ইতিউতি-গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে by আতাউস সামাদ
জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজন করা এক বৈঠকে আলোচনা হয়েছিল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে এখন যে সরকার চলছে তার তথ্য মন্ত্রণালয় 'বেসরকারি সম্প্রচার নীতিমালা-২০১১' নামে যে খসড়া দলিল তৈরি করেছে সেটা নিয়ে। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও স্টেশনগুলো কিভাবে কাজ করবে সেই সম্পর্কে নীতিমালা তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। খসড়া হিসেবে যে প্রস্তাব সরকার দিয়েছে তার মূল বিষয় হলো
বেসরকারি টিভি ও রেডিওগুলো কী প্রচার করতে পারবে আর কী প্রচার করতে পারবে না। অন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো যে বর্তমানে চালু সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নতুন করে লাইসেন্স নিতে হবে। যারা লাইসেন্স পাবেন তাদেরকে যেসব শর্ত মানতে হবে তাও বলা আছে এতে। প্রস্তাবিত নীতিমালায় একেবারে শুরুর দিকেই বলা হয়েছে, কারা লাইসেন্স পাবেন না। সরকার এই খসড়া নীতিমালাটি জাতীয় সংসদের তথ্য মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত কমিটিতে পাঠিয়েছিল। খসড়াটিকে পরিশীলিত করার নির্দেশ দিয়ে বা অনুরোধ করে স্থায়ী কমিটি সেটিকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠিয়েছে। তবে তথ্য মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির এই সিদ্ধান্তকে আমার কাছে ক্রন্দনরত শিশুর প্যানপ্যানানির মতো মনে হচ্ছে। খিদে পেলে বাচ্চা কাঁদতে শুরু করলে তখন তাকে যে দুধ এনে দেওয়া হয় তা যদি বেশি গরম হয় তাহলে বাচ্চাটি আবার কাঁদতে আরম্ভ করে এবং বলে, 'এত গরম দুধ আনলে কেন, ওটা ঠাণ্ডা করে দাও।' সরকারের প্রস্তাবিত নীতিমালাটি এতই বাজে এবং দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য এতই ক্ষতিকর যে জাতীয় সংসদের তথ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক স্থায়ী কমিটির জন্য উচিত কাজ হতো ওটিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা এবং সরকারকে সতর্ক করে দেওয়া যে ওই ধরনের নোংরা কাজে সংসদকে জড়ানোর সাহস ভবিষ্যতে যেন না দেখায়। দুঃখের বিষয় হলো যে আমাদের সাতিশয় ভদ্র সংসদ সদস্যরা যুক্তিসংগত কারণ থাকা সত্ত্বেও সরকারের প্রতি কঠিন হতে পারলেন না। তবে ফিরে আসি জাতীয় প্রেসক্লাবের আলোচনা সভা প্রসঙ্গে। শ্রদ্ধেয় মূসা ভাই (এবিএম মূসা) ওই সভায় অংশগ্রহণকারী সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবদিকদের উপদেশ দিয়েছেন যে এই সরকারি নীতিমালা প্রত্যাহার করার দাবিতে এবং গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা প্রতিরোধ করার জন্য এখনই বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করতে, অর্থাৎ রাজপথে নেমে আন্দোলন শুরু করতে, কারণ এ ছাড়া অন্য কিছুতে কাজ হবে না। এ প্রসঙ্গে মূসা ভাই পাকিস্তানি জামানায় সেনাশাসক আইয়ুব খান সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার জন্য যে কালাকানুন জারি করেছিলেন তার বিরুদ্ধে বৃদ্ধ প্রকাশক মওলানা আকরম খাঁ এবং প্রবীণ সম্পাদক আবদুস সালাম ও আবুল কালাম সামসুদ্দিনকে সামনে রেখে খবরের কাগজের সাংবাদিক, প্রেস কর্মচারী ও বাণিজ্যিক বিভাগের কর্মীরা সবাই মিলে ঢাকার রাজপথে যে মিছিল করেছিলেন সে কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি এবারও একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছেন। মূসা ভাইয়ের প্রস্তাবটি সঠিক। সেই আমলে আমি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাহী কমিটিতে ছিলাম, পরে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছি। মূসা ভাইরা আমাদের নেতা ছিলেন। এখানে শ্রদ্ধাভরে শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদ খোন্দকার আবু তালেব, শহীদ শহীদুল্লা কায়সার ও প্রয়াত কেজি মুস্তাফার নাম স্মরণ করি। তাঁরা সবাই সাংবাদিক ইউনিয়ন তথা তৎকালীন পাকিস্তানের পেশাদার সাংবাদিক জগতের নেতা ছিলেন। আমি যতদূর জানি, শ্রদ্ধেয় নির্মল সেন ও ফয়েজ আহ্মেদও সরকারের গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টার বিরুদ্ধে জোরদার প্রতিবাদ হোক তা চান।
