বিশেষ সাক্ষাৎকার : আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী-দেশে একটি সমাজ বিপ্লব প্রয়োজন by আলী হাবিব

কুশের অমর গানের রচয়িতা তিনি। সেই গানটিই আজ বিশ্বজুড়ে গীত হচ্ছে প্রভাতফেরির গান হিসেবে। কথাশিল্পী হিসেবেও তিনি সমধিক পরিচিত। আজকের প্রজন্ম তাঁকে জানে সাংবাদিক ও কলাম লেখক হিসেবে। কালের কণ্ঠের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে লন্ডনপ্রবাসী সেই সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলী হাবিব কালের কণ্ঠ : প্রায় তিন বছর পার করতে যাচ্ছে মহাজোট সরকার।


সরকারের এই সময়টা আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : প্রায় তিন বছর তো হলো মহাজোট বা আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় থাকা। তারা হয়তো মেয়াদ পূর্ণ করবে। কিন্তু দ্বিতীয় হাসিনা সরকার প্রথমবারের মতো সুনাম অর্জন করতে পারেনি। প্রথমবারের হাসিনা সরকারের যে ভাবমূর্তি ছিল, তা এবার অর্জিত হয়নি। এবার তাদের বহু ক্ষেত্রে সাফল্য ও অর্জন বেশি। কিন্তু ব্যর্থতা আরো বড়। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, যানজট প্রভৃতি সংকট মোচনে এবং বিশেষ করে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদনে তারা সফল হয়নি। অথচ গতবার তারা গঙ্গার পানি চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম হয়েছিল। শেখ হাসিনা যখন এবার প্রথম মন্ত্রিসভা গঠন করেন, তখন তাঁর মন্ত্রিসভার তালিকা দেখে এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম যে 'শেখ হাসিনা একটি অদক্ষ মন্ত্রিসভা এবং তার মাথার ওপর উপদেষ্টাদের একটি দ্বৈত শাসন চাপিয়ে দিয়ে অত্যন্ত কঠিন এক সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছেন। তাঁর শত্রুপক্ষ নির্বাচনে পরাজিত হলেও প্রশাসনের ভেতরে তাদের অস্তিত্ব ও প্রভাব রয়েছে এবং তারা অর্থ ও প্রপাগান্ডার শক্তিতে বলীয়ান। এই প্রবল প্রতিপক্ষের শক্তি উপেক্ষা করে একটি দুর্বল ও অদক্ষ মন্ত্রিসভা নিয়ে তাঁর পক্ষে চলা কঠিন হবে।' গত তিন বছরে আমার মতো অনেকের এই সতর্কবাণী সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এ অবস্থায় সরকার কী ব্যবস্থা নিতে পারত বলে আপনি মনে করেন?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি আগের বিএনপি-জামায়াত সরকার অত্যন্ত কঠিন করে রেখে গেছে। তারেক রহমান এবং তাঁর হাওয়া ভবন যে অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট গঠন করে গেছে, তার আধিপত্য এখনো বাজারে বর্তমান। আমার ধারণা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের সব প্রচেষ্টা এই অসাধু সিন্ডিকেট ব্যর্থ করে দিচ্ছে। সরকারের ব্যর্থতা এখানে যে তারা এই সিন্ডিকেটের চক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বরং এক শ্রেণীর মন্ত্রী ও এমপি এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত বলে আমার ধারণা। প্রধানমন্ত্রীর উচিত ছিল সময় থাকতে এই মন্ত্রীদের অপসারণ করা এবং সিন্ডিকেটগুলো নিষ্ক্রিয় করার ব্যবস্থা করা। এখন শর্ষের ভেতরেই ভূত প্রবেশ করায় সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হচ্ছে না। এই অবস্থা চলতে থাকলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা যাবে না। এটা আগামী নির্বাচনে সরকারের বিপক্ষে একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে।
কালের কণ্ঠ : বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের দক্ষতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আপনার মূল্যায়ন কী?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : মন্ত্রিসভা গঠনের সূচনাপর্বেই আমি এই মন্ত্রীদের সম্পর্কে আমার মত ব্যক্ত করেছিলাম। এ মন্ত্রিসভায় দু-তিনজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ মন্ত্রী আছেন; যেমন_নুরুল ইসলাম নাহিদ, আবুল মাল আবদুল মুহিত, মতিয়া চৌধুরী, ড. আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ। কিন্তু স্থানীয় সরকার ও সমবায়মন্ত্রী থেকে শুরু করে তথ্যমন্ত্রী পর্যন্ত যাঁরা মন্ত্রী হয়েছেন, তাঁদের দক্ষতা সম্পর্কে এই তিন বছর পরও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী যতই বলুন, 'তাঁরা স্মার্ট এবং তাঁরা ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত', তা সঠিক হলে গত তিন বছরে বহু ব্যাপারে সরকারের লেজে-গোবরে অবস্থা হতো না।
কালের কণ্ঠ : ধরা যাক বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা। তাঁর পারফরম্যান্স নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। আমার ধারণা, তিনি কাজের চেয়ে কথা বলেন বেশি। কথা বলে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে ফেলেন। তিনি অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কি না জানি না। কিন্তু তাঁর দায়িত্বহীন কিছু কথাবার্তা বাজার নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে বলে মনে হয়।
কালের কণ্ঠ : আলোচনায় আছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রীও। তাঁদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে তাঁর পারফরম্যান্স বিবেচনা করে মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণ করা উচিত ছিল বলে অনেকের ধারণা। আমি এর সঙ্গে অনেকটাই সহমত পোষণ করি। তিনি একদিকে মন্ত্রী, অন্যদিকে সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা। এ দুই পদে অবস্থান সাংঘর্ষিক। তিনি শ্রমিকদের স্বার্থ দেখবেন, নাকি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন? দেশে যখন সড়ক ও নৌপথের দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে, তখন তাঁকে দেখা যায় জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ অর্থাৎ তাদের নিরাপত্তার চেয়ে অদক্ষ চালকদের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে। মাঝেমধ্যে তিনি দায়িত্বহীন কথাবার্তাও বলেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর গাড়িচালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কথা বলাটা ছিল তাঁর জন্য বালখিল্যতা। মন্ত্রী থাকতে হলে তাঁর উচিত নৌ ও সড়কপথের যাত্রীদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। অথবা শ্রমিক নেতৃত্বে বহাল থাকা।
যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন সম্পর্কেও আমার একই কথা। তিনি হয় ভালোভাবে ব্যবসা করুন, না হয় মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনে তাঁর শক্তি ও সময় ব্যয় করুন। ওজারতি ও তেজারতিকে মিশিয়ে তিনি বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক বলেছে, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার কারণে এ সম্পর্কিত তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ রাখবে। এ ধরনের অভিযোগ বিএনপি সরকারের আমলেও উঠেছিল। ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত বিএনপির নৌপরিবহনমন্ত্রী কর্নেল আকবরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন। তখনো তাঁকে অপসারণ করার দাবি উঠেছিল। অবশ্য তাঁকে অপসারণ করা হয়নি। বর্তমানেও যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে অপসারণের দাবি উঠতে পারে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে তখন এই সমস্যায় পড়তে হবে যে বিশ্বব্যাংককে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে দেওয়া হবে কি না। তিনি যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ যথাযথ তদন্ত করে তাঁকে অপসারণ করতে পারেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত অপ্রমাণিত বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের মুখে তা করতে পারেন না।
বাজারে শোনা যাচ্ছে, পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এই অভিযোগের পেছনেও রাজনীতি আছে। আবুল হোসেনের 'চায়না কানেকশন' এবং পদ্মা সেতুর জন্য একটি কনসাল্টিং কম্পানিকে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ করা কম্পানিকে নিয়োগ না দিয়ে এমন একটি কম্পানিকে নিয়োগ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে, যে কম্পানির 'চায়না কানেকশন' নাকি স্পষ্ট। বিশ্বব্যাংক তাতে নাখোশ এবং তার ফলেই নাকি পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে এই ঘাপলা। এই খবর সঠিক হলে বিশ্বব্যাংকের প্রতি নতজানু হওয়া বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে না। বিশ্বব্যাংক এই খেলা প্রেসিডেন্ট নাসেরের আমলে মিসরের আসোয়ান বাঁধ নির্মাণ নিয়েও খেলেছে। নাসের বিশ্বব্যাংকের কাছে নতি স্বীকার করেননি। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। শেখ হাসিনাকেও পদ্মা সেতুর জন্য বিকল্প আর্থিক উৎসের অনুসন্ধান করতে হবে। যোগাযোগমন্ত্রী দুর্নীতি করে থাকলে তার তদন্ত হোক। প্রমাণিত হলে তাঁকে অপসারণও করা যেতে পারে। কিন্তু তাঁকে পদ্মা সেতুর ব্যাপারে 'এস্কেপ গোট' করা উচিত হবে না।
কালের কণ্ঠ : আপনার কি মনে হয় মন্ত্রীদের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ম্লান হচ্ছে?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : আমি এ প্রশ্নের জবাব গোড়াতেই দিয়েছি। বেশ কিছু মন্ত্রী ও উপদেষ্টার কার্যকলাপ ও কথাবার্তায় সরকারের ভাবমূর্তিই শুধু ক্ষুণ্ন হয়নি, দক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, একেবারেই অনভিজ্ঞ ব্যক্তিকে একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মতো বিশাল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হয়নি। দলে ও মন্ত্রিসভায় তাঁর সমালোচনা হচ্ছে প্রচুর। তিনি তাতে দৃকপাত না করে বিএনপি-জামায়াতের এই রোডমার্চ আন্দোলনের সময়ও লন্ডনে এসেছেন পরিবারের সঙ্গে অবসর কাটাতে। তাঁর মতো আরো মন্ত্রী আছেন, তাঁদের আচার-আচরণ ও কথাবার্তায় মনে হয় না, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করা ছাড়া দায়িত্ব পালনে আদৌ আগ্রহী। এবার তিস্তা নদীর পানি বণ্টন আলোচনায় আমাদের তরফে কৌশল নির্ধারণে যে অদক্ষতা ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যদি এখনো তাঁর মন্ত্রিসভার রদবদল না করেন, তাহলে এই সরকারের ভাবমূর্তি উদ্ধার করা দুরূহ হবে।
কালের কণ্ঠ : সামগ্রিক বিবেচনায় সরকার সফল, না ব্যর্থ?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : সামগ্রিক বিবেচনায়, আমার মতে, এই সরকার সাফল্য ও ব্যর্থতার একটি যোগফল। সরকার প্রকাশ্য সন্ত্রাস অনেক কমিয়েছে, জঙ্গি-মৌলবাদীদের দমনে সাবেক সরকারের চেয়ে আগ্রহ ও আন্তরিকতা বেশি দেখিয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে দুর্নীতি দূর হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে চাষিদের জন্য ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, সরাসরি ঋণ ও সাহায্য প্রদান, সার ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধি, গ্রামীণ বেকারত্ব দূর করার ব্যাপারে অনেক সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু যে ক্ষেত্রগুলোতে সাফল্য দেখিয়ে তারা নাগরিক জীবনে মধ্যম আয়ের মানুষের মধ্যে স্বস্তি ও শান্তি আনতে পারত, সেসব ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য গৌণ। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, যানজট, সড়ক ও নৌপথে দুর্ঘটনা, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি বন্ধ করা এবং প্রশাসনের বিরাট দুর্নীতি, সীমান্ত সংঘাত বন্ধ করা ইত্যাদি ব্যাপারে সরকার দৃষ্টিগ্রাহ্য সাফল্য দেখাতে পারেনি। আগামী নির্বাচনে এ বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে। 'অতীতের বিএনপি-জামায়াত সরকার এই সমস্যাগুলো সৃষ্টি করে গেছে'_তিন বছর পরও এই ধুয়া তুলে জনগণের কাছে ভোট চাইতে যাওয়া যাবে না। আগামী দুই বছরে যদি সরকার দক্ষতা অর্জনে এবং জনগণের সমস্যা মোচনে সাফল্য দেখাতে না পারে, তাহলে বিএনপিকে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে হবে না, ভোটারদের প্রোটেস্ট নির্বাচনে অন্য রকম ফল দাঁড়াতে পারে।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান অবস্থাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতা ফিরে আসেনি এবং গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎও নিশ্চিত হয়নি। আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনে বিশাল জয় নিয়ে ফিরে আসায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তনের আশা দেশের মানুষ করেছিল, তা পূরণ হয়নি। মহাজোটের নামে নির্বাচন হয়েছিল, কিন্তু প্রতিষ্ঠা হয়েছে মূলত দলীয় সরকার এবং ভালো হোক আর মন্দ হোক, প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্বসুলভ ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে। দেশে কেবিনেট পদ্ধতির সরকারের বিকাশ ঘটেনি, ঘটেছে প্রেসিডেন্সিয়াল ধরনের সরকারের বিকাশ। এটা সংসদীয় সরকারের বিকাশের জন্য সহায়ক হয়নি। অন্যদিকে বিরোধী দল সংসদীয় রাজনীতিতে আস্থাবান বলে মনে হয় না। তারা গোড়া থেকেই নানা অজুহাতে সংসদ বর্জনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রকে দেশে অকার্যকর করে রেখেছে। বিশ্বপরিস্থিতিতে এক ধরনের পরিবর্তন ঘটায় বাংলাদেশে হয়তো সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা নেই। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্র বর্তমান অবস্থার মতো চলতে থাকলে বিদেশি হস্তক্ষেপ দ্বারা তৈরি জারদারি বা কারজাই সরকারের মতো সরকার ক্ষমতায় আসার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে আফগান যুদ্ধে জয়ী হতে না পেরে আমেরিকা তালেবানের সঙ্গে যে আপস-আলোচনা শুরু করেছে, তা সফল হলে এবং আফগানিস্তানে আবার তালেবান ক্ষমতায় এলে তার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান ও বাংলাদেশে মৌলবাদীরা আবার শক্তিশালী হবে। সুতরাং বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো দূর না করেন, মন্ত্রিসভাকে শক্তিশালী না করেন, মৌলবাদীদের প্রতি তোয়াজনীতি পরিহার না করেন, সর্বোপরি ছোটবড় সব গণতান্ত্রিক দলকে মহাজোটে এনে জোটকে সক্রিয় ও শক্তিশালী না করেন তাহলে সিলেটের মাদ্রাসা মাঠে বেগম জিয়া যে নতুন যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন, তার ফল কী হবে জানি না।
কালের কণ্ঠ : দেশের সাধারণ মানুষ কেমন আছে বলে মনে হয় আপনার?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : দেশের সাধারণ মানুষ বলতে আগে আমরা মনে করতাম ধনী ও দরিদ্র। বর্তমানে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। দেশে এখন একটি বিশাল নব্যধনী শ্রেণী তৈরি হয়েছে। মধ্যবিত্তের একটি ক্ষুদ্র অংশের খুবই সমৃদ্ধি হয়েছে। বাকি অংশ অভাবের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে। গ্রামাঞ্চলে একটি সচ্ছল কৃষক ও কৃষিশ্রমিক শ্রেণী তৈরি হয়েছে। নারীর বন্দিদশা অনেকটাই কমেছে। অর্থাৎ দেশের মানুষের ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। কিন্তু মন্দ দিকটাই বেশি। সাধারণভাবে বলতে গেলে দেশের মানুষ ভালো নেই। এর বড় কারণ সামাজিক অবক্ষয় এবং ব্যাপক অর্থনৈতিক দুর্নীতি। নারীর মুক্তি ঘটেছে, কিন্তু বহুগুণ বেড়েছে নারী নির্যাতন। কৃষিশ্রমিকদের আয় বেড়েছে, কিন্তু পণ্যমূল্যের অসম্ভব ঊর্ধ্বগতি তাদের সে আয়কে স্বস্তিদায়ক করতে পারছে না। বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণী অসম্ভব চাপে পিষ্ট। তারা নির্দিষ্ট আয় দিয়ে জীবন ধারণ করতে পারছে না। ফলে দুর্নীতির প্রসার ঘটছে হু হু করে। সমাজের শীর্ষ থেকে পাদদেশ_সর্বস্তরে দুর্নীতি বিরাজিত। কোনো ক্ষেত্রেই সামাজিক কোনো মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা নেই। আইনশৃঙ্খলার প্রতি কারো কোনো শ্রদ্ধা নেই। ফলে ভয়াবহ এক নৈরাজ্যের ভেতর দেশ ঘুরপাক খাচ্ছে। একটি কালো টাকা ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এবং সবচেয়ে ভালো আছে এই কালো টাকা নির্ভর নব্যধনী সম্প্রদায়। সরকার, সংসদ, এমনকি উপাসনালয়ে পর্যন্ত এই কালো হাতের থাবা বিস্তার লাভ করেছে। দেশে একটি সমাজ বিপ্লব প্রয়োজন। তা না হলে এই অধোগতি থেকে দেশকে রক্ষা করা যাবে না।
কালের কণ্ঠ : আগামী দুই বছরে দেশ ও দেশের মানুষের ব্যাপারে সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : আমি দুই কথায় জবাব দিতে চাই। সরকার কেবিনেট পদ্ধতির শাসনে ফিরে যাক, যেকোনোভাবে সংসদকে কার্যকর করুক, মন্ত্রিসভায় দক্ষতা আনুক, দ্বৈতশাসন বর্জন করুক, মৌলবাদের বিরুদ্ধে কঠোর হোক, প্রশাসন ও মন্ত্রিসভা থেকে দুর্নীতি উচ্ছেদকে অগ্রাধিকার দেওয়া হোক_আগামী দুই বছরে সরকারের কাছে এটাই আমার প্রত্যাশা।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির গতি-প্রকৃতি কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন আপনি?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : এ বিষয়ে আমি কালের কণ্ঠে চার পর্বে লিখেছি।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশেকে ভবিষ্যতে কী অবস্থায় দেখতে চান?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : আমার একান্ত আশা, বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মৌলবাদের উত্থান প্রতিহত করা এবং সাম্রাজ্যবাদের নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সব বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির একটি ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী মোর্চা গঠিত হবে। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর মতো সাহস ও উদারতা নিয়ে এই মোর্চার নেতৃত্ব দেবেন। নিজের দলকে কালো টাকা ও নব্যধনীদের একাধিপত্য থেকে মুক্ত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর মতো সাহসী পদক্ষেপ নেবেন। বিদেশনীতির ক্ষেত্রে তিনি কেবল ভারতনির্ভর না হয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে একটি ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাবেন এবং লাতিন আমেরিকা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বহু দেশে যে নতুন সমাজভাবনা ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে, ধীরে হলেও কৌশলে তার সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মোর্চার সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালাবেন।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : আপনাকেও ধন্যবাদ। কালের কণ্ঠকে ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.