চলতি পথে-মিশ্রিপাড়া সীমা ঘর by দীপংকর চন্দ
মেঘের সামান্যতম প্রতিবন্ধকতা নেই আকাশে। স্বেচ্ছাচারী, দুর্বিনীত রোদের নির্বাধ রাজত্ব উপকূলীয় এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রান্তরজুড়ে। স্বভাবতই ভীষণ গরম আজ। একটু পরপরই ঘেমে-নেয়ে উঠছি আমরা। তবু হাঁটছি সামনে। আশপাশের বৃক্ষরাজির চকচকে পত্রপল্লব, দিগন্তরেখা স্পর্শ করা ধানখেতের সজীবতা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য
দাতা সংস্থা নির্মিত নতুন টিনের ঘরের চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য উপেক্ষা করে এগোচ্ছি অনতিদূরের একটি ছোট্ট বাজার অভিমুখে। সেখানে ঘর্মক্লান্ত শরীর জুড়ানোর বন্দোবস্ত হবে নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই সৃষ্টি হবে তৃষ্ণা নিবারণের সুযোগ! হ্যাঁ, হলোও তাই। অল্প কয়েকটি দোকানে সাজানো বাজারটির এক কোণে একটি আমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে প্রথমে শরীর জুড়ালাম আমরা। তারপর জলপান-পর্ব। অতিসাধারণ এই পর্বটি শেষ হতে না-হতেই সুঠামদেহী একজন রাখাইন যুবকের আগমন ঘটল গাছতলায়। আমরা কৌতূহল বোধ করলাম। বাঙালি ও আদিবাসী রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যকার সংকোচের সামাজিক দেয়াল অতিক্রম করে জানতে চাইলাম যুবকের নাম। প্রশ্নের আকস্মিকতায় খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলেও দ্রুত সামলে নিলেন রাখাইন যুবক। আলাপচারিতার শুরুতেই হাসিমুখে বললেন, ‘আমার নাম মং চো মেন।’
কলাপাড়া মোজাহারউদ্দিন ডিগ্রি কলেজে মানবিক শাখায় অধ্যয়নরত মং চো মেন থাকেন বাজারসংলগ্ন রাখাইনপাড়ায়। রাখাইন ভাষায় পাড়াটির নাম ‘ক্রাসেকুন রোয়া’। কিন্তু বাঙালিদের কাছে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের এই পাড়াটির পরিচয় ‘মিশ্রিপাড়া’ হিসেবে। মিশ্রিপাড়ায় রাখাইনদের বসবাস বহুকাল যাবৎ। পললবিধৌত এই ভূমিতে তাদের বিচরণকাল প্রায় ২০০ বছরের। মং চো মেন যত দূর জানেন, তাঁদের আদি বাসস্থান আরাকানে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩১৫ থেকে খ্রিষ্টীয় ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার সীমান্ত-সংলগ্ন আরাকান রাজ্যই ছিল রাখাইনদের স্বাধীন দেশ। কিন্তু ম্রাউক তৃতীয় যুগের ২৭তম রাজপুরুষ মাহা থামাদা যুদ্ধবাজ বর্মিরাজ বোদ মংয়েইনের হাতে পরাজিত ও নিহত হলে আরাকান তার স্বাধীন সত্তা হারিয়ে ব্রহ্মদেশের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। সে সময় বর্মিরাজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ রাখাইনেরা দলে দলে দেশত্যাগ করে। দেশত্যাগী রাখাইনদের একটি ক্ষুদ্র অংশ বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে উপস্থিত হয় বাংলাদেশে। গলাচিপা উপজেলার রাঙ্গাবালী দ্বীপে স্থাপন করে বসতি। সেখান থেকে পরবর্তী ৫০ বছরে বড় বাইশদিয়া, মৌডুবী, বালিয়াতলী, বগী, খাপড়াভাঙ্গাসহ লতাচাপলীর বহু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তারা। তৎকালীন জনমানবহীন জঙ্গলাকীর্ণ দ্বীপাঞ্চলে শুরু করে জীবনসংগ্রাম। এই সংগ্রামে ধীরে ধীরে জয়লাভ করে রাখাইনরা। বিভিন্ন অঞ্চলে বসতির ভিত্তি মজবুত করার পর তারা ধর্মের প্রতি বিশেষভাবে মনোনিবেশ করে।
রাখাইনেরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং রাখাইন-বসতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বসতিসংলগ্ন বৌদ্ধ বিহার। হ্যাঁ, পটুয়াখালী-বরগুনার বিভিন্ন বসতিতে বহু বিচিত্র আকার এবং প্রকারের বৌদ্ধ বিহার নির্মিত হয়েছে রাখাইনদের হাতে। সেই সব বিহারের মধ্যে অনিন্দ্যসুন্দর একটি বিহার মিশ্রিপাড়া রাখাইন বসতির প্রাণকেন্দ্রেও অস্তিত্বমান। কথা বলতে বলতে মং চো মেন মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ বিহার পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানালেন আমাদের। আমরা সানন্দে তাঁর সঙ্গী হলাম। বাজারের গুটিকয়েক দোকান অতিক্রম করে ঘাসের গালিচা পাতা সবুজ প্রান্তরে প্রবেশ করলাম। সামনেই টিন ও কাঠে নির্মিত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার।
বিহারের প্রবেশদ্বারের দুই পাশে দুটি হলুদ ড্রাগনমূর্তি। পুরোনো জীর্ণ প্রবেশদ্বারের ডান দিকে একটি সাইনবোর্ড। রংচটা সেই সাইনবোর্ডের শীর্ষদেশে লেখা ‘সর্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু’। বাক্যটির নিচে বিহারের নাম ‘বৌদ্ধ সীমা ঘর’। এইবার ভেতরে প্রবেশের পালা। মং চো মেন প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করতেই ‘সীমা ঘরের’ অভ্যন্তরে পা রাখলাম আমরা এবং সঙ্গে সঙ্গেই ধারণাতীত এক বস্তুসত্তার বিশালত্বের অভিঘাতে অপ্রস্তুত হলাম। ছয় ফুট উঁচু বেদির ওপর প্রায় ৩০ ফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তি আমাদের দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে! ‘ভূপৃষ্ঠ থেকে বৌদ্ধ বিহারের চূড়ার চাল স্পর্শ করা অনন্যসাধারণ এই মূর্তিটি চুন-সুরকি এবং পাথরে নির্মিত,’ বললেন মং চো মেন। ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তিটির কাছে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম আমরা। হলুদ বসন পরিহিত বুদ্ধের ডান হাত ডান জানুর ওপর প্রসারিত। বাম করতল স্থাপিত পদ্মাসনে নিবদ্ধ গোড়ালিদ্বয়ের মধ্যপ্রান্তে। আমরা ঘুরে দেখলাম বুদ্ধের চারপাশ। মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলাম সীমা ঘরের সম্পূর্ণ কাঠামো। ছয়টি কাঠের খুঁটির ওপর দণ্ডায়মান বৌদ্ধ সীমা ঘরটি। খুঁটিগুলো কি খুব মজবুত প্রকৃতির? না, মোটেই মজবুত নয় খুঁটিগুলো।
উপরন্তু ভয়ংকর দৈন্য দশায় আক্রান্ত সীমা ঘরটির চাল-দেয়াল-ভিত্তিভূমি; প্রাকৃতিক যেকোনো বিপর্যয়ে যখন-তখন ভেঙে পড়তে পারে। অনাকাঙ্ক্ষিত অবহেলার আঘাতে যেকোনো দিন ভূলুণ্ঠিত হতে পারে অনিন্দ্যসুন্দর বুদ্ধমূর্তিটি। কিন্তু তেমন অন্ধকার দিন কি আসবেই? তেমন কৃষ্ণকালে উপনীত হওয়ার আগেই কি সচেতন হব না আমরা? জাতি-ধর্ম-বর্ণভেদের অনালোকিত মানসিকতা পেছনে ফেলে কি সুরক্ষিত করব না বাংলাদেশের এই অপরূপ সৃষ্টিগুলো? চাই, প্রশ্নগুলোর উত্তর ইতিবাচক হোক। সপ্তবর্ণ আলোর উদ্ভাসে উল্লসিত হবে আমাদের মসীলিপ্ত সময়।
দীপংকর চন্দকলাপাড়া মোজাহারউদ্দিন ডিগ্রি কলেজে মানবিক শাখায় অধ্যয়নরত মং চো মেন থাকেন বাজারসংলগ্ন রাখাইনপাড়ায়। রাখাইন ভাষায় পাড়াটির নাম ‘ক্রাসেকুন রোয়া’। কিন্তু বাঙালিদের কাছে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের এই পাড়াটির পরিচয় ‘মিশ্রিপাড়া’ হিসেবে। মিশ্রিপাড়ায় রাখাইনদের বসবাস বহুকাল যাবৎ। পললবিধৌত এই ভূমিতে তাদের বিচরণকাল প্রায় ২০০ বছরের। মং চো মেন যত দূর জানেন, তাঁদের আদি বাসস্থান আরাকানে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩১৫ থেকে খ্রিষ্টীয় ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার সীমান্ত-সংলগ্ন আরাকান রাজ্যই ছিল রাখাইনদের স্বাধীন দেশ। কিন্তু ম্রাউক তৃতীয় যুগের ২৭তম রাজপুরুষ মাহা থামাদা যুদ্ধবাজ বর্মিরাজ বোদ মংয়েইনের হাতে পরাজিত ও নিহত হলে আরাকান তার স্বাধীন সত্তা হারিয়ে ব্রহ্মদেশের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। সে