জাতীয় সংগীত গাইতে হবে নিয়ম মেনে by আকরামুল ইসলাম
‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’—কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত এই গানটি শুধু আমাদের জাতীয় সংগীত নয়, সোনার বাংলাদেশের প্রতি মন-প্রাণ উজাড় করে হূদয় নিংড়ানো ভালোবাসারও এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ। জাতীয় সংগীতের সঙ্গে আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বন্ধন এমন এক মালায় গাঁথা, যা কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়।
হয়তো সে জন্যই কোনো কারণ ছাড়াই নিজের মনের অজান্তেই ভালোবাসার আবেগে গুনগুনিয়ে গানটি গেয়ে উঠি। যে গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের গৌরবময় ইতিহাস, যে গান স্থান করে নিয়ে প্রত্যেক বাংলাদেশির হূদয়ের মণিকোঠায়, সেই গানটির শুদ্ধতা বাণীতে, সুরে, উচ্চারণে এবং গায়নে বজায় রাখার দায়িত্ব নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বেশির ভাগ লোকই জাতীয় সংগীত গাওয়ার শুদ্ধ ও সঠিক নিয়ম সম্পর্কে অবহিত নন। কখন, কোথায়, কীভাবে, কতটুকু গাইতে বা বাজাতে হবে, সে বিষয়ে অনেকেই জানেন না। ২৫ লাইন গানের ১০ লাইনকে জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও সব অনুষ্ঠানে পুরো সংগীত বাজানোর নিয়ম নেই। জাতীয় সংগীত কখন, কোথায়, কীভাবে এবং কতটুকু গাইতে ও বাজাতে হবে, সে বিষয়ে ১৯৭৮ সালেই জাতীয় সংগীত বিধিমালা, ১৯৭৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই বিধি অনুযায়ী কয়েকটি অনুষ্ঠানে পূর্ণ সংগীত বাজানোর নিয়ম ছাড়া অন্য প্রায় সব অনুষ্ঠানেই প্রথম দুই লাইন (আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি) বাজানোর নিয়ম রয়েছে। এই বিধিতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন জাতীয় দিবস, যেমন—একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের শুরুতে ও শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ সংগীত বাজাতে হবে। তবে এসব দিবসের প্যারেড অনুষ্ঠানে দুই লাইন শুরুতে বাজানোর নিয়ম রয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতির ভাষণ দেওয়ার উদ্দেশ্যে সংসদ ভবনে প্রবেশ করার শুরুতে এবং ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ জাতীয় সংগীত বাজাতে হবে। তবে রাষ্ট্রপতির ভাষণ যখন জাতির উদ্দেশে সম্প্রচার করা হয়, তখন সম্প্রচারের শুরু ও শেষে দুই লাইন বাজাতে হবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের প্রথম দুই লাইন তাঁদের আগমন ও প্রস্থানের সময় বাজানোর কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি যখন কোনো প্যারেডে সালাম গ্রহণ করেন, তখনো দুই লাইন বাজাতে হয়। তা ছাড়া রাষ্ট্রপতি যদি কোনো অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হন বা কোনো অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন অথবা প্রধানমন্ত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে স্বাধীনতা পদক প্রদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন, তাহলে এসব ক্ষেত্রে তাঁদের আগমন ও প্রস্থানের সময় দুই লাইন সংগীত বাজানোর নিয়ম রয়েছে। রাষ্ট্রপতির সম্মানে যদি কোনো ভোজের আয়োজন করা হয় এবং তিনি যদি উপস্থিত থাকেন, তবে ভোজ গ্রহণের আগে দুই লাইন বাজাতে হবে। বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের সম্মানেও জাতীয় সংগীত বাজানোর নিয়ম রয়েছে। এ ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান তাঁর রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সফরে বাংলাদেশে এলে তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করার সময় আগে জাতীয় সংগীতের প্রথম দুই লাইন বাজাতে