গার্মেন্ট শ্রমিকের মানবেতর জীবন-ন্যূনতম মজুরি কাঠামো পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন
গার্মেন্ট কারখানার একজন শ্রমিক দৈনিক ১৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করে মাসে যে বেতন পান, তা দিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করাও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বস্তির একটি ঘরে সিট ভাড়া আর নিজের প্রতিদিনের খাবার জোটাতেই চলে যায় তাঁর রোজগারের পুরোটা। গ্রামে থাকা মা-বাবা কিংবা পরিবারকে সহযোগিতা করা তো দূরে থাক, তেল-সাবান আর কাপড়চোপড়ের মতো নিজের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার ক্ষমতাও তাঁদের থাকে না। এ চিত্র দেশের অধিকাংশ গার্মেন্ট
কারখানার শ্রমিকদের। গতকাল কালের কণ্ঠে এ ব্যাপারে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। অথচ রাষ্ট্র গার্মেন্ট কারখানার মালিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পরিমাণ কেবল বাড়িয়েই চলেছে। তাঁদের বিত্তবৈভবের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
রামপুরার একটি গার্মেন্টে কর্মরত একজন নারী শ্রমিক জানান, সকাল ৮টায় তিনি কারখানায় ঢোকেন আর বের হন রাত ১০টায়। মাসে ৩০ দিনই কাজ করতে হয়। তারপর মাসশেষে বেতন পান মাত্র তিন হাজার ৭০০ টাকা। তাঁকে বস্তির একটি ঘরে একটি সিটের জন্য দিতে হয় এক হাজার ২০০ টাকা। বাকি আড়াই হাজার টাকায় মাছ-মাংস দূরে থাক, একটু ভালোমন্দ সবজি দিয়েও খাবার জোটানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। গোসলের সাবান, কাপড় কাচার সাবান, মাথার তেলসহ আরো অনেক কিছুরই দরকার হয়। তিনি সেসব প্রয়োজন মেটাবেন কী দিয়ে? আবার বাড়িতে মা-বাবা চেয়ে থাকেন তাঁর দিকে। ছোট ভাইবোন থাকলে তারাও আশায় থাকে। বাড়িতে ৫০০ টাকা পাঠাতে গেলেও তাঁকে উপোস করে টাকা জমাতে হবে। অথচ বিপরীতক্রমে পোশাক শিল্পের মালিকরা দেশের বিত্তবানদের শীর্ষ সারিতে চলে এসেছেন। সরকারও তাঁদের নানাভাবে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি শ্রমিকদের জন্য গৃহনির্মাণের নাম করে অনেক মালিক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে সেই অর্থ অন্য খাতে ব্যয় করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। শুল্ক ও কর রেয়াত তো আছেই। দেশের কোনো নাগরিক বিপদে পড়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে তাঁকে কমপক্ষে ১৮ শতাংশ সুদ দিতে হয়, আর রপ্তানি খাত হওয়ায় গার্মেন্ট মালিকরা ব্যাংক থেকে মাত্র ৭ শতাংশ সুদে ঋণ পেয়ে যান। এমন ছাড় তাঁদের আরো অনেক ক্ষেত্রেই দেওয়া হচ্ছে। তার পরও একজন শ্রমিকের বেঁচে থাকার নূ্যনতম চাহিদাটুকু পূরণ করতে তাঁদের এত কার্পণ্য কেন?
আমাদের মনে আছে, গত বছর নূ্যনতম মজুরি কাঠামো ঘোষণার আগে শ্রমিকরা আন্দোলন করছিলেন নূ্যনতম মজুুরি পাঁচ হাজার টাকা করার দাবিতে। কিন্তু গার্মেন্ট মালিকরা আড়াই হাজার টাকার ওপর উঠতে রাজি হচ্ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা তিন হাজার টাকা নির্ধারিত হয়েছিল। তখন মালিকপক্ষ থেকে এমন কথাও বলা হয়েছিল, এর ফলে দেশের ৭০ শতাংশ কারখানা বিপদে পড়বে। সেগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাস্তবে আমরা সে রকম কিছু দেখতে পাইনি, বরং উত্তরোত্তর তাঁদের শান-শওকত বাড়তেই দেখছি। তাঁদের বিত্তবৈভব আরো বৃদ্ধি পাক, তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু দৈনিক ১৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করেও একজন শ্রমিক কেন তাঁর মুখের আহার জোটাতে পারবেন না? কেন তাঁর নূ্যনতম প্রয়োজনটুকু মেটাতে পারবেন না? সামাজিক ও নৈতিকতার মানদণ্ডে এটি অন্যায়। সরকারকে দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সংগতি রেখে তাঁদের নূ্যনতম মজুরি কাঠামো পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। সেই সঙ্গে তাঁদের মানবেতর জীবনকে উন্নত করতে আবাসন সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাও দিতে হবে।
No comments