সময় বর্মিরাজের অত্যাচারে অতিষ্ঠ রাখাইনেরা দলে দলে দেশত্যাগ করে। দেশত্যাগী রাখাইনদের একটি ক্ষুদ্র অংশ বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে উপস্থিত হয় বাংলাদেশে। গলাচিপা উপজেলার রাঙ্গাবালী দ্বীপে স্থাপন করে বসতি। সেখান থেকে পরবর্তী ৫০ বছরে বড় বাইশদিয়া, মৌডুবী, বালিয়াতলী, বগী, খাপড়াভাঙ্গাসহ লতাচাপলীর বহু অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তারা। তৎকালীন জনমানবহীন জঙ্গলাকীর্ণ দ্বীপাঞ্চলে শুরু করে জীবনসংগ্রাম। এই সংগ্রামে ধীরে ধীরে জয়লাভ করে রাখাইনরা। বিভিন্ন অঞ্চলে বসতির ভিত্তি মজবুত করার পর তারা ধর্মের প্রতি বিশেষভাবে মনোনিবেশ করে।
রাখাইনেরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং রাখাইন-বসতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বসতিসংলগ্ন বৌদ্ধ বিহার। হ্যাঁ, পটুয়াখালী-বরগুনার বিভিন্ন বসতিতে বহু বিচিত্র আকার এবং প্রকারের বৌদ্ধ বিহার নির্মিত হয়েছে রাখাইনদের হাতে। সেই সব বিহারের মধ্যে অনিন্দ্যসুন্দর একটি বিহার মিশ্রিপাড়া রাখাইন বসতির প্রাণকেন্দ্রেও অস্তিত্বমান। কথা বলতে বলতে মং চো মেন মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ বিহার পরিদর্শনের আমন্ত্রণ জানালেন আমাদের। আমরা সানন্দে তাঁর সঙ্গী হলাম। বাজারের গুটিকয়েক দোকান অতিক্রম করে ঘাসের গালিচা পাতা সবুজ প্রান্তরে প্রবেশ করলাম। সামনেই টিন ও কাঠে নির্মিত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার।
বিহারের প্রবেশদ্বারের দুই পাশে দুটি হলুদ ড্রাগনমূর্তি। পুরোনো জীর্ণ প্রবেশদ্বারের ডান দিকে একটি সাইনবোর্ড। রংচটা সেই সাইনবোর্ডের শীর্ষদেশে লেখা ‘সর্বে সত্তা সুখিতা হোন্তু’। বাক্যটির নিচে বিহারের নাম ‘বৌদ্ধ সীমা ঘর’। এইবার ভেতরে প্রবেশের পালা। মং চো মেন প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করতেই ‘সীমা ঘরের’ অভ্যন্তরে পা রাখলাম আমরা এবং সঙ্গে সঙ্গেই ধারণাতীত এক বস্তুসত্তার বিশালত্বের অভিঘাতে অপ্রস্তুত হলাম। ছয় ফুট উঁচু বেদির ওপর প্রায় ৩০ ফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তি আমাদের দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে! ‘ভূপৃষ্ঠ থেকে বৌদ্ধ বিহারের চূড়ার চাল স্পর্শ করা অনন্যসাধারণ এই মূর্তিটি চুন-সুরকি এবং পাথরে নির্মিত,’ বললেন মং চো মেন। ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তিটির কাছে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম আমরা। হলুদ বসন পরিহিত বুদ্ধের ডান হাত ডান জানুর ওপর প্রসারিত। বাম করতল স্থাপিত পদ্মাসনে নিবদ্ধ গোড়ালিদ্বয়ের মধ্যপ্রান্তে। আমরা ঘুরে দেখলাম বুদ্ধের চারপাশ। মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলাম সীমা ঘরের সম্পূর্ণ কাঠামো। ছয়টি কাঠের খুঁটির ওপর দণ্ডায়মান বৌদ্ধ সীমা ঘরটি। খুঁটিগুলো কি খুব মজবুত প্রকৃতির? না, মোটেই মজবুত নয় খুঁটিগুলো।
উপরন্তু ভয়ংকর দৈন্য দশায় আক্রান্ত সীমা ঘরটির চাল-দেয়াল-ভিত্তিভূমি; প্রাকৃতিক যেকোনো বিপর্যয়ে যখন-তখন ভেঙে পড়তে পারে। অনাকাঙ্ক্ষিত অবহেলার আঘাতে যেকোনো দিন ভূলুণ্ঠিত হতে পারে অনিন্দ্যসুন্দর বুদ্ধমূর্তিটি। কিন্তু তেমন অন্ধকার দিন কি আসবেই? তেমন কৃষ্ণকালে উপনীত হওয়ার আগেই কি সচেতন হব না আমরা? জাতি-ধর্ম-বর্ণভেদের অনালোকিত মানসিকতা পেছনে ফেলে কি সুরক্ষিত করব না বাংলাদেশের এই অপরূপ সৃষ্টিগুলো? চাই, প্রশ্নগুলোর উত্তর ইতিবাচক হোক। সপ্তবর্ণ আলোর উদ্ভাসে উল্লসিত হবে আমাদের মসীলিপ্ত সময়।
No comments