হবে। এ ছাড়া কোনো বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান, রাজপরিবারের সদস্য, রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার বা সমমর্যাদার কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধি যখন রাষ্ট্রপতির সালাম গ্রহণ করেন, তখন দুই লাইন বাজবে। এ ছাড়া বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে যদি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তবে ওই অতিথির আগমন ও প্রস্থানের সময় প্রথমে কিংবা বাংলাদেশে নিযুক্ত ওই রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব প্রতিনিধি দ্বারা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে সেই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানোর পর বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের দুই লাইন ড্রামের তালে বাজাতে হবে। বাংলাদেশে অবস্থিত কোনো বিদেশি মিশন যদি কোনো অনুষ্ঠানে সে দেশের জাতীয় সংগীত বাজাতে চায়, তবে তার জন্য পররাষ্ট্র দপ্তরের পূর্বানুমোদন লাগবে এবং যদি অনুমোদন দেওয়া হয়, তবে সেই দেশের জাতীয় সংগীতের আগে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজবে। তা ছাড়া যখন বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি কোনো রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে তাঁর পরিচয়পত্র হস্তান্তরের সময় গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন, তখনো দুই লাইন বাজাতে হয়। এ ছাড়া সিনেমা প্রদর্শনের আগে ও রেডিও, টেলিভিশনের দিনের অনুষ্ঠানের শেষেও দুই লাইন বাজানোর কথা বলা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোনো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে শব দাহ বা দাফন করার পরও দুই লাইন ড্রামের তালে বাজানোর কথা বলা হয়েছে। তবে নৌবাহিনীর কোনো জাহাজে রাষ্ট্রপতি ছাড়া অন্য কারও জন্য জাতীয় সংগীত বাজানো যাবে না। বিধিতে বলা হয়েছে, সব স্কুলের দিনের কার্যক্রম জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হবে। অনেক অনুষ্ঠানেই দেখা যায়, জাতীয় সংগীতের চার লাইন গাওয়া হয়, কিন্তু বিষয়টি ভুল। বিধিতে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, যদি কোনো অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়, তবে তা সবটুকুই গাইতে হবে। জাতীয় সংগীত শুধু গাইলেই হবে না, তা শুদ্ধ করে গাইতে হবে এবং গাওয়ার সময় এর প্রতি যথাযথ সম্মানও দেখাতে হবে। যখন কোনো উচ্চপদস্থ ব্যক্তির আগমনে বা কোনো অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় জাতীয় সংগীত বাজানো হয়, তখন প্যারেড কমান্ডিং অফিসারের অর্ডারের অধীনে ব্যতীত অন্য সব অফিসার ও নন-কমিশন অফিসারকে জাতীয় সংগীতের প্রথম নোট থেকে শেষ নোট বাজানো পর্যন্ত স্যালুট করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এ ছাড়া যখন জাতীয় সংগীত বাজানো হয় ও জাতীয় পতাকা প্রদর্শন হয়, তখন উপস্থিত সবাইকে জাতীয় পতাকার দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে এবং যখন পতাকা প্রদর্শন শেষ না করা হয়, তখন সবাইকে বাদকদলের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে এবং কারও মাথায় টুপি থাকলে খুলে ফেলতে হবে। যদি কেউ এসব নিয়ম ভঙ্গ করে, তবে তিনি এক বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা আমাদের জাতিসত্তার সঙ্গে জড়িত। তাই রক্তমূল্যে অর্জিত এই অমূল্য সম্পদের অবমূল্যায়ন আমাদের জন্য রীতিমতো পীড়াদায়ক এবং জাতিসত্তার প্রতি অবমাননাকর। তাই আমরা ও আগামী প্রজন্ম যাতে শুদ্ধ করে ও সঠিকভাবে জাতীয় সংগীতকে কণ্ঠে ও অন্তরে ধারণ করে সামনে এগিয়ে যেতে পারি, সে জন্য সবার সচেষ্ট থাকা নৈতিক ও আইনগত দায়িত্ব।
No comments