অর্থনীতি-ক্ষুদ্রঋণ :বাস্তবতা ও সম্ভাবনা by এম মাসুদুর রহমান
ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে একদিকে যেমন স্বচ্ছতা আনতে হবে, তেমনি অন্যদিকে খরচ কমিয়ে সার্ভিস চার্জের মাত্রা কমাতে হবে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের প্রধান উদ্দেশ্য দারিদ্র্য বিমোচন, এই মানসিকতার পরিচয় দিতে হবে। ব্যবসা করার প্রবণতা থেকে সরে এসে আমাদের বড় এনজিওগুলোকে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে বর্তমানে সারাবিশ্বে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তার স্বরূপ বিশেল্গষণ করতে হলে, ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রমের
বিভিন্ন দিক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশেল্গষণ করা প্রয়োজন। এটা অনস্বীকার্য, ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। অনেক গবেষণাতে দারিদ্র্য বিমোচন ও সার্বিক সামাজিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণের বহুমাত্রিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে এনজিওগুলো বছরে দু'বার তাদের সার্বিক তথ্য বিবরণী মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিতে প্রেরণ করে। তাছাড়া আমরা নিয়মিত মাঠ পর্যায়ে সার্ভে করে তাদের তথ্য ও উপাত্ত বিশেল্গষণ করে ক্ষুদ্রঋণের ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে একদিকে অনেক নারী যেমন লাভবান হচ্ছে, তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে কিছু এনজিও দরিদ্র মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের শোষণ করছে। দেশে প্রায় দুই কোটি ক্ষুদ্র, নিরক্ষর ও দরিদ্র মানুষ ক্ষুদ্রঋণের গ্রাহক। এই বিশাল ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে অনেক বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকতে পারে এবং এর মাধ্যমে সবার ভাগ্য উন্নয়নে সমানভাবে অবদান রাখা সম্ভবও নয়। সেখানে শতভাগ সাফল্য অবশ্য যুক্তিসঙ্গত কারণেই অর্জন সম্ভব নয়। তবে ক্ষুদ্রঋণের এ সমস্যাগুলো বিশেল্গষণ করে কীভাবে এই মডেল আরও কার্যকর করা যায় সে নির্দেশনা অত্যন্ত জরুরি।
ক্ষুদ্রঋণ এখন দ্বিতীয় প্রজন্মে প্রবেশ করেছে, বিশ্বব্যাপী এই মডেল ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে আজ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অনেক বহুজাতিক কোম্পানি ক্ষুদ্রঋণের বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে অনেক আন্তর্জাতিক কোম্পানি কার্যক্রম শুরু করছে। ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রমে আরও গতিশীলতা ও দারিদ্র্য বিমোচনে সফলভাবে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০০৬ সালে এমআরএ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এই খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ক্ষুদ্রঋণকে আরও কার্যকর ও টেকসই করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এমআরএতে ৪ হাজার ৫০০-এর বেশি এনজিও-এমএফআই সনদের জন্য দরখাস্ত করেছিল। ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত এমআরএ মাত্র ৬০০টি এনজিওকে লাইসেন্স দিয়েছে। এমআরএ থেকে জুন ২০১০ পর্যন্ত সনদপ্রাপ্ত ৫১৬টি প্রতিষ্ঠানের ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ১৯.২১ মিলিয়ন এবং মাঠ পর্যায়ে ঋণস্থিতি ১৪৫ বিলিয়ন টাকা ও সদস্যদের সঞ্চয়ের পরিমাণ ৫১.৪ বিলিয়ন টাকা। যা জুন ২০১১ সালে (৬০০টি) ঋণস্থিতির পরিমাণ ২০% বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৭৩.৬৯ বিলিয়ন টাকা এবং সঞ্চয়ের পরিমাণ ২৩% বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৩.১৬ বিলিয়ন টাকা।
যে ৬০০টি এনজিওকে সনদ দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকগুলোকে একাধিকবার বিভিন্ন কারণে সতর্ক করা হচ্ছে তাদের কার্যক্রমে আরও শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা আনার জন্য। মূলত এমএফআই প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণস্থিতির ৮৫% আগে কিছু বড় (১০টি) এনজিও থেকে আসে। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছোট-বড় সবধরনের এনজিও-এমএফআই পর্যবেক্ষণ করা এমআরএর কর্মপরিধির আওতাভুক্ত। বিশেষ করে বড় এনজিওগুলো পর্যবেক্ষণ বা তদারকি করা এমআরএর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। ৬০০টি এনজিও দেখভাল বা তদারকি করার জন্য পর্যাপ্ত জনবল ও অবকাঠামো এমআরএতে বর্তমানে নেই। প্রয়োজনীয় লোকবল বৃদ্ধির প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বিবেচনাধীন রয়েছে।
ক্ষুদ্রঋণের প্রধান বিতর্ক হলো ঋণের ওপর উচ্চ সুদের হার ও দরিদ্রদের সঞ্চয়ের ওপর নিম্ন সুদের হার। বর্তমানে অধিকাংশ এনজিওর সুদের হার ২৫-৩০ ভাগের মধ্যে। ব্র্যাক, আশা, টিএমএসএস, ব্যুরো প্রভৃতি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের গ্রাহককে প্রদত্ত ঋণের সর্বনিম্ন সুদের হার প্রায় ৩০%। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম, ২০%। বাংলাদেশি এনজিও যারা আফ্রিকা বা অন্যান্য দেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছে তাদের সুদের হার উচ্চ। যেমন_ ব্র্যাকের সুদের হার আফ্রিকার দেশগুলোতে ফ্ল্যাট ২২% অর্থাৎ ক্রমহ্রাসমান পদ্ধতিতে প্রায় ৪৪%। উলেল্গখ্য, এটাই ওই অঞ্চলের সর্বনিম্ন সুদের হার। অন্যান্য এনজিও আরও অধিক হারে সুদ নিয়ে থাকে।
অন্যদিকে যেসব এনজিও পিকেএসএফ থেকে ঋণ নিয়েছে তাদের সুদের হার প্রায় ২৫%। কারণ, তারা পিকেএসএফ থেকে ৬% হারে ঋণ নিয়ে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন রকমের ঋণের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুদ ধার্য করে থাকে এবং সবগুলোর সুদের হার অত্যন্ত বেশি, ৩০%-এর ওপর। এখন প্রশ্ন হলো, তাদের এ সুদের হার কতটুকু যৌক্তিক? এ ছাড়া এ সুদ ছাড়াও অন্যান্য খরচ ও বীমা বাবদ তারা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রাখে, বিভিন্ন রকমের সঞ্চয় নিয়ে থাকে এবং সেসব সঞ্চয়ের ওপর মাত্র ৪-৬% হারে সুদ দিয়ে থাকে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
তবে এমআরএ কর্তৃক সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়ায় এখন অতি উচ্চ সুদের হার থেকে এনজিওগুলো সরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। সম্প্রতি এমআরএ সর্বোচ্চ সুদের হার ২৭% নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা গত জুলাই মাস থেকে কার্যকর হয়েছে। এমআরএর গবেষণা থেকে পাওয়া গেছে, সার্ভিস চার্জ কোনোভাবেই ১০%-এর বেশি হয় না। সে হিসাবে সর্বোচ্চ সুদের হার মূলধনের ১০% ও সার্ভিস চার্জ ১০% ধরে সুদের হার ২০%-এর ওপর যায় না। এ ক্ষেত্রে সুদের হার ২০-২২%-এর মধ্যে রাখা উচিত। এ সীমার ওপর সুদ কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে একদিকে যেমন স্বচ্ছতা আনতে হবে, তেমনি অন্যদিকে খরচ কমিয়ে সার্ভিস চার্জের মাত্রা কমাতে হবে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের প্রধান উদ্দেশ্য দারিদ্র্য বিমোচন, এই মানসিকতার পরিচয় দিতে হবে। ব্যবসা করার প্রবণতা থেকে সরে এসে আমাদের বড় এনজিওগুলোকে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রঋণের ফান্ডের একটি ঘাটতি সমস্যা দেখা দিতে পারে। কেননা এ খাত প্রথম দিকের দাতানির্ভর অবস্থান থেকে সরে এসে আত্মনির্ভরশীল বা দেশীয় অর্থের জোগানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৬ সালের দিকে ২৫% ফান্ড আসত দাতাদের অনুদান থেকে। সেটা এখন ৩.৫% -এ কমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক এগিয়ে আসছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে এমএফআইদের অবশ্যই প্রচলিত হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি মেনে চলতে হবে, কার্যক্রমকে আরও স্বচ্ছ করতে হবে।
এমআরএ এ পর্যন্ত ৬০০টি এনজিওকে লাইসেন্স দিয়েছে এবং তাদের মনিটরিং করছে। তাদের প্রশিক্ষণও হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে এবং সংশিল্গষ্ট প্রতিষ্ঠান ও পরিচালনা পর্ষদকে একটি সার্বিক কাঠামোর মধ্যে আনার চেষ্টা চলছে। তবে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করতে হলে সংস্থাগুলোকে মাইক্রোএন্টারপ্রাইজে উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান ও ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং তা দিয়ে ধীরে ধীরে এসএমইর দিকে চালিত করতে হবে।
এনজিওগুলোর লভ্যাংশ যেহেতু সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করার কোনো সুযোগ নেই, ফলে দেখা যায় ব্যবস্থাপনা পরিষদ এই লভ্যাংশ নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নয়নে ব্যয় করে থাকে অথবা অন্যান্য লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করে থাকে। এমআরএতে প্রতিদিন অসংখ্য দরখাস্ত আসছে লভ্যাংশে একটি অংশ অন্য কোথায়ও বিনিয়োগ করার জন্য। যেহেতু এমআরএ আইনে বলা হয়েছে, লভ্যাংশ অন্য কোথাও বিনিয়োগ করা যাবে না এমআরএর পূর্ব অনুমতি ছাড়া। সে জন্য অনেক সময় এই লভ্যাংশ মালিক নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে থাকে, সেটা কাম্য হতে পারে না।
গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষ বিশেষত নারীদের একত্র করে, যাদের কোনোদিন ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার অবস্থা ছিল না, তাদের ঋণ দিয়ে আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তন করে দেওয়ার জন্য ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। গ্রামীণ জীবনে অর্থের প্রবাহ বেড়েছে, গরিব কৃষকের কাছে ক্ষুদ্রঋণের সহজলভ্যতা বেড়েছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে তাদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়ছে। এমনকি বাংলাদেশের বড় এনজিওগুলো তাদের কার্যক্রম পৃথিবীর অনেক দেশে বহু আগেই শুরু করে দিয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণের বহুবিধ প্রভাব রয়েছে। সেটা সহজেই অনুধাবন করা যায়। তবে লক্ষ্য করা যায় যে, কিছু এনজিও প্রধান উদ্দেশ্য থেকে সরে এসেছে। তারা মূলত নিজেদের ব্যবসায়িক মুনাফা লাভের জন্য তাদের কাজ করে চলছে। ক্ষুদ্রঋণে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা অধিক স্বচ্ছ, কার্যকরী হওয়া প্রয়োজন। উন্নয়ন এবং গ্রাহককে প্রদেয় ঋণের উৎপাদনমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যাবে।
ড. এম মাসুদুর রহমান
অর্থনীতিবিদ, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি
masud611@hotmail.com
ক্ষুদ্রঋণ এখন দ্বিতীয় প্রজন্মে প্রবেশ করেছে, বিশ্বব্যাপী এই মডেল ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশে আজ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অনেক বহুজাতিক কোম্পানি ক্ষুদ্রঋণের বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে অনেক আন্তর্জাতিক কোম্পানি কার্যক্রম শুরু করছে। ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রমে আরও গতিশীলতা ও দারিদ্র্য বিমোচনে সফলভাবে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০০৬ সালে এমআরএ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এই খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ক্ষুদ্রঋণকে আরও কার্যকর ও টেকসই করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এমআরএতে ৪ হাজার ৫০০-এর বেশি এনজিও-এমএফআই সনদের জন্য দরখাস্ত করেছিল। ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত এমআরএ মাত্র ৬০০টি এনজিওকে লাইসেন্স দিয়েছে। এমআরএ থেকে জুন ২০১০ পর্যন্ত সনদপ্রাপ্ত ৫১৬টি প্রতিষ্ঠানের ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ১৯.২১ মিলিয়ন এবং মাঠ পর্যায়ে ঋণস্থিতি ১৪৫ বিলিয়ন টাকা ও সদস্যদের সঞ্চয়ের পরিমাণ ৫১.৪ বিলিয়ন টাকা। যা জুন ২০১১ সালে (৬০০টি) ঋণস্থিতির পরিমাণ ২০% বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১৭৩.৬৯ বিলিয়ন টাকা এবং সঞ্চয়ের পরিমাণ ২৩% বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৩.১৬ বিলিয়ন টাকা।
যে ৬০০টি এনজিওকে সনদ দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকগুলোকে একাধিকবার বিভিন্ন কারণে সতর্ক করা হচ্ছে তাদের কার্যক্রমে আরও শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা আনার জন্য। মূলত এমএফআই প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণস্থিতির ৮৫% আগে কিছু বড় (১০টি) এনজিও থেকে আসে। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছোট-বড় সবধরনের এনজিও-এমএফআই পর্যবেক্ষণ করা এমআরএর কর্মপরিধির আওতাভুক্ত। বিশেষ করে বড় এনজিওগুলো পর্যবেক্ষণ বা তদারকি করা এমআরএর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। ৬০০টি এনজিও দেখভাল বা তদারকি করার জন্য পর্যাপ্ত জনবল ও অবকাঠামো এমআরএতে বর্তমানে নেই। প্রয়োজনীয় লোকবল বৃদ্ধির প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বিবেচনাধীন রয়েছে।
ক্ষুদ্রঋণের প্রধান বিতর্ক হলো ঋণের ওপর উচ্চ সুদের হার ও দরিদ্রদের সঞ্চয়ের ওপর নিম্ন সুদের হার। বর্তমানে অধিকাংশ এনজিওর সুদের হার ২৫-৩০ ভাগের মধ্যে। ব্র্যাক, আশা, টিএমএসএস, ব্যুরো প্রভৃতি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের গ্রাহককে প্রদত্ত ঋণের সর্বনিম্ন সুদের হার প্রায় ৩০%। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম, ২০%। বাংলাদেশি এনজিও যারা আফ্রিকা বা অন্যান্য দেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছে তাদের সুদের হার উচ্চ। যেমন_ ব্র্যাকের সুদের হার আফ্রিকার দেশগুলোতে ফ্ল্যাট ২২% অর্থাৎ ক্রমহ্রাসমান পদ্ধতিতে প্রায় ৪৪%। উলেল্গখ্য, এটাই ওই অঞ্চলের সর্বনিম্ন সুদের হার। অন্যান্য এনজিও আরও অধিক হারে সুদ নিয়ে থাকে।
অন্যদিকে যেসব এনজিও পিকেএসএফ থেকে ঋণ নিয়েছে তাদের সুদের হার প্রায় ২৫%। কারণ, তারা পিকেএসএফ থেকে ৬% হারে ঋণ নিয়ে থাকে। এ ছাড়া বিভিন্ন রকমের ঋণের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুদ ধার্য করে থাকে এবং সবগুলোর সুদের হার অত্যন্ত বেশি, ৩০%-এর ওপর। এখন প্রশ্ন হলো, তাদের এ সুদের হার কতটুকু যৌক্তিক? এ ছাড়া এ সুদ ছাড়াও অন্যান্য খরচ ও বীমা বাবদ তারা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রাখে, বিভিন্ন রকমের সঞ্চয় নিয়ে থাকে এবং সেসব সঞ্চয়ের ওপর মাত্র ৪-৬% হারে সুদ দিয়ে থাকে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।
তবে এমআরএ কর্তৃক সুদের হার নির্ধারণ করে দেওয়ায় এখন অতি উচ্চ সুদের হার থেকে এনজিওগুলো সরে আসতে বাধ্য হচ্ছে। সম্প্রতি এমআরএ সর্বোচ্চ সুদের হার ২৭% নির্ধারণ করে দিয়েছে, যা গত জুলাই মাস থেকে কার্যকর হয়েছে। এমআরএর গবেষণা থেকে পাওয়া গেছে, সার্ভিস চার্জ কোনোভাবেই ১০%-এর বেশি হয় না। সে হিসাবে সর্বোচ্চ সুদের হার মূলধনের ১০% ও সার্ভিস চার্জ ১০% ধরে সুদের হার ২০%-এর ওপর যায় না। এ ক্ষেত্রে সুদের হার ২০-২২%-এর মধ্যে রাখা উচিত। এ সীমার ওপর সুদ কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে একদিকে যেমন স্বচ্ছতা আনতে হবে, তেমনি অন্যদিকে খরচ কমিয়ে সার্ভিস চার্জের মাত্রা কমাতে হবে। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের প্রধান উদ্দেশ্য দারিদ্র্য বিমোচন, এই মানসিকতার পরিচয় দিতে হবে। ব্যবসা করার প্রবণতা থেকে সরে এসে আমাদের বড় এনজিওগুলোকে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রঋণের ফান্ডের একটি ঘাটতি সমস্যা দেখা দিতে পারে। কেননা এ খাত প্রথম দিকের দাতানির্ভর অবস্থান থেকে সরে এসে আত্মনির্ভরশীল বা দেশীয় অর্থের জোগানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৬ সালের দিকে ২৫% ফান্ড আসত দাতাদের অনুদান থেকে। সেটা এখন ৩.৫% -এ কমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক এগিয়ে আসছে। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে এমএফআইদের অবশ্যই প্রচলিত হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি মেনে চলতে হবে, কার্যক্রমকে আরও স্বচ্ছ করতে হবে।
এমআরএ এ পর্যন্ত ৬০০টি এনজিওকে লাইসেন্স দিয়েছে এবং তাদের মনিটরিং করছে। তাদের প্রশিক্ষণও হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে এবং সংশিল্গষ্ট প্রতিষ্ঠান ও পরিচালনা পর্ষদকে একটি সার্বিক কাঠামোর মধ্যে আনার চেষ্টা চলছে। তবে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করতে হলে সংস্থাগুলোকে মাইক্রোএন্টারপ্রাইজে উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থান ও ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে এবং তা দিয়ে ধীরে ধীরে এসএমইর দিকে চালিত করতে হবে।
এনজিওগুলোর লভ্যাংশ যেহেতু সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করার কোনো সুযোগ নেই, ফলে দেখা যায় ব্যবস্থাপনা পরিষদ এই লভ্যাংশ নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নয়নে ব্যয় করে থাকে অথবা অন্যান্য লাভজনক কাজে বিনিয়োগ করে থাকে। এমআরএতে প্রতিদিন অসংখ্য দরখাস্ত আসছে লভ্যাংশে একটি অংশ অন্য কোথায়ও বিনিয়োগ করার জন্য। যেহেতু এমআরএ আইনে বলা হয়েছে, লভ্যাংশ অন্য কোথাও বিনিয়োগ করা যাবে না এমআরএর পূর্ব অনুমতি ছাড়া। সে জন্য অনেক সময় এই লভ্যাংশ মালিক নিজের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে থাকে, সেটা কাম্য হতে পারে না।
গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষ বিশেষত নারীদের একত্র করে, যাদের কোনোদিন ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার অবস্থা ছিল না, তাদের ঋণ দিয়ে আর্থ-সামাজিক অবস্থা পরিবর্তন করে দেওয়ার জন্য ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। গ্রামীণ জীবনে অর্থের প্রবাহ বেড়েছে, গরিব কৃষকের কাছে ক্ষুদ্রঋণের সহজলভ্যতা বেড়েছে, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে তাদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়ছে। এমনকি বাংলাদেশের বড় এনজিওগুলো তাদের কার্যক্রম পৃথিবীর অনেক দেশে বহু আগেই শুরু করে দিয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ক্ষুদ্রঋণের বহুবিধ প্রভাব রয়েছে। সেটা সহজেই অনুধাবন করা যায়। তবে লক্ষ্য করা যায় যে, কিছু এনজিও প্রধান উদ্দেশ্য থেকে সরে এসেছে। তারা মূলত নিজেদের ব্যবসায়িক মুনাফা লাভের জন্য তাদের কাজ করে চলছে। ক্ষুদ্রঋণে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা অধিক স্বচ্ছ, কার্যকরী হওয়া প্রয়োজন। উন্নয়ন এবং গ্রাহককে প্রদেয় ঋণের উৎপাদনমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে এই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যাবে।
ড. এম মাসুদুর রহমান
অর্থনীতিবিদ, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি
masud611@hotmail.com
No comments