কাল রঙ্গ-'ও আশরাফ কাকু' by হিলাল ফয়েজী

শরাফ' শব্দটির মানে 'সেরা'। জনগণের ভোটে সেরা প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন কিশোরগঞ্জ শহর থেকে, আড়াই বছর আগে। অতিসম্প্রতি তিনি নিজের নির্বাচনী এলাকায় স্বাভাবিক কর্মসূচির অংশ হিসেবেই গমন করেছিলেন হয়তোবা। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলটির গুরুভার তাঁর হাতে। তত্ত্বাবধায়কের জরুরি আমলে বিপন্ন সেই রাজনৈতিক দলটির মুখপাত্র হিসেবে গৃহীত ভূমিকায় রাজনৈতিক মহলের দৃষ্টি পড়ল তাঁর দিকে। দলনেত্রীর নেত্রপাত হলো রাজনৈতিক


অনুজের প্রতি। বাকি অংশ দেশবাসীর জানা। এই 'আশরাফ' নামের লোকটির জীবনে যে আঘাত, যে দুঃখ, যে কষ্ট_তা হয়তো রাজনীতির ডামাডোলে অনেকেরই খেয়ালে থাকে না। তাঁর বাবা ছিলেন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজের পরাজয়ের ২১৪ বছর পর মুজিবনগর (বৈদ্যনাথতলা) আম্রকাননে শপথ নেওয়া মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট প্রধানত কিসিঞ্জারি নৃশংসতায় বঙ্গবন্ধু পরিবারের হত্যাকাণ্ডের পর মাথা নত না করা আওয়ামী লীগের যে চার জাতীয় নেতা ৩ নভেম্বর কারাগারে ঘাতক দলের হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদেরই একজন। এমন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল যে পরিবার, উদীয়মান ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ আশরাফ তারপর কোথায় গেলেন, কোথায় ছিলেন_তেমন খবর রাখার বাস্তবতা চারপাশে দেখিনি।
বিংশ শতাব্দীর অন্তিম দশকে দেশে ফিরে এলেন সৈয়দ আশরাফ। ক্রমে ক্রমে জানা গেল, বিদেশে অবস্থানের সময়কালে জ্ঞান ও তথ্যে পুষ্ট হওয়ার আধুনিক সুযোগগুলোর তিনি যথাসাধ্য সদ্ব্যবহার করেছেন। ২০০৭-উত্তর বাংলাদেশে প্রধান দলটির দ্বিতীয় কাণ্ডারি হিসেবে ভূমিকাপ্রাপ্তিতে তাঁর এই জ্ঞানবান বৈশিষ্ট্যও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তাঁর প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষীদের আক্ষেপ, কেন যেন তিনি তাঁর যোগ্যতার নানা বর্ণের পালকগুলো দিয়ে দলটিকে সাজাতে যথাসাধ্য মনোযোগ দিতে সক্ষম হচ্ছেন না।
যাক, ওসব তো ক্ষমতা, রাজনীতি, রাষ্ট্র পরিচালনা, নীতি, দর্শন ইত্যাদি বড় ব্যাপারে বিরাট বিরাট কথা। আমরা সাধারণরা ওটার বাইরে। আমরা সেদিন হঠাৎ শুধু একটি ব্যানারের একটি বাক্যে চমকিত-পুলকিত হতে পারি সহজে। সেটি নিয়েই আজকের কালরঙ্গ।
