রঙ্গব্যঙ্গ-যত দোষ... by মোস্তফা কামাল

মাদের সমাজে একটি প্রবাদ চালু আছে_'যত দোষ নন্দ ঘোষ।' প্রবাদটি কবে কোথা থেকে কিভাবে চালু হয়েছে, তা আমাদের জানা নেই। তবে নন্দকে নিয়ে গল্প শোনা যায় এবং সে গল্প একেকজন একেকভাবে উপস্থাপন করে থাকেন। কেউ বলেন, নন্দ নিরীহ গোবেচারা টাইপের মানুষ! সে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালোই বলতে জানত। এর বাইরে অন্য কোনো কিছু থাকতে পারে তা সে চিন্তাও করত না। সমাজের প্রভাবশালীরা দুষ্কর্ম করে তার দায় চাপাত নন্দ ঘোষের


ওপর। প্রভাবশালীদের ওই কথার প্রতিবাদ করার সাহস কার! নিরীহ নন্দও প্রতিবাদ না করে তাদের কথাই মেনে নিত। ফলে প্রভাবশালীদের দুষ্কর্মের খেসারত দিতে হতো নন্দকে। এ যেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পের 'কেষ্ট ব্যাটাই চোর!'-এর মতো।
সেই কেষ্ট কিংবা নন্দ ঘোষের মতো দশা হয়েছে আমাদের মিডিয়ার প্রতিনিধিদের। কী সরকারি, কী বিরোধী দল_সবাই এখন মিডিয়াকে দুষছেন। সব কিছুর জন্য নাকি মিডিয়াই দায়ী। যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির খবর প্রকাশ করে মিডিয়া নাকি পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলেছে। আবার দ্রব্যমূল্য নিয়ে লেখালেখি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে মিডিয়া। মিডিয়াই তারেক-কোকোর দুর্নীতির গোপন খবর ফাঁস করে বিএনপিকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তা ছাড়া রাজনৈতিক নেতাদের স্বেচ্ছাচারী আচরণের কথা মিডিয়ায় উঠে আসে। এতে করে রাজনৈতিক দলগুলোকে বেকায়দায় পড়তে হয়। কাজেই সবার এক স্লোগান_'মিডিয়া ঠেকাও!'
এই একটা ইস্যুতে কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের মধ্যে চমৎকার মিল। যদিও আর কোনো ইস্যুতে দুই দলের মধ্যে কোনো মিল দেখা যায় না। রাজনীতিতে তাদের সম্পর্ক পুরোপুরি বিরোধপূর্ণ। এ কারণে সবার আশঙ্কা, সামনে রাজনীতিতে সংঘাত আরো বাড়বে। এই সংঘাতের রাজনীতি কিন্তু আর কিছু নিয়ে নয়, ক্ষমতার চেয়ারে বসা নিয়ে। একজনকে তুলে দিয়ে আরেকজন বসবেন। ওই চেয়ারেই যেন সব সুখ, সব শান্তি লুকিয়ে আছে। আসলে ক্ষমতার সাধই অন্য রকম। বাঘের কাছে মানুষের রক্তের সাধ যেমন, ক্ষমতার সাধও তেমনি।
রাজনীতির জনৈক বিশ্লেষক ক্ষমতার একটা নতুন সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'ক্ষমতা আসলে কিছুই না। এর অস্তিত্ব তখনই টের পাওয়া যায় যখন তা অপব্যবহার হয়।' আমাদের নেতা-নেত্রীরা ক্ষমতা অপব্যবহার করেন বলেই ওর মধ্যে তারা স্বর্গের সাধ খুঁজে পেয়েছেন। তাই ক্ষমতার চেয়ারে বসা নিয়ে এত ঝগড়াবিবাদ ও রক্তপাত!
আমাদের রাজনৈতিক দলের লড়াইটা যদি হতো সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য; তাহলে একটা কথা ছিল। অথচ উভয় দলের নেতারাই সাংবাদিক ঠ্যাঙানোর ব্যাপারে এক পায়ে খাড়া। অবশ্য নিন্দুকেরা(!) বলেন, আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে আরো একটি ক্ষেত্রে খুব মিল। সেটা হচ্ছে নিজেদের স্বার্থ। সংসদে না গিয়ে সুযোগ-সুবিধা নেওয়া, শুল্কমুক্ত গাড়ি নেওয়া, টেলিফোন বিল না দেওয়া, সরকারি অর্থে বিদেশ যাওয়া, সরকারি খাস জমি নিজের নামে লিখে নেওয়া ইত্যাদি। আর সব বিষয়ে অমিল।
সরকার সব কিছুতে তালগোল পাকিয়ে এখন তার দায় চাপাচ্ছে সাংবাদিকদের ওপর। সাংবাদিকরাই নাকি সব নষ্টের মূল! তার মানে, সরকার যা খুশি তা করবে, অন্যরা ডুগডুগি বাজিয়ে সরকারকে বাহবা দেবে। যেমনি আমলারা দিয়ে থাকেন। তাঁরা সকালে মন্ত্রীর রুমে গিয়ে হাতে-পায়ে তেল মেখে দিনের কার্যাদি শুরু করেন। সেই তেল নিয়ে নানা তেলেসমাতি কারবার চলতে থাকে। বৈঠক, সেমিনার ও সমাবেশে যেখানে পারছেন মন্ত্রী-উপদেষ্টারা তেলের টিন নিয়ে হাজির হন। তারপর হরদম তেল মালিশে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কে কত বেশি তেল দিতে পারেন, তা নিয়ে বেশ প্রতিযোগিতা দেখা যায়।
এই তৈলাক্ত লোকগুলোই মিডিয়াকে নিজেদের মতো করে পেতে চান। মন্ত্রী, উপদেষ্টা, আমলারা যা করবেন মিডিয়া সব কিছুতেই বাহবা দেবে। মিডিয়াও তাদের মতো তেলের টিন নিয়ে বসে থাকবে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মিডিয়া তেল মালিশ করবে। তেল ছাড়া যেন কোনো কথা নেই। তেলই জীবন, তেলই মরণ! আর তেলই যদি না দিল তাহলে কিসের সাংবাদিক!
ইদানীং সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে। নেত্রী নাকি মামলা দিতে হুকুম দিয়েছেন। সেই উসকানিতে উৎসাহিত হয়ে বড় নেতা, মাঝারি নেতা, ছোট নেতা, পাতি নেতা_সবাই মামলা ঠুকছেন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, একেকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ৪০-৫০টি মামলা দিয়ে হাতে হারিকেন ধরিয়ে দেবেন। এ জন্য নতুন নতুন গল্প সাজানো হচ্ছে। যে মামলায় সাংবাদিকদের ফাঁসানো যাবে, সেই মামলা রুজু করতে তাঁরা মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে কিছু গডফাদার সংসদ সদস্যের মুখোশ উন্মোচন করেছেন সাংবাদিকরা। তাতে তাঁরা নাকি বেশ মাইন্ড করেছেন! কুমিল্লার এক গডফাদার এমপি এতই ক্ষেপেছেন যে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কারপ্রাপ্ত এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ঠুকে দিলেন চাঁদাবাজির মামলা। কী আশ্চর্য! সুসাংবাদিকতার জন্য প্রধানমন্ত্রী যাঁকে দিলেন লাখ টাকার পুরস্কার, আর তাঁর দলের এমপিই সেই সাংবাদিককে দিলেন এত বড় তিরস্কার!
কথায় বলে না, যে যায় লঙ্কায় সে হয় রাবণ। আমাদের নেতা-নেত্রীদের সেই অবস্থা হয়েছে। তাঁরা ক্ষমতায় গিয়ে অন্ধ হয়ে যান। ভুলে যান অতীত বন্ধুদের। চাটুকার তোষামোদকারীরা তাঁদের এমন ঘোরের মধ্যে রাখে, তখন আর তাঁরা টের পান না কোথায় আছেন; আকাশে নাকি পাতালে! অকস্মাৎ একদিন তাঁদের পায়ের তলার মাটি সরে যায়। তাঁরা ছিটকে পড়েন গভীর খাদে। জনগণ তখন শুধু তাকিয়ে রয়। দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলে, 'ওহে ভাই অন্ধ (রাজনীতিক), আজ কোথায় তোমার ক্ষমতার সেই দম্ভ!'
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.