বেসরকারি সম্প্রচার নীতিমালা-২০১১-এর খসড়াটির সামান্য দু-চারটি প্রস্তাব উল্লেখ করলেই প্রিয় পাঠকরা অনুভব করতে পারবেন কেন আমাদের এই ক্ষোভ ও উদ্বেগ। একটি প্রস্তাবিত নীতি আছে যা কার্যকর হলে বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিওতে কোনো রাজনৈতিক খবরই পরিবেশন করা যাবে না। নীতিটিতে বলা হয়েছে, 'অনুষ্ঠানে সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দলের বক্তব্য বা মতামত প্রচার করা যাবে না।' রেডিও-টিভির স্রোতা ও দর্শক এবং খবরের কাগজের পাঠকরা সবাই জানেন যে গণমাধ্যমের জন্য রাজনৈতিক সংবাদ পরিবেশন করা প্রধান কাজ। কারণ রাজনৈতিক দলের কাজকর্মের সঙ্গে জনজীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনা গভীরভাবে জড়িত। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা ও জনমতের ভিত্তিতে সরকার পরিচালনা করা হয়। জনগণ তাই ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদের সব খবরই ন্যায়সংগতভাবে জানতে চান। তদুপরি বহুমতের দেশে রাজনৈতিক দল থাকতেই হয় এবং সংগঠন করার স্বাধীনতা আমাদের সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের অন্যতম। এখন প্রস্তাবিত সম্প্রচার নীতিমালা নির্দেশ দিতে যাচ্ছে যে গণমাধ্যম রাজনৈতিক দলের বক্তব্য বা মতামত প্রচার করতে পারবে না। এর ফলে তো এমনকি জাতীয় সংসদের আলোচনা বা আদালতে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট অথবা সংবিধানবিষয়ক মামলার শুনানি বা রায়ও প্রচার করা যাবে না। তাহলে আর রেডিও-টিভি এবং সংবাদপত্রে খবর থাকলো কোথায়।
আরেকটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, 'কোনো মানুষ বা প্রাণী নির্যাতনের দৃশ্য অনুষ্ঠানে প্রচার করা যাবে না। নাটকের প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষেত্রে এই নীতি শিথিল করা যেতে পারে।' এই প্রস্তাবের মানে দাঁড়ায়, কেউ কাউকে মারপিট করছে, রামদা নিয়ে তাড়া করেছে বা গুলি করতে যাচ্ছে বা বুট দিয়ে মাড়াচ্ছে_এ রকম বাস্তব ঘটনার ছবি দেখানো বা ছাপানো যাবে না। এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হলো, সরকারের পুলিশ ও ক্যাডার বাহিনী বিক্ষোভকারী বিরুদ্ধমতবাদী রাজনৈতিক কর্মী বা বেতনবঞ্চিত শ্রমিক বা নির্যাতিত ছাত্র বা সার-পানি অথবা ফসলের ন্যায্যমূল্যের দাবি উত্থাপনকারী কৃষকদের দমনের নামে নিপীড়ন করলে তার সচিত্র সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না।
আসলে এই উদ্দেশ্যটা অন্যত্র স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যথা, 'সশস্ত্র বাহিনী/পুলিশ বাহিনী অথবা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত দায়িত্বশীল অন্য কোনো বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ, বিদ্রূপ বা অবমাননা, অপরাধ নিবারণ অথবা অপরাধীদের দণ্ডবিধানে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তাদের হাস্যস্পদ করে, তাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে এমন দৃশ্য প্রদর্শন করা যাবে না।' এ রকম নীতি কার্যকর করলে গণমাধ্যম কোথাও পুলিশের কোনো বাড়াবাড়ি বা সশস্ত্র বাহিনীর কোনো সদস্যের কোনো উচ্ছৃঙ্খল কাজ সম্পর্কে খবর পরিবেশন করতে পারবে না। এই প্রস্তাবিত নীতিমালা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানি জামানার অগণতান্ত্রিক ও নিপীড়ক শাসনের প্রেতাত্মাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। যেমন_এটির এক জায়গায় প্রস্তাব করেছে, 'গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা (সরকারের) বা প্রেস নোট' প্রচার করা বাধ্যতামূলক হবে। আইয়ুব আমলের কালাকানুনে ঠিক এ রকম নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
প্রস্তাবিত নীতিমালায় এমন একটি বিষয় আছে যা সংবিধানের কয়েকটি ধারার পরিপন্থী। এই প্রস্তাবটিতে বলা আছে, 'কোনো প্রতিষ্ঠান, যার মালিকানা কোনো ব্যক্তির যিনি কোনো দলের শীর্ষ পর্যায়ে পদ অধিকার করেন তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান টিভি বা রেডিও প্রচার কেন্দ্র করার লাইসেন্স পাবে না।' তা কেন? আমাদের সংবিধানে তো বৈধভাবে সম্পত্তির মালিক হওয়ার অধিকার দেওয়া আছে, সংগঠনের স্বাধীনতা দেওয়া আছে, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া আছে, তাহলে তাঁরা কেন এমন একটি মাধ্যমের মালিক হতে পারবেন না, যাতে বিনিয়োগ করতে হয় বিধায় এটা একটা সম্পত্তি এবং যেটা এমন একটা মাধ্যম যা দিয়ে মতপ্রকাশ করা সম্ভব? আর বাস্তব পরিস্থিতিইবা কী, বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অনেক মালিক বা অংশীদার বা পরিচালক তো শাসক আওয়ামী লীগ দলের সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীর আত্মীয়। এখন তাঁদের কী হবে।
এই প্রস্তাবিত নীতিমালাটির খসড়া কে তৈরি করেছেন তা জানি না, তবে বিশ্বাস হয় না যেন সচিবালয়ের কোনো কনিষ্ঠ কেরানিও এত সংকীর্ণমনা বা বুদ্ধিহীন হতে পারে।
সরকার থেকে এভাবে যখন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ঠিক তার পর পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে তাঁর মন্ত্রীদের বললেন তাঁদের কারো সম্পর্কে কোনো মিথ্যা রিপোর্ট বের হলেই সেই পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিতে, তাতে আতঙ্কিত হচ্ছি। কারো সম্পর্কে কেউ মিথ্যা প্রচার করলে বা অবমাননাকর কিছু প্রচার করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করার মতো আইন দেশে আছে। প্রেস কাউন্সিলেও এ রকম মামলা করা যায়, যদিও প্রধানমন্ত্রী এটির কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন এমন কথা শুনিনি। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার একটা জোয়ার এল বলে, যেমন করা হয়েছিল আমার দেশ পত্রিকার বিরুদ্ধে। তবে গণমাধ্যমে কর্মরতদের নিপীড়ন করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের বাইরেও অনেক ব্যবস্থা নিচ্ছে তাঁর দলের লোকেরা। তার মধ্যে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া বা হাত-পা ভেঙে দেওয়া তো আছেই; আরো আছে ছিনতাই, ডাকাতি, চুরি ও চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা দেওয়া। এসব মামলায় রিমান্ড বা কাস্টডিতে পাঠানো খুব সহজ। আর যাকে পুলিশের রিমান্ডে নেওয়া হলো তাকে যে কত রকমভাবে অত্যাচার করা যায় তার কাহিনী তো নিত্যই দেখা ও শোনা যাচ্ছে।
এ অবস্থায় এই নিপীড়নমূলক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সংবাদপত্রের মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক ও সব বিভাগের অন্য কর্মীদের একত্র হয়ে রাস্তায় নামা উচিত। অন্তত বারকয়েকের জন্য হলেও। তবে সে রকম ঘটতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। তবু কেউ যেন এ উদ্যোগ নেন। ইতিমধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির প্রতি সংক্ষিপ্ত স্বাগত ভাষণে বাংলাদেশে গণমাধ্যম যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এ কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, এটা খুবই লক্ষণীয়। মনে হয় বাংলাদেশে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের সম্ভাবনা যে এখন বাস্তবিক হুমকিতে পরিণত হয়েছে মার্কিন সরকার সে রকম আশঙ্কা করছে। বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়টি আমলে নিতে পারে, আবার নাও পারে। তাই আমাদের নিজেদেরই প্রতিবাদ করার ক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমকে রক্ষা করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
