দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা by ইফতেখার আহমেদ টিপু

জকের এই যুগে সে জাতিই উন্নতির পথে পা বাড়াতে সক্ষম হয়, শিল্পায়নের ক্ষেত্রে যারা সক্ষমতা দেখায়। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ও সস্তা শ্রম দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণ বলে বিবেচিত হলেও ইন্ধনশক্তির অভাব তাদের নিরুৎসাহী করছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করে বলা হয়েছে, এটি বিশ্বের অন্যতম উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হতে


পারে। চীন, মালয়েশিয়া ও কোরিয়া উপদ্বীপ এলাকায় শ্রমের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে তাঁদের কারখানা স্থানান্তরে আগ্রহও দেখিয়েছেন। কিন্তু গ্যাস ও বিদ্যুৎ-সংকট বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহী করছে। এ সংকট দেশীয় বিনিয়োগকেও একই সঙ্গে অনিশ্চিত করে তুলছে। এমনকি যেসব কলকারখানা চালু রয়েছে, সেগুলোতেও উৎপাদন অব্যাহত রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। গ্যাসের নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার উদাসীনতাকে দায়ী করেন ব্যবসায়ীরা। গত মার্চে দেশে তেমন কোনো বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব আসেনি। দু-একটি যা এসেছে, তা উল্লেখ করার মতো নয়। ফেব্রুয়ারিতে ছয়টি শতভাগ বিদেশি ও ১৫টি যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়, যার মাধ্যমে ছয় হাজার ১৩ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা। অবশ্য মার্চে দেশি ও যৌথ মিলে ২০৫টি বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছে। এতে টাকার অঙ্কে বিনিয়োগের পরিমাণ ছয় হাজার ৬১০ কোটি ৫১ লাখ টাকা। ফেব্রুয়ারিতে এর সংখ্যা ছিল ১৮৩টি। ফেব্রুয়ারির চেয়ে মার্চে দেশি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি ৩৯ শতাংশ। বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যমতে, গত অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশি, যৌথ ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ হয় ৪৯ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা, আগস্টে ৯৬ হাজার ১২২ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৭১৯ কোটি টাকায়। অক্টোবরে তা আবার সামান্য বেড়ে ২৩ হাজার ৫৫০ কোটি ও নভেম্বরে ৪৩ হাজার ৯১ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে তা আবার কমে ২৯ হাজার ৬৪৭ কোটি, জানুয়ারিতে ২৮ হাজার ৮০১ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে ৪৮ হাজার ৩৫২ কোটি ও মার্চে ৬০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। মার্চে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমে ৫০০ কোটি টাকারও নিচে। গত বছরের মার্চেও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুতের অভাবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ স্তিমিত হয়ে পড়ছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির সরকারি পরিকল্পনা হোঁচট খাচ্ছে। চাহিদা পূরণে কয়লাভিত্তিক বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প চালু করার পরিকল্পনা নেওয়া হলেও সেটি কবে আলোর মুখ দেখবে তা অনিশ্চিতই রয়ে গেছে। বিদ্যুৎ ঘাটতি জনজীবনে যে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে, সেটিকে সরকারের জন্য হুমকি বললেও অত্যুক্তি হবে না। প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতায় মহাজোট সরকারের বিদ্যুৎ-সংক্রান্ত পরিকল্পনার সুফল আদৌ নিজেরা ভোগ করতে পারবেন কি না সংশয় দেখা দিয়েছে। আণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের চিন্তাভাবনা থাকলেও বাস্তবায়ন পর্যায়ে তার শম্বুকগতি পুরো জাতিকে হতাশ করছে। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ব্যক্তিবিশেষের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অনেকেই নিরুৎসাহী হয়ে পড়েছেন।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের মুখ্য প্রাকৃতিক সম্পদ হলো গ্যাস। গ্যাসের উৎপাদন কমে আসছে। গ্যাসকূপের সন্ধান নেই। অথচ গ্যাস ও বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েই চলছে। কিন্তু সরকার ঘোষণা দিয়েছে, গ্যাস সংযোগ বন্ধ। সরকার বলছে বিদেশ থেকে কয়লা ও ফার্নেস অয়েল আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাবে। বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলা করতে কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। কয়লাভিত্তিক ৫০০ মে.ও. করে চারটি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গ্যাসের অভাবে সব বিদ্যুৎকেন্দ্র ফার্নেস অয়েল এবং কয়লাভিত্তিক করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সৌরসহ অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রও স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে। রাজধানীর শিল্পাঞ্চল, বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী সাভার, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও চট্টগ্রামের শিল্প-কারখানায় গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ বলতে গেলে বিধ্বস্ত রূপ নিয়েছে। এর বড় ধাক্কা এসে লেগেছে উৎপাদনে। এ অবস্থায় উদ্যোক্তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে কারখানা চালু রাখতে। যার প্রভাব পড়ছে দ্রব্যমূল্যের ওপর। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছিল ঘরে ঘরে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এ প্রতিশ্রুতি পালনে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট প্রধান বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে। ইন্ধনশক্তির সংকটে হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য হলো_চলতি দশকের মধ্যে মধ্য-আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। কিন্তু গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট সামাল দিতে না পারলে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার প্রত্যাশা দুরাশায় পরিণত হবে। স্মর্তব্য যে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ১৫০ কোটি ঘনফুট হলেও সরবরাহ হচ্ছে ১২০ কোটি ঘনফুট। অন্যদিকে বিদ্যুতের নূ্যনতম চাহিদা ছয় হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে উৎপাদনের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। আমাদের মতে, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে গ্যাস ও বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা মনে রেখে দ্রুত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কথা ভাবতে হবে। একই সঙ্গে গ্যাস উৎপাদন বাড়াতেও নিতে হবে নানামুখী উদ্যোগ।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ, চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ
chairman@ifadgroup.com

No comments

Powered by Blogger.