'কিশোরগঞ্জ' নামটি কোন উৎস থেকে এসেছে জানি না। বিশ্বসেরা চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের বংশধারার পূর্বসূরি ধীজেন্দ্রকিশোর, হরিকিশোর প্রমুখ তো কিশোরগঞ্জেরই অধিবাসী। একটি পত্রিকায় একবার একটি ধাঁধা দেখেছিলাম, বাংলাদেশের কোন জেলায় 'প্রৌঢ় কিংবা বৃদ্ধ' নেই? উত্তর হলো, কিশোরগঞ্জ, যেখানে শুধুই 'কিশোর' মেলে। নিজের বাড়ি, নিজের নির্বাচনী এলাকায় গিয়েছিলেন সৈয়দ আশরাফ। হঠাৎ তিনি ঘেরাও হলেন কিশোরগঞ্জেরই একদল শিশু-কিশোর দ্বারা। ওদের হাতে ব্যানার, 'ও আশরাফ কাকু, আমাদের একটা শিশুপার্ক দাও না।'
সত্যি বলি, ব্যানারের এমন একটি বাক্য-ভাষায় চমকে গেছি, ভেসে গেছি প্রবল আনন্দে। জীবনের বেশির ভাগ সময় সামাজিক আন্দোলন ও আকর্ষণীয় কর্মসূচি সৃষ্টির কাজে অতিবাহিত করেছি। অবশেষে নিজেই চমকিত হয়ে গেলাম সামাজিক আন্দোলনের এমন অসাধারণ অনবদ্য প্রকাশে। কিশোরগঞ্জবাসীর, সব শিশু-কিশোর, জনক-জননীর প্রাণের দাবি_চাই একটি শিশুপার্ক। তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে এমন শিশুসুলভ আবদারের ভাষায় 'কাকুকে' ঘিরে ধরে এভাবে দাবি জানানোর আইডিয়া যাঁর বা যাঁদের মাথা থেকে এসেছে, তাঁদের হাজারো সালাম। যথাযোগ্য সামাজিক আন্দোলন কাকে বলে, কিশোরগঞ্জ থেকে শিখে নাও হে পৃথিবী। এমন দাবি সৈয়দ আশরাফের মতো মানুষ তো মেনে নেবেনই। এমন বুদ্ধিদীপ্ত শিশু ঘেরাওয়ে এতটুকু কূপিত হবেন যেকোনো স্বাভাবিক-মানবিক মানুষ। একটি প্রয়োজনীয় দাবি আদায়ের এটি সুন্দর পথ।
কিশোরগঞ্জ থেকে এবার ফিরে আসি পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল রাজধানী ঢাকা শহরে। এ শহরে এক কংক্রিট-দানব প্রবেশ করেছে লোভের ও আবাসন-প্রয়োজনের ফাঁকতাল-সড়ক দিয়ে। সেই লোভ, সেই কংক্রিট-দানব যা গিলে খাচ্ছে, তার নাম মুক্ত জমি, মুক্ত উদ্যান ও খোলা মাঠ। প্রতি ইঞ্চি জায়গাকে কংক্রিট দিয়ে মুড়ে দাও, মুদ্রার ঝনাৎকারে শিশুর উদ্দাম বিচরণের সব প্রান্তর গিলে ফেলো। অথচ রাজধানী ঢাকায় এখন চাই রবীন্দ্রসরোবরের মতো নূ্যনতম ১০০টি স্থান, চাই অজস্র শিশুপার্ক। নগর-বাহাদুর এখনো রোর্ডমার্চ-ক্ষমতামার্চে ব্যস্ত। এই শহরের শিশুরা আহা যদি নগরভবন ঘিরে একটি বিশাল ব্যানার ঝুলিয়ে ওই প্রধান নগর বাহাদুরকে ঘিরে কলরব-কলতান তোলে, 'ও খোকা দাদু, আমাদের ১০০টি খোলা মাঠ, শিশুপার্ক দাও না!' খোকা দাদুর এখনো ফোকলা দাঁত হয়নি, হয়তোবা মেডিক্যাল জাদুকরীতে। এদিকে যে খোকা দাদুর গোপীবাগ থেকেই সব বাগান উধাও। সারা দেশের সব ক্ষমতাবান কাকু-মামু-দাদুদের কাছে কিশোরগঞ্জের কায়দায় তাই বাংলার সব শিশু-কিশোরের মনের কথার সঙ্গে সায় দিয়ে বলতে চাই_দাও না, যত পারো শিশুপার্ক, খোলা মাঠ দাও না। এ দেশে আর কত খোলা মাঠ, নদী-নালা, প্রকৃতি খুন করে চলব আমরা_সমাজের চালাক-লোভীর দল!
লেখক : রম্যলেখক

No comments

Powered by Blogger.