সার বিপণন ব্যবস্থাপনা অমীমাংসিত কিছু সমস্যা by এ এম এম শওকত আলী
অক্টোবরের ৮ তারিখে একটি ইংরেজি দৈনিক তিন বিলিয়ন টাকা সারের উৎপাদন ভর্তুকি বাবদ অবমুক্ত করার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। এটা একমাত্র উৎপাদন ভর্তুকি নয়। এর কিছু অংশ বেসরকারি সার ডিলাররাও পায়। দেশে উৎপাদিত ও বিদেশ থেকে আমদানি করা ইউরিয়া, টিএসপি ও পটাশ সারের বিক্রয়মূল্য সরকার নির্ধারণ করে থাকে। উদ্দেশ্য কৃষকদের সহনীয় মূল্যে সার সরবরাহ নিশ্চিত করা। দুই উৎস থেকে প্রাপ্ত সারের সরকার নির্ধারিত মূল্য ও
উৎপাদিত অথবা আমদানি মূল্যের মধ্যে পার্থক্য থাকে। শেষোক্ত মূল্য সব সময়ই নির্ধারিত মূল্যের অধিক হয়। এ কারণেই ভর্তুকির প্রয়োজন। ১৯৯০ পূর্ববর্তী সময়ে সব ধরনের সার সংগ্রহ ও বিতরণ করার জন্য বিএডিসির একচেটিয়া অধিকার ছিল। এ অধিকার সম্পূর্ণরূপে ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে রহিত করা হয়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিতরণ করার জন্য বিএডিসির নিজস্ব থানা বিক্রয়কেন্দ্র ছাড়াও প্রায় এক লাখ ডিলার ছিল। মূলত এসব ডিলার বিভিন্ন হাট-বাজারে খুচরা মূল্যে সার বিক্রয়ে নিযুক্ত ছিল।
বিএডিসি কর্তৃক সার বিপণন ব্যবস্থা রহিত হওয়ার পরও এসব ডিলার কাজ চালিয়ে যায়। ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে বিসিআইসি নিজস্ব সার ফ্যাক্টরি থেকে ইউরিয়া ও টিএসপি সার বিপণনের জন্য ডিলার প্রথার প্রবর্তন করে। এসব ডিলারের মধ্যে অনেকেই আগে বিএডিসির ডিলার ছিল। অবশ্য কিছু নতুন ডিলারেরও উদ্ভব হয়। বিসিআইসি কর্তৃক ডিলারপ্রথা প্রবর্তনের বিষয়ে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর আপত্তি ছিল। বিসিআইসিসহ সরকারের যুক্তি ছিল, বিদেশি বেসরকারি মালিকানায় উৎপাদিত পণ্য বিপণনের জন্য যদি তারা নিজস্ব ডিলার নিয়োগ করে, তাহলে বিসিআইসি কেন করতে পারবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে দাতাগোষ্ঠীর আপত্তি অগ্রাহ্য করে ডিলারপ্রথা স্থায়ী রূপ লাভ করে। প্রতি জেলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডিলার নিয়োগ করা হয়। ওই সময় উপজেলা পর্যায়ে কোনো ডিলার ছিল না। প্রয়োজনও ছিল না। কারণ বিএডিসির পূর্ববর্তী সময়ের থানা পর্যায়ের খুচরা সার ডিলাররা জেলার ডিলারের সার ক্রয় করে বিপণন করত।
১৯৯৪-৯৫ সালে ইউরিয়া সারের ভয়ংকর সংকটের পর ১৯৯৬-২০০১ সালে সরকার ডিলার ব্যবস্থাকে আরো সুসংহত করে। ওই সময় উপজেলা পর্যায়েও সার ডিলার নিয়োগের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি। এর পেছনে দুটি কারণ ছিল প্রধান। এক. উপজেলা পর্যায়ে সার সরবরাহ ও বিপণনব্যবস্থা পরিবীক্ষণে সমস্যা। দুই. জেলা পর্যায়ে সার ডিলারদের প্রাপ্য সারের পরিমাণ হ্রাসের ফলে সার বিপণন অলাভজনক হওয়া। ২০০৭-০৮ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় প্রথম উপজেলা পর্যায়ে উপডিলার বা সেলস এজেন্ট প্রথার প্রর্বতন করে। এ সিদ্ধান্তের ফলে ইউনিয়নের একাধিক ওয়ার্ডে সার সরবরাহ নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। এ সিদ্ধান্ত কতটুকু কার্যকর হয়েছিল তা অনুসন্ধানযোগ্য। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ২০০৯ সালে 'সার বিপণন নীতিমালা-২০০৯' জারি করে। এ নীতিতেও উপজেলাভিত্তিক খুচরা সার ব্যবসায়ী প্রথা অনেকটা স্থায়ী রূপ লাভ করে। এ ব্যবস্থার কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য ২০১০ সালে একটি সমীক্ষা করা হয়। একাধিক জেলার কয়েকটি উপজেলা নিয়ে এ সমীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায়, কোনো উপজেলায়ই এ ব্যবস্থা স্থায়ী রূপ লাভ করেনি। সমীক্ষাধীন সব জেলায় অনেকেই খুচরা বিক্রেতা হওয়ার জন্য কোনো আবেদন করেননি। অন্যদিকে যারা নির্বাচিত হয়েছিল তাদের অনেকেই প্রয়োজনীয় জামানতের টাকা দাখিল করেনি। সমীক্ষার গবেষকরা উপজেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়টি জানতে পারে।
জেলার বীজ ও সার বিপণন পরিবীক্ষণ কমিটির সদস্য ব্যতীত এতে কৃষক, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তিও উপস্থিত ছিল। দীর্ঘ আলোচনার পর প্রবর্তিত ব্যবস্থার অকার্যকারিতার জন্য কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করা হয়। এক. উপজেলা পর্যায়ে সার ব্যবসায়ী নির্বাচন পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। দুই. অনেক ক্ষেত্রেই সার ব্যবসায়ী হওয়ার জন্য কোনো অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। এ বিষয়ে অনেকেই মনে করে যে সার ব্যবসা মৌসুমভিত্তিক ও ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় এটা লাভজনক ব্যবসা হবে না। তিন. কিছু সার ব্যবসায়ী মনে করে, যাদের ব্যবসা প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত, সেখানে সার পরিবহনে যে ব্যয় হয়, তাতে নির্ধারিত মূল্য দিয়ে ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়। চার. এর মধ্যে স্বল্পসংখ্যক ব্যবসায়ী মনে করে, জেলাভিত্তিক ডিলারদের কাছ থেকে চাহিদা মোতাবেক সার তারা পায় না। এসব আলোচনা সভায় উপস্থিত অনেকেই আগের উন্মুক্ত খুচরা সার ব্যবসা প্রথার পক্ষে মত প্রদান করে।
ওই সময় সমীক্ষা দল আরো একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। উপজেলা পর্যায়ে এ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ কার্যকর না হওয়া সত্ত্বেও সারের সরবরাহ নিয়ে কেন কোনো সংকট হয়নি_আলোচনায় এ প্রশ্নের উত্তর ছিল প্রধানত তিনটি। এক. জেলাভিত্তিক সার ডিলাররা শর্তানুযায়ী প্রাপ্ত সারের শতকরা ৫০ ভাগ নিজেরাই বিক্রি করতে সক্ষম। দুই. উপজেলাভিত্তিক সার ডিলারদের পাশাপাশি কিছু ব্যবসায়ী, যারা আগে এ কাজ করত, তারা এখনো এ ব্যবসা করছে। মূলত এরাই জেলাভিত্তিক ডিলারদের কাছ থেকে সার কিনে হাটে-বাজারে বিক্রি শুরু করেছে। তাদের স্থানীয়ভাবে বলা হয় ঝবপড়হফধৎু গধৎশবঃ। জেলা কমিটির প্রধান ডিসি এবং বিএফএর সদস্যদের মতে, তাঁরা এ ব্যবসা আইনে নিষিদ্ধ হলেও কোনো প্রতিরোধ সৃষ্টি করেননি। কারণ আইন প্রয়োগ করলে সংকটের সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণেই কোনো সংকট সৃষ্টি হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অনিবন্ধিত সার ব্যবসায়ীদের এ ব্যবসা অবাধে চালাতে সাহায্য করে।
উপর্যুক্ত বিষয়টি আইনের অকার্যকারিতাই প্রকাশ করে। কারণ বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। ধরে নেওয়া যায় যে এর জন্য আইনের সংস্কার প্রয়োজন। নিবন্ধন প্রথা আইনে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে উত্তম। উদ্দেশ্য হলো, কেউ যেন ভেজাল সার বিক্রি করতে না পারে। এ বিষয়ে আরো বলা হয়েছে, বাধ্যতামূলক নিবন্ধন সম্পর্কিত আইনের বিধান বাস্তবসম্মত নয়। কারণ এর ফলে ভেজাল সার বিক্রি বন্ধ হয়নি। মূলত ভেজাল সারের উৎস দুটি। এক. পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অবৈধ পথে আসা কিছু সার, যেমন জিংক বা এসএসপি। দুই. বেসরকারি মালিকানায় প্রস্তুত এনপিকেএস সার। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন নিবিড় পরিবীক্ষণসহ নির্ভুল পরীক্ষার মাধ্যমে আইনের যথাযথ প্রয়োগ। আইন প্রয়োগ বর্তমানে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে করা হয়। এ ব্যবস্থায় অনেক দুর্বলতা রয়েছে। যে বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে_ক. প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব; খ. জেলা পর্যায়ে মৃত্তিকা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার পরীক্ষাগারের অপ্রতুলতা; গ. পরীক্ষার জন্য মানসম্পন্ন রিএজেন্ট সংগ্রহের প্রতিবন্ধকতা এবং ঘ. পরিবীক্ষণের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তার কিছু সংগত কারণে এ কাজে অনীহা।
নব্বই দশকের প্রথমার্ধে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সব ধরনের সার ব্যবসায়ীর সমন্বয়ে একটি সংগঠন করা হয়। এর নাম বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ)। এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল এটি একটি পেশাদারি সংগঠন হিসেবে সার সংগ্রহ, আমদানি, বিপণনসহ আরো কিছু কাজ করবে, যা দেশের কৃষি উৎপাদনে সহায়ক হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যথাসময়ে চাহিদা মোতাবেক সার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহসহ বিপণন। ভেজাল সার বিপণন প্রতিরোধ ও জমির উর্বরতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত বিষয় ও অন্যান্য ক্ষেত্র।
প্রতিবছর সারের চাহিদা নিরূপণ করার জন্য কৃষিমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি দায়িত্ব পালন করে। শিল্পমন্ত্রীও এর সদস্য বা কো-চেয়ারম্যান। চাহিদা নিরূপণের জন্য জাতীয় কমিটি মাঠ পর্যায়ের কৃষিকর্মীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে চাহিদা নিরূপণ করে থাকে। বিএফএর চেয়ারম্যানও এর সদস্য। নির্ধারিত চাহিদা নিয়ে কিছু বিতর্কও রয়েছে। বিএফএর মতে, তাদের ওপর অতিরিক্ত চাহিদা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের মনে সন্দেহ, বিএফএ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে। এর জন্য বিএডিসিকে দেওয়া হয়েছে টিএসপি, ডিএপি ও পটাশ সার আমদানির দায়িত্ব। মোট নির্ধারিত চাহিদার শতকরা ৫০ ভাগ বিএডিসি আমদানি করে। অন্যদিকে চাহিদা মোতাবেক ইউরিয়া সার আমদানির জন্য বিসিআইসিকে একচেটিয়া অধিকার দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি আমদানিকারকরা এ সার আমদানি করতে পারে না।
সব মিলিয়ে সার সংগ্রহ ও বিপণন ব্যবস্থায় এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার জন্য প্রয়োজন সংস্কার। বিএফএরও সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ পেশাদারি সংগঠন হিসেবে কাজ করতে সক্ষম না হলে এটি কখনো সরকার তথা জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে না।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
বিএডিসি কর্তৃক সার বিপণন ব্যবস্থা রহিত হওয়ার পরও এসব ডিলার কাজ চালিয়ে যায়। ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে বিসিআইসি নিজস্ব সার ফ্যাক্টরি থেকে ইউরিয়া ও টিএসপি সার বিপণনের জন্য ডিলার প্রথার প্রবর্তন করে। এসব ডিলারের মধ্যে অনেকেই আগে বিএডিসির ডিলার ছিল। অবশ্য কিছু নতুন ডিলারেরও উদ্ভব হয়। বিসিআইসি কর্তৃক ডিলারপ্রথা প্রবর্তনের বিষয়ে বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর আপত্তি ছিল। বিসিআইসিসহ সরকারের যুক্তি ছিল, বিদেশি বেসরকারি মালিকানায় উৎপাদিত পণ্য বিপণনের জন্য যদি তারা নিজস্ব ডিলার নিয়োগ করে, তাহলে বিসিআইসি কেন করতে পারবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে দাতাগোষ্ঠীর আপত্তি অগ্রাহ্য করে ডিলারপ্রথা স্থায়ী রূপ লাভ করে। প্রতি জেলায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডিলার নিয়োগ করা হয়। ওই সময় উপজেলা পর্যায়ে কোনো ডিলার ছিল না। প্রয়োজনও ছিল না। কারণ বিএডিসির পূর্ববর্তী সময়ের থানা পর্যায়ের খুচরা সার ডিলাররা জেলার ডিলারের সার ক্রয় করে বিপণন করত।
১৯৯৪-৯৫ সালে ইউরিয়া সারের ভয়ংকর সংকটের পর ১৯৯৬-২০০১ সালে সরকার ডিলার ব্যবস্থাকে আরো সুসংহত করে। ওই সময় উপজেলা পর্যায়েও সার ডিলার নিয়োগের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা করা হয়নি। এর পেছনে দুটি কারণ ছিল প্রধান। এক. উপজেলা পর্যায়ে সার সরবরাহ ও বিপণনব্যবস্থা পরিবীক্ষণে সমস্যা। দুই. জেলা পর্যায়ে সার ডিলারদের প্রাপ্য সারের পরিমাণ হ্রাসের ফলে সার বিপণন অলাভজনক হওয়া। ২০০৭-০৮ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় প্রথম উপজেলা পর্যায়ে উপডিলার বা সেলস এজেন্ট প্রথার প্রর্বতন করে। এ সিদ্ধান্তের ফলে ইউনিয়নের একাধিক ওয়ার্ডে সার সরবরাহ নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়। এ সিদ্ধান্ত কতটুকু কার্যকর হয়েছিল তা অনুসন্ধানযোগ্য। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ২০০৯ সালে 'সার বিপণন নীতিমালা-২০০৯' জারি করে। এ নীতিতেও উপজেলাভিত্তিক খুচরা সার ব্যবসায়ী প্রথা অনেকটা স্থায়ী রূপ লাভ করে। এ ব্যবস্থার কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য ২০১০ সালে একটি সমীক্ষা করা হয়। একাধিক জেলার কয়েকটি উপজেলা নিয়ে এ সমীক্ষা করা হয়। এতে দেখা যায়, কোনো উপজেলায়ই এ ব্যবস্থা স্থায়ী রূপ লাভ করেনি। সমীক্ষাধীন সব জেলায় অনেকেই খুচরা বিক্রেতা হওয়ার জন্য কোনো আবেদন করেননি। অন্যদিকে যারা নির্বাচিত হয়েছিল তাদের অনেকেই প্রয়োজনীয় জামানতের টাকা দাখিল করেনি। সমীক্ষার গবেষকরা উপজেলা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সব ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়টি জানতে পারে।
জেলার বীজ ও সার বিপণন পরিবীক্ষণ কমিটির সদস্য ব্যতীত এতে কৃষক, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তিও উপস্থিত ছিল। দীর্ঘ আলোচনার পর প্রবর্তিত ব্যবস্থার অকার্যকারিতার জন্য কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করা হয়। এক. উপজেলা পর্যায়ে সার ব্যবসায়ী নির্বাচন পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। দুই. অনেক ক্ষেত্রেই সার ব্যবসায়ী হওয়ার জন্য কোনো অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। এ বিষয়ে অনেকেই মনে করে যে সার ব্যবসা মৌসুমভিত্তিক ও ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় এটা লাভজনক ব্যবসা হবে না। তিন. কিছু সার ব্যবসায়ী মনে করে, যাদের ব্যবসা প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত, সেখানে সার পরিবহনে যে ব্যয় হয়, তাতে নির্ধারিত মূল্য দিয়ে ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়। চার. এর মধ্যে স্বল্পসংখ্যক ব্যবসায়ী মনে করে, জেলাভিত্তিক ডিলারদের কাছ থেকে চাহিদা মোতাবেক সার তারা পায় না। এসব আলোচনা সভায় উপস্থিত অনেকেই আগের উন্মুক্ত খুচরা সার ব্যবসা প্রথার পক্ষে মত প্রদান করে।
ওই সময় সমীক্ষা দল আরো একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। উপজেলা পর্যায়ে এ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ কার্যকর না হওয়া সত্ত্বেও সারের সরবরাহ নিয়ে কেন কোনো সংকট হয়নি_আলোচনায় এ প্রশ্নের উত্তর ছিল প্রধানত তিনটি। এক. জেলাভিত্তিক সার ডিলাররা শর্তানুযায়ী প্রাপ্ত সারের শতকরা ৫০ ভাগ নিজেরাই বিক্রি করতে সক্ষম। দুই. উপজেলাভিত্তিক সার ডিলারদের পাশাপাশি কিছু ব্যবসায়ী, যারা আগে এ কাজ করত, তারা এখনো এ ব্যবসা করছে। মূলত এরাই জেলাভিত্তিক ডিলারদের কাছ থেকে সার কিনে হাটে-বাজারে বিক্রি শুরু করেছে। তাদের স্থানীয়ভাবে বলা হয় ঝবপড়হফধৎু গধৎশবঃ। জেলা কমিটির প্রধান ডিসি এবং বিএফএর সদস্যদের মতে, তাঁরা এ ব্যবসা আইনে নিষিদ্ধ হলেও কোনো প্রতিরোধ সৃষ্টি করেননি। কারণ আইন প্রয়োগ করলে সংকটের সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণেই কোনো সংকট সৃষ্টি হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অনিবন্ধিত সার ব্যবসায়ীদের এ ব্যবসা অবাধে চালাতে সাহায্য করে।
উপর্যুক্ত বিষয়টি আইনের অকার্যকারিতাই প্রকাশ করে। কারণ বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। ধরে নেওয়া যায় যে এর জন্য আইনের সংস্কার প্রয়োজন। নিবন্ধন প্রথা আইনে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে উত্তম। উদ্দেশ্য হলো, কেউ যেন ভেজাল সার বিক্রি করতে না পারে। এ বিষয়ে আরো বলা হয়েছে, বাধ্যতামূলক নিবন্ধন সম্পর্কিত আইনের বিধান বাস্তবসম্মত নয়। কারণ এর ফলে ভেজাল সার বিক্রি বন্ধ হয়নি। মূলত ভেজাল সারের উৎস দুটি। এক. পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে অবৈধ পথে আসা কিছু সার, যেমন জিংক বা এসএসপি। দুই. বেসরকারি মালিকানায় প্রস্তুত এনপিকেএস সার। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন নিবিড় পরিবীক্ষণসহ নির্ভুল পরীক্ষার মাধ্যমে আইনের যথাযথ প্রয়োগ। আইন প্রয়োগ বর্তমানে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে করা হয়। এ ব্যবস্থায় অনেক দুর্বলতা রয়েছে। যে বিষয়গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে_ক. প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব; খ. জেলা পর্যায়ে মৃত্তিকা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার পরীক্ষাগারের অপ্রতুলতা; গ. পরীক্ষার জন্য মানসম্পন্ন রিএজেন্ট সংগ্রহের প্রতিবন্ধকতা এবং ঘ. পরিবীক্ষণের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তার কিছু সংগত কারণে এ কাজে অনীহা।
নব্বই দশকের প্রথমার্ধে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সব ধরনের সার ব্যবসায়ীর সমন্বয়ে একটি সংগঠন করা হয়। এর নাম বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ)। এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল এটি একটি পেশাদারি সংগঠন হিসেবে সার সংগ্রহ, আমদানি, বিপণনসহ আরো কিছু কাজ করবে, যা দেশের কৃষি উৎপাদনে সহায়ক হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যথাসময়ে চাহিদা মোতাবেক সার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহসহ বিপণন। ভেজাল সার বিপণন প্রতিরোধ ও জমির উর্বরতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত বিষয় ও অন্যান্য ক্ষেত্র।
প্রতিবছর সারের চাহিদা নিরূপণ করার জন্য কৃষিমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি দায়িত্ব পালন করে। শিল্পমন্ত্রীও এর সদস্য বা কো-চেয়ারম্যান। চাহিদা নিরূপণের জন্য জাতীয় কমিটি মাঠ পর্যায়ের কৃষিকর্মীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে চাহিদা নিরূপণ করে থাকে। বিএফএর চেয়ারম্যানও এর সদস্য। নির্ধারিত চাহিদা নিয়ে কিছু বিতর্কও রয়েছে। বিএফএর মতে, তাদের ওপর অতিরিক্ত চাহিদা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়। সরকারি কর্মকর্তাদের মনে সন্দেহ, বিএফএ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে। এর জন্য বিএডিসিকে দেওয়া হয়েছে টিএসপি, ডিএপি ও পটাশ সার আমদানির দায়িত্ব। মোট নির্ধারিত চাহিদার শতকরা ৫০ ভাগ বিএডিসি আমদানি করে। অন্যদিকে চাহিদা মোতাবেক ইউরিয়া সার আমদানির জন্য বিসিআইসিকে একচেটিয়া অধিকার দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি আমদানিকারকরা এ সার আমদানি করতে পারে না।
সব মিলিয়ে সার সংগ্রহ ও বিপণন ব্যবস্থায় এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার জন্য প্রয়োজন সংস্কার। বিএফএরও সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। কারণ পেশাদারি সংগঠন হিসেবে কাজ করতে সক্ষম না হলে এটি কখনো সরকার তথা জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে না।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments