গণতন্ত্র-দুই মেয়াদে সীমিত সরকারপ্রধান হোক by কাজী জহিরুল ইসলাম
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আগামী দুটি সংসদ নির্বাচনের পর বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ, এই পদ্ধতি সংসদের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখন কথা হলো, মানুষের জন্য আইন, না আইনের জন্য মানুষ? অতি পুরোনো কথা, তার পরও মাঝেমধ্যে এই পুরোনো কথা আমাদের মনে মনে আওড়াতে হয়।
অবশ্যই মানুষের জন্য আইন। আমাদের সবার নিশ্চয়ই মনে আছে, কী পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করতে হয়েছিল। এই ব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো এযাবৎকালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। ফখরুদ্দীন আহমদের দুই বছরের সরকার ছাড়া আর কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামল নিয়ে কোনো কথাও ওঠেনি।
তিন মাস আয়ুষ্কালের এই সরকারের মূল দায়িত্ব হলো জাতিকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন উপহার দেওয়া। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে যে নিরপেক্ষ নির্বাচন বাংলাদেশে হয় না, তার প্রমাণ আমরা অতীতে অনেক পেয়েছি। নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার কথা বলা হচ্ছে। বিচার বিভাগ স্বাধীন করে কি কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে? নির্বাচন কমিশনও রাজনৈতিক সরকারের অধীনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না। কাজেই স্বাধীন বা অধিক ক্ষমতাধর নির্বাচন কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হিসেবে অন্তত খুব নিকট ভবিষ্যতে কাজ করতে পারবে না বলেমনে হয় না।
আমরা যদি আরও কিছুটা সভ্য-ভব্য হই, সহনশীলতা বাড়ে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে, সর্বোপরি নিজের চেয়ে দেশকে বেশি ভালোবেশে নির্লোভ ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে পারি, তখন হয়তো চিন্তা করা যেতে পারে। আমরা লঙ্কায় গেলেই রাবণ হয়ে যাই। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার নানা আয়োজন করতে থাকি। এর প্রমাণ বহুবার দিয়েছি।
ফখরুদ্দীন আহমদ নির্ধারিত নিয়মের হাত ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হননি। তিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিও ছিলেন না। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে জাতিকে এই সরকার গঠন এবং তা মেনে নিতে হয়েছিল। আমরা সবাই জানি, সেই বিশেষ পরিস্থিতিটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুব সুখকর ছিল না। তবে সেই সময়ে প্রকাশ্যে যে জাতির ঘাড়ে সেনাশাসনের খড়্গ নেমে আসেনি, এ জন্য শুকরিয়া আদায় করা উচিত। দেশের ভেতর তখন নানা রকমের রাজনৈতিক ফর্মুলা, ধরপাকড় চলছিল। অনেকে নাজেহালও হয়েছেন। তবে সেই পরিস্থিতিতে যদি ফখরুদ্দীনের সরকার না এসে সরাসরি মইন উ আহমেদের সরকার ক্ষমতায় আসত, তাহলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক খারাপ হয়ে যেত। আমরা আশঙ্কা করছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দিলে জাতি বারবার এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।
নিয়ম করে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার বিষয়টি নিয়েও এখন অনেক মহল থেকে আপত্তি উঠেছে। আমাদের রাজনীতিবিদদের অসহিষ্ণু এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব থেকেই এ রকম বিধান করার প্রয়োজন হয়েছিল। এখন কি আমরা সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি? আমরা কি নিশ্চিত যে সব দল মিলে সমঝোতায় এসে একজন মানুষ খুঁজে বের করতে পারব? ভয় হয়, আবার না ঝগড়া লেগে যায়, আর সেই ঝগড়া মেটাতে তৃতীয় পক্ষকে আসতে হয়।
সংবিধান সংশোধনের জন্য জাতি এখন মুখিয়ে আছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন এবার হবে বলে অনেকের মতো আমিও আশাবাদী। সেই সংশোধিত সংবিধান নিশ্চয়ই আমাদের জাতীয় জীবনে গতি আনবে, আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে, আমাদের রাজনীতি নির্মোহ হবে, আমরা জাতি হিসেবে একধাপ উঁচুতে উঠে যাব। এ বিষয়ে গঠিত কমিটি বিভিন্ন মহলের মতামত নিচ্ছে, এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। যদিও দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদের ভোটে সংবিধান সংশোধন করার বিধান রয়েছে। এ রকম বড় আয়োজনের সঙ্গে সরাসরি জনগণকে সম্পৃক্ত করাই সমীচীন হবে, অর্থাৎ গণভোটে নিষ্পত্তি হওয়াই উত্তম। এর আগে চূড়ান্ত খসড়াটি সব জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ করা হোক, যাতে জনগণ জানতে পারে যে কী কী সংযোজন-বিয়োজন হচ্ছে।
সংবিধান সংশোধনের এই ব্যাপক আয়োজনের সময় একটি প্রস্তাব রাখতে চাই। সরকারের মেয়াদকাল পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছরে আনা হোক, আর কোনো ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি সরকারপ্রধান না থাকার বিধান করা হোক। এতে করে রাজনীতিতে গতি আসবে, নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবে। কেউ যখন জানবে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার উপায় নেই, তখন বৈধ-অবৈধ উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার ফন্দিফিকিরও কমে যাবে। একজন মানুষ যতবার খুশি সরকারপ্রধান হিসেবে শপথ নেওয়ার বিধান থাকলে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারও (আরও সুনির্দিষ্টভাবে সরকারপ্রধান) ক্রমশ স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ করতে শুরু করে।
কেউ কেউ হয়তো ভারতের উদাহরণ দেবেন। ভারতের গণতন্ত্রকে বাংলাদেশে না টেনে আনাই ভালো। সম্প্রতি খবরে দেখলাম, ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক ও সোনিয়া গান্ধীর ছেলে রাহুল গান্ধীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তিনি কৃষকদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ভাবুন তো, বাংলাদেশে এ রকম ঘটনা কি সম্ভব? কাজেই ভারতের সঙ্গে না মেলানোই ভালো। আমরা যদি শিগগিরই দুই মেয়াদে সীমিত সরকারপ্রধানের বিধান প্রবর্তন না করি, তাহলে গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ কমে যাবে। ক্ষমতার জন্য নেতানেত্রীরাও মরিয়া হয়ে উঠবেন না। মানুষ অচিরেই ফুঁসে উঠবে, তখন তিউনিসিয়া বা মিসরের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
কাজী জহিরুল ইসলাম: প্রবাসী লেখক।
তিন মাস আয়ুষ্কালের এই সরকারের মূল দায়িত্ব হলো জাতিকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন উপহার দেওয়া। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে যে নিরপেক্ষ নির্বাচন বাংলাদেশে হয় না, তার প্রমাণ আমরা অতীতে অনেক পেয়েছি। নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার কথা বলা হচ্ছে। বিচার বিভাগ স্বাধীন করে কি কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে? নির্বাচন কমিশনও রাজনৈতিক সরকারের অধীনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না। কাজেই স্বাধীন বা অধিক ক্ষমতাধর নির্বাচন কমিশন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হিসেবে অন্তত খুব নিকট ভবিষ্যতে কাজ করতে পারবে না বলেমনে হয় না।
আমরা যদি আরও কিছুটা সভ্য-ভব্য হই, সহনশীলতা বাড়ে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে, সর্বোপরি নিজের চেয়ে দেশকে বেশি ভালোবেশে নির্লোভ ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে পারি, তখন হয়তো চিন্তা করা যেতে পারে। আমরা লঙ্কায় গেলেই রাবণ হয়ে যাই। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার নানা আয়োজন করতে থাকি। এর প্রমাণ বহুবার দিয়েছি।
ফখরুদ্দীন আহমদ নির্ধারিত নিয়মের হাত ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হননি। তিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিও ছিলেন না। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে জাতিকে এই সরকার গঠন এবং তা মেনে নিতে হয়েছিল। আমরা সবাই জানি, সেই বিশেষ পরিস্থিতিটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য খুব সুখকর ছিল না। তবে সেই সময়ে প্রকাশ্যে যে জাতির ঘাড়ে সেনাশাসনের খড়্গ নেমে আসেনি, এ জন্য শুকরিয়া আদায় করা উচিত। দেশের ভেতর তখন নানা রকমের রাজনৈতিক ফর্মুলা, ধরপাকড় চলছিল। অনেকে নাজেহালও হয়েছেন। তবে সেই পরিস্থিতিতে যদি ফখরুদ্দীনের সরকার না এসে সরাসরি মইন উ আহমেদের সরকার ক্ষমতায় আসত, তাহলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক খারাপ হয়ে যেত। আমরা আশঙ্কা করছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দিলে জাতি বারবার এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।
নিয়ম করে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার বিষয়টি নিয়েও এখন অনেক মহল থেকে আপত্তি উঠেছে। আমাদের রাজনীতিবিদদের অসহিষ্ণু এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাব থেকেই এ রকম বিধান করার প্রয়োজন হয়েছিল। এখন কি আমরা সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি? আমরা কি নিশ্চিত যে সব দল মিলে সমঝোতায় এসে একজন মানুষ খুঁজে বের করতে পারব? ভয় হয়, আবার না ঝগড়া লেগে যায়, আর সেই ঝগড়া মেটাতে তৃতীয় পক্ষকে আসতে হয়।
সংবিধান সংশোধনের জন্য জাতি এখন মুখিয়ে আছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন এবার হবে বলে অনেকের মতো আমিও আশাবাদী। সেই সংশোধিত সংবিধান নিশ্চয়ই আমাদের জাতীয় জীবনে গতি আনবে, আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে, আমাদের রাজনীতি নির্মোহ হবে, আমরা জাতি হিসেবে একধাপ উঁচুতে উঠে যাব। এ বিষয়ে গঠিত কমিটি বিভিন্ন মহলের মতামত নিচ্ছে, এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। যদিও দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদের ভোটে সংবিধান সংশোধন করার বিধান রয়েছে। এ রকম বড় আয়োজনের সঙ্গে সরাসরি জনগণকে সম্পৃক্ত করাই সমীচীন হবে, অর্থাৎ গণভোটে নিষ্পত্তি হওয়াই উত্তম। এর আগে চূড়ান্ত খসড়াটি সব জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ করা হোক, যাতে জনগণ জানতে পারে যে কী কী সংযোজন-বিয়োজন হচ্ছে।
সংবিধান সংশোধনের এই ব্যাপক আয়োজনের সময় একটি প্রস্তাব রাখতে চাই। সরকারের মেয়াদকাল পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছরে আনা হোক, আর কোনো ব্যক্তির দুই মেয়াদের বেশি সরকারপ্রধান না থাকার বিধান করা হোক। এতে করে রাজনীতিতে গতি আসবে, নতুন নেতৃত্ব তৈরি হবে। কেউ যখন জানবে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার উপায় নেই, তখন বৈধ-অবৈধ উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার ফন্দিফিকিরও কমে যাবে। একজন মানুষ যতবার খুশি সরকারপ্রধান হিসেবে শপথ নেওয়ার বিধান থাকলে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারও (আরও সুনির্দিষ্টভাবে সরকারপ্রধান) ক্রমশ স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ করতে শুরু করে।
কেউ কেউ হয়তো ভারতের উদাহরণ দেবেন। ভারতের গণতন্ত্রকে বাংলাদেশে না টেনে আনাই ভালো। সম্প্রতি খবরে দেখলাম, ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক ও সোনিয়া গান্ধীর ছেলে রাহুল গান্ধীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তিনি কৃষকদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ভাবুন তো, বাংলাদেশে এ রকম ঘটনা কি সম্ভব? কাজেই ভারতের সঙ্গে না মেলানোই ভালো। আমরা যদি শিগগিরই দুই মেয়াদে সীমিত সরকারপ্রধানের বিধান প্রবর্তন না করি, তাহলে গণতন্ত্রের মোড়কে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ কমে যাবে। ক্ষমতার জন্য নেতানেত্রীরাও মরিয়া হয়ে উঠবেন না। মানুষ অচিরেই ফুঁসে উঠবে, তখন তিউনিসিয়া বা মিসরের মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
কাজী জহিরুল ইসলাম: প্রবাসী লেখক।
No comments