বিশেষ সাক্ষাৎকার-সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশ জয়ী হবে by পায়াম আকাভান
কানাডার মন্ট্রিলের ম্যাগগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পায়াম আকাভানের জন্ম ইরানের তেহরানে। বাহাই সম্প্রদায়ভুক্ত আকাভান পরিবার ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবে নিপীড়নের শিকার হয়। নয় বছর বয়সেই কানাডায় তাঁর নির্বাসিত জীবনের শুরু।
১৯৯০ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম এবং ২০০১ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুরিডিক্যাল সায়েন্সে ডক্টরেট (এসজেডি) অর্জন করেন। তিনি রুয়ান্ডা ও সাবেক যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের প্রসিকিউটর অফিসের আইন উপদেষ্টা ছিলেন। কম্বোডিয়া, গুয়াতেমালা ও পূর্ব তিমুরে ফৌজদারি আইন প্রণয়নে জাতিসংঘকে পরামর্শ দিয়েছেন। গুয়ানতানামো বে-তে এক মার্কিন নাগরিকের আটকাদেশের বৈধতা তিনি চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। ১৯৯০ ও ১৯৯৩ সালে যথাক্রমে নরওয়ে ও ডেনমার্কের মানবাধিকার ইনস্টিটিউটের গবেষণা সহকারী এবং ২০০৩-০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ল স্কুল এবং ইয়েল ইউনিভার্সিটি জেনোসাইড স্টাডিজ প্রোগ্রামে সিনিয়র ফেলো ছিলেন। গত ১৫ থেকে ২৩ মার্চ ই-মেইলে এই সাক্ষাৎকার দেন তিনি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত বাংলাদেশের আইনি লড়াইয়ে ইটলসের বিজয়ের পরে ভারতের বিরুদ্ধে হেগের সালিস আদালতের আইনজীবী হিসেবে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাংলাদেশের অর্জনকে কীভাবে দেখেন?
পায়াম আকাভান এই রায় বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ বিজয়। মিয়ানমার ও ভারত তিন দশক ধরে যে দাবি করে আসছিল, তাতে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (২০০ নটিক্যাল মাইল) এবং মহীসোপানের সীমা বৃদ্ধির পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়। সে কারণে আমরা প্রথমেই সালিসি চেয়েছি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সাহসী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এবং সেটা বাংলাদেশের জন্য বিরাট সুফল বয়ে এনেছে। আমরা যা চেয়েছিলাম, ঠিক তা-ই পেয়েছি।
প্রথম আলো এই কথাটি নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক হয়েছে। আমরা কীভাবে যা চেয়েছি তা পেয়েছি বলতে পারি?
পায়াম আকাভান তার কারণ জাতিসংঘের ট্রাইব্যুনাল যথার্থই মন্তব্য করেন যে সমদূরত্ব পদ্ধতিতে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা কাটা পড়ে, আর সেটা অন্যায্য। এবং তাঁরা তা স্বীকার করেই বাংলাদেশের অনুকূলে উল্লেখযোগ্যভাবে সমুদ্রসীমা সমন্বয় করে দিয়েছেন। এর ফলে ২০০ নটিক্যাল মাইল এবং তারও বাইরে যাওয়া নিশ্চিত হয়েছে। সমুদ্রসীমা বিচারের ইতিহাসে এই প্রথম আউটার মহীসোপান এলাকার সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই সমুদ্র আইন এবং বাংলাদেশের জন্য এটা এক ঐতিহাসিক রায়। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর ফলে সাগরে বিপুল সম্ভাবনাময় গ্যাস ও তেল আহরণ করা সম্ভব হবে। এবং তা নিশ্চিত করতে পারে জ্বালানি সম্পদের স্বনির্ভরতা।
প্রথম আলো ২১ জন বিচারক বাংলাদেশের পক্ষে কিন্তু একজন ভিন্নমত দিয়েছেন। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
পায়াম আকাভান শুধু একটি ভিন্নমত এসেছে। অনেক বিচারকের মধ্যে একজনের ভিন্নমত কার্যত সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের প্রতিফলন। একটা ব্যাপকভিত্তিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি একটি সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ারই নির্দেশক। ইটলস একই সঙ্গে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন যে তাঁরা অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে রায় দিতে পারেন। তাঁরা সময় নেন আড়াই বছরের কম। হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) কাতার ও বাহরাইনের মধ্যকার সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তিতে সময় লেগেছিল এক দশকের বেশি। হামবুর্গের সমুদ্র আইন ট্রাইব্যুনালটি ঘন ঘন বসে না। কিন্তু বাংলাদেশ ও মিয়ানমার যখন তাদের সামনে এই মামলাটি নিয়ে গেল, তখন তারা ন্যায্যতার প্রমাণ রাখলেন।
প্রথম আলো ভবিষ্যতে একই ধরনের উপকূলীয় বৈশিষ্ট্য-সংবলিত দেশগুলোর মধ্যকার বিরোধ মেটাতে এই রায়ের নীতিগুলো কীভাবে পথ দেখাতে পারে? ইটলসের রায় কি সালিস আদালতের জন্য কোনোভাবে নির্দেশক বা বাধ্যতামূলক?
পায়াম আকাভান এটা জটিল মামলা। বাংলাদেশকে অন্যায্য অবস্থানে না ঠেলে দিয়ে তুলনামূলক সহজসাধ্য সমদূরত্বের সূত্র প্রয়োগ করা সম্ভব ছিল না। ১৯৬৭ সালে বিশ্ব আদালত নর্থ সি (জার্মান, নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্কের মধ্যকার বিরোধ) মামলায় যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন তার সঙ্গে এই রায়ের মিল রয়েছে। নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্ক সমদূরত্ব পদ্ধতি দাবি করে জার্মানির সমুদ্রসীমায় এমনই এক কাটাপড়া অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। ওই মামলায় জার্মানি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমুদ্র উপকূলকে এক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখিয়েছিল। তারা বলেছিল, যদি সমদূরত্ব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তাহলে পূর্ব পাকিস্তান কী করে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সেটা এক চিরায়ত উদাহরণ বটে। জার্মানির নর্থ সি থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে বসে ইটলসের শুনানিকালে আমরা বিচারকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে, ১৯৬৭-তে জার্মানির অনুকূলে দেওয়া রায়টি বিবেচনায় নিলেই বাংলাদেশের প্রতি সুবিচার করা সম্ভব হবে।
প্রথম আলো ইটলসের রায়ের বৈশিষ্ট্যগুলো কী?
পায়াম আকাভান আউটার মহীসোপানের সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়াই ইটলসের রায়ের ইতিহাস সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্য। ২০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি এলাকার অধিকার নির্ধারণে ‘প্রাকৃতিক বিস্তৃতি’ সংজ্ঞায়িত করা গুরুত্বপূর্ণ। আউটার মহীসোপানের সীমা ঠিক করে দেওয়ার সঙ্গে ওই সংজ্ঞাসহ আরও বহুবিধ মাত্রা জড়িয়ে আছে।
প্রথম আলো মিয়ানমারের সঙ্গে ২০০ নটিক্যাল মাইলের পরের সমুদ্রসীমা মানে মহীসোপানের সীমা নির্ধারণ বাকি থাকল। ইটলসের রায়ে মহীসোপান নিয়ে আমাদের অর্জনকে তাহলে কেন বিশেষ অর্জন বলছেন?
পায়াম আকাভান বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মহীসোপানবিষয়ক দাবি রীতিমাফিক জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট কমিশনে আগে থেকেই বিবেচনাধীন ছিল। সুতরাং ইটলস বলেছেন, এই অবস্থায় যদি মহীসোপানের পুরোপুরি এলাকা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না-ও হয়, তাহলে তাঁরা অন্ততপক্ষে কোথা থেকে মহীসোপান চিহ্নিতকরণ শুরু হবে, সেটা নির্ধারণ করতে পারেন। দুই রাষ্ট্রের উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল শেষে যেখানে মহীসোপান শুরু হবে, সেই জায়গাটি একটি তিরচিহ্ন দিয়ে দেখানোর এখতিয়ার আদালতের রয়েছে। এই মামলার রায়ে তাঁরা কিন্তু সেই কাজটিই করেছেন। এ ঘটনা ইতিহাসে এই প্রথম।
প্রথম আলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, ‘আমাদের সকল স্ট্র্যাটেজিক উদ্দেশ্য অর্জিত হয়েছে।’ আর আপনি বলছেন, ‘এটা একটা সম্পূর্ণ বিজয়।’ কিন্তু আমাদের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে ফারাক তো একটা ঘটেছে।
পায়াম আকাভান আমি বিশ্বাস করি যে, তিনি যা বলেছেন, তার অর্থ হলো—মিয়ানমার সমুদ্রসীমা নির্ধারণে অসমতাভিত্তিক যে নীতি অনুসরণের দাবি তুলেছিল, বাংলাদেশ তা এড়াতে পেরেছে। উপরন্তু বাংলাদেশ তার দক্ষিণ-পশ্চিমে সর্বাধিক ২১৫ ডিগ্রি দাবি করেছিল এবং সেটা সামান্যই কাটছাঁট করে ইটলসের রায় হয়েছে। সর্বোচ্চ দাবি করা হয় সাধারণত এই আশায় যে, যাতে তার চেয়ে কিছু কমে প্রকৃত অর্জন নিশ্চিত হয়। সুতরাং আমরা সর্বোচ্চ জলসীমার যে দাবি করেছিলাম, সেখানে ন্যায্যতাভিত্তিক প্রাপ্তি ঘটেছে বলেই এটা এক বিরাট বিজয়।
প্রথম আলো ইটলসের রায়ে আমরা মহীসোপানের চূড়ান্ত এলাকা বুঝে পাইনি। এটা নির্ভর করবে জাতিসংঘ মহীসোপান কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর, যা এখনো বিবেচনাধীন। তাহলে এখানে আমরা কী পেলাম?
পায়াম আকাভান জাতিসংঘের কমিশন বাংলাদেশের মহীসোপানের সীমানা কোথায় শেষ হবে, তা নির্ধারণ করে দেবে। তার আউটার লিমিট ঠিক করবে। এবং কোন বিন্দুতে ২১৫ ডিগ্রির রেখা আউটার লিমিটকে স্পর্শ করবে, এটা করতে কমিশনের কয়েক বছর লেগে যেতে পারে, এমনকি তার শেষ সীমা ২০৩৫ সাল পর্যন্ত গড়াতে পারে। সে কারণেই হামবুর্গে আমরা প্রবলভাবে যুক্তি তুলে ধরেছিলাম যে, জাতিসংঘের কমিশন এখন পর্যন্ত আউটার লিমিট নির্দিষ্ট করে না দিলেও ইটলসের উচিত হবে মহীসোপানের শুরুর সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া। মহীসোপানের এই এলাকা তেল ও গ্যাস আহরণের দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে দুর্গম এলাকা। সুতরাং বাস্তব অর্থে ওই আউটার এলাকা অর্থপূর্ণ করে তুলতে বহু বছর লেগে যেতে পারে।
প্রথম আলো চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উল্লেখযোগ্য সমুদ্রশক্তি তাদের প্রতিবেশীরা যাতে সমুদ্র বিরোধনিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সমুদ্র আইনের আওতায় প্রতিকার পেতে না পারে, সে জন্য তারা আদালতে যাওয়া ব্লক করে দিয়েছে। মিয়ানমারও ইটলস থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল। আপনি কীভাবে দেখছেন?
পায়াম আকাভান বাংলাদেশের আইনি উদ্যোগ গ্রহণ করার পরে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলো কিছুটা উদ্যোগ নিয়েছিল। ভারত বিশ্ব আদালতের এখতিয়ারের ক্ষেত্রে সব ধরনের সীমান্ত বিরোধের বিষয়ে আপত্তি দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু তারা জাতিসংঘের সমুদ্র আইনের আওতায় আপত্তি দেয়নি। এটা হয়তো ভারতের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। যা হোক, এটা যদি সহজলভ্য না হতো, তাহলে আজকের তুলনায় বাংলাদেশকে অনেক বেশি খারাপ অবস্থায় পড়তে হতো। এখন বাংলাদেশ তার অধিকার খাটাতে পারবে, এ নিয়ে তাকে আর ক্ষমতার ভারসাম্যের দিকে তাকাতে হবে না। দরকষাকষি অবস্থানে থাকতে হবে না। স্বাভাবিকভাবেই ছোট রাষ্ট্রগুলো তাই সব সময় আন্তর্জাতিক আইনের দিকে তাকায়। এবং বড় রাষ্ট্রগুলো তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে তাদের শক্তি প্রয়োগ করে থাকে। আর সেটা মার্কিন, রুশ, চীনা কিংবা ভারতীয়—সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অস্ট্রেলিয়াও তার প্রতিবেশী পূর্ব তিমুরের সঙ্গে একটি সমুদ্র সীমানা চাপিয়ে দিতে তার শক্তির ওপরে ভর করেছে।
প্রথম আলো ইটলসের রায়ের মতো হেগের সালিস আদালতের রায় কি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক? ভারত কি এখন চলমান বিচারিক-প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারে?
