গদ্যকার্টুন-সংবাদপত্রের অক্ষর কি আপনার চোখে ঝাপসা লাগে? by আনিসুল হক
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চোখমুখ ধুয়ে প্রাতরাশের টেবিলে বসি। সামনে থাকে এক কাপ গরম ধূমায়িত চা। আর থাকে গরম গরম পত্রিকা। পত্রিকা পড়া শুরু করি। কিন্তু পাঁচ মিনিটের মাথায় চোখে আর কিছু দেখি না। অক্ষর সব ঝাপসা হয়ে আসে। চোখের ডাক্তারের কাছে গেলাম। তাঁকে সব খুলে বললাম। তিনি ভালোভাবে চোখ পরীক্ষা করলেন।
চশমার পাওয়ার আগে যা ছিল, তা-ই রইল। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না। পরের দিন সকালবেলা আবারও একই সমস্যা। পাঁচ মিনিট পড়েছি কি পড়িনি, পত্রিকার অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে এল। বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। গেলাম স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। সব শুনে তিনি নিজেই একটু ভয় পেয়ে গেলেন বলে মনে হলো। বললেন, ‘ব্রেনের একটা এমআরআই আর এমআরএ করে ফেলুন। এসব সমস্যা অনেক সময় সিরিয়াস হয়ে যেতে পারে।’
ব্রেনের এমআরআই পরীক্ষাটা খুবই ভয়ংকর ধরনের জিনিস। এর আগের নির্বাচন কমিশনার আজিজ সাহেব বলেছিলেন, ‘আমার কোনো শত্রুকেও যেন জীবনে কোনো দিন এমআরআই করতে না হয়।’ ব্রেনের এমআরআই করতে গিয়ে আমারও একই উপলব্ধি হলো।
প্রথমে আপনাকে শোয়ানো হবে একটা উঁচু টেবিলে। তারপর আপনার মাথাটা কফিন-সদৃশ একটা চেম্বারে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। চোখ মেললে আপনি দেখবেন, আপনার মাথাটা যেন একটা অনড় হেলমেটের মধ্যে বন্দী। আপনার কানে দুটো রবারের প্যাড পরানো হয়েছে, যাতে শব্দ কানে কম যায়। কিন্তু ভয়ংকর শব্দ হতে থাকবে। নানা ধরনের শব্দ। আপনার হাতে একটা সুইচ দিয়ে বলা হবে, কোনো অসুবিধা হলে এটাতে চাপ দেবেন। বেল বেজে উঠবে।
আমার একটা ফোবিয়া আছে। আমি বদ্ধ জায়গায় ঢুকলে খুব ভয় পাই। যেমন—লিফটে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। এমআরআই করানোর জন্য আমার মাথাটা ওই বদ্ধ চেম্বারে ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে আমার কলজে শুকিয়ে এল। এমআরআই শুরু করার আগেই আমি বেলের সুইচে চাপ দিতে লাগলাম। ওঁরা ছুটে এলেন। আমি বললাম, ‘আমার কোনো অসুবিধা নাই। আমি দিব্যি সুস্থ আছি। আমার এমআরআই করা লাগবে না। যা টাকা বিল হয় আমি দিয়ে দেব।’ ওঁরা অভয় দিলেন। একজন কর্মী আমার হাত ধরে বললেন, ‘আমি আপনার হাত ধরে থাকি। আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন। মাত্র কুড়ি মিনিট।’
আমার জীবনের দীর্ঘতম ২০ মিনিট পার করলাম। ভিনি ভিডি ভিসি। আমি এলাম, শুয়ে থাকলাম, জয় করলাম। আমি এমআরআই করাতে সক্ষম হলাম।
রিপোর্ট পাওয়া গেল সঙ্গে সঙ্গেই। আমার মস্তিষ্ক চমৎকার আছে। কোনো সমস্যা নেই।
তাহলে?
আমি পড়া আরম্ভ করার পাঁচ মিনিট পর কেন আর পড়তে পারি না?
আমার এই সমস্যার সমাধান আমি নিজেই আবিষ্কার করে ফেলেছি। আমি খেয়াল করে দেখলাম, চশমা ছাড়া পড়তে পারি। চশমা দিয়ে পারি না। তখন আমি ‘ইউরেকা ইউরেকা’ বলে দৌড় ধরলাম। বাসার দ্বাররক্ষীরা জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, কী হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘আমি আমার রোগের কারণ ধরতে পেরেছি।’
‘কী রোগ, স্যার?’
‘আছে আছে।’
আমি ডাক্তারের কাছে গেলাম। বললাম, ‘স্যার, আমার রোগের কারণ ধরতে পেরেছি।’
তিনি বললেন, ‘কী রকম?’
‘স্যার, আমার রোগের কারণ হলো গরম চা।’
‘মানে কী? গরম চা খেলে আপনার মাথা বিকল হয়ে পড়ে?’
‘জি না, স্যার। আমি ইয়া বড় মগে চা খাই। চা থাকে গরম। সকালবেলা চোখে চশমা দিয়ে চায়ের কাপে বার দুই চুমুক দিতেই চায়ের কাপ থেকে বাষ্প উঠে চশমার কাচ ঘোলা করে দেয়। এ কারণে আমি পাঁচ মিনিট পর আর পড়তে পারি না।’
আমার এই ঘটনা গল্প নয়, সত্যি।
তবে, একটা গল্প প্রচলিত আছে ইন্টারনেটে।
এক ভদ্রমহিলা তাঁর ঘরে বসে পাশের বাড়ির বারান্দার দিকে তাকান আর বলেন, ‘ওরা যে কাপড়চোপড়গুলো রোদে শুকুতে দিয়েছে, সেসব তো পরিষ্কার হয়নি। ওদের উচিত ভালো সাবান ব্যবহার করা। তবে ওরা ভালো সাবান ব্যবহার করবে কী করে? ওদের তো দরজা-জানালা দেয়াল—সবই নোংরা।’
ভদ্রমহিলার স্বামী করলেন কি, তাদের ঘরের জানালার কাচটা বদলে একটা নতুন কাচ লাগিয়ে দিলেন।
আর পরের দিন ভদ্রমহিলা সেই ঘরে বসে স্বামীকে বললেন, ‘বাহ্, ওরা তো দেখি, দেয়াল রং করেছে আর ওদের কাপড়চোপড়গুলোও আজ খুব পরিষ্কার হয়েছে।’
এই গল্প থেকে আমরা কী শিক্ষা লাভ করলাম?
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর বহু কিছু নির্ভর করে। একই জিনিস কেউ ঘোলা চশমা দিয়ে দেখতে পারেন, কেউ রঙিন চশমা দিয়ে দেখতে পারেন। কেউ বা পারেন পরিষ্কার সাদা চোখে দেখতে। একেকজনের চোখে জিনিসটা একেক রকম লাগবে। আকিরা কুরোসাওয়ার ছবি রশোমন-এ একই ঘটনা সাতজন বলে। সাত রকমের বর্ণনা পাওয়া যায়। ওই ছবিটায় পর পর সাতটা ঘটনা দেখানো হয়।
অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, যে দেশে গণতন্ত্র ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। তাঁর চিন্তাটা এ রকম, দেশের কোনো অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিলে তা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবে, আর সরকারকে যেহেতু ভোট চাইতে জনগণের কাছে যেতে হবে, তাই তারা ওই খাদ্যাভাব মোকাবিলার জন্য তৎপর হবে, ফলে দুর্ভিক্ষ হবে না। তিনি সরল পণ্ডিত, তিনি জানেন না, পৃথিবীতে এমন গণতান্ত্রিক দেশ আছে, সেখানে যদি বলা হয়, অমুক অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে, তখন সরকার ব্যবস্থা নেয় বটে, তবে ব্যবস্থাটা হলো এই: তারা সংবাদ সম্মেলন ডেকে দাবি করে, সাংবাদিকতার নামে চলছে তথ্যসন্ত্রাস। উত্তরাঞ্চলে তো বটেই, দেশের কোথাও কোনো খাদ্যসংকট নেই। পত্রপত্রিকায় যা ছাপা হচ্ছে তা মিথ্যা, ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সরকারের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত একটা মহলের ষড়যন্ত্রের অংশমাত্র।
এমনকি পত্রপত্রিকায় যদি ক্ষমতাবানদের বা ক্ষমতাসীনদের প্রশংসা করে কোনো খবর বা কলাম ছাপা হয়, তখন তারা বলতে থাকবে, ‘ছাপবে না? ওষুধের এমন ডোজ দিয়েছি, ওষুধে কাজ না হয়ে যায়-ই না!’
আসলে চশমাই যদি হয় ঘোলা, সংবাদপত্রের লেখা তো ঝাপসা দেখা যাবেই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
ব্রেনের এমআরআই পরীক্ষাটা খুবই ভয়ংকর ধরনের জিনিস। এর আগের নির্বাচন কমিশনার আজিজ সাহেব বলেছিলেন, ‘আমার কোনো শত্রুকেও যেন জীবনে কোনো দিন এমআরআই করতে না হয়।’ ব্রেনের এমআরআই করতে গিয়ে আমারও একই উপলব্ধি হলো।
প্রথমে আপনাকে শোয়ানো হবে একটা উঁচু টেবিলে। তারপর আপনার মাথাটা কফিন-সদৃশ একটা চেম্বারে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। চোখ মেললে আপনি দেখবেন, আপনার মাথাটা যেন একটা অনড় হেলমেটের মধ্যে বন্দী। আপনার কানে দুটো রবারের প্যাড পরানো হয়েছে, যাতে শব্দ কানে কম যায়। কিন্তু ভয়ংকর শব্দ হতে থাকবে। নানা ধরনের শব্দ। আপনার হাতে একটা সুইচ দিয়ে বলা হবে, কোনো অসুবিধা হলে এটাতে চাপ দেবেন। বেল বেজে উঠবে।
আমার একটা ফোবিয়া আছে। আমি বদ্ধ জায়গায় ঢুকলে খুব ভয় পাই। যেমন—লিফটে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। এমআরআই করানোর জন্য আমার মাথাটা ওই বদ্ধ চেম্বারে ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে আমার কলজে শুকিয়ে এল। এমআরআই শুরু করার আগেই আমি বেলের সুইচে চাপ দিতে লাগলাম। ওঁরা ছুটে এলেন। আমি বললাম, ‘আমার কোনো অসুবিধা নাই। আমি দিব্যি সুস্থ আছি। আমার এমআরআই করা লাগবে না। যা টাকা বিল হয় আমি দিয়ে দেব।’ ওঁরা অভয় দিলেন। একজন কর্মী আমার হাত ধরে বললেন, ‘আমি আপনার হাত ধরে থাকি। আপনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন। মাত্র কুড়ি মিনিট।’
আমার জীবনের দীর্ঘতম ২০ মিনিট পার করলাম। ভিনি ভিডি ভিসি। আমি এলাম, শুয়ে থাকলাম, জয় করলাম। আমি এমআরআই করাতে সক্ষম হলাম।
রিপোর্ট পাওয়া গেল সঙ্গে সঙ্গেই। আমার মস্তিষ্ক চমৎকার আছে। কোনো সমস্যা নেই।
তাহলে?
আমি পড়া আরম্ভ করার পাঁচ মিনিট পর কেন আর পড়তে পারি না?
আমার এই সমস্যার সমাধান আমি নিজেই আবিষ্কার করে ফেলেছি। আমি খেয়াল করে দেখলাম, চশমা ছাড়া পড়তে পারি। চশমা দিয়ে পারি না। তখন আমি ‘ইউরেকা ইউরেকা’ বলে দৌড় ধরলাম। বাসার দ্বাররক্ষীরা জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার, কী হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘আমি আমার রোগের কারণ ধরতে পেরেছি।’
‘কী রোগ, স্যার?’
‘আছে আছে।’
আমি ডাক্তারের কাছে গেলাম। বললাম, ‘স্যার, আমার রোগের কারণ ধরতে পেরেছি।’
তিনি বললেন, ‘কী রকম?’
‘স্যার, আমার রোগের কারণ হলো গরম চা।’
‘মানে কী? গরম চা খেলে আপনার মাথা বিকল হয়ে পড়ে?’
‘জি না, স্যার। আমি ইয়া বড় মগে চা খাই। চা থাকে গরম। সকালবেলা চোখে চশমা দিয়ে চায়ের কাপে বার দুই চুমুক দিতেই চায়ের কাপ থেকে বাষ্প উঠে চশমার কাচ ঘোলা করে দেয়। এ কারণে আমি পাঁচ মিনিট পর আর পড়তে পারি না।’
আমার এই ঘটনা গল্প নয়, সত্যি।
তবে, একটা গল্প প্রচলিত আছে ইন্টারনেটে।
এক ভদ্রমহিলা তাঁর ঘরে বসে পাশের বাড়ির বারান্দার দিকে তাকান আর বলেন, ‘ওরা যে কাপড়চোপড়গুলো রোদে শুকুতে দিয়েছে, সেসব তো পরিষ্কার হয়নি। ওদের উচিত ভালো সাবান ব্যবহার করা। তবে ওরা ভালো সাবান ব্যবহার করবে কী করে? ওদের তো দরজা-জানালা দেয়াল—সবই নোংরা।’
ভদ্রমহিলার স্বামী করলেন কি, তাদের ঘরের জানালার কাচটা বদলে একটা নতুন কাচ লাগিয়ে দিলেন।
আর পরের দিন ভদ্রমহিলা সেই ঘরে বসে স্বামীকে বললেন, ‘বাহ্, ওরা তো দেখি, দেয়াল রং করেছে আর ওদের কাপড়চোপড়গুলোও আজ খুব পরিষ্কার হয়েছে।’
এই গল্প থেকে আমরা কী শিক্ষা লাভ করলাম?
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর বহু কিছু নির্ভর করে। একই জিনিস কেউ ঘোলা চশমা দিয়ে দেখতে পারেন, কেউ রঙিন চশমা দিয়ে দেখতে পারেন। কেউ বা পারেন পরিষ্কার সাদা চোখে দেখতে। একেকজনের চোখে জিনিসটা একেক রকম লাগবে। আকিরা কুরোসাওয়ার ছবি রশোমন-এ একই ঘটনা সাতজন বলে। সাত রকমের বর্ণনা পাওয়া যায়। ওই ছবিটায় পর পর সাতটা ঘটনা দেখানো হয়।
অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, যে দেশে গণতন্ত্র ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। তাঁর চিন্তাটা এ রকম, দেশের কোনো অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিলে তা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবে, আর সরকারকে যেহেতু ভোট চাইতে জনগণের কাছে যেতে হবে, তাই তারা ওই খাদ্যাভাব মোকাবিলার জন্য তৎপর হবে, ফলে দুর্ভিক্ষ হবে না। তিনি সরল পণ্ডিত, তিনি জানেন না, পৃথিবীতে এমন গণতান্ত্রিক দেশ আছে, সেখানে যদি বলা হয়, অমুক অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে, তখন সরকার ব্যবস্থা নেয় বটে, তবে ব্যবস্থাটা হলো এই: তারা সংবাদ সম্মেলন ডেকে দাবি করে, সাংবাদিকতার নামে চলছে তথ্যসন্ত্রাস। উত্তরাঞ্চলে তো বটেই, দেশের কোথাও কোনো খাদ্যসংকট নেই। পত্রপত্রিকায় যা ছাপা হচ্ছে তা মিথ্যা, ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সরকারের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত একটা মহলের ষড়যন্ত্রের অংশমাত্র।
এমনকি পত্রপত্রিকায় যদি ক্ষমতাবানদের বা ক্ষমতাসীনদের প্রশংসা করে কোনো খবর বা কলাম ছাপা হয়, তখন তারা বলতে থাকবে, ‘ছাপবে না? ওষুধের এমন ডোজ দিয়েছি, ওষুধে কাজ না হয়ে যায়-ই না!’
আসলে চশমাই যদি হয় ঘোলা, সংবাদপত্রের লেখা তো ঝাপসা দেখা যাবেই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments