও মনে রাখতে হবে। বামরা সেখানে সাফল্যের সঙ্গে টিকে আছে। ত্রিপুরাই এ মুহূর্তে ভারতের শেষ লাল দুর্গ।
মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এখন পর্যন্ত বিরোধী দলের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা নিয়ে কোনো বক্তব্য শুনিনি। অথচ আমি সেটাই শোনার জন্য উদ্গ্রীব ছিলাম। কারণ, পরিবর্তনের লিটমাস টেস্ট হচ্ছে এটাই। সেই পরীক্ষায় নতুন সরকার এখনো উতরায়নি। তবে আশার কারণ আছে।
সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকদের কাছে ২০০ একর জমি ফেরত দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত ঠিক ‘পরিবর্তন’বহ নয়, বরং নিজেদের নেতা-কর্মীদের নামে তথাকথিত হয়রানিমূলক মামলা তুলে নিতে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের ঘোষণা চিন্তার বিষয়। এতে অনেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মার্কা মডেলের কমিটির কথা স্মরণ করতে পারেন। পরিবর্তন চাইলে রাজবন্দী মুক্তির প্রশ্নে নির্মোহ হতে হবে। কমিটি মানে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা। বিচার বিভাগের সামনে মামলাগুলো আনুন। তাঁদেরই ফয়সালা দিতে দিন। অহেতুক যারা হয়রানির শিকার, তাদের প্রয়োজনে ক্ষতিপূরণ দিন। ক্ষতিপূরণ দিতে পারেন আদালতই; কোনো বিশেষজ্ঞ কমিটি পারে না। শহীদবেদি নিয়ে তৃণমূলের এত বেশি আগ্রহ দেখেছি, ভেবেছিলাম, ‘রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের’ বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মতো ঘোষণা থাকবে। তবে মামলা প্রসঙ্গ এল, খুন এল না। পশ্চিমবঙ্গে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটানোর মতো সরকারি এলিট বাহিনী নেই, কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড আছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু ঘটনা আছে। অথচ মানবাধিকার কমিশনকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে।
বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি এ পর্যন্ত আলোকপাত করেছেন তৃণমূলের উপনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়। আর তাতেই স্পষ্ট যে তৃণমূলের পরিকল্পনায় বিরোধী দল গঠন বা পুনর্গঠনের জায়গা এখনো সংকীর্ণ। পার্থ বলেন, ‘বিরোধী দলের নেতাকে আমরা বলেছি, তিনি বিরোধী দলের নেতা হিসেবে সব সময় সরকারকে গঠনমূলক পরামর্শ দিতে পারেন। আমরা তা মুখ্যমন্ত্রীকে অবহিত করব। আমরা বিরোধী দলকে যথাযথ শ্রদ্ধা দেখাব।’ উল্লেখ্য, বিরোধী দলের নেতাই শুধু মন্ত্রীর পদমর্যাদা পান। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো আলোচনার দরকার মনে করেনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। অথচ পশ্চিমবঙ্গে ২৯ বছর পর প্রথম স্পিকার বদল হচ্ছে।
মমতা এসব জায়গায় পরিবর্তন আনতে পারেন। তাঁর সেই আগ্রহটা চোখে পড়ে। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের জাদু ছিল বাম নেতাদের প্রতি মমতার নমস্কার। বিমান বসু প্রতিনমস্কার করেন। একই সোফায় প্রণব মুখার্জিকে বাঁয়ে রেখে বসে ছিলেন বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। কিন্তু তাঁদের বাক্যবিনিময় হয়নি। অনুষ্ঠান শেষ হতেই যথেষ্ট গাম্ভীর্যের সঙ্গে তাঁরা হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। বুদ্ধদেব স্বয়ং নাকি ‘আমরা’ ও ‘ওরা’ কথাটির প্রচলন করেছিলেন। সেখানে তেমন কোনো রক্তপাত কিংবা আদর্শগত ভিন্নতা না থাকলেও গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর ‘আমরা’ ও ‘ওরা’ তৈরি হতে সমস্যা হয়নি। রেলমন্ত্রী মমতার অনুষ্ঠানে বাম নেতারা আমন্ত্রিত হতেন না। রাজ্য সরকারের সর্বদলীয় বৈঠকে বিরোধী দল থেকেছে গরহাজির।
বামফ্রন্ট থেকে অপসারিত সাবেক স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় হঠাৎ অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি দেন মমতাকে। এর পরই দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যায়। সোমনাথের বাড়ি যান মমতা। বুদ্ধদেবের বাড়ি যান পার্থ। অন্যদের বাড়িতে পাঠানো হয় বিশেষ দূত। কলকাতার গণমাধ্যমের বয়ান হচ্ছে, মমতার এটা ‘মাস্টার স্ট্রোক’। এতেই বধ হয় বামরা। বামদের মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যও ‘নীরব দর্শক’ ছিলেন শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে।
কংগ্রেসের নেতা আবু নাসের খান চৌধুরী বললেন, ‘বিরোধী দল কী, তা এবারই প্রথম দেখবে রাজ্য। আমাদের ১৯টা আসন ছিল। বামদের ২০০-এর বেশি। সুতরাং আমরা ওয়াকআউট করতাম, কিন্তু তার কোনো মানে থাকত না।’
সুধাংশু জীবন গাঙ্গুলির বয়স ৯৭। তিনি রাজ্য সরকারের মুক্তিযোদ্ধাদের (ব্রিটিশবিরোধী) পেনশনবিষয়ক একটি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান। মাথায় গুলির দাগ দেখালেন। বিক্রমপুরের পাইকপাড়ায় তাঁর গ্রাম ছিল। তাঁর কথায়, দুই তরফেই ‘ইগো’ আছে। আরও কয়েকজনের কাছে বিরোধী দলের জন্য কোনো ‘পরিবর্তনের প্যাকেজ’ আছে কি না বোঝার চেষ্টা করি। সামাজিক চাহিদা অবশ্য প্রবল নয়। এদিকে নজর না দিলে মমতাকে কেউ দুষবে না।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পূর্ণদাস বাউল একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে লন্ডনের হাইড পার্কে গান গেয়েছিলেন। বললেন, মমতা বিরোধীদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাবেন না। কিন্তু তাঁকে পথ করে নিতে হবে এবং সেটাই তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জ। বাংলা চলচ্চিত্রের স্বনামধন্য নায়িকা সন্ধ্যা রায়ের কাছে মমতা নতুন সূর্য, নতুন সকাল। কালীঘাটে মমতার অনুরোধে জনতার উদ্দেশে দেওয়া সন্ধ্যার বক্তব্য শুনেছিলাম। কিন্তু বিরোধী দলের বিষয়ে তাঁর কথা, ওদেরই শান্তি বজায় রাখা উচিত।
মন্ত্রীদের মনোভঙ্গি আঁচ করতে চাই। মনে হলো না, বিরোধী দল নিয়ে তাঁদের তেমন কোনো বিশেষ প্রস্তুতি আছে। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী। তাঁর কথা, মানুষ উন্নয়ন চায়। মানুষের চাপে বিরোধী দল গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে বলেই তাঁর বিশ্বাস। বিরোধী দল যে সংখ্যালঘু, সেটা তাঁর দ্রুত মনে পড়ে। সংখ্যালঘুর উপযোগী ভূমিকাই তাঁর প্রত্যাশা। দমদমের দুঁদে বাম নেতা গৌতম দেবকে হারিয়েছেন উচ্চশিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। তাঁকে বলি, দেব বলেছেন, ৩৪ দিন পর তাঁরা বিরোধী দলের ভূমিকা দেখাবে। এর মানে কী? বোধগম্য কারণেই তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। শ্রমমন্ত্রী পূর্ণান্দু বসুর কাছেও বিরোধী দল সম্পর্কে জানতে চেয়ে নতুন কিছু জানা গেল না।
বিরোধী দলকে কার্যকর অর্থে ধারণ করাই সংসদীয় গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র। এ ক্ষেত্রে দুটি পথ—বিরোধী দলকে দায়িত্বহীন ও বেপরোয়াভাবে চলতে দেওয়া; অন্যটি বিরোধী দলকে ধারণ করা। লোকসভার সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ও ভারতীয় সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. সুভাষ কাশ্যপের সঙ্গে আলোচনা করে মনে হলো, পরিষদীয় নেত্রী মমতা বিরোধী দলের জন্য এমন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেন, যা ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য বিরাট দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে। কারণ, বিধানসভার কার্যপ্রণালি বিধি পরিবর্তনে কেন্দ্রীয় সংসদ বা সরকারের কোনো হাত নেই।
লোকসভায় ১৯৬৭ সাল থেকে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান মনোনয়ন দিয়ে আসছেন বিরোধী দলের নেতা। অথচ এটা কোনো আইন বা বিধি দ্বারা সমর্থিত নয়। ড. কাশ্যপ বলেছেন, অনেক রাজ্য এই মডেল অনুসরণ করছে। পশ্চিমবঙ্গেও এটা হচ্ছে, কিন্তু যথেষ্ট কার্যকর অর্থে নয়। দুই লাখ কোটি টাকার ঋণরাজ্যের অর্থনীতি চাঙা করতে বামদের সঙ্গে রাখার চেষ্টাই সংগত।
মমতা বিধানসভার কমিটিগুলোতে বামদের রাখতে আসনসংখ্যার প্রথাগত ঘেরাটোপ ভাঙতে পারেন।
বিরোধী দলে বাম কেমন হতে পারে, তা পশ্চিমবঙ্গের নতুন প্রজন্ম দেখেনি। হিন্দুস্তান টাইমস-এর সাবেক সহযোগী সম্পাদক অমূল্য গাঙ্গুলি অবাক করা তথ্য দিলেন। তিনি বললেন, বামরা বিরোধী দলে যখন ছিল, গোটা পাঁচ বছরই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা বয়কট করেছিল। ভারতের ইতিহাসে এটা সম্ভবত নজিরবিহীন। গাঙ্গুলি অবশ্য মনে করেন, বিরোধী বাম হয়তো মমতার জন্য অতটা হুমকি হবে না। বিরোধী দলের প্রতি বাড়াবাড়ি বা উপেক্ষা কোনোটিই তিনি করবেন না। তবে আমি বলি কি, বিরোধী দলের এই দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার লোভ সংবরণই কঠিন কাজ। ৩৪ বছরে কিচ্ছু হয়নি, সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে, শূন্য থেকে শুরু করতে হবে—এ ধরনের উক্তি করার লোভ সংবরণও কম কঠিন নয়। বাম নেতারা শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে গিয়ে নিশ্চয় ঔদার্যের পরিচয় দেন। এখন বিধানসভার কমিটি-ব্যবস্থাকে যথাসাধ্য বামবান্ধব করার উদ্যোগ মমতাই নিতে পারেন। এতে সফল হলে জিত তাঁরই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments