চরাচর-কালিটিলার কালীবাড়ী by দীপংকর ভট্টাচার্য লিটন
ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার অর্ধশতাধিক দর্শনীয় স্থানের মধ্যে লুকিয়ে আছে কালিটিলার কালীবাড়ী। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে ফুলছড়া চা-বাগানের ৫ নম্বর সেকশনে একটি লাল টিলায় এই কালীমন্দিরটির অবস্থান। চা-বাগানে প্রবেশপথের প্রথম নিরাপত্তা গেট থেকে বাঁ পাশের রাস্তা দিয়ে দুই কিলোমিটার এগোলেই চোখে পড়বে টিলার ওপর একটি লাল মন্দির। সমতল থেকে প্রায় ২০০ ফুট
ওপরে টিলার ওপর মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছে। টিলায় ওঠার জন্য পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে রাস্তা। দুই পাশে সারি সারি চা-বাগান পেরিয়েই চোখে পড়বে দুর্গম পাহাড় আর এই পাহাড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কালিটিলার কালীবাড়ীর চূড়ায় উঠতে হবে। তবে টিলায় উঠেও কিন্তু স্বস্তি নেই, পা পিছলেই বিপদ হতে পারে। কারণ টিলার চারপাশে গভীর অরণ্য। সরেজমিন কালিটিলার কালীবাড়ীতে গিয়ে দেখা যায়, দর্শনার্থীরা পাহাড় পেরিয়ে টিলার মন্দিরে উঠে প্রথমেই কালীমাতাকে দর্শন করে প্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে সবুজের সমারোহ। বারবার শীতল বাতাস দোলা দিয়ে যাচ্ছে মনকে। টিলা থেকে মনে হয় যেন দূরের আকাশটা মাটিতে মিশে আছে। আকাশে শিমুল তুলার মতো উড়ে বেড়াচ্ছে জমাট বাঁধা মেঘের দল। আবার মেঘে ডাকা নীল আকাশের এক কোণে দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে রংধনু। আমরা যেদিন গিয়েছিলাম তখন সময়টা ছিল পড়ন্ত বিকেল। তাই পাহাড়ের চূড়া থেকে সূর্য ডোবার দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেল কেউই বুঝতে পারিনি। ফেরার পথে বাগানের চা শ্রমিক জগীন্দ্রর (৬৫) সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শতাধিক বছর আগ থেকে এখানে দণ্ডকালী পূজা হতো। তখন এই টিলায় শ্রমিক লাইন ছিল। কিন্তু বাগান কর্তৃপক্ষ চা শ্রমিকদের এ টিলা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পর এখানে পূজা-অর্চনা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বছর চারেক আগে বাগানের এক শ্রমিক স্বপ্নে দেখেন কালিটিলা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর গাড়িটি ঝিলের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এ সময় একজন কালো করে লম্বা মহিলা তাঁর গাড়িটি বিপদমুক্ত করে দিচ্ছেন। বাগানের এক কর্মকর্তা জানান, এখানে কালীমাতার মূর্তির কাজ অর্ধেক বানিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। তখন একটি সাপ ওই অর্ধসমাপ্ত মূর্তিটি পেঁচিয়ে রাখে। অনেক চেষ্টা করেও সাপটিকে সরানো যাচ্ছিল না। পরে পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে সাপটিকে সরিয়ে কালীমূর্তি বানানোর কাজ শেষ করা হয়। এই কালিটিলাকে নিয়ে একটি অলৌকিক ঘটনা জানা যায় চা শ্রমিক জগীন্দ্রর মুখ থেকে। ১০ বছর আগে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রছাত্রীরা পিকনিক করতে এসে টিলার এই পবিত্র স্থানটি বেছে নিয়েছিল। পিকনিক শেষে করে বিকেল বেলা তারা টিলা থেকে নামার সময় তাদের বহন করা গাড়িটি পাশের খাদে পড়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই চালক প্রাণ হারান। প্রতিবছর চৈত্র মাসে এখানে দণ্ডকালীর পূজা হয়। এ ছাড়া বর্তমানে জাগ্রত এই কালীবাড়ীর প্রচার লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ায় প্রতিদিনই এখানে অসংখ্য ভক্তের সমাগম হচ্ছে। কেউ মানত করে আসছেন, কেউবা এসে মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ায় কালীমাতার পূজা দিচ্ছেন। চারদিকে সবুজে ঘেরা পাহাড়ের চূড়ায় স্থাপিত এই কালীমন্দিরটির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য কর্তৃপক্ষ যদি একটু নজর দেয়, তাহলে এই কালিটিলাটিও হতে পারে পর্যটকদের জন্য একটি দর্শনীয় স্থান।
No comments