যুগের বাণী-মৃত্যুর পর মৃত্যু পেরিয়ে by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী

জকের লেখার শিরোনামটি মনের আকাশ চমকিয়ে বিদ্যুতের ঝলকানির মতো হাজির হলো ১২ অক্টোবরের সকালে যখন দৈনিক খবরের কাগজে একটি সংবাদ প্রতিবেদন পড়লাম। সেটা ছিল তার আগের দিনে সিলেটের জনসভায় বিএনপি চেয়ারপারসনের বক্তৃতার বিবরণ। কিন্তু সেখান থেকে তো মৃত্যুযাত্রার শুরু নয়, সেটাই জানান দিয়ে শিরোনামটি হাজির হয়েছে। সুতরাং গোড়া থেকে শুরু করা যাক। বাহাত্তরের সংবিধান শুরু হয়েছিল 'প্রস্তাবনা' ভাগে নিম্নোক্ত বাক্যটি


দিয়ে : 'আমরা বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।' উপরিউক্ত 'জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের' বাক্যাংশটির পরিবর্তে ১৯৭৮ সালের সামরিক আইন দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন দ্বারা 'জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের' শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হয়। এটি একটি ধূর্ত পরিবর্তন ছিল এবং আসলে পরিবর্তন নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মৃত্যু ঘটানো হলো। সেটা অতিসহজেই ধরা পড়বে যদি অত্যাচার-উৎপীড়ন, শোষণ-লুণ্ঠন প্রতিরোধে বাংলার কৃষকদের অত্যুজ্জ্বল ইতিহাস, মৃত্যুর শোকগাথা আমরা পড়ি। সে ইতিহাসের সূচিপত্র এই_সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০), মাঝি বিদ্রোহ (১৭৬৬-৮৩), সমশের গাজীর বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮, ১৮৪৪-৯০), সন্দ্বীপের বিদ্রোহ (১৭৬৯, ১৮১৯, ১৮৭০), কৃষক-তাঁতি বিদ্রোহ (১৭৭০-৮০), গারো বিদ্রোহ (১৭৭৫-১৮০২), চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-৮৭), নীলচাষিদের বিদ্রোহ (১৭৭৮-১৮০০, ১৮৩০-৪৮, ১৮৫৯-৬১), লবণচাষিদের বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০৪), রেশমচাষিদের বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০০), রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩), বরিশালের বিদ্রোহ (১৭৯২), ময়মনসিংহের কৃষক বিদ্রোহ (১৮১২-৩০), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭), সুন্দরবন অঞ্চলে বিদ্রোহ (১৮৬১), সিরাজগঞ্জ কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭২-৭৩), তেভাগার দাবিতে কৃষক বিদ্রোহ (১৯৪৬-৪৭)। উপরিউক্ত প্রতিটি বিদ্রোহের ফলাফল আদৌ বিবেচ্য নয়, বরং আসল বিবেচ্য হচ্ছে এগুলোর চরিত্র এবং সেটি হলো, অসম অথচ সাহসিক লোকায়ত বিদ্রোহ।
এই বিদ্রোহ-সংগ্রামগুলোর ধারাবাহিকতায়ই ১৯৭১ সালের সশস্ত্র প্রতিরোধ ও যুদ্ধ। তাই এই যুদ্ধের জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক 'সংগ্রাম' উল্লেখ না করে শুধু যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করলে ১৯৭১ সালের মুক্তির জন্য সংগ্রাম ইতিপূর্বের দুই শতাধিক বছরের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ঐতিহাসিক ধারাকে ভুলে যেতে হয়। বাংলাদেশ শুধু একটি স্বাধীন দেশ না হয়ে একটি মুক্ত স্বাধীন দেশ হবে_এই আকাঙ্ক্ষায় জনগণের সশস্ত্র যুদ্ধের নাম স্বাধীনতার যুদ্ধ না হয়ে আপনাআপনি মুক্তিযুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেননা 'স্বাধীন' ও 'মুক্ত' শব্দ দুটি সমার্থক নয়। একটি স্বাধীন দেশে অনাহার, অচিকিৎসা, অশিক্ষা, অবিচার থাকতেই পারে, কিন্তু একটি মুক্তিপ্রাপ্ত দেশে এগুলো থাকে না, থাকতেই পারে না।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে আশা করা গিয়েছিল এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক ছিল আমাদের মৃত্যুর পর মৃত্যু পার হওয়ার সমাপ্তি ঘটেছে। আমাদের এবার যাত্রা শুরু হবে একটি সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ, অর্থাৎ লোকায়ত রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার স্বর্ণশিখরের উদ্দেশ্যে, সেই লক্ষ্যে বাহাত্তরের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদের নির্দেশনা অনুযায়ী রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের ধারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সব বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, সে পাঠক্রমে আমাদের উত্তর পুরুষ বালক-বালিকারা পড়বে মুক্তিযুদ্ধসহ সব বিদ্রোহ-সংগ্রামের ইতিহাস। যার একটি অতিসংক্ষিপ্ত উদাহরণ দেওয়া যাক।
'বাংকারে শুয়েছিলাম আমরা। বলতে গেলে একটা বন্ধ্যা সময় যাচ্ছে। জেনারেল রাও ফরমান আলীকে চূড়ান্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে আত্মসমর্পণের জন্য। কিন্তু তাঁর তরফ থেকে কোনো রকম সাড়া-শব্দ নেই। এদিকে ফ্রন্টও চুপচাপ। সুবেদারকে বলি, যাবেন কোথায় দাদু? (তিনি বলেন), চলেন একটু লঙ্গরখানা থন ঘুইরা আসি। সময় কাটতেছে না বুঝছোননি? ২০-২৫ মিনিট হাঁটার পর আমাদের লঙ্গরখানায় পেঁৗছানো যায়। বেশ বড় একটা পরিত্যক্ত ধানকলের ভেতরে স্থাপন করা হয়েছে লঙ্গরখানাটি। এই লঙ্গরখানা থেকে প্রতিদিন আমাদের খাবার তৈরি হয়েছে, অমানুষিক পরিশ্রম করেছে লঙ্গরখানার প্রত্যেক সদস্য এ কাজে নানা প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিতে, বিপদের ভয়াবহ ঝুঁকি মাথায় নিয়ে। বাঁশের ভারে করে এখান থেকে খাবার পেঁৗছানো হয়েছে ফ্রন্টের প্রতিটা বাংকার-ট্রেঞ্চের পোস্টে। এ কাজ করতে গিয়ে অনেককেই জীবন দিতে হয়েছে। আমাদের সম্মুখযুদ্ধে আসার প্রথম দিন চৈতনপাড়ার চারজন খাদ্যবাহী মানুষকে একেবারে চোখের সামনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে দেখেছি।
বিকেল ৪টা তখন। হঠাৎ ওয়াকিটকি সেটে ভেসে আসে ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের গলা। আজ বিকেলে ঢাকা রেসকোর্সে পাকিস্তানি বাহিনী সারেন্ডার করেছে। আমাদের সম্মুখে সৈয়দপুর রণাঙ্গনে পাকিস্তানি সেনারা ভাতগা নদীর ওপারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তারা আজ সারেন্ডার করতে পারে। কথোপকথন শেষে সুবেদার খালেক জড়িয়ে ধরলেন। পাশে দাঁড়ানো আমার কম্পানির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পিন্টু। জাপটে ধরে সে আমাকে। তারপর ছেড়ে দিয়ে দুই পাক ঘুরে নাচার ভঙ্গিতে হাত ওপরে চিৎকার করে বলতে থাকে, 'স্বাধীনতা, স্বাধীনতা, মুক্তি-মুক্তি, সারেন্ডার, সারেন্ডার এবং সবশেষে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল সেই চিরায়ত স্লোগান_ জয় বাংলা। না, আমরা মরিনি। অনেকে মারা গেছে। আজ যদি গোলাম গউস বেঁচে থাকত, আক্কাস বেঁচে থাকত, মতিয়ার বেঁচে থাকত, কার কী ক্ষতি হতো।' মাহবুব আলম, গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭৬-৫৭৮ (সংক্ষেপিত)।
এই হচ্ছে আরেক মৃত্যু_বইয়ের মৃত্যু। মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব আলমের এই বইটি কিংবা এমন আরো বই, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জিইয়ে রাখতে পারত_সেই সাহিত্যকে নামতে হয়েছে টিভির ধারাবাহিক কাহিনী চিত্রের সঙ্গে দৌড়ে। ফলাফল বইয়ের মৃত্যু। অথচ বই-ই মানুষের জগৎ। বই-ই মানুষকে মুক্তি দেয়। বই পায়ে ঠেকলে তাকে সালাম করতে হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২১৩ সালে চীনের এক সম্রাট আদেশ দিয়েছিলেন, যেহেতু ইতিহাস শুরু হয়েছে আমার শাসন দিয়ে, সুতরাং আগেকার সব বই নিক্ষেপ করতে হবে অগি্নকুণ্ডে। ১৯৩৩ সালে নাৎসি জার্মানিতে গোয়েবলসের নেতৃত্বে সেখানে পোড়ানো হয়েছিল বিশ হাজার বই। এখন আগুনে নয়, পরোক্ষভাবে বই পুড়ছে।
হ্যাঁ, এখন ওই সংবাদ-প্রতিবেদনটি উল্লেখ করতে হয়, যার পাঠের প্রতিক্রিয়ায় আজকের লেখার শিরোনামের জন্ম হয়েছে। সিলেট শহরে অনুষ্ঠিত জনসভায় বিএনপি চেয়ারপারসন যা বক্তৃতা দিয়েছেন তার সারকথা হচ্ছে_আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দিচ্ছি। সরকার শিগগির পদত্যাগ করুক। দেরি করবে না। তাহলে জনগণের ধাক্কায় পড়ে যাবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের ৩ দফা এই : 'যে সংসদ সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হইবেন, রাষ্ট্রপতি তাঁহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন' এবং ৫৭ অনুচ্ছেদের ৩ দফাবলে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নিজ পদে বহাল থাকবেন। সুতরাং আন্দোলন দ্বারা নয়, বরং জাতীয় সংসদের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের আস্থাভাজন একজন সংসদ সদস্যই কেবল পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রীর স্থান পূরণ করতে পারেন। এটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের সর্বজনীন নিয়ম। তবে কি সংসদীয় গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটবে? আর কত মৃত্যুর পর মৃত্যু বাংলাদেশের জনগণকে পার করতে হবে?

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট

No comments

Powered by Blogger.