স্বাধীন বাংলার প্রথম বেসামরিক প্রশাসন by মোঃ আজিজুল হক

র্তমান রৌমারী ও রাজিবপুর উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ছিল বৃহত্তর রৌমারী থানা। ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব পারে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ভারত সীমান্ত ঘেঁষে এই থানাটি মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। পাক হানাদার বাহিনী বারবার চেষ্টা করেও এ অঞ্চলটিকে দখলে নিতে পারেনি। কোদালকাটি যুদ্ধে সূচনীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পরাজিত হয়ে রৌমারী ও তৎসংলগ্ন মুক্তাঞ্চল দখলের আশা পরিত্যাগ করে পাকবাহিনী কোদালকাটি থেকে ফেরত যেতে বাধ্য


হয়েছিল। স্বাধীন বাংলার পতাকা এখানে কখনও নমিত হয়নি। এই রৌমারীর মুক্ত মাটিতে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলার বেসামরিক প্রশাসন চালু করা হয়েছিল। এই থানার মুক্ত মাটিতে অবস্থান নিয়ে আমেরিকার টেলিভিশন এনবিসির টিম The country made for disaster and Date line Bangladesh নামক দুটি প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করেছিল, যা বিভিন্ন দেশে সম্প্রচারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিসহ মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করেছিল।
রৌমারীর মুক্ত মাটিতে রৌমারী সিজি জামান উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বাধীন বাংলার প্রথম মুক্তিফৌজ ক্যান্টনমেন্ট স্থাপন করা হয়েছিল। এই রৌমারীর জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ সংগ্রহ থেকে শুরু করে চলাচলের জন্য নৌকা, গাড়ি, এমনকি রান্নার খড়ি পর্যন্ত সরবরাহ করে এবং অধিকৃত অঞ্চল থেকে আগত উদ্বাস্তু জনতাকে সাহায্য-সহযোগিতা ও আশ্রয় দিয়ে ত্যাগের এক মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে রূপান্তরিত করেছিল।
রৌমারীর মুক্ত মাটি থেকেই স্বাধীন বাংলার সাপ্তাহিক মুখপত্র 'অগ্রদূত' রৌমারী সিজি জামান উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আজিজুল হকের (লেখক নিজে) সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো।
মুক্তিফৌজকে ট্রেনিং দেওয়া জন্য এখানে একটি চাঁদমারি নির্মাণ করা হয়েছিল, যা আজও মুক্তিযুদ্ধের রৌমারী গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অম্লান সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সুচিকিৎসার জন্য রৌমারীতে একটি বিরাট অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছিল। এ হাসপাতাল থেকে আহত মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় জনসাধারণকে চিকিৎসা দেওয়া হতো।
২৬ মার্চে রৌমারীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল এবং স্থানীয় একদল মুক্তিফৌজ ট্রেনিং ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি এক বিশাল মুক্তাঞ্চলের বেসামরিক প্রশাসন চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছিল।
কুড়িগ্রাম মহকুমার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল লতিফ তখন রৌমারীতেই অবস্থান করতেন। তাকে দিয়ে সিও (উন্নয়ন) অফিসের একটি কক্ষে কুড়িগ্রাম মহকুমা প্রশাসন চালু করা হয়েছিল। সিও (উন্নয়ন) অফিসের হলরুমটিকে বিচার কার্য পরিচালনার জন্য কোর্টে রূপান্তর করা হয়েছিল।
থানায় পুলিশ প্রশাসন চালু করতে গিয়ে বেশ কিছুটা অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। কারণ এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই রৌমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হোসেন থানার অন্য স্টাফদের নিয়ে পাক প্রশাসনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে থানা প্রাঙ্গণে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করেছিল এবং স্থানীয় কিছু স্বাধীনতাবিরোধী লোকের সাহায্যে চিলমারীতে অবস্থানরত পাক হানাদর বাহিনীর অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে পাকবাহিনীর একটা অংশকে রৌমারীতে আনয়নের চেষ্টা করেছিল। পাকবাহিনীকে লেখা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার চিঠি পথিমধ্যে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। এই সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর মুক্তিফৌজ ও স্থানীয় জনগণ একত্র হয়ে ওই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং অন্যান্য পুলিশ স্টাফকে আটক করেছিল। শেষে ওই পুলিশ স্টাফকে ছেড়ে দিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হোসেনকে বন্দি করে বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের কোনো এক হাজতে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। ফলে রৌমারী থানা জনবলশূন্য এক পরিত্যক্ত গৃহে পরিণত হয়েছিল। কাজেই থানা উদ্বোধনের আগেই পুলিশ জনবল সংগ্রহ করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। খোঁজাখুঁজির পর অধিকৃত এলাকা থেকে পালিয়ে আশা কয়েকজন কনেস্টবল পাওয়া গেলেও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করার মতো কোনো লোক পাওয়া গেল না। আবার খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে একজনকে পাওয়া গেল, যার নাম মোগল আবদুস সামাদ। বাড়ি গাইবান্ধা মহকুমার সাদুল্যাপুর থানায়। তিনিই স্বাধীন বাংলার মুক্তাঞ্চল থানার মৌখিকভাবে নিযুক্ত প্রথম ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তা ও কনস্টেবলদের কারোই পুলিশি ইউনিফর্ম ছিল না। মাইনকারচর বাজার থেকে কাপড় কিনে ইউনিফর্ম এবং স্বর্ণকারদের কাছ থেকে বাংলাদেশের পুলিশি ব্যাচ তৈরি করা হয়েছিল।
২৮ আগস্ট রৌমারী মুক্তাঞ্চলের বেসামরিক প্রশাসন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়েছিল। ১২ আগস্ট মেজর আবু তাহের মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ১১নং সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে রৌমারী বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থাকে জোরদার করেন। ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলোতে চেয়ারম্যান, মেম্বার মনোনয়ন করে ওইগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছিল। বেসামরিক প্রশাসনকে সাহায্য করার জন্য একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছিল। মুক্তাঞ্চলের প্রাইমারি স্কুলগুলোকে চালু করে দেওয়া হয়েছিল। চিঠিপত্র আদান-প্রদানের জন্য পোস্ট অফিসগুলোকেও চালু করা হয়েছিল। বেসামরিক প্রশাসন ও মুক্তিফৌজদের অর্থের প্রয়োজন মেটানোর জন্য কতগুলো ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল_ ১. হাট-বাজার থেকে টোল আদায়; ২. আমদানি- রফতানির কর আদায়; ৩. জমির খাজনা আদায়; ৪. জমি বিক্রয় রেজিস্ট্রেশন। ওই ব্যবস্থাগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন পদে জোনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কর্তৃক লোক নিয়োগ করা হয়েছিল। এই নিয়োজিত লোকগুলোই মুজিবনগর স্টাফ নামে পরিচিতি পেয়েছিল।
দেশ স্বাধীন হয়েছে বটে, কিন্তু জনগণের সত্যিকার মুক্তি এখনও আসেনি। স্বাধীন বাংলার চিরমুক্ত রৌমারী, রাজিবপুর ও তৎসংলগ্ন অন্যান্য থানার মুক্তাঞ্চলের জনগণ যারা জীবন, অর্থ, শ্রম, বাসস্থান এবং দেওয়ার মতো যা কিছু ছিল তাই দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে জয়ের পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন সেই মুক্তাঞ্চলটি আজও অবহেলিত, উন্নয়নের ছোঁয়া থেকে অনেক দূর পিছিয়ে। তাই এর উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা সরকার ও জাতির ভাবা প্রয়োজন। এই বিশাল মুক্তাঞ্চল যার পরিমাপ আনুমানিক এক হাজার বর্গমাইল। লোকসংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক। এই অঞ্চলের জনগণের প্রাণের দাবি, মুজিবনগরের সমমর্যাদা দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই মুক্তাঞ্চলটিকে জেলায় রূপান্তর করে উন্নয়নের সব পথকে উন্মক্ত করে দেওয়া।

No comments

Powered by Blogger.