পায়াম আকাভান তাদের রায় চূড়ান্ত এবং বাধ্যতামূলক। এর বাধ্যকর প্রক্রিয়াকে মিয়ানমার কিংবা ভারত কেউ এড়াতে পারবে না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে আশা ব্যক্ত করেছেন, সেভাবেই ২০১৪ সালে রায় মিলবে।
প্রথম আলো সালিস আদালত সমুদ্র আইনের আওতায় যত রায় দিয়েছেন তা কি সব বিচারে সুষ্ঠু হিসেবে গণ্য হয়েছে? বাংলাদেশ বনাম ভারতের মতো কোনো সমুদ্রসীমা বিরোধ কি ওই আদালত নিষ্পত্তি করেছেন?
পায়াম আকাভান স্থায়ী সালিস আদালত শুধুই মধ্যস্থতা বা সালিস-নিষ্পত্তি পরিচালনা করে থাকেন। ইটলসের মতো হেগের আদালত স্থায়ী নয়। সে কারণে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে পাঁচজন মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করেছে। এবং স্থায়ী আদালত সালিস-নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া পরিচালনা করবেন। এ ধরনের সালিসির ঘটনা এর আগে অনেকই ঘটেছে এবং তা ব্যাপক অর্থেই সব দৃষ্টিকোণ থেকে সুষ্ঠু ও ন্যায়পর বলে বিবেচিত হয়েছে। বাংলাদেশ ইটলসের বিচারক প্যানেল থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সালিস-নিষ্পত্তিকারী মনোনীত করতে পেরে বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। পাঁচজনের তিনজনই ইটলসের বিচারক। সুতরাং মিয়ানমারের সঙ্গে যে নীতি তাঁরা অনুসরণ করেছেন, সেই একই বিষয় যে ভারতের সঙ্গেও রয়েছে সে বিষয়ে তাঁরা সচেতন থাকবেন। তাঁরা ন্যায্যতাভিত্তিক একই নীতি অনুসরণ করবেন বলে খুব সম্ভাবনা রয়েছে। সালিস আদালত গঠনে বাংলাদেশ তাই এক বিরাট কার্যপ্রণালিঘটিত বিজয় ইতিমধ্যেই নিশ্চিত করে ফেলেছে। তাই বলতে পারি, বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় বিজয় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটা খুবই আত্মবিশ্বাসমূলক।
প্রথম আলো হেগের সালিস আদালতে বিচারাধীন মামলায় ভারত তার উত্তর জমা দিতে দুই মাস সময় বাড়িয়ে নিয়েছিল এই যুক্তি দিয়ে যে, ইটলসের রায় তাদের খতিয়ে দেখতে হবে। দুই মামলা কি একই ধরনের?
পায়াম আকাভান বাংলাদেশ বনাম ভারত মামলাটি একই ধরনের, যদিও তা মিয়ানমারের মামলাটির মতো সর্বতোভাবে একরূপ নয়। তবে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা আটকাপড়া এড়ানোর যে নীতি সেটাই ভারতের মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে ভারত এখন বিবেচনা করতে পারে যে বাংলাদেশের অনুকূলে যাওয়া ইটলসের রায়কে সামনে রেখে তারা একটি অনিশ্চিত সালিস আদালতের রায়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে? নাকি তার চেয়ে বরং সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা সমঝোতায় পৌঁছানোটা তার জন্য কাম্য হতে পারে কি না।
প্রথম আলো বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের নতুন হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সালিস আদালত চলবে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুরাহার বিরোধিতা করছেন। আপনি কীভাবে দেখছেন?
পায়াম আকাভান মিয়ানমারের মামলায় সাফল্যের আলোকে ভারতের মামলার ক্ষেত্রেও একটি অনুকূল রায় পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ একটি সালিসি-প্রক্রিয়া থেকে যা পেতে পারত ঠিক সে রকমই একটি উত্তম প্রাপ্তি ভারত যদি বাংলাদেশকে নিশ্চিত না করে, তাহলে সালিস-প্রক্রিয়া থেকে তার সরে আসার কোনো কারণই নেই। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ক্ষতি নেই। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেমনটা বলেছেন তাতে সালিস বন্ধ করার কথা নেই।
প্রথম আলো হামবুর্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের কৃতিত্ব সম্পর্কে মন্তব্য করুন।
পায়াম আকাভান এই মামলা দায়েরে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত ছিল দূরদর্শী। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সক্রিয় সম্পৃক্ততা তাকে সফল রূপ দিয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে আমি অ্যাডমিরাল মো. খুরশেদ আলমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সরকারি দলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান উল্লেখ করতে চাই। খুরশেদ আলম দেশ ও জনগণের প্রতি ব্যতিক্রমীভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। তিনি মামলার বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ এবং গভীর জ্ঞানসম্পন্ন। তিনি না হলে এই মামলার ফল অবশ্যই এতখানি বিশিষ্টতা পেত না।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
পায়াম আকাভান আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো সমুদ্রসীমাসংক্রান্ত বাংলাদেশের আইনি লড়াইয়ে ইটলসের বিজয়ের পরে ভারতের বিরুদ্ধে হেগের সালিস আদালতের আইনজীবী হিসেবে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বাংলাদেশের অর্জনকে কীভাবে দেখেন?
পায়াম আকাভান এই রায় বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ বিজয়। মিয়ানমার ও ভারত তিন দশক ধরে যে দাবি করে আসছিল, তাতে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (২০০ নটিক্যাল মাইল) এবং মহীসোপানের সীমা বৃদ্ধির পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়। সে কারণে আমরা প্রথমেই সালিসি চেয়েছি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সাহসী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এবং সেটা বাংলাদেশের জন্য বিরাট সুফল বয়ে এনেছে। আমরা যা চেয়েছিলাম, ঠিক তা-ই পেয়েছি।
প্রথম আলো এই কথাটি নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক হয়েছে। আমরা কীভাবে যা চেয়েছি তা পেয়েছি বলতে পারি?
পায়াম আকাভান তার কারণ জাতিসংঘের ট্রাইব্যুনাল যথার্থই মন্তব্য করেন যে সমদূরত্ব পদ্ধতিতে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা কাটা পড়ে, আর সেটা অন্যায্য। এবং তাঁরা তা স্বীকার করেই বাংলাদেশের অনুকূলে উল্লেখযোগ্যভাবে সমুদ্রসীমা সমন্বয় করে দিয়েছেন। এর ফলে ২০০ নটিক্যাল মাইল এবং তারও বাইরে যাওয়া নিশ্চিত হয়েছে। সমুদ্রসীমা বিচারের ইতিহাসে এই প্রথম আউটার মহীসোপান এলাকার সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই সমুদ্র আইন এবং বাংলাদেশের জন্য এটা এক ঐতিহাসিক রায়। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর ফলে সাগরে বিপুল সম্ভাবনাময় গ্যাস ও তেল আহরণ করা সম্ভব হবে। এবং তা নিশ্চিত করতে পারে জ্বালানি সম্পদের স্বনির্ভরতা।
প্রথম আলো ২১ জন বিচারক বাংলাদেশের পক্ষে কিন্তু একজন ভিন্নমত দিয়েছেন। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
পায়াম আকাভান শুধু একটি ভিন্নমত এসেছে। অনেক বিচারকের মধ্যে একজনের ভিন্নমত কার্যত সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের প্রতিফলন। একটা ব্যাপকভিত্তিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি একটি সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ারই নির্দেশক। ইটলস একই সঙ্গে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন যে তাঁরা অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে রায় দিতে পারেন। তাঁরা সময় নেন আড়াই বছরের কম। হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) কাতার ও বাহরাইনের মধ্যকার সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তিতে সময় লেগেছিল এক দশকের বেশি। হামবুর্গের সমুদ্র আইন ট্রাইব্যুনালটি ঘন ঘন বসে না। কিন্তু বাংলাদেশ ও মিয়ানমার যখন তাদের সামনে এই মামলাটি নিয়ে গেল, তখন তারা ন্যায্যতার প্রমাণ রাখলেন।
প্রথম আলো ভবিষ্যতে একই ধরনের উপকূলীয় বৈশিষ্ট্য-সংবলিত দেশগুলোর মধ্যকার বিরোধ মেটাতে এই রায়ের নীতিগুলো কীভাবে পথ দেখাতে পারে? ইটলসের রায় কি সালিস আদালতের জন্য কোনোভাবে নির্দেশক বা বাধ্যতামূলক?
পায়াম আকাভান এটা জটিল মামলা। বাংলাদেশকে অন্যায্য অবস্থানে না ঠেলে দিয়ে তুলনামূলক সহজসাধ্য সমদূরত্বের সূত্র প্রয়োগ করা সম্ভব ছিল না। ১৯৬৭ সালে বিশ্ব আদালত নর্থ সি (জার্মান, নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্কের মধ্যকার বিরোধ) মামলায় যে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন তার সঙ্গে এই রায়ের মিল রয়েছে। নেদারল্যান্ড ও ডেনমার্ক সমদূরত্ব পদ্ধতি দাবি করে জার্মানির সমুদ্রসীমায় এমনই এক কাটাপড়া অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। ওই মামলায় জার্মানি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমুদ্র উপকূলকে এক দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখিয়েছিল। তারা বলেছিল, যদি সমদূরত্ব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়, তাহলে পূর্ব পাকিস্তান কী করে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সেটা এক চিরায়ত উদাহরণ বটে। জার্মানির নর্থ সি থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে বসে ইটলসের শুনানিকালে আমরা বিচারকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে, ১৯৬৭-তে জার্মানির অনুকূলে দেওয়া রায়টি বিবেচনায় নিলেই বাংলাদেশের প্রতি সুবিচার করা সম্ভব হবে।
প্রথম আলো ইটলসের রায়ের বৈশিষ্ট্যগুলো কী?
পায়াম আকাভান আউটার মহীসোপানের সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়াই ইটলসের রায়ের ইতিহাস সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্য। ২০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি এলাকার অধিকার নির্ধারণে ‘প্রাকৃতিক বিস্তৃতি’ সংজ্ঞায়িত করা গুরুত্বপূর্ণ। আউটার মহীসোপানের সীমা ঠিক করে দেওয়ার সঙ্গে ওই সংজ্ঞাসহ আরও বহুবিধ মাত্রা জড়িয়ে আছে।
প্রথম আলো মিয়ানমারের সঙ্গে ২০০ নটিক্যাল মাইলের পরের সমুদ্রসীমা মানে মহীসোপানের সীমা নির্ধারণ বাকি থাকল। ইটলসের রায়ে মহীসোপান নিয়ে আমাদের অর্জনকে তাহলে কেন বিশেষ অর্জন বলছেন?
পায়াম আকাভান বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মহীসোপানবিষয়ক দাবি রীতিমাফিক জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট কমিশনে আগে থেকেই বিবেচনাধীন ছিল। সুতরাং ইটলস বলেছেন, এই অবস্থায় যদি মহীসোপানের পুরোপুরি এলাকা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না-ও হয়, তাহলে তাঁরা অন্ততপক্ষে কোথা থেকে মহীসোপান চিহ্নিতকরণ শুরু হবে, সেটা নির্ধারণ করতে পারেন। দুই রাষ্ট্রের উপকূল থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল শেষে যেখানে মহীসোপান শুরু হবে, সেই জায়গাটি একটি তিরচিহ্ন দিয়ে দেখানোর এখতিয়ার আদালতের রয়েছে। এই মামলার রায়ে তাঁরা কিন্তু সেই কাজটিই করেছেন। এ ঘটনা ইতিহাসে এই প্রথম।
প্রথম আলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, ‘আমাদের সকল স্ট্র্যাটেজিক উদ্দেশ্য অর্জিত হয়েছে।’ আর আপনি বলছেন, ‘এটা একটা সম্পূর্ণ বিজয়।’ কিন্তু আমাদের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে ফারাক তো একটা ঘটেছে।
পায়াম আকাভান আমি বিশ্বাস করি যে, তিনি যা বলেছেন, তার অর্থ হলো—মিয়ানমার সমুদ্রসীমা নির্ধারণে অসমতাভিত্তিক যে নীতি অনুসরণের দাবি তুলেছিল, বাংলাদেশ তা এড়াতে পেরেছে। উপরন্তু বাংলাদেশ তার দক্ষিণ-পশ্চিমে সর্বাধিক ২১৫ ডিগ্রি দাবি করেছিল এবং সেটা সামান্যই কাটছাঁট করে ইটলসের রায় হয়েছে। সর্বোচ্চ দাবি করা হয় সাধারণত এই আশায় যে, যাতে তার চেয়ে কিছু কমে প্রকৃত অর্জন নিশ্চিত হয়। সুতরাং আমরা সর্বোচ্চ জলসীমার যে দাবি করেছিলাম, সেখানে ন্যায্যতাভিত্তিক প্রাপ্তি ঘটেছে বলেই এটা এক বিরাট বিজয়।
প্রথম আলো ইটলসের রায়ে আমরা মহীসোপানের চূড়ান্ত এলাকা বুঝে পাইনি। এটা নির্ভর করবে জাতিসংঘ মহীসোপান কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর, যা এখনো বিবেচনাধীন। তাহলে এখানে আমরা কী পেলাম?
পায়াম আকাভান জাতিসংঘের কমিশন বাংলাদেশের মহীসোপানের সীমানা কোথায় শেষ হবে, তা নির্ধারণ করে দেবে। তার আউটার লিমিট ঠিক করবে। এবং কোন বিন্দুতে ২১৫ ডিগ্রির রেখা আউটার লিমিটকে স্পর্শ করবে, এটা করতে কমিশনের কয়েক বছর লেগে যেতে পারে, এমনকি তার শেষ সীমা ২০৩৫ সাল পর্যন্ত গড়াতে পারে। সে কারণেই হামবুর্গে আমরা প্রবলভাবে যুক্তি তুলে ধরেছিলাম যে, জাতিসংঘের কমিশন এখন পর্যন্ত আউটার লিমিট নির্দিষ্ট করে না দিলেও ইটলসের উচিত হবে মহীসোপানের শুরুর সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া। মহীসোপানের এই এলাকা তেল ও গ্যাস আহরণের দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে দুর্গম এলাকা। সুতরাং বাস্তব অর্থে ওই আউটার এলাকা অর্থপূর্ণ করে তুলতে বহু বছর লেগে যেতে পারে।
প্রথম আলো চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উল্লেখযোগ্য সমুদ্রশক্তি তাদের প্রতিবেশীরা যাতে সমুদ্র বিরোধনিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সমুদ্র আইনের আওতায় প্রতিকার পেতে না পারে, সে জন্য তারা আদালতে যাওয়া ব্লক করে দিয়েছে। মিয়ানমারও ইটলস থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল। আপনি কীভাবে দেখছেন?
পায়াম আকাভান বাংলাদেশের আইনি উদ্যোগ গ্রহণ করার পরে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলো কিছুটা উদ্যোগ নিয়েছিল। ভারত বিশ্ব আদালতের এখতিয়ারের ক্ষেত্রে সব ধরনের সীমান্ত বিরোধের বিষয়ে আপত্তি দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু তারা জাতিসংঘের সমুদ্র আইনের আওতায় আপত্তি দেয়নি। এটা হয়তো ভারতের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। যা হোক, এটা যদি সহজলভ্য না হতো, তাহলে আজকের তুলনায় বাংলাদেশকে অনেক বেশি খারাপ অবস্থায় পড়তে হতো। এখন বাংলাদেশ তার অধিকার খাটাতে পারবে, এ নিয়ে তাকে আর ক্ষমতার ভারসাম্যের দিকে তাকাতে হবে না। দরকষাকষি অবস্থানে থাকতে হবে না। স্বাভাবিকভাবেই ছোট রাষ্ট্রগুলো তাই সব সময় আন্তর্জাতিক আইনের দিকে তাকায়। এবং বড় রাষ্ট্রগুলো তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে তাদের শক্তি প্রয়োগ করে থাকে। আর সেটা মার্কিন, রুশ, চীনা কিংবা ভারতীয়—সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অস্ট্রেলিয়াও তার প্রতিবেশী পূর্ব তিমুরের সঙ্গে একটি সমুদ্র সীমানা চাপিয়ে দিতে তার শক্তির ওপরে ভর করেছে।
প্রথম আলো ইটলসের রায়ের মতো হেগের সালিস আদালতের রায় কি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক? ভারত কি এখন চলমান বিচারিক-প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারে?
পায়াম আকাভান তাদের রায় চূড়ান্ত এবং বাধ্যতামূলক। এর বাধ্যকর প্রক্রিয়াকে মিয়ানমার কিংবা ভারত কেউ এড়াতে পারবে না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে আশা ব্যক্ত করেছেন, সেভাবেই ২০১৪ সালে রায় মিলবে।
প্রথম আলো সালিস আদালত সমুদ্র আইনের আওতায় যত রায় দিয়েছেন তা কি সব বিচারে সুষ্ঠু হিসেবে গণ্য হয়েছে? বাংলাদেশ বনাম ভারতের মতো কোনো সমুদ্রসীমা বিরোধ কি ওই আদালত নিষ্পত্তি করেছেন?
পায়াম আকাভান স্থায়ী সালিস আদালত শুধুই মধ্যস্থতা বা সালিস-নিষ্পত্তি পরিচালনা করে থাকেন। ইটলসের মতো হেগের আদালত স্থায়ী নয়। সে কারণে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে পাঁচজন মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ করেছে। এবং স্থায়ী আদালত সালিস-নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া পরিচালনা করবেন। এ ধরনের সালিসির ঘটনা এর আগে অনেকই ঘটেছে এবং তা ব্যাপক অর্থেই সব দৃষ্টিকোণ থেকে সুষ্ঠু ও ন্যায়পর বলে বিবেচিত হয়েছে। বাংলাদেশ ইটলসের বিচারক প্যানেল থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সালিস-নিষ্পত্তিকারী মনোনীত করতে পেরে বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছে। পাঁচজনের তিনজনই ইটলসের বিচারক। সুতরাং মিয়ানমারের সঙ্গে যে নীতি তাঁরা অনুসরণ করেছেন, সেই একই বিষয় যে ভারতের সঙ্গেও রয়েছে সে বিষয়ে তাঁরা সচেতন থাকবেন। তাঁরা ন্যায্যতাভিত্তিক একই নীতি অনুসরণ করবেন বলে খুব সম্ভাবনা রয়েছে। সালিস আদালত গঠনে বাংলাদেশ তাই এক বিরাট কার্যপ্রণালিঘটিত বিজয় ইতিমধ্যেই নিশ্চিত করে ফেলেছে। তাই বলতে পারি, বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় বিজয় নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এটা খুবই আত্মবিশ্বাসমূলক।
প্রথম আলো হেগের সালিস আদালতে বিচারাধীন মামলায় ভারত তার উত্তর জমা দিতে দুই মাস সময় বাড়িয়ে নিয়েছিল এই যুক্তি দিয়ে যে, ইটলসের রায় তাদের খতিয়ে দেখতে হবে। দুই মামলা কি একই ধরনের?
পায়াম আকাভান বাংলাদেশ বনাম ভারত মামলাটি একই ধরনের, যদিও তা মিয়ানমারের মামলাটির মতো সর্বতোভাবে একরূপ নয়। তবে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা আটকাপড়া এড়ানোর যে নীতি সেটাই ভারতের মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে ভারত এখন বিবেচনা করতে পারে যে বাংলাদেশের অনুকূলে যাওয়া ইটলসের রায়কে সামনে রেখে তারা একটি অনিশ্চিত সালিস আদালতের রায়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে? নাকি তার চেয়ে বরং সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা সমঝোতায় পৌঁছানোটা তার জন্য কাম্য হতে পারে কি না।
প্রথম আলো বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের নতুন হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সালিস আদালত চলবে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সুরাহার বিরোধিতা করছেন। আপনি কীভাবে দেখছেন?
পায়াম আকাভান মিয়ানমারের মামলায় সাফল্যের আলোকে ভারতের মামলার ক্ষেত্রেও একটি অনুকূল রায় পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশ একটি সালিসি-প্রক্রিয়া থেকে যা পেতে পারত ঠিক সে রকমই একটি উত্তম প্রাপ্তি ভারত যদি বাংলাদেশকে নিশ্চিত না করে, তাহলে সালিস-প্রক্রিয়া থেকে তার সরে আসার কোনো কারণই নেই। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ক্ষতি নেই। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেমনটা বলেছেন তাতে সালিস বন্ধ করার কথা নেই।
প্রথম আলো হামবুর্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের কৃতিত্ব সম্পর্কে মন্তব্য করুন।
পায়াম আকাভান এই মামলা দায়েরে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত ছিল দূরদর্শী। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সক্রিয় সম্পৃক্ততা তাকে সফল রূপ দিয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে আমি অ্যাডমিরাল মো. খুরশেদ আলমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সরকারি দলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান উল্লেখ করতে চাই। খুরশেদ আলম দেশ ও জনগণের প্রতি ব্যতিক্রমীভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। তিনি মামলার বিষয়ে অত্যন্ত দক্ষ এবং গভীর জ্ঞানসম্পন্ন। তিনি না হলে এই মামলার ফল অবশ্যই এতখানি বিশিষ্টতা পেত না।
প্রথম আলো আপনাকে ধন্যবাদ।
পায়াম আকাভান আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments