সময়ের কথা-ঢাকার যে পরিচয় গর্বের নয় by অজয় দাশগুপ্ত
বাংলাদেশে এখন অন্তত ২৫ হাজার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যার প্রতিটিতে জমা আছে কোটি টাকার বেশি। ১০-১২ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল দুই হাজারের মতো। ধনবান লোকের সংখ্যা কী হারে বাড়ছে, এ থেকে তার ধারণা মেলে। এই ধনবানদের কারণেই ঢাকাকে দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে 'ধনবানদের শহর' বলা হচ্ছে।
এসব ধনবানের টাকা কামানোর অনেক উপায় জানা আছে। প্রকৃতপক্ষে, সরকার চলে তাদের কথায়। তারা যা চায়, সেটাই হয়। ইকনোমিস্ট বলছে, ঢাকা, দিলি্ল, করাচি, মুম্বাইয়ের মতো বড় বড় পরিচিত শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলক কম হওয়ার কারণে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করা সহজ
বিশ্বের যেসব বড় বড় শহরে থাকতে হলে অনেক অনেক টাকা (মানে ডলার, পাউন্ড, ইউরো আর কি!) দরকার হয়, তার একটা তালিকা দিয়েছে ইকনোমিক্স ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। দি ইকনোমিস্ট নামের বিখ্যাত পত্রিকাটির হয়েই তারা এ কাজ করেছে। একই সঙ্গে তারা ছেপেছে কয়েকটি দেশের বড় বড় শহরের নাম, যেখানে কম খরচে বসবাস করা যায়। আমাদের রাজধানী ঢাকা রয়েছে এই শেষের তালিকায়।
ঢাকা নিয়ে আমাদের অশেষ গৌরব। চারশ' বছরের প্রাচীন এই মহানগরেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। ২৫ মার্চ এখানেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করেছিল। এ শহরেই লে. জেনারেল নিয়াজি ১৬ ডিসেম্বর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
স্বাধীন দেশের রাজধানী এই শহরকে অভিহিত করা হয় মেগাসিটি হিসেবে। এক কোটির বেশি লোকের বসবাস এখানে। অনেকের হিসাবে এখানে দেড় কোটি লোক রয়েছে এবং প্রতিদিন তা বাড়ছে। বাংলাদেশের যেখান থেকেই যে আসতে চাইছে, ঢাকা কাউকে বিমুখ করে না, বরং বরণ করে নেয়। মাথা গোঁজার ঠাঁই দেয়, কোনো না কোনো কাজের ব্যবস্থাও হয়ে যায়।
এই ঢাকাকেই ইকনোমিস্ট স্বীকৃতি দিয়েছে কম ব্যয়ে বাঁচা যায়, এমন দশ শহরের তালিকায়। বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের জমিজমা কম, শিল্প ও কৃষিপণ্য উৎপাদন আহামরি কিছু নয়। সব ঘরে বিদ্যুৎ নেই। কিন্তু মানুষ অনেক অনেক বেশি। তাই মাথাপিছু ভাগ করা হলে পরিমাণ পড়ে খুব কম। এই দেশের রাজধানীকে কম ব্যয়ের রাজধানীর তালিকায় রাখা হলে দোষের কিছু নেই। আমাদের ঢাকার মতো এই তালিকায় আরও রয়েছে ভারতের মুম্বাই ও দিলি্ল, পাকিস্তানের করাচি, ইরানের তেহরান, সৌদি আরবের জেদ্দা এবং নেপালের কাঠমান্ডু।
কিন্তু তারপরও উদ্বেগ রয়েছে। যেভাবে তালিকাটি সাজানো হয়েছে, সেটাতে অনেকের দুশ্চিন্তা। আবার কেউ কেউ তাতে আনন্দও বোধ করতে পারেন।
বিষয়টিতে যাওয়ার আগে সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহরগুলোর তালিকা দেখা যাক। সবার শীর্ষে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ। তারপরে জাপানের টোকিও, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা, জাপানের ওসাকা কোবে, ফ্রান্সের প্যারিস। ব্যয়ের হিসাব কষতে গিয়ে কিছু পণ্যের দামের তুলনা করা হয়েছে। যেমন_ এক কেজি পাউরুটি কিনতে জুরিখে এখন ব্যয় করতে হয় ৬.১৫ ডলার। বাংলাদেশের টাকায় মোটামুটি ৫০০ টাকা। যাবেন নাকি জুরিখে থাকার জন্য?
এক বছর আগে সেখানে ৫.১০ ডলারেই মিলত এক কেজি রুটি। পাঁচ বছর আগে এ জন্য খরচ করতে হতো চার ডলারেরও কম_ ৩০০ টাকার মতো। এই জুরিখ শহরেই এখন এক কেজি চাল কিনতে ব্যয় করতে হবে ৫ ডলার ৩৮ সেন্ট (৪৪০ টাকার মতো)।
জাপানের টোকিওতে এক কেজি পাউরুটির দাম আরও বেশি_ ৭.৯৬ ডলার_ সাড়ে ছয়শ' টাকারও বেশি। পাঁচ বছর আগে দাম ছিল পাঁচ ডলার বা ৪২০ টাকা। কিন্তু দিলি্লতে এই পরিমাণ রুটি কিনতে পাবেন ৭৬ সেন্ট খরচ করেই_ অর্থাৎ ৬০-৬২ টাকা।
অর্থনীতির হিসাব বলছে, আয় বেশি হলে ব্যয় করতে সমস্যা নেই। কেন আয় বেশি হলেই বেশি দাম দিয়ে জিনিস কিনতে হবে, এত জটিলতায় গিয়ে কাজ নেই। আমরা বরং ঢাকার কথাতে আসি। ইকনোমিক্স বলছে, ঢাকায় থাকা-খাওয়া, যাতায়াত ও শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনে যা ব্যয় হয়, তার চেয়ে কম ব্যয় হয় ভারতের দিলি্ল ও মুম্বাই এবং পাকিস্তানের করাচিতে। ভারত ও পাকিস্তানের অর্থনীতি বাংলাদেশের তুলনায় শক্তিশালী। সঙ্গত কারণেই তাদের গুরুত্বপূর্ণ শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের ঢাকা মুম্বাই, দিলি্ল এবং করাচির চেয়ে কেন ব্যয়বহুল? এ শহরের অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ লোক খুব গরিব। তারা থাকে বস্তিতে। পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা সেখানে নেই। তাদের ঘরে খাট-পালং থাকার প্রশ্ন আসে না। ভালো স্কুলে তারা পড়ে না। দামি পোশাক তাদের গায়ে চাপে না। এর অর্থ হচ্ছে, তাদের কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বড় অঙ্কের হয় না।
মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীই ঢাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা সরকারি-বেসরকারি অফিসে প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে। তাদের আয় সীমিত, খরচের স্বপ্ন অসীম। আরাম-আয়েশের সবকিছু তারা পেতে চায়। সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়াতে চায়। বিনোদনের সব উপকরণ উপভোগ করতে চায়। নিজের গাড়িতে চাপতে চায়। ভালো বাড়িতে ভাড়া থাকতে চায়। নিজের জন্য একটি বাড়ি চায়। কিন্তু সব কিছুতে প্রধান বাধা সীমিত আয়। তাদের কারণেও ঢাকার জীবনযাত্রার ব্যয় দিলি্ল-মুম্বাই-করাচির চেয়ে বেশি হওয়ার কথা নয়। তাদের বেশি ব্যয় করার স্বপ্ন আছে, কিন্তু সামর্থ্য নেই।
প্রকৃতপক্ষে ঢাকাকে কেন্দ্র করে যে ধনবান শ্রেণী গড়ে উঠছে, তাদের কারণেই এ অবস্থা। এখানে ব্যাংক করার জন্য আগ্রহী লোকের অভাব নেই। আরেক দল চায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনে বিনিয়োগ করতে। একদল ফাস্টফুড ও অন্যান্য খাবারের দোকান দিচ্ছে তো, অন্যদল গড়ে তুলছে ক্লিনিক। জন্মদিনের একটি ছোট কেক কিনতে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা ব্যয় করার জন্য অনেক অনেক পরিবার পাওয়া যাবে। রাজধানীতে অন্তত দেড় লাখ প্রাইভেট গাড়ি চলছে, এমন হিসাব দিচ্ছে সরকার। এমপি-মন্ত্রীরা কোটি টাকা দামের গাড়ি হাঁকান। অনেক পরিবার রয়েছে, যাদের বিয়ের বাজার হয় দেশের বাইরে। গুলশান-বনানী-বারিধারায় মাসে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা ভাড়া দিয়ে থাকেন, এমন অনেক লোক রয়েছেন। এসব বাড়িতে যে আসবাবপত্র ব্যবহার হয়, তার দাম কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত এক বছরে এসব এলাকায় বাড়ি ভাড়া দেড়-দুই গুণ বেড়েছে। কিন্তু তাতেও ভাড়াটে পেতে সমস্যা হয় না। এসব বাড়ির ঘরে ঘরে এয়ারকন্ডিশনড মেশিন। ২০-২৫ ধরনের সরঞ্জাম তারা ব্যবহার করে, যা চলে বিদ্যুতে। তাদের জন্য ওয়াসার পানি ব্যবহার হয় প্রচুর। এ পানি দিয়ে তারা ফুল বাগান করে, দামি গাড়ি ধোয়ামোছা করে। অথচ বস্তির বাসিন্দাদের পানি দিতে পারে না ওয়াসা।