বেসরকারি সম্প্রচার নীতিমালা-২০১১-এর খসড়াটির সামান্য দু-চারটি প্রস্তাব উল্লেখ করলেই প্রিয় পাঠকরা অনুভব করতে পারবেন কেন আমাদের এই ক্ষোভ ও উদ্বেগ। একটি প্রস্তাবিত নীতি আছে যা কার্যকর হলে বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিওতে কোনো রাজনৈতিক খবরই পরিবেশন করা যাবে না। নীতিটিতে বলা হয়েছে, 'অনুষ্ঠানে সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক দলের বক্তব্য বা মতামত প্রচার করা যাবে না।' রেডিও-টিভির স্রোতা ও দর্শক এবং খবরের কাগজের পাঠকরা সবাই জানেন যে গণমাধ্যমের জন্য রাজনৈতিক সংবাদ পরিবেশন করা প্রধান কাজ। কারণ রাজনৈতিক দলের কাজকর্মের সঙ্গে জনজীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনা গভীরভাবে জড়িত। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা ও জনমতের ভিত্তিতে সরকার পরিচালনা করা হয়। জনগণ তাই ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদের সব খবরই ন্যায়সংগতভাবে জানতে চান। তদুপরি বহুমতের দেশে রাজনৈতিক দল থাকতেই হয় এবং সংগঠন করার স্বাধীনতা আমাদের সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের অন্যতম। এখন প্রস্তাবিত সম্প্রচার নীতিমালা নির্দেশ দিতে যাচ্ছে যে গণমাধ্যম রাজনৈতিক দলের বক্তব্য বা মতামত প্রচার করতে পারবে না। এর ফলে তো এমনকি জাতীয় সংসদের আলোচনা বা আদালতে রাজনীতিসংশ্লিষ্ট অথবা সংবিধানবিষয়ক মামলার শুনানি বা রায়ও প্রচার করা যাবে না। তাহলে আর রেডিও-টিভি এবং সংবাদপত্রে খবর থাকলো কোথায়।
আরেকটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, 'কোনো মানুষ বা প্রাণী নির্যাতনের দৃশ্য অনুষ্ঠানে প্রচার করা যাবে না। নাটকের প্রয়োজনে বিশেষ ক্ষেত্রে এই নীতি শিথিল করা যেতে পারে।' এই প্রস্তাবের মানে দাঁড়ায়, কেউ কাউকে মারপিট করছে, রামদা নিয়ে তাড়া করেছে বা গুলি করতে যাচ্ছে বা বুট দিয়ে মাড়াচ্ছে_এ রকম বাস্তব ঘটনার ছবি দেখানো বা ছাপানো যাবে না। এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হলো, সরকারের পুলিশ ও ক্যাডার বাহিনী বিক্ষোভকারী বিরুদ্ধমতবাদী রাজনৈতিক কর্মী বা বেতনবঞ্চিত শ্রমিক বা নির্যাতিত ছাত্র বা সার-পানি অথবা ফসলের ন্যায্যমূল্যের দাবি উত্থাপনকারী কৃষকদের দমনের নামে নিপীড়ন করলে তার সচিত্র সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না।
আসলে এই উদ্দেশ্যটা অন্যত্র স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে যথা, 'সশস্ত্র বাহিনী/পুলিশ বাহিনী অথবা দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত দায়িত্বশীল অন্য কোনো বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ, বিদ্রূপ বা অবমাননা, অপরাধ নিবারণ অথবা অপরাধীদের দণ্ডবিধানে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তাদের হাস্যস্পদ করে, তাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে এমন দৃশ্য প্রদর্শন করা যাবে না।' এ রকম নীতি কার্যকর করলে গণমাধ্যম কোথাও পুলিশের কোনো বাড়াবাড়ি বা সশস্ত্র বাহিনীর কোনো সদস্যের কোনো উচ্ছৃঙ্খল কাজ সম্পর্কে খবর পরিবেশন করতে পারবে না। এই প্রস্তাবিত নীতিমালা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানি জামানার অগণতান্ত্রিক ও নিপীড়ক শাসনের প্রেতাত্মাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। যেমন_এটির এক জায়গায় প্রস্তাব করেছে, 'গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা (সরকারের) বা প্রেস নোট' প্রচার করা বাধ্যতামূলক হবে। আইয়ুব আমলের কালাকানুনে ঠিক এ রকম নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
প্রস্তাবিত নীতিমালায় এমন একটি বিষয় আছে যা সংবিধানের কয়েকটি ধারার পরিপন্থী। এই প্রস্তাবটিতে বলা আছে, 'কোনো প্রতিষ্ঠান, যার মালিকানা কোনো ব্যক্তির যিনি কোনো দলের শীর্ষ পর্যায়ে পদ অধিকার করেন তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান টিভি বা রেডিও প্রচার কেন্দ্র করার লাইসেন্স পাবে না।' তা কেন? আমাদের সংবিধানে তো বৈধভাবে সম্পত্তির মালিক হওয়ার অধিকার দেওয়া আছে, সংগঠনের স্বাধীনতা দেওয়া আছে, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া আছে, তাহলে তাঁরা কেন এমন একটি মাধ্যমের মালিক হতে পারবেন না, যাতে বিনিয়োগ করতে হয় বিধায় এটা একটা সম্পত্তি এবং যেটা এমন একটা মাধ্যম যা দিয়ে মতপ্রকাশ করা সম্ভব? আর বাস্তব পরিস্থিতিইবা কী, বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অনেক মালিক বা অংশীদার বা পরিচালক তো শাসক আওয়ামী লীগ দলের সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীর আত্মীয়। এখন তাঁদের কী হবে।
এই প্রস্তাবিত নীতিমালাটির খসড়া কে তৈরি করেছেন তা জানি না, তবে বিশ্বাস হয় না যেন সচিবালয়ের কোনো কনিষ্ঠ কেরানিও এত সংকীর্ণমনা বা বুদ্ধিহীন হতে পারে।
সরকার থেকে এভাবে যখন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ঠিক তার পর পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে তাঁর মন্ত্রীদের বললেন তাঁদের কারো সম্পর্কে কোনো মিথ্যা রিপোর্ট বের হলেই সেই পত্রিকার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিতে, তাতে আতঙ্কিত হচ্ছি। কারো সম্পর্কে কেউ মিথ্যা প্রচার করলে বা অবমাননাকর কিছু প্রচার করলে তার বিরুদ্ধে মামলা করার মতো আইন দেশে আছে। প্রেস কাউন্সিলেও এ রকম মামলা করা যায়, যদিও প্রধানমন্ত্রী এটির কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন এমন কথা শুনিনি। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার একটা জোয়ার এল বলে, যেমন করা হয়েছিল আমার দেশ পত্রিকার বিরুদ্ধে। তবে গণমাধ্যমে কর্মরতদের নিপীড়ন করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের বাইরেও অনেক ব্যবস্থা নিচ্ছে তাঁর দলের লোকেরা। তার মধ্যে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া বা হাত-পা ভেঙে দেওয়া তো আছেই; আরো আছে ছিনতাই, ডাকাতি, চুরি ও চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা দেওয়া। এসব মামলায় রিমান্ড বা কাস্টডিতে পাঠানো খুব সহজ। আর যাকে পুলিশের রিমান্ডে নেওয়া হলো তাকে যে কত রকমভাবে অত্যাচার করা যায় তার কাহিনী তো নিত্যই দেখা ও শোনা যাচ্ছে।
এ অবস্থায় এই নিপীড়নমূলক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সংবাদপত্রের মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক ও সব বিভাগের অন্য কর্মীদের একত্র হয়ে রাস্তায় নামা উচিত। অন্তত বারকয়েকের জন্য হলেও। তবে সে রকম ঘটতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। তবু কেউ যেন এ উদ্যোগ নেন। ইতিমধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির প্রতি সংক্ষিপ্ত স্বাগত ভাষণে বাংলাদেশে গণমাধ্যম যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এ কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, এটা খুবই লক্ষণীয়। মনে হয় বাংলাদেশে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের সম্ভাবনা যে এখন বাস্তবিক হুমকিতে পরিণত হয়েছে মার্কিন সরকার সে রকম আশঙ্কা করছে। বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়টি আমলে নিতে পারে, আবার নাও পারে। তাই আমাদের নিজেদেরই প্রতিবাদ করার ক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে গণমাধ্যমকে রক্ষা করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
No comments