অর্থনীতি-বাজেট হোক পরিবেশবান্ধব by ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিকে অবশ্যই যেকোনো টেকসই উন্নয়ন-কৌশলের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সে কারণেই একটি পরিবেশবান্ধব বাজেটের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব করতে গিয়ে মূলধনি সামগ্রীর অপচয় বাদ দিয়ে নিট প্রবৃদ্ধির হিসাব পাওয়া যায় (যাকে যথাক্রমে জিএনপি ও এনএনপি বলা হয়)। এর সঙ্গে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতির অর্থনৈতিক মূল্যায়ন হিসাবে নিলে আমাদের জিডিপি ও বার্ষিক নিট প্রবৃদ্ধির প্রকৃত হার ৬ শতাংশের বদলে ৪ শতাংশেও নেমে আসতে পারে (যাকে গ্রিন অ্যাকাউন্টিং বলা যায়)। এই ক্ষয়ক্ষতির উৎসের মধ্যে আছে জমির উর্বরতা হ্রাস, জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি, যানজটজনিত ক্ষতি, নদীর দূষণ ও নাব্যতা হ্রাস, বনসম্পদ, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ইত্যাদি। পরিবেশ সংরক্ষণে এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এসবের ক্ষতিপূরণের ব্যয় অনেক বেশি হবে।
অর্থমন্ত্রী বাপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পরিবেশসংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ও সচেতনতার ঘাটতি থাকার কথা নয়। তাঁর গত দুটি বাজেট বক্তৃতাতেই তা স্পষ্ট; বিশেষ করে, চলতি বছরের বাজেট বক্তৃতায় প্রথমবারের মতো পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক প্রায় সব প্রসঙ্গই এসেছে। বেশ কিছু নীতিমালা প্রণয়ন ও কার্যক্রম গ্রহণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রারও উল্লেখ ছিল। মুশকিল হলো, বাজেট বরাদ্দে অগ্রাধিকার নির্ধারণে বা প্রকল্প নির্বাচন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এসব চিন্তাভাবনার প্রতিফলন তেমন দেখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো তাদের গতানুগতিক প্রকল্প-ছকের বাইরে এ নিয়ে নতুন কিছু করছে বলেও মনে হয় না।
উদাহরণস্বরূপ, নদীর দখল-দূষণ প্রতিকারে ‘জাতীয় নদী কমিশন’ গঠনের সুপারিশ ছিল; কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। আরও যেসব প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল মাটির গুণাগুণ রক্ষার প্রযুক্তি হস্তান্তর, চিংড়িচাষের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার উপায় বের করা, একটি ‘পানি ব্যবহার নীতিমালা’র অধীনে নদী খনন, সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, উপকূলীয় অঞ্চলে জমি উদ্ধার ও লবণাক্ততা রোধ, টেকসই নদীব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ১৫ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ, হাওর ও জলাভূমি উন্নয়নে লাগসই পরিকল্পনা তৈরি, গ্রামীণ এলাকায় জমির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে পরিকল্পিত জনবসতি গড়ে তোলা ইত্যাদি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব বিষয়ে কোনো বাস্তব পরিকল্পনা বা আর্থিক বরাদ্দ লক্ষণীয় হয়নি।
যেসব ক্ষেত্রে বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা হয় অপ্রতুল, অথবা প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতার কারণে ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। গত দুটি বাজেটেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্থানচ্যুত মানুষের পুনর্বাসনের জন্য ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। অথচ দক্ষিণাঞ্চলের আইলাদুর্গত এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকার পুনর্বাসন ও বিধ্বস্ত উপকূলীয় বাঁধগুলোর মেরামতকাজের অগ্রগতি হতাশাব্যঞ্জক। দক্ষিণাঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসন ও সেচ সম্প্রসারণ এবং হাওর এলাকার উন্নয়নের জন্য মাত্র ৩০০ কোটি টাকার বরাদ্দ একে তো যথেষ্ট ছিল না, তার ওপর এসব কর্মসূচির অগ্রগতি কত দূর হয়েছে, তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ। উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমি পুনরুদ্ধার ও জমি লবণাক্ততামুক্ত করার কর্মসূচির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে বলেও মনে হয় না।
পরিবেশসংক্রান্ত অনেক নীতি ও প্রকল্পের বাস্তবায়নেই নানা জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ‘হাতিরঝিল’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নেওয়ার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন; কিন্তু বাস্তবে তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। তীব্র দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) স্থাপনের আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকার পরও ৩০০ কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বলা বাহুল্য, শিল্পবর্জ্যজনিত নদীদূষণের মাত্রা ও ব্যাপ্তির তুলনায় সরকারি কার্যক্রমের গতি ও শক্তি এখন পর্যন্ত খুবই দুর্বল। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি ঢাকার বাইরে স্থানান্তরের পরিকল্পনাটিরও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
ভূগর্ভস্থ পানির আর্সেনিক দূষণ একটি নীরব ঘাতক এবং বড় স্বাস্থ্যবিপর্যয় হয়ে দেখা দিয়েছে। সে তুলনায় আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহের কর্মসূচিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বনায়ন কর্মসূচির আওতায় চলতি অর্থবছরে ১৬টি বিনিয়োগ প্রকল্প গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, কিন্তু এ খাতে প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য পরিমাণ যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তা-ও পুরো ব্যবহার করা যায়নি। বনায়ন কর্মসূচির বড় প্রতিবন্ধকতা হলো নীতিগত বিভ্রান্তি, দুর্নীতি ও বন ধ্বংসের বেআইনি কার্যকলাপ। এ ক্ষেত্রে শুধু বাজেটের বরাদ্দ দিয়ে খুব লাভ হবে না।
স্পষ্টতই পরিবেশবান্ধব বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও আর্থিক বরাদ্দই যথেষ্ট নয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার কঠোর বাস্তবায়নের জন্য দরকার প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠীর পরিবেশবিরোধী অন্যায় কার্যকলাপ প্রতিরোধে রাজনৈতিক অঙ্গীকার। বাংলাদেশে জমি এতই মূল্যবান ও লোভনীয় সম্পদ যে এর পরিকল্পিত ব্যবহার দূরে থাক, প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের হাত থেকে পাহাড়, বন, খাসজমি, খাল-বিল, নদীতীর—কিছুই রক্ষা করা যাচ্ছে না। উৎপাদনশীল যেকোনো বিনিয়োগের তুলনায় জমির ব্যবসাই অনেক বেশি লাভজনক। এর প্রতিকারের জন্য জমি ব্যবহারের নীতি প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত করনীতির সংস্কারও প্রয়োজন।
টেকসই উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী প্রকল্প তৈরি ও যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের বিচার-বিশ্লেষণ, ক্ষমতার অভাব ও চিন্তাভাবনার দৈন্যও আছে। এটা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প তৈরি ও বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যবহারের বিষয় থেকে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত পানি, নদী, বন, জ্বালানি, পরিবহন, কৃষি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ সার্বিক জাতীয় নীতিমালার পুনর্মূল্যায়ন এবং সেই অনুযায়ী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণ। ছিটেফোঁটা অপরিকল্পিত প্রকল্প দিয়ে শুধু অর্থেরই অপচয় হবে। সমস্যা হলো আমাদের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তি অনুশীলনের প্রতি একধরনের অনীহা (অ্যান্টি-ইন্টেলেকচুয়ালিজম) কাজ করে; গভীর চিন্তাভাবনার বদলে আমরা তাৎক্ষণিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণের মতো জটিল বিষয়ে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়ার এটা উপযুক্ত পন্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি নয়।
পরিবেশ সুরক্ষা একটি বহুমাত্রিক বিষয় এবং এর সঙ্গে অনেক মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড জড়িত। গত দুটি বাজেটে পরিবেশকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হলেও পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি সামগ্রিক অগ্রাধিকার নিরূপণের ক্ষেত্রে স্পষ্ট করা হয়নি। এবার থেকে বাজেটের একটি পরিবেশভিত্তিক বিশ্লেষণ-প্রক্রিয়া শুরু করা দরকার।
[বাপার সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত]
১৪ মে, রিপোর্টার্স ইউনিটি।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: অর্থনীতিবিদ ও সহসভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।
অর্থমন্ত্রী বাপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পরিবেশসংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ও সচেতনতার ঘাটতি থাকার কথা নয়। তাঁর গত দুটি বাজেট বক্তৃতাতেই তা স্পষ্ট; বিশেষ করে, চলতি বছরের বাজেট বক্তৃতায় প্রথমবারের মতো পরিবেশ সংরক্ষণবিষয়ক প্রায় সব প্রসঙ্গই এসেছে। বেশ কিছু নীতিমালা প্রণয়ন ও কার্যক্রম গ্রহণ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রারও উল্লেখ ছিল। মুশকিল হলো, বাজেট বরাদ্দে অগ্রাধিকার নির্ধারণে বা প্রকল্প নির্বাচন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এসব চিন্তাভাবনার প্রতিফলন তেমন দেখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো তাদের গতানুগতিক প্রকল্প-ছকের বাইরে এ নিয়ে নতুন কিছু করছে বলেও মনে হয় না।
উদাহরণস্বরূপ, নদীর দখল-দূষণ প্রতিকারে ‘জাতীয় নদী কমিশন’ গঠনের সুপারিশ ছিল; কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। আরও যেসব প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল মাটির গুণাগুণ রক্ষার প্রযুক্তি হস্তান্তর, চিংড়িচাষের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার উপায় বের করা, একটি ‘পানি ব্যবহার নীতিমালা’র অধীনে নদী খনন, সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, উপকূলীয় অঞ্চলে জমি উদ্ধার ও লবণাক্ততা রোধ, টেকসই নদীব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ১৫ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ, হাওর ও জলাভূমি উন্নয়নে লাগসই পরিকল্পনা তৈরি, গ্রামীণ এলাকায় জমির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে পরিকল্পিত জনবসতি গড়ে তোলা ইত্যাদি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব বিষয়ে কোনো বাস্তব পরিকল্পনা বা আর্থিক বরাদ্দ লক্ষণীয় হয়নি।
যেসব ক্ষেত্রে বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা হয় অপ্রতুল, অথবা প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতার কারণে ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। গত দুটি বাজেটেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্থানচ্যুত মানুষের পুনর্বাসনের জন্য ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। অথচ দক্ষিণাঞ্চলের আইলাদুর্গত এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকার পুনর্বাসন ও বিধ্বস্ত উপকূলীয় বাঁধগুলোর মেরামতকাজের অগ্রগতি হতাশাব্যঞ্জক। দক্ষিণাঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসন ও সেচ সম্প্রসারণ এবং হাওর এলাকার উন্নয়নের জন্য মাত্র ৩০০ কোটি টাকার বরাদ্দ একে তো যথেষ্ট ছিল না, তার ওপর এসব কর্মসূচির অগ্রগতি কত দূর হয়েছে, তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ। উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমি পুনরুদ্ধার ও জমি লবণাক্ততামুক্ত করার কর্মসূচির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে বলেও মনে হয় না।
