মঞ্চে পেশাদারিত্ব by আলী যাকের
আমরা এখন এক উন্মুক্ত বিশ্বের অধিবাসী, যেখানে অসংখ্য দেশ এবং জাতি রয়েছে। তারা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। সে জন্য আমাদের নিজস্ব সমস্যার গভীরে প্রবেশ করার আগে একটু দেখে নেওয়া ভালো যে, নাটকে পেশাদারিত্ব প্রসঙ্গে বিশ্বের অন্যত্র কী হচ্ছে এবং সেইসব দেশের নাট্যধারা কীভাবে চলছে। আমি প্রথমেই শুরু করছি বিশ্বের দুটি নাট্যকেন্দ্রের নাট্য প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা দিয়ে। যে দুটি শহর আমাদের বাংলাদেশি বিদগ্ধজনের কাছে সমধিক
পরিচিত, তা হলো যুক্তরাজ্যের লন্ডন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক। এই দুই শহরই ওই দুটি দেশের অত্যন্ত পরিচিত নাট্যকেন্দ্র এবং বিশ্বের নানা জায়গা থেকে উন্মুখ নাট্যদর্শকরা এখানে হাজির হন নাটক দেখার জন্য। অস্বীকার করার উপায় নেই এ দুটি কেন্দ্রেই নাটকের মান অত্যন্ত উঁচু এবং বিশ্বের অন্যান্য নাট্যকেন্দ্রের সবাই এ শহর দুটিতে কী ঘটছে তা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। এ দুই শহরেই মঞ্চে দুই ধরনের নাটক হয়ে থাকে। উৎকৃষ্ট পেশাদারি নাটক এবং বাণিজ্যিক নাটক। লন্ডনের কথা দিয়েই শুরু করি। সেখানে রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানি, ন্যাশনাল থিয়েটার, রয়্যাল কোর্ট থিয়েটার_ এ নাট্যকেন্দ্রগুলোতে যে নাটক অভিনীত হয় তাকে সাধারণত সাবসিডাইজড থিয়েটার বা ভর্তুকিনির্ভর নাটক হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আরেকটি নাট্যরীতি অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে এই লন্ডন শহরে পাশাপাশি চলে আসছে, যা ওয়েস্ট এন্ডের বাণিজ্যিক নাটক হিসেবে সংজ্ঞায়িত। যে কোনো গ্রীষ্মের ছুটিতে লন্ডনে নাটক দেখতে গেলে দেখা যায়, ওই শহরে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে বেড়াতে আসা পর্যটকরা এই ওয়েস্ট এন্ডে অবস্থিত নাট্যমঞ্চগুলোতে ভিড় করে। এখানে নানা রুচির নাটক দেখানো হয়। তবে লক্ষ্য অবশ্যই থাকে কী করে নাটককে আরও বেশি মনোগ্রাহী করে আরও বেশি অর্থায়ন করা ন সম্ভব হয়। বস্তুতপক্ষে ওয়েস্ট এন্ডে মঞ্চায়িত নাটকের শরীরে যে বাণিজ্যের প্রলেপ, তা খুব সহজেই মানুষকে আকর্ষণ করে। তবে এখানেও যে একেবারে ভালো নাটক অভিনীত হয় না, তাও ঠিক নয়। কিন্তু তার সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা যায়। আমাদের গ্রুপ থিয়েটার কার্যক্রমে যে বিষয়টি সম্বন্ধে আমরা অত্যন্ত সচেতন, অর্থাৎ প্রয়াত শম্ভু মিত্রের ভাষায়, 'ভালো নাটক', যা 'ভালোভাবে করতে হয়'_ সেই নাটক ব্রিটেনে সাবসিডাইজড থিয়েটার বা ভর্তুকি নির্ভরশীল নাটক হিসেবেই পরিচিত। আমাদের গ্রুপ থিয়েটার নাট্যচর্চা অনেকটা ওই সাবসিডাইজড থিয়েটারের আদলে সংগঠিত। ব্রিটিশ কাউন্সিলের আমন্ত্রণে ১৯৮৪ সালে আমাকে যুক্তরাজ্যের নাট্যকেন্দ্রগুলো দেখার সুযোগ দেওয়া হয়। সে সময় আমি ৩ সপ্তাহ লন্ডনের একাডেমী অব মিউজিক অ্যান্ড ড্রামাটিক আর্টের সঙ্গে নির্দেশক হিসেবে একটি ওরিয়েন্টেশন কোর্স করি। ওই সময় আমি শুনেছিলাম, ব্রিটেনের বিখ্যাত নাট্যদল রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানিকে সে বছর দশ লাখ স্টার্লিং পাউন্ড ভর্তুকি দেওয়া হয় তাদের কার্যক্রম চালানোর জন্য। দশ লাখ পাউন্ড আজকের বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ১২ কোটি টাকা। সেদিন আমি এ তথ্য জেনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এই টাকা কিসে খরচ হয় জানার চেষ্টা করায় আমাকে বলা হলো যে, নাটকের প্রযোজনা ব্যয় মেটাতে এই ভর্তুকির প্রয়োজন হয়। কেবল টিকিট বিক্রি করে অভিনেতাদের পারিশ্রমিক, আলো, সেট এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ মেটানো সম্ভব নয়। কেননা ভালো নাটক, ধরা যাক সফোক্লিস কিংবা শেক্সপিয়রের নাটক, দেখতে সেরকম ভিড় করে দর্শক আসেন না, যেমন দেখা যায় ওয়েস্ট এন্ডে 'দ্য ক্যাটস' অথবা 'মিস সাইগন'-এর প্রতিটি মঞ্চায়নে। কেননা ওইসব নাটকের শরীরে চমক রয়েছে আর ভালো নাটকের একমাত্র অবলম্বন সৃজনশীল সুনাট্যের সুপ্রযোজনা। সেখানে বাহুল্য কোনো আকর্ষণ প্রয়োগের সুযোগ নেই। ২০১০-১১ অর্থবছরে ব্রিটিশ আর্টস কাউন্সিলের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য সরকার রয়্যাল শেক্সপিয়র কোম্পানিকে ১৬,৪১,০৪,৮৯৯ (ষোল কোটি একচলি্লশ লাখ চার হাজার আটশ' নিরানব্বই) পাউন্ড অনুদান দেয়। এছাড়াও আরও অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি বা ব্যবসায়িক সামাজিক দায়িত্বের নিদর্শন হিসেবে সব সাবসিডাইজড থিয়েটারকে অল্পবিস্তর অর্থ বরাদ্দ করে থাকে। এসবই করা হয় উন্নতমানের শিল্পকলার চলার পথকে সুগম করার জন্য সমাজ, জাতি এবং দেশের দায়িত্ব হিসেবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় সুপ্রযোজিত, সুঅভিনীত নাট্যকলার সাহায্যে এগিয়ে আসে। ওদের ভাষায় এই অনুদান বা সহায়তাকে 'এনডাওমেন্ট' বলে বর্ণনা দেওয়া হয়ে থাকে। সেখানে এ ধরনের নাটকগুলো সাধারণত অভিনীত হয় অফ্্ ব্রডওয়ে কিংবা অফ্্-অফ্্ ব্রডওয়ে থিয়েটারগুলোতে। ব্রডওয়েতে সাধারণত বাণিজ্যিক নাটকই অভিনীত হয়। আমি আমার আলোচনার শুরুতেই বিশ্বের উন্নত অর্থনীতির দুই প্রধান নাট্যকেন্দ্রের উদাহরণ তুলে ধরলাম এই কারণে যে, এই তথ্যের দ্বারা আমরা বুঝতে পারব যে, পেশা হিসেবে নাটককে গ্রহণ করা এবং 'ভালো নাটকে' 'ভালো অভিনয়' দিনের পর দিন চালিয়ে যাওয়া বড় সহজ কাজ নয়। আমার জানামতে, বিশ্বের বিভিন্ন নাট্যকেন্দ্র যেমন প্যারিস, মস্কো, কলকাতা কিংবা টোকিও এইসব জায়গাতেও দুটি স্বতন্ত্র ধারায় নাট্যকলার চর্চা হয়ে থাকে।
আমাদের মতো দরিদ্র দেশে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর প্রতি সরকারকে মনোযোগ দিতে হয় এবং ওইসব কাজে, যেমন_ আহার, বাসস্থান, পরিচ্ছদ এবং স্বাস্থ্যসেবা, সড়ক, জলপথ এসব খরচাপাতির পর খুব পরিমিত অর্থই থাকে শিল্পকলাতে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য। আমাদের এখানকার বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও তেমন দড় হয়নি যাতে তাদের পক্ষে শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ণ সহায়তা প্রদান করা সম্ভব। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে আমাদের আরও অনেক দিন কষ্টে-সৃষ্টে শিল্পসম্মত নাট্যের মঞ্চায়ন করে যেতে হবে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। একটা সময় ছিল, সেই সত্তরের দশকের শুরুতে, যখন আমরা ভাবতাম যে, বাণিজ্যিক নাটক যদি আমাদের চলচ্চিত্রের তারকাদের নিয়ে নির্মাণ করা যায় এবং তা যদি মঞ্চে নামানো যায় তাহলে তাদের দেখতেই হাজার হাজার দর্শক মিলনায়তনে উপস্থিত হবে। কে না চায় তার স্বপ্নের মানুষগুলোকে রক্ত-মাংসে দেখতে? কিন্তু এখন সেই সম্ভাবনাটাও অত্যন্ত ক্ষীণ। কেননা আমাদের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের অধঃগতি, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তথাকথিত সব তারকা। [চলবে]
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় সুপ্রযোজিত, সুঅভিনীত নাট্যকলার সাহায্যে এগিয়ে আসে। ওদের ভাষায় এই অনুদান বা সহায়তাকে 'এনডাওমেন্ট' বলে বর্ণনা দেওয়া হয়ে থাকে। সেখানে এ ধরনের নাটকগুলো সাধারণত অভিনীত হয় অফ্্ ব্রডওয়ে কিংবা অফ্্-অফ্্ ব্রডওয়ে থিয়েটারগুলোতে। ব্রডওয়েতে সাধারণত বাণিজ্যিক নাটকই অভিনীত হয়। আমি আমার আলোচনার শুরুতেই বিশ্বের উন্নত অর্থনীতির দুই প্রধান নাট্যকেন্দ্রের উদাহরণ তুলে ধরলাম এই কারণে যে, এই তথ্যের দ্বারা আমরা বুঝতে পারব যে, পেশা হিসেবে নাটককে গ্রহণ করা এবং 'ভালো নাটকে' 'ভালো অভিনয়' দিনের পর দিন চালিয়ে যাওয়া বড় সহজ কাজ নয়। আমার জানামতে, বিশ্বের বিভিন্ন নাট্যকেন্দ্র যেমন প্যারিস, মস্কো, কলকাতা কিংবা টোকিও এইসব জায়গাতেও দুটি স্বতন্ত্র ধারায় নাট্যকলার চর্চা হয়ে থাকে।
আমাদের মতো দরিদ্র দেশে মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর প্রতি সরকারকে মনোযোগ দিতে হয় এবং ওইসব কাজে, যেমন_ আহার, বাসস্থান, পরিচ্ছদ এবং স্বাস্থ্যসেবা, সড়ক, জলপথ এসব খরচাপাতির পর খুব পরিমিত অর্থই থাকে শিল্পকলাতে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য। আমাদের এখানকার বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও তেমন দড় হয়নি যাতে তাদের পক্ষে শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ণ সহায়তা প্রদান করা সম্ভব। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে আমাদের আরও অনেক দিন কষ্টে-সৃষ্টে শিল্পসম্মত নাট্যের মঞ্চায়ন করে যেতে হবে, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। একটা সময় ছিল, সেই সত্তরের দশকের শুরুতে, যখন আমরা ভাবতাম যে, বাণিজ্যিক নাটক যদি আমাদের চলচ্চিত্রের তারকাদের নিয়ে নির্মাণ করা যায় এবং তা যদি মঞ্চে নামানো যায় তাহলে তাদের দেখতেই হাজার হাজার দর্শক মিলনায়তনে উপস্থিত হবে। কে না চায় তার স্বপ্নের মানুষগুলোকে রক্ত-মাংসে দেখতে? কিন্তু এখন সেই সম্ভাবনাটাও অত্যন্ত ক্ষীণ। কেননা আমাদের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের অধঃগতি, তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তথাকথিত সব তারকা। [চলবে]
No comments