নিত্যজাতম্-পৃথিবী যখন দুই রকম by মহসীন হাবিব
শুক্রবার ব্রিটেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়াম ফঙ্ পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগের কারণ তাঁর মন্ত্রী হিসেবে ব্যর্থতা নয়, সরাসরি তিনি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হননি, এমনকি ব্রিটেনের জনগণও তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেনি। তিনি পদত্যাগ করেছেন তাঁর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অ্যাডাম ওয়েরিটিকে বহুবার তাঁর অফিসে প্রবেশের সুযোগ দিয়ে এবং বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক মিটিংয়ে উপস্থিত হতে দেওয়ার অভিযোগে; যে মিটিংগুলোতে বন্ধু
ওয়েরিটির উপস্থিত থাকাটা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। এ নিয়ে ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর ফঙ্ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। তিনি তাঁর পদত্যাগপত্রে লিখেছেন, 'I mistakenly allowed the distinction between my personal interest and my government activities to become blurred. The consequences of this have become clearer in recent days. I am very sorry for this.'
২০১০ সালে আমরা দেখেছি, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছেন গর্ডন ব্রাউন। তখন তিনি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে স্বীকার করে বলেছিলেন, 'It was a privilege to serve and, yes, I love the job, not for its prestige, its titles and ceremo�, which I do not love at all.'
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামরনের নিয়োগের ব্যাপারে ব্রাউন বলেছিলেন, 'ভবিষ্যতে তাঁর সফলতার জন্য আমি শুভ কামনা করি।'
এর আগে ২০০৩ সালে ব্রিটেনে আমরা ফরেন সেক্রেটারি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) রবিন কুককে দুঃখজনকভাবে পদত্যাগ করতে দেখেছি। রবিন কুকের একটি বড় অর্জন ছিল। তিনি প্যান অ্যাম বিমান বোম্বিংয়ের (লকারবি) দুই অভিযুক্ত মেঘরাহি এবং ফিমাহকে নেদারল্যান্ডসে নিরপেক্ষ আদালতে হস্তান্তর করতে লিবিয়াকে রাজি করিয়েছিলেন। ব্যতিক্রম চরিত্রের এই মানুষটি ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ প্রশ্নে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন। সেই প্রথম কোনো ব্রিটিশ মন্ত্রী বিদেশি কোনো ব্যাপার নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। পদত্যাগ করে তিনি ভাষণে বলেছিলেন, I cannot accept collective responsibility for the decision to commit Britain now to military action in Iraq without international agreement or domestic support.
যখন-তখন দায়িত্ব (ক্ষমতা!) ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে জাপানিরা আরো এক কাঠি সরেস। জাপানি মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীরা এমন তুচ্ছ কারণেও পদত্যাগ করে বসেন যে মনে হয়, তাঁকে জোর করে মন্ত্রীর আসনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এখন একটা খোঁড়া যুক্তি দিয়ে পদত্যাগ করে বেঁচে গেলেন!
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে জাপানের ফুকুশিমার পরমাণু রেডিয়েশন পরিদর্শনে গিয়ে জাপানের বাণিজ্যমন্ত্রী ইউশিরো হাচিরো মন্তব্য করেন, 'ফুকুশিমা একটি মৃত্যুর শহর'। জাপানের পার্লামেন্টের বিরোধী দল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, এমনকি সরকারি দলের সদস্যরাও সমালোচনা করে বলতে থাকলেন, কী বললেন এটা হাচিরো? সঙ্গে সঙ্গে হাচিরো প্রধানমন্ত্রী ইওশিহিকো নোদাকে গিয়ে তাঁর পদত্যাগের কথা জানালেন। সারা দেশের মানুষের কাছে বারবার বলতে থাকলেন, 'আমি দুঃখিত, আমি খুবই দুঃখিত।' তিনি তাঁর পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার আগে কারো সঙ্গে আলোচনা করেননি, একমাত্র তাঁর স্ত্রী ছাড়া।
শুধু মন্ত্রী নয়, জাপানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা একের পর এক প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে দেখলাম। ২০০৭ সালে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে আসন হারানোর পর এবং একটি গণজরিপে প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবের জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার সংবাদে তিনি নির্দ্বিধায় পদত্যাগ করলেন। বললেন, 'আমি সিদ্ধান্তে এসেছি যে একটি পরিবর্তিত পরিস্থিতির দরকার। জনগণের এমন একজন নেতার প্রয়োজন, যাঁর ওপর তারা আস্থা রাখতে পারে এবং যাঁকে তারা সমর্থন জানাতে পারবে।'
গত আগস্টে আরেক প্রধানমন্ত্রী নায়োতো কান পদত্যাগ করেন। সেই পদত্যাগের জন্য কাউকে হরতাল করতে হয়নি, তীব্র আন্দোলন করতে গিয়ে কোনো নাগরিককে জীবন ত্যাগ করতে হয়নি, জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুর করে জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলতে হয়নি।
এসব কাহিনী যেন এই পৃথিবীর কোনো দেশের রাজনীতিবিদদের কাহিনী নয়! নাকি আমরাই আসলে কোনো পৃথিবীতে বাস করছি না, প্রকারান্তরে বাস করছি একটি নিষ্ঠুর জঙ্গলে। আমরা, মানে মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা এবং বাংলাদেশের মতো দুর্ভাগা কিছু দেশের নাগরিকরা। দায়িত্ব থেকে এত সহজে কেউ সরে দাঁড়াতে পারে; দায়িত্বে থেকে ক্ষমতার ব্যাপারে এতটা নির্লিপ্ত থাকতে পারে মানুষ_এ যেন আমাদের জন্য কল্পনা করাও কঠিন।
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কেউ নিরীহ জনগণের ওপর সওয়ার হয়, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের রক্ত ঝরে পড়ে আর সেই রক্তকে ব্যবহার করে। আবার কেউ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিরীহ মানুষের ওপর গুলি চালায়। কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
তবে এই দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া এবং জীবন দিয়ে হলেও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার যে চিত্র আমরা একই পৃথিবীতে বাস করে দেখতে পাই, তার পেছনের কাহিনী বা কারণ সবারই কমবেশি জানা আছে। যেসব দেশে দায়িত্ব গ্রহণের অর্থ হলো আইনের শাসনের ঊধর্ে্ব উঠে যাওয়া, পদবি ব্যবহার করে ধনসম্পদের পাহাড় তৈরি করা, সেসব দেশে কেউ পদ-পদবি ছাড়তে চান না। গোটা দেশের মানুষ জেগে ওঠার পরও মন্ত্রিত্ব ধরে রাখার জন্য এসব দেশের জনগণের প্রতি লোকেরা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। লাজ, লজ্জা, ভয় কোনো কিছুই তাঁদের ছুঁতে পারে না।
সরাসরি একটু বাংলাদেশের কথা বলি : দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪০ বছর। লক্ষ করে দেখুন, এই সময়ের মধ্যে যেকোনো সময় ধরুন একজন মানুষ একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। ধরুন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলেই একজন একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। মধ্যবিত্ত অথবা নিম্নবিত্ত ঘর থেকে উঠে আসা তৎকালীন মন্ত্রীর আজও কোনো পেশা নেই। এখনো তাঁর উপার্জনের সুনির্দিষ্ট কোনো উৎস নেই। মুদ্রাস্ফীতির কারণে তখনকার ১০০ টাকার মূল্যমান এখন কমপক্ষে ৫০০ টাকা হয়েছে। অথচ একদা মন্ত্রী এখনো বিজনেস ক্লাসে বছরে একাধিকবার আমেরিকায় যাতায়াত করেন! বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন। ভেবে দেখুন, দু-তিন বছরের মন্ত্রিত্বে কী দর! বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন রাজনীতিবিদ পাওয়া যাবে না, যিনি মন্ত্রিত্ব করেছেন অথচ আর্থিক অসংগতিতে রয়েছেন। এমন সুযোগ ব্রিটেনের বা জাপানের মন্ত্রীদের খুব কম। সবচেয়ে বড় বিপদের কথা, ক্ষমতার পূজা এবং ক্ষমতায় টিকে থাকা এ দেশের সমাজ-সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।
২. সম্প্রতি হাতে একটি গ্রন্থ এসেছে। গ্রন্থটি লিখেছেন জাপানের একসময়ের খ্যাতিমান কূটনীতিক ইচিরো কাওয়াসাকি। ১৯৭০ সালে প্রথম প্রকাশিত বইটির নাম জাপান আনমাস্কড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে হঠাৎ করে দ্রুতগতিতে জাপান কিভাবে পাল্টে গেল, তাই নিয়ে লেখা বড় মজাদার গ্রন্থ। বিশ্বযুদ্ধের অবসানের মুখে আমেরিকার সেনারা জাপানে প্রবেশ করে। মার্কিন জেনারেল ডগলাস ম্যাক আর্থার জাপানে প্রবেশ করেই এই জাতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, মানসিকভাবে জাপানিরা ১২ বছরের শিশুর মতো। ভীষণ নাখোশ হয়েছিল জাপানিরা।
বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কয়েক বছর জাপান ছিল এক বিশৃঙ্খল দেশ। তখন লক্কড়ঝক্কড় ট্রেনের কামরায় মাইকে বা লাউড স্পিকারে বলা হতো, ট্রেনে ভয়ানক ভিড় হওয়ায় আমরা দুঃখিত। আপনার পকেট সাবধান রাখুন। যেকোনো সময় আপনার টাকা-পয়সা চুরি হয়ে যেতে পারে।
তবে সব সময়ই বিশ্বের অন্যতম আবেগপ্রবণ জাতি জাপানিরা। তখন আমেরিকার সেনাদের বাড়িতে কাজ করত জাপানি মেয়েরা। মার্কিন সেনারা যখন পরিবার-পরিজন নিয়ে জাপান ছেড়ে চলে যায়, তখন রেলস্টেশনে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে সেসব কাজের মেয়ে চিৎকার করে কেঁদেছিল। দরিদ্র দেশটির এসব মেয়েদের আমেরিকার সেনা এবং তাদের পরিবার পিঠ চাপড়িয়ে, সান্ত্বনা দিয়ে হাতে কয়েকটি বেশি টাকা ধরিয়ে দিয়ে সেই কান্নার দাম শোধ করতে চেষ্টা করেছিল। ১৯৫৬ সালে জাপানের রাজধানী টোকিওতে প্রথম ডাবলডেকার বাসের প্রদর্শনী হয়। সেখানে ইংল্যান্ড থেকে ডাবলডেকার বাস প্রদর্শনীর জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই বাসের জন্য জাপান শহরের রাস্তা উপযুক্ত ছিল না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল ব্রিটিশ ড্রাইভারদের ডাবলডেকার বন্দর থেকে প্রদর্শনী স্থলে চালিয়ে নিয়ে যেতে। তারা খিস্তিখেউর শুরু করেছিল।
এর মাত্র ২০ বছরের মধ্যে জাপান নিজের চেহারা ঘুরিয়ে ফেলে। আলো ঝলমলিয়ে ওঠে টোকিওসহ অন্যান্য শহর। আর তারও মাত্র ৪০ বছর পর একজন সাধারণ ব্রিটিশ বা একজন সাধারণ আমেরিকান এখন জাপানে ঢুকে থমকে যাচ্ছে। জাপান যেন এলিয়েনদের ভূমি!
৪০ বছর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার আগে ক্ষুধা ছিল, দরিদ্রতা ছিল। কিন্তু এ দেশে ট্রেন-বাসে চুরির ঘটনা এমন কিছু ছিল না। এখন মলম পার্টির খপ্পরে পড়ে বাসস্ট্যান্ডগুলোতে প্রতিনিয়ত মানুষ পড়ে থাকতে দেখা যায় অচেতন অবস্থায়। শুধু কী তাই, এই ৪০ বছর পর মাইছা চোর, গাইছা চোর, লাল চোর, নীল চোর দিয়ে বাংলাদেশ ছেয়ে গেছে। সবার চোখের সামনে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যে অনিয়ম হচ্ছে, তা ৪০ বছর আগের বাংলাদেশের মানুষ কল্পনা করেনি। সেই হিন্দি গানের কলি যেন বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে_দুনিয়া মে সব চোর চোর হ্যায়...।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com
No comments