প্রেসক্লাব এলাকায় দিনভর বিক্ষোভ-বাসের চাপায় পা হারালেন সাংবাদিক

বাসের নিচে চাপা পড়ে এক পা হারালেন সাংবাদিক নিখিল ভদ্র। গতকাল বুধবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে রাস্তা পারাপারের সময় বিআরটিসির একটি বাস তাঁকে ধাক্কা দিলে তিনি রাস্তায় পড়ে যান। এরপর চালক না থামিয়ে তাঁর পায়ের ওপর দিয়েই যাত্রীভর্তি বাসটি নিয়ে চলে যান। গুরুতর অবস্থায় তাঁকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতাল) নিয়ে যাওয়া হয়।


সেখানে চিকিৎসকেরা তাঁর ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলেন। এদিকে, সহকর্মীর দুর্ঘটনার খবরে দুপুর থেকে প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় অবস্থান করে যান চলাচল বন্ধ করে দেন বিক্ষুব্ধ সাংবাদিকেরা। তাঁরা কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। বিআরটিসির দুটি বাস আটকে সড়কের ওপর আড়াআড়ি রেখে দেওয়া হয়। সাংবাদিকেরা বাসচালকের গ্রেপ্তার এবং আহত সাংবাদিকের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দাবিতে সন্ধ্যা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ করে রাখেন। বিক্ষোভরত সাংবাদিকদের কাছে এসে দুই মন্ত্রী ঘটনার সুষ্ঠু বিচার, নিখিলের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়েছেন।
নিখিল ভদ্র দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সাংবাদিকতায় আসার আগে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও খুলনা জেলার সভাপতি ছিলেন।
পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, নিখিলের ডান পা থেঁতলে গেছে; বাঁ পায়েও আঘাত পেয়েছেন। প্রাণ বাঁচাতে তাঁর ডান পা-টি কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকেরা। প্রায় তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে অস্ত্রোপচার।
শাহবাগ থানা থেকে জানানো হয়েছে, স্থানীয় লোকজন ঘটনাস্থলেই বাসটি আটক করে। তবে চালককে গ্রেপ্তার করা হয়নি। সন্ধ্যায় বাসটি থানায় নিয়ে আসা হয়। তবে এ বিষয়ে কোনো মামলা বা জিডি হয়নি।
দিনভর বিক্ষোভ: নিখিলের দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সাংবাদিকেরা পঙ্গু হাসপাতাল ও প্রেসক্লাবের সামনে ভিড় জমাতে শুরু করেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিক্ষুব্ধ সাংবাদিক ও পথচারীরা প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় পাঁচ-ছয়টি গাড়ির কাচ ভাঙচুর করা হয়। সাংবাদিকেরা দোষী বাসচালকের গ্রেপ্তার দাবি করে খণ্ড খণ্ড মিছিল এবং প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়, র‌্যাবও তৎপর ছিল। উপস্থিত সাংবাদিক নেতারা অযোগ্য চালকদের লাইসেন্স পাওয়ার বিষয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন।
তোপের মুখে বিআরটিসির চেয়ারম্যান: বেলা দুইটার কিছু পর বিআরটিসির পরিচালক মেজর কাজী শফিকউদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলে যান। বিকেলে বিআরটিসির চেয়ারম্যান মেজর (অব.) এম এম ইকবাল প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় বিক্ষোভরত সাংবাদিকদের কাছে এসে বাসচালককে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সাংবাদিকেরা ওই বাসচালকের গ্রেপ্তারের দাবি করতে থাকেন। উত্তেজিত সাংবাদিকদের তোপের মুখে পড়েন বিআরটিসির চেয়ারম্যানসহ আশ্বাসদানকারীরা। তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা তখন মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রেসক্লাবের ভেতরে চলে যান।
এর পরও সাংবাদিকেরা সেখানে অবস্থান করতে থাকেন। বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশাহ সাংবাদিকদের পক্ষে অবস্থান কর্মসূচি মুলতবির ঘোষণা দিয়ে জানান, দাবি মেনে না নিলে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে আবারও অবস্থান কর্মসূচি শুরু হবে।
মন্ত্রীদের আশ্বাস: সাংবাদিকেরা কর্মসূচি স্থগিত করার পর সেখানে আসেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রেসক্লাবের লাউঞ্জে বসে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটি পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। এর ভিত্তিতেই চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেন, অতিদ্রুত বিষয়টির সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকার নিখিলের সুষ্ঠু চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে। তিনি পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে নিখিলের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক গতকাল সন্ধ্যায় নিখিলকে দেখতে হাসপাতালে যান।
তদন্ত কমিটি: ঘটনা তদন্তে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সড়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব মো. মঈনুদ্দিনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গতকাল রাত নয়টার দিকে পল্লবী থানার পুলিশ মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের বিআরটিসি বাস ডিপো থেকে চালক সোহেল রানাকে (২২) আটক করেছে। জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিম প্রথম আলোকে জানান, আটক সোহেল রানাকে শাহবাগ থানায় আনা হয়েছে। সাংবাদিক নিখিল ভদ্রকে চাপা দেওয়ার ঘটনায় সোহেলকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে।

No comments

Powered by Blogger.