সেই ১৩ অস্ত্রধারী ছাত্র ও যুবদল ক্যাডার ধরাছোঁয়ার বাইরে! by মাসুক আলতাফ চৌধুরী

ডেটলাইন ১০ অক্টোবর ২০১০। যুবদলের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে নগরীর প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে ঘটে যায় স্মরণকালের সবচেয়ে আলোচিত অস্ত্রবাজির ঘটনা। কুমিল্লা টাউন হলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজি করে ছাত্র ও যুবদল ক্যাডাররা। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপির বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু সমর্থিত ক্যাডাররা ওই অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটায়। ঘটনার সময় তোলা ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ ১৩ অস্ত্রধারী ক্যাডারকে শনাক্ত করে।


কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনকে সামনে রেখে ওই ১৩ অস্ত্রবাজ আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, মনিরুল হক সাক্কুর নির্বাচনী প্রচারে তারা অংশ নিচ্ছে। এদিকে ১৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া পুলিশের চিরুনি অভিযান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অবশ্য সেই ১৩ অস্ত্রধারীর একজন আশিকুর রহমান আরিফকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জানা যায়, ঘটনার পরপরই প্রথম গ্রেফতার হয়েছিল চর্থা তালতলা চৌমুহনীর টিটু। ওই তালিকায় আরও রয়েছে বিষ্ণুপুরের জেমি, ভাটপাড়ার নাহিন, চকবাজার বালুধুম এলাকার আশিকুর রহমান আরিফ, কাপ্তানবাজারের রাজন, বিষ্ণুপুরের কোরবান।
পুলিশ জানায়, তাদের সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। বর্তমানে তারা জামিনে আছে। এ ছাড়া চান্দিনার হাড়ং এলাকার আরিফুজ্জামান তুহিন ওরফে ঢাকাইয়্যা তুহিন, বিষ্ণুপুরের জামান, চর্থার পাভেল, বিষ্ণুপুরের নাজিম, মুন্সেফবাড়ী এলাকার রাসেল ওরফে উলু রাসেল ও চর্থার সজীব আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়েছে। ঘটনার পরপরই কোতোয়ালি থানায় দুটি মামলা হয়। একটি দ্রুত বিচার আইনে ও অন্যটি পুলিশকে আহত করা এবং বিস্ফোরক আইনে। ভাটপাড়া-বিষ্ণুপুর এলাকার অস্ত্রবাজ ক্যাডারদের নেতৃত্ব দেন ওই এলাকার বর্তমানে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া নেহাল, দুটি হত্যা মামলায় কারাগারে আটক বিলুপ্ত কুমিল্লা পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও বর্তমান কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদপ্রার্থী সোহাগ ওরফে হাতকাটা সোহাগ, তুহিন ও কাউসার। চর্থা এলাকার ক্যাডারদের নেতৃত্ব দেন বিএনপি নেতা মাসুক কমিশনারের ছোট ভাই সহিদ এবং সহযোগী অমি ও বসির। এদিকে বর্তমানে পুলিশের খাতায় জামান ও তুহিনসহ চারজন পলাতক। পুলিশ জানায়, অস্ত্রবাজ পাভেল, অমি, বসির, সহিদ, নাজিম, রাসেল, সজীব, কাউসার, সোহাগ, টিটু, জেমি, রাজন, জামান ও কোরবান তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। কাউন্সিলর সোহাগের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা হয়েছে বলে রেকর্ড পাওয়া গেছে। সহিদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনেসহ পাঁচটি মামলা রয়েছে। পাভেলের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা আছে। উলু রাসেলের বয়স কম বলে তাকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করা হয়নি।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আফজল খান অভিযোগ করেন, সাক্কুর পক্ষ নিয়েছে অস্ত্রবাজরা। আমি নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করেছি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তাদের গ্রেফতার করতে। তারা প্রকাশ্যে সাক্কুর সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিচ্ছে। তিনি বলেন, ওইসব ক্যাডার আমাদের নিরীহ কর্মী-সমর্থকদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। কুমিল্লা জেলা পরিষদের প্রশাসক আলহাজ ওরম ফারুক বলেন, ওই অস্ত্রবাজদের বিষয়ে আমরা জেলা ও পুলিশ প্রশাসনকে আইনি পদক্ষেপ নিতে অনেক আগেই অনুরোধ করেছি। রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছি। অভিযোগ অস্বীকার করে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু বলেন, আমার সঙ্গে সবাই চেনেন-জানেন এমন দু'তিনজন সাধারণ মানুষকে নিয়ে প্রতিদিন জনসংযোগে যাচ্ছি। কোনো সন্ত্রাসী আমার সঙ্গে নেই। থাকলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, এবারের নির্বাচনে সন্ত্রাসীদের কেউ প্রশ্রয় দেবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নূর উর রহমান মাহমুদ তানিমও ওই অস্ত্রবাজদের গ্রেফতারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি অবশ্য একই সঙ্গে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়ে ঘটে যাওয়া অস্ত্রবাজির চিহ্নিত সন্ত্রাসীদেরও গ্রেফতারের দাবি জানান। অন্য বিদ্রোহী প্রার্থী অ্যাডভোকেট আনিছুর রহমান মিঠু বলেন, আফজল খান ও সাক্কু দু'জনই সন্ত্রাসী লালন-পালন করেন। এটা কুমিল্লার মানুষ ভালোভাবেই জানেন। মিঠু নগরীর ঠাকুরপাড়া ও গোবিন্দপুর এলাকার চিহ্নিত অস্ত্রবাজ ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। কোতোয়ালি থানার ওসি মহিউদ্দিন মাহমুদ জানান, এ পর্যন্ত বাগিচাগাঁওয়ের পলাশ ওরফে ডিব্বা পলাশ, মুন্সেফ কোয়ার্টারের কাজী মোঃ নেহাল, কালিকাপুরের কামাল হোসেন, দক্ষিণ চর্থার সাজ্জাদ হোসেন, মোঃ রাসেল, কালিয়াজুড়ির খুরশিদ, জামতলার সোহাগ, ধর্মপুরের ফারুক ও আশিক, ঠাকুরপাড়ার রাজীব ও দীপ খানসহ তালিকাভুক্ত ১১ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাতে যুবদলের সম্মেলনের অস্ত্রবাজ আশিকুর রহমান আরিফকে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী হিসেবে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। তিনি আরও বলেন, কোতোয়ালি থানায় তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীর সংখ্যা ১১৩ জন। তাদের মধ্যে ৮৩ জন আদালতের আদেশে জামিনে রয়েছে। তাদের মধ্যে ৫৯ জনকে এ পর্যন্ত পুলিশ বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করেছে। তাদের ৪৩ জন জামিনে আছে। বাকি ১৫ জন কারাগারে। বাকি ২৪ সন্ত্রাসীকে ধরতে চিরুনি অভিযান অব্যাহত আছে। তিনি বলেন, ১১৩ জনের মধ্যে ১৯ জনকে পুলিশ কখনও গ্রেফতার করতে পারেনি। পুলিশ সুপার মোঃ মোখলেছুর রহমান জানান, তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী, যারা জামিনে রয়েছে, তাদের গ্রেফতারের সুযোগ নেই। তিনি উল্টো বলেন, এমন কেউ যদি থেকে থাকে, যার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে, অবশ্যই আমরা তাকে গ্রেফতার করব।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতবিনিময় সভায়ও একই আলোচনা
বুধবার কুমিল্লা টাউন হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মতবিনিময় সভায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আফজল খানের পক্ষে উপস্থিত হওয়া তার বড় ছেলে ইমরান খান প্রশ্নোত্তর পর্বে অভিযোগ করেন, যুবদলের সম্মেলনের অস্ত্রধারীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের এক প্রার্থীর সঙ্গে দেখা যাচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করেন, ওইসব অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করা হবে কি-না? জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেন, আমিও বিষয়টি জানতে চাই। সভায় উপস্থিত পুলিশ সুপারকে এ বিষয়ে জানাতে তিনি অনুরোধ করেন। পুলিশ সুপার মোঃ মোখলেছুর রহমান বলেন, যারা জামিনে আছে আবার কোনো অপরাধ না করলে তাদের ধরার সুযোগ নেই। তবে ওই অস্ত্রবাজির ঘটনায় পলাতক চারজনকে ধরতে তাদের অভিযান অব্যাহত আছে বলে তিনি জানান। পুলিশ সুপার আরও বলেন, ওই ঘটনার পর আর কোনো অস্ত্রবাজির ঘটনা ঘটেনি। তিনি বলেন, পুলিশ ২৪ ঘণ্টা পাহারায় রয়েছে। তিনি মতামত ব্যক্ত করে বলেন, আমার মনে হয় আর কোনো সন্ত্রাস ঘটার সুযোগ নেই। তিনি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো ও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি করেন।

No comments

Powered by Blogger.