পরিবেশসংক্রান্ত অনেক নীতি ও প্রকল্পের বাস্তবায়নেই নানা জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ‘হাতিরঝিল’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নেওয়ার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন; কিন্তু বাস্তবে তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। তীব্র দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) স্থাপনের আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকার পরও ৩০০ কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বলা বাহুল্য, শিল্পবর্জ্যজনিত নদীদূষণের মাত্রা ও ব্যাপ্তির তুলনায় সরকারি কার্যক্রমের গতি ও শক্তি এখন পর্যন্ত খুবই দুর্বল। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি ঢাকার বাইরে স্থানান্তরের পরিকল্পনাটিরও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
ভূগর্ভস্থ পানির আর্সেনিক দূষণ একটি নীরব ঘাতক এবং বড় স্বাস্থ্যবিপর্যয় হয়ে দেখা দিয়েছে। সে তুলনায় আর্সেনিকমুক্ত সুপেয় পানি সরবরাহের কর্মসূচিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বনায়ন কর্মসূচির আওতায় চলতি অর্থবছরে ১৬টি বিনিয়োগ প্রকল্প গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, কিন্তু এ খাতে প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য পরিমাণ যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, তা-ও পুরো ব্যবহার করা যায়নি। বনায়ন কর্মসূচির বড় প্রতিবন্ধকতা হলো নীতিগত বিভ্রান্তি, দুর্নীতি ও বন ধ্বংসের বেআইনি কার্যকলাপ। এ ক্ষেত্রে শুধু বাজেটের বরাদ্দ দিয়ে খুব লাভ হবে না।
স্পষ্টতই পরিবেশবান্ধব বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও আর্থিক বরাদ্দই যথেষ্ট নয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার কঠোর বাস্তবায়নের জন্য দরকার প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠীর পরিবেশবিরোধী অন্যায় কার্যকলাপ প্রতিরোধে রাজনৈতিক অঙ্গীকার। বাংলাদেশে জমি এতই মূল্যবান ও লোভনীয় সম্পদ যে এর পরিকল্পিত ব্যবহার দূরে থাক, প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের হাত থেকে পাহাড়, বন, খাসজমি, খাল-বিল, নদীতীর—কিছুই রক্ষা করা যাচ্ছে না। উৎপাদনশীল যেকোনো বিনিয়োগের তুলনায় জমির ব্যবসাই অনেক বেশি লাভজনক। এর প্রতিকারের জন্য জমি ব্যবহারের নীতি প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত করনীতির সংস্কারও প্রয়োজন।
টেকসই উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী প্রকল্প তৈরি ও যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের বিচার-বিশ্লেষণ, ক্ষমতার অভাব ও চিন্তাভাবনার দৈন্যও আছে। এটা সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প তৈরি ও বরাদ্দকৃত অর্থের ব্যবহারের বিষয় থেকে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত পানি, নদী, বন, জ্বালানি, পরিবহন, কৃষি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ সার্বিক জাতীয় নীতিমালার পুনর্মূল্যায়ন এবং সেই অনুযায়ী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণ। ছিটেফোঁটা অপরিকল্পিত প্রকল্প দিয়ে শুধু অর্থেরই অপচয় হবে। সমস্যা হলো আমাদের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তি অনুশীলনের প্রতি একধরনের অনীহা (অ্যান্টি-ইন্টেলেকচুয়ালিজম) কাজ করে; গভীর চিন্তাভাবনার বদলে আমরা তাৎক্ষণিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণের মতো জটিল বিষয়ে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়ার এটা উপযুক্ত পন্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি নয়।
পরিবেশ সুরক্ষা একটি বহুমাত্রিক বিষয় এবং এর সঙ্গে অনেক মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড জড়িত। গত দুটি বাজেটে পরিবেশকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হলেও পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি সামগ্রিক অগ্রাধিকার নিরূপণের ক্ষেত্রে স্পষ্ট করা হয়নি। এবার থেকে বাজেটের একটি পরিবেশভিত্তিক বিশ্লেষণ-প্রক্রিয়া শুরু করা দরকার।
[বাপার সংবাদ সম্মেলনে উত্থাপিত]
১৪ মে, রিপোর্টার্স ইউনিটি।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: অর্থনীতিবিদ ও সহসভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।
No comments