শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের অসংগতি by রওশন আক্তার
শিশুদের বইয়ের ভার কমাতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে এ বছর থেকে চারটির পরিবর্তে একটি বই চালু করেছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। বাংলা, ইংরেজি, পরিবেশবিদ্যা ও গণিতের পরিবর্তে মাত্র একটি বইয়ে প্রকৃতিকে চেনানোর পাঠ শুরু করেছে তাদের শিক্ষা অধিদপ্তর। ছবির মাধ্যমে শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে গণিতের জটিল সব বিষয়। ইতিহাস শেখাতে শিশুদের শিক্ষকরা নিয়ে যাবেন আশপাশের দর্শনীয় সব
স্থানে। ইংরেজি শেখাতে বইজুড়ে আছে রঙিন ছবি। আর এ সব কিছুই হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরাসরি উৎসাহে। সংবাদপত্রে প্রতিবেশী দেশের শিশুদের জন্য এই উদ্যোগের খবর জেনে যেমন আনন্দিত হই, তেমনি ব্যথিত হই আমাদের দেশের শিশুদের জন্য এ রকম সত্যিকারের উদ্যোগের অভাব দেখে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষামন্ত্রীর নানা উদ্যোগে আমরাও আশান্বিত হয়েছিলাম। ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া শৈশব খুঁজে পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল অনেকেই শিক্ষামন্ত্রীর নানা ঘোষণায়। কিন্তু তিন বছরে তিনি শিক্ষা খাতে যে পরিবর্তন এনেছেন, তাতে বোঝা না কমে আরো বেড়েছে। এসএসসি আর এইচএসসির পরিবর্তে জেএসসি ও এইচএসসি চালুর কথা শোনা গেলেও এখন পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসিসহ মোট চারটি পরীক্ষা দিতে হচ্ছে ছেলেমেয়েদের। কলকাতায় যখন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিশুদের সহজ পড়াশোনার উপযোগী সিলেবাস তৈরি করা হচ্ছে, তখন আমাদের ছেলেমেয়েদের পঞ্চম শ্রেণীতেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কঠিন বোর্ড পরীক্ষার তীব্র প্রতিযোগিতায়। এ প্লাস পাওয়া আর না পাওয়ার পার্থক্য তারা না বুঝলেও অভিভাবকদের কঠিন নজরদারি আর ২৪ ঘণ্টা পড়াশোনার চাপে জীবন তাদের সত্যিই অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে জমে উঠছে সুযোগসন্ধানীদের গাইড বই, নোট আর টিউশনির জমজমাট ব্যবসা। স্কুলগুলো পঞ্চম আর অষ্টম শ্রেণীতে চালু করছে স্পেশাল কোচিং। বাড়ছে শিক্ষকদের বাড়তি আয়ের পথ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর নতুন এই দুটি পরীক্ষা চালুর প্রত্যক্ষ প্রভাব কী? বেড়েছে কি শিক্ষার মান? কিংবা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত কোনো উন্নয়ন কি ঘটছে? গত দুই বছরে নতুন এই দুটি পরীক্ষার পর কোনো মূল্যায়ন কি করা হয়েছে? সম্প্রতি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের (গত ২১ ডিসেম্বর) শিক্ষানীতি ২০১০ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় শিক্ষামন্ত্রী দাবি করেছেন, তিনি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াননি, বরং কমিয়েছেন। যুক্তি হিসেবে তিনি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানান এবং এর ফলে স্কুলগুলোতে কোচিংয়ের নামে টাকা আদায় বন্ধ হয়েছে বলেও দাবি করেন। অথচ বাস্তবতা কিন্তু উল্টো। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বড় শহরের নামি স্কুলগুলো পর্যন্ত এখন পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষার কোচিংয়ের নামে এই দুটি শ্রেণীর শতভাগ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কোচিংয়ের টাকা আদায় করছে। অথচ আগে শুধু যারা বৃত্তি পরীক্ষা দিত তাদেরই কোচিং করতে হতো।
শিক্ষানীতির মুখবন্ধে বলা আছে, 'শিক্ষার্থীদের তথাকথিত নোট বই, প্রাইভেট টিউশনি প্রভৃতি অনাকাঙ্ক্ষিত আপদ থেকে মুক্তি দিতে হবে। পরীক্ষা হবে শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও স্বাভাবিক পরিবেশে, পরীক্ষাকে শিক্ষার্থীরা ভীতিকর মনে করবে না, বরং আনন্দময় উৎসব হিসেবে গ্রহণ করবে। পরীক্ষাকে পরীক্ষার্থীরা তার শিক্ষাজীবনের সার্থকতার মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি হিসেবে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করবে। সার্বিক শিক্ষাজীবনকেই আকর্ষণীয়, নিরাপদ ও আনন্দময় করে তুলতে হবে। এ রকম পরিবেশই আমাদের লক্ষ্য ও কাম্য।' আর এ নীতির বাস্তব রূপ দিতে চালু করা হয়েছে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র। অদৃষ্টের পরিহাস হয়তো একেই বলে! বাজারজুড়ে এখন সৃজনশীল গাইড আর নোট বইয়ের ছড়াছড়ি। টিভি চ্যানেল খুললেই দেখতে পাই, এসব নোট আর গাইড বইয়ের সরাসরি বিজ্ঞাপন। ভাবি, কী করে সম্ভব?
গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ বেশ কটি শিক্ষা কমিশন আর একেক সরকারের আমলে একেক শিক্ষানীতি পেলেও শিক্ষাব্যবস্থায় সে রকম কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। নকলমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার জন্য সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনের দেশজুড়ে অনেক প্রশংসা। কিন্তু সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন দেখি এখনো ছাত্রছাত্রীরা নকলের ওপর নির্ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি স্কুল-কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা নকলমুক্ত? তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এই অভ্যাস কোত্থেকে এল?
শিক্ষানীতির বাস্তবায়নে সরকার সারা দেশে ২৪টি স্কুলকে কলেজে রূপান্তর করেছে। এর সব কটিই বড় শহরে অবস্থিত. পিছিয়ে আছে গ্রামের স্কুল। অথচ এই শিক্ষানীতিতেই আছে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোতে পরিকল্পিত কর্মসূচির মাধ্যমে বিশেষ সহায়তা দেওয়া হবে, যাতে দ্রুত শহর আর গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য কমিয়ে আনা যায়। উপজেলার কিছু কিছু স্কুলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে সত্যি। কিন্তু শিক্ষকদের মানোন্নয়নে কোনো ট্রেনিং হচ্ছে না। বিশেষ করে গ্রামের শিক্ষকদের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের বর্তমান পদ্ধতি নিয়েও আমার প্রশ্ন আছে। এমএ পাস করার পর একজন শিক্ষার্থী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা পাসের জন্য কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন। আর একজন এসএসসি পাস প্রতিযোগীও কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন। তাঁদের মধ্যে যার কোচিং ভালো হয় তিনি শিক্ষক হিসেবে চাকরি পান! তারপর নিজেও কোচিং সেন্টার খুলে বিদ্যার ব্যবসা শুরু করেন। কোচিংনির্ভর এই শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার মানে কী? যে শিক্ষক নিজেই কোচিং করে চাকরি পান, তিনি কী করে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে কোচিং আর টিউশন পদ্ধতি উঠিয়ে দেবেন?
সরকার শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞান আর কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছে। মেধা তালিকার প্রথম দিকে যারা থাকে তারা বিজ্ঞান পড়ে আর অপেক্ষাকৃত দুর্বলরা বেছে নেয় মানবিক। এত দিনের এই ধারণা বদলে এখন সত্যি হলো যাদের বাবা-মায়ের আর্থিক সামর্থ্য আছে তারা বিজ্ঞান পড়ে আর গরিবের ছেলেমেয়েরা পড়ে মানবিক। কারণ বিজ্ঞান পড়তে হলে প্রতিটি বিষয়ের কোচিং-টিউশন নিতেই হবে। সংবাদপত্রেও তাই দেখা যায়, ঢাকার নামকরা বিদ্যালয়ে প্রাইভেট পড়ানো যাবে না, তাই শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মানবিক বিষয়ে পড়তে দিচ্ছেন না। সবাইকে বাধ্য করছেন বিজ্ঞান পড়তে। অবশ্য এই বিজ্ঞান আর মানবিকের সব হিসাবই পাল্টে যায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। সেখানেও চলে এই টাকার খেলা। ধনীর দুলালরা সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ না পেলে আছে বেসরকারি কলেজ। কিন্তু যার সেই সামর্থ্য নেই, সে বিজ্ঞান নিয়ে এইচএসসি পাসের পর হয়তো পড়তে শুরু করে ইতিহাস। উচ্চশিক্ষায় অবশ্য শুধু টাকা না, চাই রাজনৈতিক শক্তিও। শিক্ষক হতে চাইলে এখানে ক্ষমতাসীন দলের শক্ত সমর্থন নিয়ে তবেই আসতে হবে। যোগ্যতর প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে যে কেউ সহজেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হতে পারেন, যদি তাঁর থাকে শক্ত রাজনৈতিক খুঁটি। ভিসি থেকে শুরু করে অনেক পদের নিয়োগই এখানে রাজনৈতিক। আর এই পদে টিকে থাকতে তাঁদের একটাই চেষ্টা_ভোটার বাড়ানো, যোগ্যতায় পিছিয়ে পড়া প্রার্থীও এখানে ভালো ভোটার হতে পারেন। বছরে কয়েকটা নির্বাচন যে হয় এখানে! এসবই ওপেন সিক্রেট। কিন্তু কখনো কখনো লজ্জার মাথা খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, যা মেনে নিতে লজ্জা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জিপিএ-৩ পেলেই শিক্ষক পদে আবেদন করতে পারার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটিও তেমনই এক সিদ্ধান্ত। একজন শিক্ষার্থীর মেধার প্রতিফলন ঘটে তার ফলাফলে। হ্যাঁ, এটা সত্যি, কখনো কখনো কম মেধার শিক্ষার্থীও ভালো ফল করতে পারেন অধ্যবসায়ের জোরে। সেই তুলনায় মেধাবী শিক্ষার্থীটি হয়তো কিছুটা পিছিয়ে পড়েন। কিন্তু তার পরও ফলাফল দিয়েই আমরা যোগ্যতার প্রাথমিক মাপকাঠিটি গড়ে তুলি। এত দিন ৩.৬৫ পেলে তাকে প্রথম শ্রেণীর মান বলে ধরে নেওয়া হতো। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অভিন্ন গ্রেডিংয়ের কারণে সেটি কমিয়ে ৩ করার আদেশ জারি করেছে। কিন্তু এটাই শিক্ষক নিয়োগের মাপকাঠি_এমন কথা কোথাও বলা নেই। এসএসসি, এইচএসসিতে এই যোগ্যতা নিয়ে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনই করতে পারে না। অথচ সে শিক্ষক হিসেবে আবেদন করার যোগ্য। আওয়ামী লীগ বর্তমান শিক্ষানীতি প্রস্তুতকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. এ কে আজাদ চৌধুরী শিক্ষা উপকমিটির প্রধান ছিলেন। তিনিই এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান। সেই ইউজিসির দোহাই দিয়েই চবির রেজিস্ট্রার যখন বলেন, জিপিএ-৩কে প্রথম শ্রেণীর সমমান ধরে নিয়োগ দেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন দিয়েছে। পরে ইউজিসি এটি বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়ার ফলেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে (সূত্র কালের কণ্ঠের আঞ্চলিক প্রকাশনা, দ্বিতীয় রাজধানী, ২২ সেপ্টেম্বর); তখন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন জাগে বৈকি। যে প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, শেষটায়ও তাদেরই উদাহরণ টানতে হচ্ছে। গত শুক্রবার বিধানসভা উত্তাল হয়ে উঠেছিল যে বিলটি নিয়ে, সেটি ছিল শিক্ষা বিল। আর 'দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি লজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০০১' নামের বিলটির প্রধান উদ্দেশ্যই হলো বিশ্ববিদ্যালয়কে দলতন্ত্রমুক্ত করা। বিলটিতে উপাচার্যের নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যের পরিবর্তে মেধা ও অভিজ্ঞতাকে মাপকাঠি করার কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে সরকার নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরো স্বায়ত্তশাসন দেওয়াসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষার মান বাড়ানোর এ উদ্যোগের প্রশংসা বিরোধী শিবিরও করেছে। আমাদের দেশেও উচ্চশিক্ষার দ্বার সবার জন্য শুধু উন্মোচন করলেই হবে না, মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগও সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন এখন জরুরি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষামন্ত্রীর নানা উদ্যোগে আমরাও আশান্বিত হয়েছিলাম। ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া শৈশব খুঁজে পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল অনেকেই শিক্ষামন্ত্রীর নানা ঘোষণায়। কিন্তু তিন বছরে তিনি শিক্ষা খাতে যে পরিবর্তন এনেছেন, তাতে বোঝা না কমে আরো বেড়েছে। এসএসসি আর এইচএসসির পরিবর্তে জেএসসি ও এইচএসসি চালুর কথা শোনা গেলেও এখন পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসিসহ মোট চারটি পরীক্ষা দিতে হচ্ছে ছেলেমেয়েদের। কলকাতায় যখন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিশুদের সহজ পড়াশোনার উপযোগী সিলেবাস তৈরি করা হচ্ছে, তখন আমাদের ছেলেমেয়েদের পঞ্চম শ্রেণীতেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কঠিন বোর্ড পরীক্ষার তীব্র প্রতিযোগিতায়। এ প্লাস পাওয়া আর না পাওয়ার পার্থক্য তারা না বুঝলেও অভিভাবকদের কঠিন নজরদারি আর ২৪ ঘণ্টা পড়াশোনার চাপে জীবন তাদের সত্যিই অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। সেই সঙ্গে জমে উঠছে সুযোগসন্ধানীদের গাইড বই, নোট আর টিউশনির জমজমাট ব্যবসা। স্কুলগুলো পঞ্চম আর অষ্টম শ্রেণীতে চালু করছে স্পেশাল কোচিং। বাড়ছে শিক্ষকদের বাড়তি আয়ের পথ।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর নতুন এই দুটি পরীক্ষা চালুর প্রত্যক্ষ প্রভাব কী? বেড়েছে কি শিক্ষার মান? কিংবা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত কোনো উন্নয়ন কি ঘটছে? গত দুই বছরে নতুন এই দুটি পরীক্ষার পর কোনো মূল্যায়ন কি করা হয়েছে? সম্প্রতি চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের (গত ২১ ডিসেম্বর) শিক্ষানীতি ২০১০ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় শিক্ষামন্ত্রী দাবি করেছেন, তিনি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াননি, বরং কমিয়েছেন। যুক্তি হিসেবে তিনি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানান এবং এর ফলে স্কুলগুলোতে কোচিংয়ের নামে টাকা আদায় বন্ধ হয়েছে বলেও দাবি করেন। অথচ বাস্তবতা কিন্তু উল্টো। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বড় শহরের নামি স্কুলগুলো পর্যন্ত এখন পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষার কোচিংয়ের নামে এই দুটি শ্রেণীর শতভাগ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কোচিংয়ের টাকা আদায় করছে। অথচ আগে শুধু যারা বৃত্তি পরীক্ষা দিত তাদেরই কোচিং করতে হতো।
শিক্ষানীতির মুখবন্ধে বলা আছে, 'শিক্ষার্থীদের তথাকথিত নোট বই, প্রাইভেট টিউশনি প্রভৃতি অনাকাঙ্ক্ষিত আপদ থেকে মুক্তি দিতে হবে। পরীক্ষা হবে শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও স্বাভাবিক পরিবেশে, পরীক্ষাকে শিক্ষার্থীরা ভীতিকর মনে করবে না, বরং আনন্দময় উৎসব হিসেবে গ্রহণ করবে। পরীক্ষাকে পরীক্ষার্থীরা তার শিক্ষাজীবনের সার্থকতার মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি হিসেবে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করবে। সার্বিক শিক্ষাজীবনকেই আকর্ষণীয়, নিরাপদ ও আনন্দময় করে তুলতে হবে। এ রকম পরিবেশই আমাদের লক্ষ্য ও কাম্য।' আর এ নীতির বাস্তব রূপ দিতে চালু করা হয়েছে সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্নপত্র। অদৃষ্টের পরিহাস হয়তো একেই বলে! বাজারজুড়ে এখন সৃজনশীল গাইড আর নোট বইয়ের ছড়াছড়ি। টিভি চ্যানেল খুললেই দেখতে পাই, এসব নোট আর গাইড বইয়ের সরাসরি বিজ্ঞাপন। ভাবি, কী করে সম্ভব?
গত ৪০ বছরে বাংলাদেশ বেশ কটি শিক্ষা কমিশন আর একেক সরকারের আমলে একেক শিক্ষানীতি পেলেও শিক্ষাব্যবস্থায় সে রকম কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। নকলমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার জন্য সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলনের দেশজুড়ে অনেক প্রশংসা। কিন্তু সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন দেখি এখনো ছাত্রছাত্রীরা নকলের ওপর নির্ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি স্কুল-কলেজের শিক্ষাব্যবস্থা নকলমুক্ত? তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এই অভ্যাস কোত্থেকে এল?
শিক্ষানীতির বাস্তবায়নে সরকার সারা দেশে ২৪টি স্কুলকে কলেজে রূপান্তর করেছে। এর সব কটিই বড় শহরে অবস্থিত. পিছিয়ে আছে গ্রামের স্কুল। অথচ এই শিক্ষানীতিতেই আছে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলোতে পরিকল্পিত কর্মসূচির মাধ্যমে বিশেষ সহায়তা দেওয়া হবে, যাতে দ্রুত শহর আর গ্রামের শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য কমিয়ে আনা যায়। উপজেলার কিছু কিছু স্কুলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে সত্যি। কিন্তু শিক্ষকদের মানোন্নয়নে কোনো ট্রেনিং হচ্ছে না। বিশেষ করে গ্রামের শিক্ষকদের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের বর্তমান পদ্ধতি নিয়েও আমার প্রশ্ন আছে। এমএ পাস করার পর একজন শিক্ষার্থী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা পাসের জন্য কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন। আর একজন এসএসসি পাস প্রতিযোগীও কোচিং সেন্টারে ভর্তি হন। তাঁদের মধ্যে যার কোচিং ভালো হয় তিনি শিক্ষক হিসেবে চাকরি পান! তারপর নিজেও কোচিং সেন্টার খুলে বিদ্যার ব্যবসা শুরু করেন। কোচিংনির্ভর এই শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার মানে কী? যে শিক্ষক নিজেই কোচিং করে চাকরি পান, তিনি কী করে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে কোচিং আর টিউশন পদ্ধতি উঠিয়ে দেবেন?
সরকার শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞান আর কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছে। মেধা তালিকার প্রথম দিকে যারা থাকে তারা বিজ্ঞান পড়ে আর অপেক্ষাকৃত দুর্বলরা বেছে নেয় মানবিক। এত দিনের এই ধারণা বদলে এখন সত্যি হলো যাদের বাবা-মায়ের আর্থিক সামর্থ্য আছে তারা বিজ্ঞান পড়ে আর গরিবের ছেলেমেয়েরা পড়ে মানবিক। কারণ বিজ্ঞান পড়তে হলে প্রতিটি বিষয়ের কোচিং-টিউশন নিতেই হবে। সংবাদপত্রেও তাই দেখা যায়, ঢাকার নামকরা বিদ্যালয়ে প্রাইভেট পড়ানো যাবে না, তাই শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের মানবিক বিষয়ে পড়তে দিচ্ছেন না। সবাইকে বাধ্য করছেন বিজ্ঞান পড়তে। অবশ্য এই বিজ্ঞান আর মানবিকের সব হিসাবই পাল্টে যায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। সেখানেও চলে এই টাকার খেলা। ধনীর দুলালরা সরকারি মেডিক্যাল কলেজে সুযোগ না পেলে আছে বেসরকারি কলেজ। কিন্তু যার সেই সামর্থ্য নেই, সে বিজ্ঞান নিয়ে এইচএসসি পাসের পর হয়তো পড়তে শুরু করে ইতিহাস। উচ্চশিক্ষায় অবশ্য শুধু টাকা না, চাই রাজনৈতিক শক্তিও। শিক্ষক হতে চাইলে এখানে ক্ষমতাসীন দলের শক্ত সমর্থন নিয়ে তবেই আসতে হবে। যোগ্যতর প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলে যে কেউ সহজেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হতে পারেন, যদি তাঁর থাকে শক্ত রাজনৈতিক খুঁটি। ভিসি থেকে শুরু করে অনেক পদের নিয়োগই এখানে রাজনৈতিক। আর এই পদে টিকে থাকতে তাঁদের একটাই চেষ্টা_ভোটার বাড়ানো, যোগ্যতায় পিছিয়ে পড়া প্রার্থীও এখানে ভালো ভোটার হতে পারেন। বছরে কয়েকটা নির্বাচন যে হয় এখানে! এসবই ওপেন সিক্রেট। কিন্তু কখনো কখনো লজ্জার মাথা খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়, যা মেনে নিতে লজ্জা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জিপিএ-৩ পেলেই শিক্ষক পদে আবেদন করতে পারার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটিও তেমনই এক সিদ্ধান্ত। একজন শিক্ষার্থীর মেধার প্রতিফলন ঘটে তার ফলাফলে। হ্যাঁ, এটা সত্যি, কখনো কখনো কম মেধার শিক্ষার্থীও ভালো ফল করতে পারেন অধ্যবসায়ের জোরে। সেই তুলনায় মেধাবী শিক্ষার্থীটি হয়তো কিছুটা পিছিয়ে পড়েন। কিন্তু তার পরও ফলাফল দিয়েই আমরা যোগ্যতার প্রাথমিক মাপকাঠিটি গড়ে তুলি। এত দিন ৩.৬৫ পেলে তাকে প্রথম শ্রেণীর মান বলে ধরে নেওয়া হতো। শিক্ষা মন্ত্রণালয় অভিন্ন গ্রেডিংয়ের কারণে সেটি কমিয়ে ৩ করার আদেশ জারি করেছে। কিন্তু এটাই শিক্ষক নিয়োগের মাপকাঠি_এমন কথা কোথাও বলা নেই। এসএসসি, এইচএসসিতে এই যোগ্যতা নিয়ে একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনই করতে পারে না। অথচ সে শিক্ষক হিসেবে আবেদন করার যোগ্য। আওয়ামী লীগ বর্তমান শিক্ষানীতি প্রস্তুতকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. এ কে আজাদ চৌধুরী শিক্ষা উপকমিটির প্রধান ছিলেন। তিনিই এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান। সেই ইউজিসির দোহাই দিয়েই চবির রেজিস্ট্রার যখন বলেন, জিপিএ-৩কে প্রথম শ্রেণীর সমমান ধরে নিয়োগ দেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন দিয়েছে। পরে ইউজিসি এটি বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়ার ফলেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে (সূত্র কালের কণ্ঠের আঞ্চলিক প্রকাশনা, দ্বিতীয় রাজধানী, ২২ সেপ্টেম্বর); তখন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন জাগে বৈকি। যে প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, শেষটায়ও তাদেরই উদাহরণ টানতে হচ্ছে। গত শুক্রবার বিধানসভা উত্তাল হয়ে উঠেছিল যে বিলটি নিয়ে, সেটি ছিল শিক্ষা বিল। আর 'দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি লজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০০১' নামের বিলটির প্রধান উদ্দেশ্যই হলো বিশ্ববিদ্যালয়কে দলতন্ত্রমুক্ত করা। বিলটিতে উপাচার্যের নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যের পরিবর্তে মেধা ও অভিজ্ঞতাকে মাপকাঠি করার কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে সরকার নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরো স্বায়ত্তশাসন দেওয়াসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষার মান বাড়ানোর এ উদ্যোগের প্রশংসা বিরোধী শিবিরও করেছে। আমাদের দেশেও উচ্চশিক্ষার দ্বার সবার জন্য শুধু উন্মোচন করলেই হবে না, মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগও সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন এখন জরুরি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments