কণ্ঠস্বর-রাস্তাঘাট, মন্ত্রীদের গল্প ইত্যাদি by রাহাত খান
রাস্তার কী দোষ? সে তো তার বিস্তার নিয়ে জনপদের পর জনপদের ভেতর শুয়ে থাকে। চিরকাল তার আশা ও প্রার্থনা সে (রাস্তা) যেন খানাখন্দ এবং ছোট-বড় গর্ত থেকে মুক্ত থাকে। নামকাওয়াস্তে সরু পিচ আর আধভাঙা ইট দিয়ে যেন তাকে ঢেকে দেওয়া না হয়।
রাস্তা তো চায় না বেপরোয়া বাস-ট্রাক-কার তার ওপর দিয়ে নিয়মনীতি ভেঙে চলাচল করুক। দুর্ঘটনা ঘটুক। রক্তপাত হোক। গাড়ি রাস্তার খাদের নিচে পড়ূক। যান্ত্রিক ত্রুটি, চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে কিংবা তার ওপর সৃষ্ট ভয়াবহ সব খানাখন্দ ও গর্তে পড়ে গাড়ি উল্টে গিয়ে কচ্ছপ হয়ে যাক, রাস্তা তো তাও চায় না।
তাহলে কে বা কারা চায় রাস্তার দুর্দশা সীমা ছাড়িয়ে যাক? কেউ তা চায় না। গাড়ির আরোহীরা তো বটেই, গাড়ি যারা চালায়, গাড়ির যারা হেলপার_ দুর্ঘটনা, মৃত্যু, রক্তপাত, পরিবারে পরিবারে হাহাকার ওঠা_ তারাও চায় না এসব ক্ষেত্রে মৃত্যুদূতের ভূমিকা পালন করতে।
তাহলে দেশের হাইওয়ে এবং জেলা-অন্তর্বর্তী রাস্তায় প্রতিবছর কেন এত দুর্ঘটনা? কেন এত মৃত্যু? সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মারা পড়ে, তাদের অনেকে নিজেরা তো মারা যায়ই, পরিবারকেও মেরে রেখে যায়। গত চলি্লশ-বিয়ালি্লশ বছরে অনুমান করি, কোটির ওপর লোক মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
আমার মতে, এসব সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ তিনটি। এক. হাইওয়ে এবং আন্তঃজেলা সড়কগুলোর বেহাল দশা। বেহাল শব্দটা আমার কাছে খুব নিরীহ ঠেকে। বেহাল দশার বদলে বলা উচিত নৃশংস দশা। দেশের সড়ক নেটওয়ার্কের জায়গায় জায়গায় সৃষ্টি হয়েছে রাস্তার এই নৃশংস দশা। সড়ক ব্যবস্থা ভিক্ষুকের মতো দিনের পর দিন সংস্কারের অপেক্ষায় পড়ে আছে। কিন্তু দেশের সড়ক মেরামত ও সংস্কার এবং সড়ক নেটওয়ার্কের অবকাঠামো নির্মাণ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করে না কেউ। না এই সরকার, না সেই সরকার। না মন্ত্রী, না আমলা। না ইঞ্জিনিয়ার, না ঠিকাদার। প্রতিবছর বাজেটে সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ থাকে। এ ছাড়া বাইরের নানা দাতা ও ঋণ সংস্থার কাছ থেকেও বিশাল বিপুল বরাদ্দ পাওয়া যায় দেশের সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজে। বলতেই হয়, প্রতিবছর সড়ক খাতে হাজার লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ ও সাহায্য পাওয়া যায়। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ও হয়। এসব ব্যয় বরাদ্দ এবং কাজের নিয়মমাফিক একটা কাগুজে হিসাবও মন্ত্রী, সচিব ও ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে থাকে। তবে সে যাই হোক, রাস্তার ভয়াবহ দুর্দশা, দুর্ঘটনা আর জনগণের ভোগান্তি কিন্তু দূর হয় না এতটুকু। সড়ক অবকাঠামো এতদিনে যতটাই নির্মাণ হয়েছে সেটা দায়বদ্ধহীনতা, দায়িত্বহীনতা এবং দুর্নীতি মিলে বহু আগেই যেতে শুরু করে দিয়েছিল। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিটি বিভাগে এবং জেলা-উপজেলায় ভাঙা রাস্তার ছড়াছড়ি। টাকা যায়। টাকা আসে। কিন্তু রাস্তার নৃশংস দশা দিন দিন যেন নৃশংসতর হয়ে উঠছে। রাস্তা তো নয়, স্থানে স্থানে সেটা যেন মৃত্যুফাঁদ হয়ে অনিবার্য দুর্ঘটনা এবং যাত্রীর প্রাণহানির অপেক্ষায় থাকে।
সড়ক দুর্ঘটনার দ্বিতীয় কারণটি, আমার মতে, রেলপথকে ধ্বংস করা। যাতায়াত ও চলাচলের সেরা বিকল্পটি প্রায় ধ্বংস করে আনার পেছনে কাদের ষড়যন্ত্র রয়েছে, সেটা সরকারই খুঁজে বের করুক। দায়িত্ব তো তাদেরই। আমরা আমজনতা শুধু সবিস্ময়ে লক্ষ্য করছি, জনচলাচল ও মাল পরিবহনে যে খাতটি যোগাযোগ ব্যবস্থার সেরা উপায় হয়ে উঠতে পারত, সেই রেলওয়ে খাতকে নব্বই দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত উন্নয়ন করা দূরে থাক, দিন দিন সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। রেলওয়ে ধ্বংসের ৯০ ভাগ কাজ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই শেষ করে দেওয়া হয়েছে। বাকি দশ ভাগও নিভু নিভু হয়ে আসছে।
নদী খনন ও রেলওয়ে ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য ভারত সরকার এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য হিসেবে দিতে রাজি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক পর্যায়ের একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তিতে ভারতের স্বার্থ অবশ্যই নিহিত রয়েছে। তবে এই কারণে বাংলাদেশের স্বার্থ কোনোক্রমে ক্ষুণ্ন হয়েছে এমনটা বলা যায় না। বরং রেলওয়ে ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনে এবং নদী খননের মাধ্যমে প্রধান নদনদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে পারলে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটা বিপ্লব সাধিত হতে পারে।
আলোচ্য চুক্তি বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং উপেক্ষার ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। রেলপথ ও জলপথ ভালোভাবে চালু হলে সড়ক ব্যবস্থার ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার এবং পরিবহন মালিকরা নিশ্চিত একটু ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাদের এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের হয়তো আশঙ্কা এই যে, যাতায়াত ও মাল পরিবহনের নিরাপত্তা, আরামদায়ক ভ্রমণ, তুলনামূলক সস্তা ভাড়া এবং অন্য কিছু কারণে জনগণ রেলপথ ও জলপথকেই প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে বেছে নেবে।
কিন্তু তেমনটা হলে যে সড়ক ভবনের টাকা-পয়সার আমদানি খুবই কমে যেতে পারে। নিজেদের যোগসাজশে (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) ইঞ্জিনিয়ার ও ঠিকাদারদের রমরমা অবস্থা যে আর থাকে না। বাংলাদেশের প্রাকৃতিকভাবেই চলাচল ও মাল পরিবহনের প্রধান পথ ছিল জলপথ। এরপর রেলপথ। জানেঅলা এবং খানেঅলারা সেটা বুঝে রেলওয়ে ধ্বংসের টার্গেট ঠিকই চিহ্নিত করেছিল। নদীতে চরা পড়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জলপথের তো তিরিশ-পঁয়তিরিশ বছর আগেই স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল। বাকি ছিল রেলপথ। 'পথের কাঁটা'। ভাবতে ইচ্ছা হয়, ভাঙাচোরা সড়কপথের সড়ক বিভাগ, সেতু বিভাগ, ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার এবং বাস-ট্রাক মালিকদের স্বার্থ বিস্তারের স্বার্থেই কি সত্তর দশক পর্যন্ত মোটামুটি ভালো অবস্থায় থাকা রেলপথকে বিদায়ের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল?
সত্তর দশক পর্যন্ত রেলপথে দেশের বিস্তর লোক যাতায়াত করত। সড়কপথে মাল পরিবহনের চেয়ে চার-পাঁচগুণ মাল পরিবহন হতো রেলপথে। সৈয়দপুর ছিল প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের প্রধান কেন্দ্র বা জংশন। কালক্রমে পূর্ব পাকিস্তানের আমল থেকেই ঢাকার কমলাপুরকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সত্তর দশক পর্যন্ত অত্যন্ত নিয়মিত চালু রেললাইনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, ঢাকা-টাঙ্গাইল, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-ভৈরব-কিশোরগঞ্জ লাইন। চালু ছিল ঢাকা-রংপুর লাইন, ঢাকা-খুলনা-বেনাপোল লাইন, ঢাকা-পাবনা-রাজশাহী লাইন। এখনকার বরিশাল বিভাগ বাদ দিয়ে সিলেট-কুলাউড়াসহ দেশের সর্বত্র রেললাইন চালু ছিল।
রেলপথ ধ্বংস করে সড়কপথকে চলাচল ও মাল পরিবহনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য করে তোলাই কি ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল? তা না হলে বাংলাদেশের রেলপথের এমন উপযোগিতা থাকা সত্ত্বেও কেন রেলের লাইনের পর লাইন, স্টেশনের পর স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে? কেন রেলের কাঙ্ক্ষিত লোকবল দশ ভাগের এক ভাগে কমিয়ে আনা হয়েছে? কেন রেলের নতুন বগি আনা প্রায় বন্ধ? কেন পুরনো বগি আরও পুরনো এবং সংস্কার না হতে হতে এখন জাংকে পরিণত?
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে শুধু তো সওজ নয়, আলাদা রেলওয়ে ডিভিশন রয়েছে। রয়েছে আলাদা সেতু বিভাগ। রয়েছে বছরওয়ারি এবং দীর্ঘমেয়াদি বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ। বিদেশি দাতা সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নতুন রেলওয়ে লাইন নির্মাণ, পুরনো লাইনের সংস্কার, বগি কেনা এবং অবকাঠামো উন্নয়নে প্রতিবছর বিশাল অঙ্কের বরাদ্দ পাওয়া যায়। এর পরও বাংলাদেশ রেলওয়ে বেশ দ্রুত গতিতে ডুবতে চলেছে কেন? কেনইবা রেলওয়ের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক এ বছর তাদের বরাদ্দকৃত হাজার কোটি টাকা প্রত্যাহার করে নিয়েছে?
লুকিয়ে লাভ নেই। সওজ এবং এলজিইডির স্বার্থে রেলওয়ের গলা কাটার কাজ চলছে বহুদিন থেকে। অথচ হাইওয়ে এবং আন্তঃজেলা সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি দেশে রেল ব্যবস্থা চাঙ্গা থাকলে রাস্তায় এত দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটত না। ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র রাস্তায় এমন ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হতে পারত না। পরিবহন মালিক এবং অদক্ষ গাড়িচালকদের কাছেও দেশের পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা এমন জিম্মি হয়ে উঠতে পারত না।
তৃতীয় যে কারণটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই তা হলো_ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনো 'মা-বাপ' নেই! তা নইলে যোগাযোগমন্ত্রীর কাছে নৌপরিবহনমন্ত্রী কোনো টেস্ট বা পরীক্ষা ছাড়াই যোগাযোগ সেক্টরে ২৮ হাজার ড্রাইভার বা গাড়িচালকের নিযুক্তি চাইছেন! নৌপরিবহনমন্ত্রী আবার পরিবহন, বাস, ট্রাকচালক ইত্যাদির নেতা। সে যা-ই হোক, সরকারের একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী হয়েও আইনকে উপেক্ষা করে 'ড্রাইভার'দের এমনধারা নিযুক্তির দাবি ইতিপূর্বে কোনো আমলেই শোনা যায়নি। মন্ত্রী শাজাহান খান আইনের শাসন মেনে চলা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের শপথ নিয়েছিলেন। সেই শপথ তিনি নিজেই ভঙ্গ করেছেন। আমার তো মনে হয় ক্যাবিনেট নয়, পরিবহন সেক্টরের একজন শক্তিশালী, প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে তিনি তার দল ও সরকারের বেশি খেদমত করতে পারেন! সেই পথটাই তাকে দেখিয়ে দেওয়া উচিত।