ঢাকায় এখন এমন কয়েকটি স্কুল রয়েছে, যেখানে মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা বেতন নিয়েও ছাত্রছাত্রী পেতে সমস্যা হয় না। ধানমণ্ডি-গুলশান-বনানীর স্কুলগুলোতে সরকার বিআরটিসির বাস দিতে চেয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট কারের ব্যবহার কমিয়ে দেয়। কিন্তু এ পরিকল্পনা সফল হয়নি। তার একটি কারণ, গাড়ির মালিকরা পাবলিক বাসে সন্তানদের পাঠাতে আগ্রহী নন।
ঢাকায় এখন ক্লিনিকের ছড়াছড়ি। কঠিন রোগে পড়ে এগুলোতে মধ্যবিত্ত কেউ ভর্তি হতে বাধ্য হলে সব সঞ্চয় ৫-৭ দিনেই শেষ হয়ে যাবে। তারপরও এগুলোতে রোগীর অভাব হয় না।
বাংলাদেশে এখন অন্তত ২৫ হাজার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যার প্রতিটিতে জমা আছে কোটি টাকার বেশি। ১০-১২ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল দুই হাজারের মতো। ধনবান লোকের সংখ্যা কী হারে বাড়ছে, এ থেকে তার ধারণা মেলে। এই ধনবানদের কারণেই ঢাকাকে দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে 'ধনবানদের শহর' বলা হচ্ছে। এসব ধনবানের টাকা কামানোর অনেক উপায় জানা আছে। প্রকৃতপক্ষে, সরকার চলে তাদের কথায়। তারা যা চায়, সেটাই হয়।
ইকনোমিস্ট বলছে, ঢাকা, দিলি্ল, করাচি, মুম্বাইয়ের মতো বড় বড় পরিচিত শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলক কম হওয়ার কারণে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করা সহজ। কম ব্যয়ের কারণে শ্রমিক ও কর্মী মেলে তুলনামূলক সস্তায়। দরিদ্র দেশ হয়েও আয় বাড়িয়ে চলার এটা হয়তো সুবিধা। কিন্তু আমরা তো জানি, আধুনিক শহরের সুবিধা ঢাকার তুলনায় দিলি্ল-মুম্বাইয়ে ঢের ঢের বেশি। তারপরও ঢাকায় কেন জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি, সেটা উদ্বেগের কারণ। এমন তো হতে পারে যে, ইকনোমিস্টের হিসাব দেখে ইউরোপ-আমেরিকার বিনিয়োগকারীরা ঢাকার চেয়ে দিলি্ল-করাচি-মুম্বাইকে বেছে নিতে অগ্রাধিকার দিতে পারে।
এসব ইস্যু আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। যেমন উপেক্ষা করা চলে না ধনী ও গরিবের সম্পদের ব্যবধান ক্রমে বেড়ে যাওয়া। সমাজে একদল লোক ধনী থাকবে, তাদের সম্পদ বাড়বে এবং তারা বিনিয়োগ করে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে, সেখানে অনেক মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু একই সঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্য দ্রুত গতিতে বদলাতে হবে। তাদের আয় অনেক বাড়াতে হবে। তারা যে সম্পদ সৃষ্টি করছে তার একটি অংশে হক রয়েছে তাদেরও। একজন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকের মাসে যা আয়, তা কোনোভাবেই তার প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কর্মীর মাসের মোট বেতনের চেয়ে বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও সেটাই যে ঘটছে। কিন্তু এই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য অবদানের হিসাব যদি নেই, তাহলে অবশ্যই দেখব সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। গরিবরাই যে বেশি প্রাণ দিয়েছে!
