সাদাকালো-শঙ্খনিধির মতো কোনো নিধিই হারাতে চাই না by আহমদ রফিক

যেকোনো জাতি তার ঐতিহ্য থেকে পোষকরস আহরণে ভবিষ্যতের সুস্থপথ রচনা করে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে শক্তি আহরণ করে থাকে। সে পথ যেমন সংস্কৃতির, তেমনি সমাজ ও রাজনীতির। সুস্থ, সুন্দর ঐতিহ্য সমাজকে সঠিক পথ দেখায়, তেমনি তার শৈল্পিক দিকগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্য আনন্দ-উপভোগের কারণ হয়ে বেঁচে থাকে। বিশ্বের নানা দেশে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, শৈল্পিক ঐতিহ্য তাদের জন্য একই সঙ্গে আনন্দ ও গর্বের বিষয়। তাই সেগুলো


রক্ষায় তাদের আন্তরিকতার শেষ নেই। সংস্কৃতিসেবীদের মতো পরিবেশবাদীরাও এসব ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকেন।
আমরা বাঙালি কি ঐতিহ্যহীন জাতি? আপাতদৃষ্টিতে তা তো মনে হয় না। আমরা রামমোহন বিদ্যাসাগরের অবিস্মরণীয় সমাজ সংস্কারের কথা গর্বের সঙ্গে উচ্চারণ করি, সে সম্বন্ধে লিখি।
যেমন লেখি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম, চিত্রকলা ও পল্লী উন্নয়ন নিয়ে। এবার তাঁর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী কী আড়ম্বরেই না পালন করেছি! যেমন আবেগে উদ্বেল হই নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা নিয়ে।
অন্যদিকে মোগল স্থাপত্যকলা নিয়ে, তাজমহল নিয়ে যেমন অহংকারবোধ করি তেমনি মহাস্থান পাহাড়পুর বা ময়নামতি থেকে শুরু করে কান্তজির মন্দির নিয়ে আমাদের বাঙালিয়ানা তৃপ্তি বোধ করে। বাংলাদেশে ছিটিয়ে আছে অনেক শিল্পস্থাপত্যের ঐতিহ্য। কোনোটি বড়, কোনোটি ছোট। ঐতিহ্যিক শিল্পের ক্ষেত্রে ছোট-বড়তে কোনো ভেদ নেই।
শিলাইদহ সাজাদপুর-পতিসরে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি থেকে দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ী, রানী ভবানির বা পুটিয়ার রাজবাড়ী এবং অনুরূপ স্থাপত্য আমাদের জন্য সমান গৌরবের। সোনারগাঁ কিংবা পানাম কোনো দিক থেকে কম নয়। উয়ারি বটেশ্বরের প্রাচীন স্থাপনা তো আমরাই খুঁড়ে বের করছি, বলধা গার্ডেনকে যেমন তেমনভাবে হলেও রক্ষা করে চলেছি। যেমন নর্থব্রুক হল তথা লালকুঠির মতো স্থাপত্যকর্ম।
তাহলে আমরা কেন বড় কাটরা, ছোট কাটরা (মোগল আমলের ঐতিহ্য) রক্ষায় মনোযোগী হইনি? কেন প্রত্নতাত্তি্বক অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত শঙ্খনিধি হাউস ভেঙে ফেলা হচ্ছে, কেন বুড়িগঙ্গা তীরের রাজনৈতিক ঐতিহ্যবাহী করোনেশন পার্কর্ বিলুপ্ত করে সেখানে মার্কেট তৈরি করা হলো? তৎকালীন মেয়র সাহেব কি বেঁচে আছেন এর জবাব দিতে?
এখন তো ঢাকা করপোরেশনে মেয়র নেই, আছেন প্রশাসক। তিনি কি আমাদের জানাবেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঐতিহ্যিক সম্পদ কে বা কারা কোন অধিকারে ভেঙে ফেলতে পারেন? পারেন কোন যুক্তিতে? প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরই বা তার সম্পদ রক্ষায় কেন এগিয়ে এল না? আমাদের কিছুসংখ্যক প্রভাবশালী বা প্রতাপশালী ব্যক্তির লোভের কাছে কি তারা অসহায়, পরাজিত?
কয়েক দিন আগে এ খবর কাগজে ছাপা হয়েছে। কোথাও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এ বিষয়ে আমাদের সদা-সক্রিয় পরিবেশবাদীরা নিশ্চুপ-নিষ্ক্রিয় কেন? আজ একটি জনপ্রিয় দৈনিকে শঙ্খনিধি হাউস নিয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। প্রতিবেদক আজহার হোসেনসহ প্রকাশককে ধন্যবাদ জানাই। সেই সঙ্গে অস্থির হয়ে ভাবি, আমার লেখা ছাপা হতে হতে হয়তোবা ঐতিহ্যবাহী এ স্থাপনা ধ্বংসের কাজ শেষ হয়ে যাবে!
ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ৩৮ টিপু সুলতান রোডে অবস্থিত শঙ্খনিধি ভবনের সঙ্গে রয়েছে একটি মন্দির। ধ্বংসযজ্ঞের কাজ শুরু সেখান থেকেই। কিছুকাল থেকে দেখছি, শ্মশান, মন্দির, দেবোত্তর সম্পত্তি দখল ও ধ্বংসের প্রবণতা যেন প্রবলভাবে বেড়ে উঠেছে অসাম্প্রদায়িক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি দখল, সম্পত্তি দখলের ঘটনা মাঝেমধ্যে কাগজে দেখি আর মনে হয় একাত্তরে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আরব্ধ কাজ সম্পূর্ণ করার দায় কি আমরা মহা উৎসাহে কাঁধে তুলে নিয়েছি? তা না হলে নির্বাচনোত্তর মাগুরা-ঘটনা নির্বিবাদে সম্পন্ন হয় কিভাবে?
একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের মানসিকতা সত্যি বলতে কি আমরা হারিয়ে ফেলেছি, সংবিধানের গায়ে যেমন-তেমনভাবে হাত দিয়েছি প্রবল প্রতাপে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে সর্বজনীন গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে থাকতে দিইনি। এদিক থেকে আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীর একাংশও ভিন্ন নয়। নয় বলেই ১৯৯৬ সালে ঢাকায় সম্প্রদায়-সম্প্রীতি সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে এক স্বনামখ্যাত সাংবাদিক বলেছিলেন, 'সম্প্রীতির অভাব কোথায় যে সম্প্রীতি সম্মেলন করতে হবে?' তাঁকে জবাবে বেশ কয়েকটি জবরদখলের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলাম, তাহলে এসব ঘটনা নিয়মিত ঘটছে কিভাবে। সমাজ তার গণতান্ত্রিক চেতনার প্রকাশে পিছিয়ে কেন? কেন সমাজ তার সচেতনতা নিয়ে এগিয়ে আসছে না। অথচ আসার উপযুক্ত হাজার ঘটনা ঘটে চলেছে একাত্তর-পরবর্তী স্বাধীন গণতন্ত্রী বাংলাদেশে। এবং সম্প্রদায়বাদী পাকিস্তানি জামানার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে একটা বই লিখতে গিয়ে দেখছি, বিদেশি সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতায় তাঁদের লেখায় বিষয়টা উঠে এসেছে যে ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রধান টার্গেট ছিল তৎকালীন পূর্ববাংলার হিন্দু সম্প্রদায়। ঘটনাও তা প্রমাণ করে যা আমরা দেখেছি, জেনেছি। দু-একজন শ্বেতাঙ্গ সাংবাদিকের কাছে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা স্বীকার করেছে যে তাদের লক্ষ্য পূর্ব বাংলা হিন্দুশূন্য করা এবং যা বলেনি তা হলো, এভাবে পূর্ববঙ্গের জনগরিষ্ঠতা নষ্ট করে পাঞ্জাবকে পাকিস্তানের জনসংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
সেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নেই, তাদের নির্দেশদাতা শাসকদলও নেই। সম্ভবত রয়ে গেছে তাদের মানসিকতা। হয়তো আমরা ঐতিহ্য হিসেবে সেই অপসংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বহন ও লালন করে চলেছি। তা না হলে পূর্বোক্ত ওই সম্প্রীতি সম্মেলন উপলক্ষে এক অধ্যাপক বলতে পারতেন না, 'আমরা তো ওদের জামাই আদরে রেখেছি, আবার সম্মেলন কেন'?
আমার প্রশ্ন : 'জামাই আদরে' রাখা না রাখার আমরা কে? কিসের অধিকার আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের? ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ এ দেশে বসবাস করছে বংশানুক্রমে বহুকাল থেকে। যেমন হিন্দু তেমন মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান। সে অধিকার কেড়ে নেওয়ার যুক্তিসংগত অধিকার কোনো শাসকগোষ্ঠীর নেই, নেই সমাজেরও কোনো অংশের।
দুঃখজনক যে এটাই অর্থাৎ অযৌক্তিক বিষয়টাই সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেমন বাংলাদেশে তেমন ভারতে। তা না হলে গৈরিকবস্ত্র ও ত্রিশূলধারী রাজনীতি প্রভাবে শাসকের আসনে বসে সেক্যুলার সংবিধানধারী ভারতে? অনায়াসে অযোধ্যাকাণ্ড ঘটায় তারা, বাধা দেওয়ার কেউ থাকে না। কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও অসহায় নাকি সেক্যুলার নীতি রক্ষায় অনিচ্ছুক?
একই রকম বীভৎস ঘটনা ঘটে গুজরাটে নরেন্দ্রমোদীর হিন্দুত্ববাদিতার কল্যাণে। এবং মজার ব্যাপার হলো, তা সত্ত্বেও নরেন্দ্রমোদীর রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে, এসব কিসের লক্ষণ? ভারতীয় পত্রপত্রিকা পাঠে ভবিষ্যতে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের সম্ভাবনারও ইঙ্গিত মেলে। সবচেয়ে বড় কথা, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের মতো কথিত সেক্যুলার সংস্থার উপস্থিতিতে কেন বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও হত্যাকাণ্ডের কিংবা অনুরূপ বীভৎস গুজরাট হত্যাকাণ্ডের নায়কদের অপরাধের সুবিচার মেলে না? এই কি সেক্যুলার সংবিধানের পরিচয়?
আমাদের তো এখন আধা সেক্যুলার সংবিধান_যেখানে আমরা ধর্মীয় সূত্র ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম শিরোপরি স্থাপন করেছি। সামাজিক আচরণে, রাজনৈতিক আচরণে এই বিধানের বাইরে কমই চলি।
যারা চলেন তাঁরা সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠ নন। অন্তত শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে নন। যদি হতো, তাহলে এত সব ঘটনা দেখা যেত না। সংবিধান পরিবর্তনের সর্বশেষ পর্বেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম টিকিয়ে রেখে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হতো না।
যাই হোক, ধান ভানতে শিবের গীত বা মহাপালের গীত গাওয়া হলেও বিষয়টা অপ্রাসঙ্গিক নয়। পূর্বোক্ত প্রতিবেদন মতে দেখা যায়, 'মন্দিরে দ্বিতল ছাদ পুরোটাই ভেঙে ফেলা হয়েছে'। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জানান, ১৫ ডিসেম্বর রাত থেকে মন্দিরটি ভাঙা শুরু হয়। খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মন্দির রক্ষার জন্য সূত্রাপুর থানায় জিডি করেন। এতে কোনো ফল হয়নি।'
জিডি নয়, রাজউকের উচিত ছিল থানা থেকে পুলিশ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যেহেতু আইন ও যুক্তি তাদের পক্ষে। কিন্তু তা করা হয়নি। আর ভবনটি যেহেতু প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত, ওই অধিদপ্তরের কি করণীয় কিছু ছিল না? অবশ্য তারা কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিল কি না আমরা জানি না। কিন্তু শাসনব্যবস্থায় যে কতটা নৈরাজ্য তার প্রমাণ মেলে ওই প্রতিবেদনের বিবরণে।
তাদের ভাষ্যে দেখা যায়, 'শঙ্খনিধি ভবনটির পুরোটাই দখলদারের কবলে। ভেতরে রয়েছে লেদ মেশিনের কারখানা। ভবনের একটি অংশ সাংবাদিক পরিচয়ে দখলে রেখেছেন সুজন সাত্তার, কাঞ্চন কুমার দে ও আজাদ হোসেন সুমন। তিনজনই সরকার থেকে ভবনটি লিজ নিয়ে নিয়মিত বসবাস করছেন।' আমাদের প্রশ্ন : সংরক্ষিত সরকারি ভবন যা প্রত্নতাত্তি্বক স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত, তা কি লিজ দেওয়া যায়?
কারুকার্যখচিত এ ভবনটি দখলমুক্ত করতে, অন্তত ঐতিহ্য রক্ষার দায়ে তা করতে আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। এ সম্বন্ধে পরিবেশ রক্ষা সংস্থারও দৃষ্টি আকর্ষণ করি, যাতে তারা এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। আর যারা সংরক্ষিত মন্দির ধ্বংস করেছে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই। এ সম্বন্ধে ওই প্রতিবেদনে ঠিকই লেখা হয়েছে, 'দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেওয়া হলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে।' এ উপলক্ষে আমরা দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ভাস্কর্য রক্ষায় আরো সচেতন ও সতর্ক হওয়ার জন্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রতি আহ্বান জানাই।
প্রসঙ্গত স্মর্তব্য পতিসরে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িটি ৪০ বছর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চোখের আড়ালে অযত্নে, অবহেলায় পড়েছিল। দেশের অন্যান্য স্থাপনা বা পুরাকীর্তি যেন এতটা অবহেলার বস্তু না হয়। কিন্তু হচ্ছে, যেমন আড়াই হাজার বছরের পুরনো ভীমের জাঙ্গাল পুড়ে শেষ হচ্ছে, সবাই নীরব।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্রগবেষক,
কবি ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.