সদরে অন্দরে-ড্যাব-স্বাচিপের জাঁতাকলে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা by মোস্তফা হোসেইন

দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অভিযোগ এন্তার। মানুষ অতি সহজেই যোগ করে দেয় মেডিক্যাল প্রশাসনের বিষয়টিও। তাদের কথা, স্বাস্থ্যসেবাকে রোগাক্রান্ত করে দেওয়ার জন্য বাইরের চেয়ে চিকিৎসকদের দলবাজি অধিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের পেশাজীবী সংগঠন বিএমএর ব্যর্থতা, নাকি দলীয় চাপে তাঁদের অক্ষমতা মানুষের সেবা খাতকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে, সেই চিন্তা এখন ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসছে। দুর্নীতির আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে গোটা


প্রশাসন_এমন অভিযোগও সবখানেই শোনা যায়। চিকিৎসা সেবায় তার কিছু প্রতিফলন অবশ্য দৃষ্টিগোচর হয়।
দলীয়করণের অভিযোগ এ মুহূর্তে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের দিকে ধাবিত হলেও এটা বলতে দ্বিধা নেই, দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতা এটি। যে কারণে এ মুহূর্তে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে দায়ী করার পাশাপাশি নিকট-অতীতের দিকেও তাকাতে হবে। তা না হলে একপেশে হয়ে যাবে যেকোনো মন্তব্য। তাই আমাদের নিকট-অতীতই দিকনির্দেশক হিসেবে আলোচনায় আসতে পারে।
গত চারদলীয় সরকারের আমলে দেখা যায়, তখনকার মেডিক্যাল প্রশাসন ড্যাব নামীয় একটি সংগঠনের অঙ্গুলীহেলনে চলেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সে সময় পিএসসি এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একের পর এক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে। ফলে সাধারণ চিকিৎসক, যারা একান্তই পেশাজীবী হিসেবে কাজ করার জন্য আত্মনিয়োজিত ছিলেন, তাঁদের বিপদগ্রস্ত হতে হয়েছে। এমন পরিবেশ ওই মুহূর্তে বিরাজ করছিল যে চিকিৎসক কিংবা চিকিৎসাকর্মীকে ভাবতে হতো_তাকে হয়তো ড্যাব কিংবা স্বাচিপ করতে হবে। ওই সময় ড্যাব করা ছিল নগদ লাভ, আর স্বাচিপ করতে অপেক্ষার পালা।
আমরা দেখেছি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ড্যাব নামক সংগঠনের দাপট কেমন। অভিযোগ আছে_কোন মেডিক্যাল কলেজে কাকে বদলি করা হবে কিংবা কার পদোন্নতি কখন হবে, কিভাবে হবে, তার গোটা ব্যবস্থাপনাই হতো ড্যাবের সহযোগিতায় এবং দিকনির্দেশনায়। আর সেই দিকনির্দেশনার বাইরে যে কারো কিছুই করার ছিল না, তাও আজ প্রতিষ্ঠিত। নিয়োগ, বদলি কিংবা পদোন্নতিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যতটা ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে ভর্তির ক্ষেত্রে দুর্নীতি। এমনও শোনা যায় যে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে ভর্তির সময় হয়তো কোনো শিক্ষার্থী কোনো বিষয়ে পরীক্ষা না দেওয়ার পরও ওই বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেছেন। এটা হয়েছে রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে। সর্বত্র প্রচলিত কথা এটা। নিজেদের সরবরাহকৃত তালিকা আর ভর্তির ক্ষমতায় সামঞ্জস্য না থাকার কারণে এমন অবস্থা হয়েছিল। অর্থাৎ প্রদত্ত তালিকায় নির্দেশিত সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানোর সুযোগ ছিল না। ব্যর্থ হওয়া শিক্ষার্থী তাই অন্য বিষয়ে ভর্তির সুযোগ করে নিলেন।
ওই আমলের ব্যাপক আলোচিত একটি বিষয় এখনো মুখে মুখে প্রচারিত। বলা হয়ে থাকে, তৎকালীন এক নেতা চারদলীয় জোটের সরকার ক্ষমতায় আসার সময় ছিলেন জুনিয়র কনসালটেন্ট, চলতি দায়িত্বে। অর্থাৎ তিনি মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কাজ করছিলেন এক জায়গায়। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সালে আমূল বদলে যায় সেই ভদ্রলোকের ভাগ্য। জুনিয়র কনসালটেন্ট থেকে এক ধাপ, দুই ধাপ করে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টির ডিন হয়ে যান। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, এই কর্মকর্তা গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে এসে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হলেন। একপর্যায়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। সর্বশেষ তিনি চাকরিচ্যুত হয়েছেন। একই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়েছে আরো দুর্নীতির। সবার মনে থাকার কথা, শিশু হাসপাতালের লটারির টিকিট কেলেঙ্কারির ঘটনায় ওই নেতার নাম জড়িয়ে পড়ে। আর সে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনারও ঝড় বয়ে যায়। বলা হয়ে থাকে, ওই নেতা শিশু হাসপাতালের লটারির প্রথম পুরস্কারটি নিজ নামে কারচুপির মাধ্যমে করিয়ে নেন। ওই সময় চিকিৎসকদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি সরকারি কেনাবেচাতেও নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করত, এমন অভিযোগও আছে। কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের এমআরআই মেশিন কেনা হয়েছিল তখন। অথচ সে সময় অবকাঠামোগত কোনো সুবিধাই সেখানে ছিল না। যে কারণে মেশিন কেনার অনেক পরে সেই মেশিনটি কর্তৃপক্ষ রিসিভ করেছিল। অবকাঠামোগত সুবিধা তৈরি করে কাজ শুরু হয়েছে বহুদিন পর। এটি একটি উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে বলে একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন।
এই আলোচনা থেকে মনে হতে পারে, অপর সংগঠন স্বাচিপ বোধ করি ভালোভাবেই তাদের কাজ চালিয়ে আসছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ড্যাবের এক নেতা স্পষ্ট করে বললেন, বিএনপিদলীয় চিকিৎসকদের সংগঠন ড্যাব ওই আমলে যেসব অনিয়ম করেছে, তার কয়েকগুণ করছে এখনকার সরকারি সংগঠন স্বাচিপ। ড্যাবের প্রধান আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর সামনে অন্যরা মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস পেতেন না। মনে হতো তিনিই যেন মন্ত্রীরও মন্ত্রী। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, তাতে মনে হয় মন্ত্রী যে কতজন তা বলা মুশকিল। স্বাচিপ দল-উপদল, নানা ভাগে বিভক্ত। কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো নির্দেশ গেলে স্থানীয় স্বাচিপ তাকে অমান্য করছে। এমনও দেখা গেছে, একজনকে হয়তো মন্ত্রণালয় বদলি করেছে সিলেটে, তিনি সেখানে গেলেন যোগ দিতে। কিন্তু সেখানকার স্থানীয় স্বাচিপ নেতারা তাঁকে যোগদান করতে দেবেন না। এমন একটি ঘটনার খবর সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে। কুমিল্লার একটি উপজেলা কেন্দ্র থেকে একজন কার্ডিওলজিস্টকে জুনিয়র কনসালটেন্ট পদে রাজধানীর জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউটে বদলি করা হয়েছিল। তিনি সেখানে যোগ দিতে গেলে স্থানীয় স্বাচিপের এক নেতা তাঁকে বলেন, 'আপনি জানেন না, রাজধানীর কোনো হাসপাতালে বদলি হয়ে আসতে হলে স্বাচিপের অনুমতি লাগে। আপনি কিভাবে এখানে বদলি হয়ে এলেন!' স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তাঁকে বদলি করা হয়েছে বলার পর তাঁকে জানানো হয়, তিনি যেন ঢাকার বাইরে কোনো উপজেলায় চলে যান। শুধু তাই নয়, স্বাচিপের ওই নেতা নাকি চিকিৎসককে ধমকও দিয়েছেন। চিকিৎসক বাধ্য হয়ে উচ্চ আদালতে গিয়েছেন মামলা করতে।
স্বাচিপের আধিপত্যবাদ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে মহাজোট-সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। এমনকি গত বিএমএ নির্বাচনেও তাদের কর্মকাণ্ড প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। ড্যাবের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, বিএমএ নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে অবৈধভাবে স্বাচিপ মনোনীত ব্যক্তিরা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে।
ড্যাবের অভিযোগ, চারদলীয় জোট আমলে যে সেটআপ হাসপাতালগুলোতে ছিল, এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরপর তার সব পরিবর্তন করে দিয়েছে। এই পরিবর্তনের ধাক্কায় যোগ্যতার দিকে তাকানো হয়নি। চারদলীয় জোট আমলে বদলি হলেই হলো। এই রাজনৈতিক বৈরী আচরণ যে স্বাস্থ্য সেবার জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, তার একটি দিক উল্লেখ করেছেন একজন চিকিৎসক। ডাক্তার জহিরুল ইসলাম শাকিল নামের একজন চিকিৎসক কাজ করছিলেন বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে রংপুরে। অথচ সেখানে রেসপিরেটরি মেডিসিনের কোনো সুযোগ-সুবিধাই নেই। শাকিল সাহেব হতে পারেন রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতাবলম্বী_তিনি চিকিৎসা করার সময় নিশ্চয়ই রোগীদের রাজনৈতিক মতাদর্শ দেখে নিতেন না। তিনি মানুষেরই চিকিৎসা করতেন। আজকে তিনি রংপুরে গিয়ে তাঁর যে মেধা আছে, তা প্রয়োগ করতে পারছেন না। এতে করে গোটা সাধারণ মানুষই তো চিকিৎসাবঞ্চিত হলো। এই পরিস্থিতি কি সাধারণ মানুষের জন্য উপকার বয়ে আনতে পারে?
নিয়োগ-পদোন্নতির ক্ষেত্রেও বর্তমানে স্বাচিপ প্রাধান্য বিস্তার করছে। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়গুলো। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন হেলথ সেন্টারে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে ৩৫০০ চিকিৎসককে নিয়োগ প্রদান করা হয়। এই নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ইতিমধ্যে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আগে যেখানে বিসিএস কিংবা স্পেশাল বিসিএসের মাধ্যমে এ ধরনের নিয়োগ দেওয়া হতো, এবার তা মানা হয়নি। এডহক ভিত্তিতে এসব নিয়োগ দেওয়ার পরপরই সমালোচনা হয়েছে নিয়োগ নিয়ে। পদোন্নতির বিষয়টিও স্পষ্ট। আগে পদোন্নতি হতো পিএসসির মাধ্যমে। সেখানে পিএসসি প্যানেল অব বোর্ড কাজ করত যাচাই-বাছাই করার জন্য। সেখানে ভাইভা নেওয়া হতো। দেখা হতো গবেষণাপত্র এবং পাবলিকেসন্স আছে কিনা। কিন্তু এখন সেই প্রমোশন-পদ্ধতি বদলে গেছে। এখন ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন হচ্ছে। এতে করে মেধার মূল্যায়ন আর হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সেবা খাতটিই বিঘি্নত হচ্ছে প্রশাসনের রাজনীতিকরণের কারণে।
পেশাজীবীরা যদি রাজনীতিবিদদের ভূমিকা গ্রহণ করেন, তাহলে পেশার উৎকর্ষ আসবে না। অন্তত, চিকিৎসার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাতকে মানবকল্যাণে নিয়োজিত করতে হলে রাজনীতির লাঠিবাজি থেকে তাকে রক্ষা করতে হবে। তা না হলে আমাদের পিছিয়েই থাকতে হবে। পর্যালোচনা করে একটা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়_পেশাজীবী সংগঠন বিএমএকে পরিচালনার জন্য স্বাচিপ কিংবা ড্যাবের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু। আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। বিএমএর কি এই দুটি সংগঠনকে তাদের কাজে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত রাখতে পারলেই মঙ্গল হবে না?
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.