ইদানীং সরকারের কয়েকজন অযোগ্য, অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ এবং দল ও সরকারের প্রতি কিছুমাত্র দরদ না থাকা মন্ত্রী দেশ শাসনে আওয়ামী লীগের ১০ ভাগ ব্যর্থতাকে নিজেদের গুণে ৫০ ভাগের দিকে নিয়ে গেছেন। আড়াই বছর তো দেখতে দেখতে কেটে গেল। বাকি আড়াই বছরও দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ক্যাবিনেট রি-শাফলিংয়ের মধ্যে অযোগ্যদের বাদ দিয়ে পূর্বজনপ্রিয়তার অনেকটা ধরে রাখতে পারে বর্তমান সরকার। নানা মহল থেকে দাবিও উঠছে। এরপরও যদি সরকার নিশ্চেষ্ট থাকে তাহলে এর দায়ভার আগামী নির্বাচনে তাদেরই নিতে হবে। জনপ্রিয়তা কোনো স্থায়ী বিষয় নয়। আগামী টার্মে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার তেমন কারণ না থাকলেও আওয়ামী লীগকে আগামী এক বছরের মধ্যে তার ব্যর্থতাগুলো দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে। ধারাবাহিকভাবে, আমার মতে, এগুলো হচ্ছে_ এক. সুষ্ঠু বিতরণ ও বিপণন ব্যবস্থার মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো ও স্থিতিশীল রাখা; দুই. সারাদেশের রাস্তাঘাট ঠিক করা এবং কম সময়ের মধ্যে সরকারের কর্তব্যকর্মের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত; তিন. বরাবর আওয়ামী লীগ তার দুর্বল প্রতিপক্ষের কাছে মিডিয়া-যুদ্ধে হেরে যায়। আওয়ামী লীগের দল বা সরকার মিডিয়ার গুরুত্বকে একেবারেই যেন পাত্তা দেয় না। বিষয়টি নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে; চার. যে কোনো সরকারে অযোগ্য, ব্যর্থ ও দুর্নীতিপরায়ণ মন্ত্রীরা দল ও সরকারের জন্য দায়বিশেষ। এই মুহূর্তে ক্যাবিনেট রি-সাফলের কোনো বিকল্প নেই বলে আমি মনে করি।
রাহাত খান :সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
তাহলে কে বা কারা চায় রাস্তার দুর্দশা সীমা ছাড়িয়ে যাক? কেউ তা চায় না। গাড়ির আরোহীরা তো বটেই, গাড়ি যারা চালায়, গাড়ির যারা হেলপার_ দুর্ঘটনা, মৃত্যু, রক্তপাত, পরিবারে পরিবারে হাহাকার ওঠা_ তারাও চায় না এসব ক্ষেত্রে মৃত্যুদূতের ভূমিকা পালন করতে।
তাহলে দেশের হাইওয়ে এবং জেলা-অন্তর্বর্তী রাস্তায় প্রতিবছর কেন এত দুর্ঘটনা? কেন এত মৃত্যু? সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মারা পড়ে, তাদের অনেকে নিজেরা তো মারা যায়ই, পরিবারকেও মেরে রেখে যায়। গত চলি্লশ-বিয়ালি্লশ বছরে অনুমান করি, কোটির ওপর লোক মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
আমার মতে, এসব সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ তিনটি। এক. হাইওয়ে এবং আন্তঃজেলা সড়কগুলোর বেহাল দশা। বেহাল শব্দটা আমার কাছে খুব নিরীহ ঠেকে। বেহাল দশার বদলে বলা উচিত নৃশংস দশা। দেশের সড়ক নেটওয়ার্কের জায়গায় জায়গায় সৃষ্টি হয়েছে রাস্তার এই নৃশংস দশা। সড়ক ব্যবস্থা ভিক্ষুকের মতো দিনের পর দিন সংস্কারের অপেক্ষায় পড়ে আছে। কিন্তু দেশের সড়ক মেরামত ও সংস্কার এবং সড়ক নেটওয়ার্কের অবকাঠামো নির্মাণ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করে না কেউ। না এই সরকার, না সেই সরকার। না মন্ত্রী, না আমলা। না ইঞ্জিনিয়ার, না ঠিকাদার। প্রতিবছর বাজেটে সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ থাকে। এ ছাড়া বাইরের নানা দাতা ও ঋণ সংস্থার কাছ থেকেও বিশাল বিপুল বরাদ্দ পাওয়া যায় দেশের সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের কাজে। বলতেই হয়, প্রতিবছর সড়ক খাতে হাজার লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ ও সাহায্য পাওয়া যায়। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ও হয়। এসব ব্যয় বরাদ্দ এবং কাজের নিয়মমাফিক একটা কাগুজে হিসাবও মন্ত্রী, সচিব ও ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে থাকে। তবে সে যাই হোক, রাস্তার ভয়াবহ দুর্দশা, দুর্ঘটনা আর জনগণের ভোগান্তি কিন্তু দূর হয় না এতটুকু। সড়ক অবকাঠামো এতদিনে যতটাই নির্মাণ হয়েছে সেটা দায়বদ্ধহীনতা, দায়িত্বহীনতা এবং দুর্নীতি মিলে বহু আগেই যেতে শুরু করে দিয়েছিল। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিটি বিভাগে এবং জেলা-উপজেলায় ভাঙা রাস্তার ছড়াছড়ি। টাকা যায়। টাকা আসে। কিন্তু রাস্তার নৃশংস দশা দিন দিন যেন নৃশংসতর হয়ে উঠছে। রাস্তা তো নয়, স্থানে স্থানে সেটা যেন মৃত্যুফাঁদ হয়ে অনিবার্য দুর্ঘটনা এবং যাত্রীর প্রাণহানির অপেক্ষায় থাকে।
সড়ক দুর্ঘটনার দ্বিতীয় কারণটি, আমার মতে, রেলপথকে ধ্বংস করা। যাতায়াত ও চলাচলের সেরা বিকল্পটি প্রায় ধ্বংস করে আনার পেছনে কাদের ষড়যন্ত্র রয়েছে, সেটা সরকারই খুঁজে বের করুক। দায়িত্ব তো তাদেরই। আমরা আমজনতা শুধু সবিস্ময়ে লক্ষ্য করছি, জনচলাচল ও মাল পরিবহনে যে খাতটি যোগাযোগ ব্যবস্থার সেরা উপায় হয়ে উঠতে পারত, সেই রেলওয়ে খাতকে নব্বই দশক থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত উন্নয়ন করা দূরে থাক, দিন দিন সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। রেলওয়ে ধ্বংসের ৯০ ভাগ কাজ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই শেষ করে দেওয়া হয়েছে। বাকি দশ ভাগও নিভু নিভু হয়ে আসছে।
নদী খনন ও রেলওয়ে ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য ভারত সরকার এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য হিসেবে দিতে রাজি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক পর্যায়ের একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তিতে ভারতের স্বার্থ অবশ্যই নিহিত রয়েছে। তবে এই কারণে বাংলাদেশের স্বার্থ কোনোক্রমে ক্ষুণ্ন হয়েছে এমনটা বলা যায় না। বরং রেলওয়ে ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধনে এবং নদী খননের মাধ্যমে প্রধান নদনদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে পারলে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটা বিপ্লব সাধিত হতে পারে।
আলোচ্য চুক্তি বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং উপেক্ষার ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। রেলপথ ও জলপথ ভালোভাবে চালু হলে সড়ক ব্যবস্থার ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার এবং পরিবহন মালিকরা নিশ্চিত একটু ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাদের এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকদের হয়তো আশঙ্কা এই যে, যাতায়াত ও মাল পরিবহনের নিরাপত্তা, আরামদায়ক ভ্রমণ, তুলনামূলক সস্তা ভাড়া এবং অন্য কিছু কারণে জনগণ রেলপথ ও জলপথকেই প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে বেছে নেবে।
কিন্তু তেমনটা হলে যে সড়ক ভবনের টাকা-পয়সার আমদানি খুবই কমে যেতে পারে। নিজেদের যোগসাজশে (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) ইঞ্জিনিয়ার ও ঠিকাদারদের রমরমা অবস্থা যে আর থাকে না। বাংলাদেশের প্রাকৃতিকভাবেই চলাচল ও মাল পরিবহনের প্রধান পথ ছিল জলপথ। এরপর রেলপথ। জানেঅলা এবং খানেঅলারা সেটা বুঝে রেলওয়ে ধ্বংসের টার্গেট ঠিকই চিহ্নিত করেছিল। নদীতে চরা পড়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জলপথের তো তিরিশ-পঁয়তিরিশ বছর আগেই স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছিল। বাকি ছিল রেলপথ। 'পথের কাঁটা'। ভাবতে ইচ্ছা হয়, ভাঙাচোরা সড়কপথের সড়ক বিভাগ, সেতু বিভাগ, ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার এবং বাস-ট্রাক মালিকদের স্বার্থ বিস্তারের স্বার্থেই কি সত্তর দশক পর্যন্ত মোটামুটি ভালো অবস্থায় থাকা রেলপথকে বিদায়ের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল?
সত্তর দশক পর্যন্ত রেলপথে দেশের বিস্তর লোক যাতায়াত করত। সড়কপথে মাল পরিবহনের চেয়ে চার-পাঁচগুণ মাল পরিবহন হতো রেলপথে। সৈয়দপুর ছিল প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের প্রধান কেন্দ্র বা জংশন। কালক্রমে পূর্ব পাকিস্তানের আমল থেকেই ঢাকার কমলাপুরকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সত্তর দশক পর্যন্ত অত্যন্ত নিয়মিত চালু রেললাইনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, ঢাকা-টাঙ্গাইল, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-ভৈরব-কিশোরগঞ্জ লাইন। চালু ছিল ঢাকা-রংপুর লাইন, ঢাকা-খুলনা-বেনাপোল লাইন, ঢাকা-পাবনা-রাজশাহী লাইন। এখনকার বরিশাল বিভাগ বাদ দিয়ে সিলেট-কুলাউড়াসহ দেশের সর্বত্র রেললাইন চালু ছিল।
রেলপথ ধ্বংস করে সড়কপথকে চলাচল ও মাল পরিবহনের ক্ষেত্রে অপরিহার্য করে তোলাই কি ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল? তা না হলে বাংলাদেশের রেলপথের এমন উপযোগিতা থাকা সত্ত্বেও কেন রেলের লাইনের পর লাইন, স্টেশনের পর স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে? কেন রেলের কাঙ্ক্ষিত লোকবল দশ ভাগের এক ভাগে কমিয়ে আনা হয়েছে? কেন রেলের নতুন বগি আনা প্রায় বন্ধ? কেন পুরনো বগি আরও পুরনো এবং সংস্কার না হতে হতে এখন জাংকে পরিণত?
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে শুধু তো সওজ নয়, আলাদা রেলওয়ে ডিভিশন রয়েছে। রয়েছে আলাদা সেতু বিভাগ। রয়েছে বছরওয়ারি এবং দীর্ঘমেয়াদি বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ। বিদেশি দাতা সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নতুন রেলওয়ে লাইন নির্মাণ, পুরনো লাইনের সংস্কার, বগি কেনা এবং অবকাঠামো উন্নয়নে প্রতিবছর বিশাল অঙ্কের বরাদ্দ পাওয়া যায়। এর পরও বাংলাদেশ রেলওয়ে বেশ দ্রুত গতিতে ডুবতে চলেছে কেন? কেনইবা রেলওয়ের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক এ বছর তাদের বরাদ্দকৃত হাজার কোটি টাকা প্রত্যাহার করে নিয়েছে?
লুকিয়ে লাভ নেই। সওজ এবং এলজিইডির স্বার্থে রেলওয়ের গলা কাটার কাজ চলছে বহুদিন থেকে। অথচ হাইওয়ে এবং আন্তঃজেলা সড়ক যোগাযোগের পাশাপাশি দেশে রেল ব্যবস্থা চাঙ্গা থাকলে রাস্তায় এত দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটত না। ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র রাস্তায় এমন ভয়াবহ যানজট সৃষ্টি হতে পারত না। পরিবহন মালিক এবং অদক্ষ গাড়িচালকদের কাছেও দেশের পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা এমন জিম্মি হয়ে উঠতে পারত না।
তৃতীয় যে কারণটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই তা হলো_ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনো 'মা-বাপ' নেই! তা নইলে যোগাযোগমন্ত্রীর কাছে নৌপরিবহনমন্ত্রী কোনো টেস্ট বা পরীক্ষা ছাড়াই যোগাযোগ সেক্টরে ২৮ হাজার ড্রাইভার বা গাড়িচালকের নিযুক্তি চাইছেন! নৌপরিবহনমন্ত্রী আবার পরিবহন, বাস, ট্রাকচালক ইত্যাদির নেতা। সে যা-ই হোক, সরকারের একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী হয়েও আইনকে উপেক্ষা করে 'ড্রাইভার'দের এমনধারা নিযুক্তির দাবি ইতিপূর্বে কোনো আমলেই শোনা যায়নি। মন্ত্রী শাজাহান খান আইনের শাসন মেনে চলা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের শপথ নিয়েছিলেন। সেই শপথ তিনি নিজেই ভঙ্গ করেছেন। আমার তো মনে হয় ক্যাবিনেট নয়, পরিবহন সেক্টরের একজন শক্তিশালী, প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে তিনি তার দল ও সরকারের বেশি খেদমত করতে পারেন! সেই পথটাই তাকে দেখিয়ে দেওয়া উচিত।
ইদানীং সরকারের কয়েকজন অযোগ্য, অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ এবং দল ও সরকারের প্রতি কিছুমাত্র দরদ না থাকা মন্ত্রী দেশ শাসনে আওয়ামী লীগের ১০ ভাগ ব্যর্থতাকে নিজেদের গুণে ৫০ ভাগের দিকে নিয়ে গেছেন। আড়াই বছর তো দেখতে দেখতে কেটে গেল। বাকি আড়াই বছরও দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ক্যাবিনেট রি-শাফলিংয়ের মধ্যে অযোগ্যদের বাদ দিয়ে পূর্বজনপ্রিয়তার অনেকটা ধরে রাখতে পারে বর্তমান সরকার। নানা মহল থেকে দাবিও উঠছে। এরপরও যদি সরকার নিশ্চেষ্ট থাকে তাহলে এর দায়ভার আগামী নির্বাচনে তাদেরই নিতে হবে। জনপ্রিয়তা কোনো স্থায়ী বিষয় নয়। আগামী টার্মে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার তেমন কারণ না থাকলেও আওয়ামী লীগকে আগামী এক বছরের মধ্যে তার ব্যর্থতাগুলো দ্রুত কাটিয়ে উঠতে হবে। ধারাবাহিকভাবে, আমার মতে, এগুলো হচ্ছে_ এক. সুষ্ঠু বিতরণ ও বিপণন ব্যবস্থার মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো ও স্থিতিশীল রাখা; দুই. সারাদেশের রাস্তাঘাট ঠিক করা এবং কম সময়ের মধ্যে সরকারের কর্তব্যকর্মের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত; তিন. বরাবর আওয়ামী লীগ তার দুর্বল প্রতিপক্ষের কাছে মিডিয়া-যুদ্ধে হেরে যায়। আওয়ামী লীগের দল বা সরকার মিডিয়ার গুরুত্বকে একেবারেই যেন পাত্তা দেয় না। বিষয়টি নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে; চার. যে কোনো সরকারে অযোগ্য, ব্যর্থ ও দুর্নীতিপরায়ণ মন্ত্রীরা দল ও সরকারের জন্য দায়বিশেষ। এই মুহূর্তে ক্যাবিনেট রি-সাফলের কোনো বিকল্প নেই বলে আমি মনে করি।
রাহাত খান :সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
No comments