আমরা দেশটাকে বদলাতে চাই। সবচেয়ে কম ব্যয়ের শহরের তালিকায় থাকা কোনো গর্বের ব্যাপার নয়। আমরা বেশি ব্যয়ের তালিকায় উঠে যেতে চাই। কিন্তু ইকনোমিস্টের তালিকায় যেভাবে আমাদের স্থান হয়েছে সেটাও কাম্য নয়।
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
বিশ্বের যেসব বড় বড় শহরে থাকতে হলে অনেক অনেক টাকা (মানে ডলার, পাউন্ড, ইউরো আর কি!) দরকার হয়, তার একটা তালিকা দিয়েছে ইকনোমিক্স ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। দি ইকনোমিস্ট নামের বিখ্যাত পত্রিকাটির হয়েই তারা এ কাজ করেছে। একই সঙ্গে তারা ছেপেছে কয়েকটি দেশের বড় বড় শহরের নাম, যেখানে কম খরচে বসবাস করা যায়। আমাদের রাজধানী ঢাকা রয়েছে এই শেষের তালিকায়।
ঢাকা নিয়ে আমাদের অশেষ গৌরব। চারশ' বছরের প্রাচীন এই মহানগরেই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। ২৫ মার্চ এখানেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করেছিল। এ শহরেই লে. জেনারেল নিয়াজি ১৬ ডিসেম্বর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
স্বাধীন দেশের রাজধানী এই শহরকে অভিহিত করা হয় মেগাসিটি হিসেবে। এক কোটির বেশি লোকের বসবাস এখানে। অনেকের হিসাবে এখানে দেড় কোটি লোক রয়েছে এবং প্রতিদিন তা বাড়ছে। বাংলাদেশের যেখান থেকেই যে আসতে চাইছে, ঢাকা কাউকে বিমুখ করে না, বরং বরণ করে নেয়। মাথা গোঁজার ঠাঁই দেয়, কোনো না কোনো কাজের ব্যবস্থাও হয়ে যায়।
এই ঢাকাকেই ইকনোমিস্ট স্বীকৃতি দিয়েছে কম ব্যয়ে বাঁচা যায়, এমন দশ শহরের তালিকায়। বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের জমিজমা কম, শিল্প ও কৃষিপণ্য উৎপাদন আহামরি কিছু নয়। সব ঘরে বিদ্যুৎ নেই। কিন্তু মানুষ অনেক অনেক বেশি। তাই মাথাপিছু ভাগ করা হলে পরিমাণ পড়ে খুব কম। এই দেশের রাজধানীকে কম ব্যয়ের রাজধানীর তালিকায় রাখা হলে দোষের কিছু নেই। আমাদের ঢাকার মতো এই তালিকায় আরও রয়েছে ভারতের মুম্বাই ও দিলি্ল, পাকিস্তানের করাচি, ইরানের তেহরান, সৌদি আরবের জেদ্দা এবং নেপালের কাঠমান্ডু।
কিন্তু তারপরও উদ্বেগ রয়েছে। যেভাবে তালিকাটি সাজানো হয়েছে, সেটাতে অনেকের দুশ্চিন্তা। আবার কেউ কেউ তাতে আনন্দও বোধ করতে পারেন।
বিষয়টিতে যাওয়ার আগে সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহরগুলোর তালিকা দেখা যাক। সবার শীর্ষে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ। তারপরে জাপানের টোকিও, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা, জাপানের ওসাকা কোবে, ফ্রান্সের প্যারিস। ব্যয়ের হিসাব কষতে গিয়ে কিছু পণ্যের দামের তুলনা করা হয়েছে। যেমন_ এক কেজি পাউরুটি কিনতে জুরিখে এখন ব্যয় করতে হয় ৬.১৫ ডলার। বাংলাদেশের টাকায় মোটামুটি ৫০০ টাকা। যাবেন নাকি জুরিখে থাকার জন্য?
এক বছর আগে সেখানে ৫.১০ ডলারেই মিলত এক কেজি রুটি। পাঁচ বছর আগে এ জন্য খরচ করতে হতো চার ডলারেরও কম_ ৩০০ টাকার মতো। এই জুরিখ শহরেই এখন এক কেজি চাল কিনতে ব্যয় করতে হবে ৫ ডলার ৩৮ সেন্ট (৪৪০ টাকার মতো)।
জাপানের টোকিওতে এক কেজি পাউরুটির দাম আরও বেশি_ ৭.৯৬ ডলার_ সাড়ে ছয়শ' টাকারও বেশি। পাঁচ বছর আগে দাম ছিল পাঁচ ডলার বা ৪২০ টাকা। কিন্তু দিলি্লতে এই পরিমাণ রুটি কিনতে পাবেন ৭৬ সেন্ট খরচ করেই_ অর্থাৎ ৬০-৬২ টাকা।
অর্থনীতির হিসাব বলছে, আয় বেশি হলে ব্যয় করতে সমস্যা নেই। কেন আয় বেশি হলেই বেশি দাম দিয়ে জিনিস কিনতে হবে, এত জটিলতায় গিয়ে কাজ নেই। আমরা বরং ঢাকার কথাতে আসি। ইকনোমিক্স বলছে, ঢাকায় থাকা-খাওয়া, যাতায়াত ও শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনে যা ব্যয় হয়, তার চেয়ে কম ব্যয় হয় ভারতের দিলি্ল ও মুম্বাই এবং পাকিস্তানের করাচিতে। ভারত ও পাকিস্তানের অর্থনীতি বাংলাদেশের তুলনায় শক্তিশালী। সঙ্গত কারণেই তাদের গুরুত্বপূর্ণ শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের ঢাকা মুম্বাই, দিলি্ল এবং করাচির চেয়ে কেন ব্যয়বহুল? এ শহরের অন্তত তিন ভাগের এক ভাগ লোক খুব গরিব। তারা থাকে বস্তিতে। পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা সেখানে নেই। তাদের ঘরে খাট-পালং থাকার প্রশ্ন আসে না। ভালো স্কুলে তারা পড়ে না। দামি পোশাক তাদের গায়ে চাপে না। এর অর্থ হচ্ছে, তাদের কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বড় অঙ্কের হয় না।
মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীই ঢাকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা সরকারি-বেসরকারি অফিসে প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করে। তাদের আয় সীমিত, খরচের স্বপ্ন অসীম। আরাম-আয়েশের সবকিছু তারা পেতে চায়। সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়াতে চায়। বিনোদনের সব উপকরণ উপভোগ করতে চায়। নিজের গাড়িতে চাপতে চায়। ভালো বাড়িতে ভাড়া থাকতে চায়। নিজের জন্য একটি বাড়ি চায়। কিন্তু সব কিছুতে প্রধান বাধা সীমিত আয়। তাদের কারণেও ঢাকার জীবনযাত্রার ব্যয় দিলি্ল-মুম্বাই-করাচির চেয়ে বেশি হওয়ার কথা নয়। তাদের বেশি ব্যয় করার স্বপ্ন আছে, কিন্তু সামর্থ্য নেই।
প্রকৃতপক্ষে ঢাকাকে কেন্দ্র করে যে ধনবান শ্রেণী গড়ে উঠছে, তাদের কারণেই এ অবস্থা। এখানে ব্যাংক করার জন্য আগ্রহী লোকের অভাব নেই। আরেক দল চায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনে বিনিয়োগ করতে। একদল ফাস্টফুড ও অন্যান্য খাবারের দোকান দিচ্ছে তো, অন্যদল গড়ে তুলছে ক্লিনিক। জন্মদিনের একটি ছোট কেক কিনতে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা ব্যয় করার জন্য অনেক অনেক পরিবার পাওয়া যাবে। রাজধানীতে অন্তত দেড় লাখ প্রাইভেট গাড়ি চলছে, এমন হিসাব দিচ্ছে সরকার। এমপি-মন্ত্রীরা কোটি টাকা দামের গাড়ি হাঁকান। অনেক পরিবার রয়েছে, যাদের বিয়ের বাজার হয় দেশের বাইরে। গুলশান-বনানী-বারিধারায় মাসে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা ভাড়া দিয়ে থাকেন, এমন অনেক লোক রয়েছেন। এসব বাড়িতে যে আসবাবপত্র ব্যবহার হয়, তার দাম কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত এক বছরে এসব এলাকায় বাড়ি ভাড়া দেড়-দুই গুণ বেড়েছে। কিন্তু তাতেও ভাড়াটে পেতে সমস্যা হয় না। এসব বাড়ির ঘরে ঘরে এয়ারকন্ডিশনড মেশিন। ২০-২৫ ধরনের সরঞ্জাম তারা ব্যবহার করে, যা চলে বিদ্যুতে। তাদের জন্য ওয়াসার পানি ব্যবহার হয় প্রচুর। এ পানি দিয়ে তারা ফুল বাগান করে, দামি গাড়ি ধোয়ামোছা করে। অথচ বস্তির বাসিন্দাদের পানি দিতে পারে না ওয়াসা।
ঢাকায় এখন এমন কয়েকটি স্কুল রয়েছে, যেখানে মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা বেতন নিয়েও ছাত্রছাত্রী পেতে সমস্যা হয় না। ধানমণ্ডি-গুলশান-বনানীর স্কুলগুলোতে সরকার বিআরটিসির বাস দিতে চেয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট কারের ব্যবহার কমিয়ে দেয়। কিন্তু এ পরিকল্পনা সফল হয়নি। তার একটি কারণ, গাড়ির মালিকরা পাবলিক বাসে সন্তানদের পাঠাতে আগ্রহী নন।
ঢাকায় এখন ক্লিনিকের ছড়াছড়ি। কঠিন রোগে পড়ে এগুলোতে মধ্যবিত্ত কেউ ভর্তি হতে বাধ্য হলে সব সঞ্চয় ৫-৭ দিনেই শেষ হয়ে যাবে। তারপরও এগুলোতে রোগীর অভাব হয় না।
বাংলাদেশে এখন অন্তত ২৫ হাজার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যার প্রতিটিতে জমা আছে কোটি টাকার বেশি। ১০-১২ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল দুই হাজারের মতো। ধনবান লোকের সংখ্যা কী হারে বাড়ছে, এ থেকে তার ধারণা মেলে। এই ধনবানদের কারণেই ঢাকাকে দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে 'ধনবানদের শহর' বলা হচ্ছে। এসব ধনবানের টাকা কামানোর অনেক উপায় জানা আছে। প্রকৃতপক্ষে, সরকার চলে তাদের কথায়। তারা যা চায়, সেটাই হয়।
ইকনোমিস্ট বলছে, ঢাকা, দিলি্ল, করাচি, মুম্বাইয়ের মতো বড় বড় পরিচিত শহরে জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলক কম হওয়ার কারণে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট করা সহজ। কম ব্যয়ের কারণে শ্রমিক ও কর্মী মেলে তুলনামূলক সস্তায়। দরিদ্র দেশ হয়েও আয় বাড়িয়ে চলার এটা হয়তো সুবিধা। কিন্তু আমরা তো জানি, আধুনিক শহরের সুবিধা ঢাকার তুলনায় দিলি্ল-মুম্বাইয়ে ঢের ঢের বেশি। তারপরও ঢাকায় কেন জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি, সেটা উদ্বেগের কারণ। এমন তো হতে পারে যে, ইকনোমিস্টের হিসাব দেখে ইউরোপ-আমেরিকার বিনিয়োগকারীরা ঢাকার চেয়ে দিলি্ল-করাচি-মুম্বাইকে বেছে নিতে অগ্রাধিকার দিতে পারে।
এসব ইস্যু আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। যেমন উপেক্ষা করা চলে না ধনী ও গরিবের সম্পদের ব্যবধান ক্রমে বেড়ে যাওয়া। সমাজে একদল লোক ধনী থাকবে, তাদের সম্পদ বাড়বে এবং তারা বিনিয়োগ করে যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে, সেখানে অনেক মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু একই সঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্য দ্রুত গতিতে বদলাতে হবে। তাদের আয় অনেক বাড়াতে হবে। তারা যে সম্পদ সৃষ্টি করছে তার একটি অংশে হক রয়েছে তাদেরও। একজন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকের মাসে যা আয়, তা কোনোভাবেই তার প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কর্মীর মাসের মোট বেতনের চেয়ে বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও সেটাই যে ঘটছে। কিন্তু এই স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য অবদানের হিসাব যদি নেই, তাহলে অবশ্যই দেখব সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। গরিবরাই যে বেশি প্রাণ দিয়েছে!
আমরা দেশটাকে বদলাতে চাই। সবচেয়ে কম ব্যয়ের শহরের তালিকায় থাকা কোনো গর্বের ব্যাপার নয়। আমরা বেশি ব্যয়ের তালিকায় উঠে যেতে চাই। কিন্তু ইকনোমিস্টের তালিকায় যেভাবে আমাদের স্থান হয়েছে সেটাও কাম্য নয়।
অজয় দাশগুপ্ত : সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments