বাসচাপায় সাংবাদিক পঙ্গু সড়ক অবরোধ ভাংচুর

কালের কণ্ঠের সাংবাদিক নিখিল চন্দ্র ভদ্র সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়ার প্রতিবাদে গতকাল বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সড়ক অবরোধ করেন বিক্ষুব্ধ সাংবাদিকরা। এ সময় কয়েকটি গাড়ি ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। এমনকি বিক্ষুব্ধ সাংবাদিকদের শান্ত করতে আসা তথ্যমন্ত্রী তোপের মুখে পড়েন। বিআরটিসি চেয়ারম্যান মেজর (অব.) এমএম ইকবালকে ধাওয়া দেওয়া হয়। এদিকে গতকাল রাত ১১টার দিকে চালক সোহেল রানাকে (২২) পল্লবী থেকে আটক করেছে পুলিশ।


সাংবাদিক আহত হওয়ার ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। রাতে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পরিস্থিতি সামাল দেন। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বলেন, নিখিলের চিকিৎসার খরচ বহনের দায়িত্ব সরকারের। প্রয়োজনে তাকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানো হবে।
দু'মাসের ফুটফুটে সন্তান ইন্দুলেখা ভদ্র। প্রতিদিনের মতো মেয়েকে আদর করেই বাসা থেকে বের হন বাবা নিখিল ভদ্র; কিন্তু কে জানত দানব বাস কেড়ে নেবে তার একটি পা। গতকাল সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের সড়ক পার হওয়ার সময় বিআরটিসির বেপরোয়া বাস (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৪৬৩৭) নিখিলকে ধাক্কা দেয়। বাসের ধাক্কায় ছিটকে পড়েন নিখিল। এরপর তার ডান পায়ের ওপর দিয়ে বাসটি চলে যায়। পরে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তার ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ কেটে ফেলেন। নিখিল বাঁ পায়েও গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। ওই সময়ই দানব বিআরটিসি বাসটি আটক করা হয়। পালিয়ে যান চালক। এ ঘটনার পর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের তোপখানা রোড পাঁচ ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন সাংবাদিকরা। তারা বিআরটিসির ওই বাসের চালককে গ্রেফতারের দাবি জানান। দুপুরের পর থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সাংবাদিকরা দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করেন। সেখানে পাঁচটি বিআরটিসি বাসসহ ৯টি বাস ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। কদম ফোয়ারা ও সচিবালয় মোড়ে বিআরটিসির তিনটি বাস দিয়ে রাস্তায় অবরোধ করা হয়। এতে ওই এলাকায় সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। প্রেস ক্লাবের পাশের বাস কাউন্টারগুলোয় ভাংচুর চালিয়ে চেয়ার-টেবিলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে অগি্নসংযোগের ঘটনা ঘটলে গোটা এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। দুপুর ২টার দিকে বিআরটিসির পরিচালক মেজর কাজী শফিক আহমেদ ঘটনাস্থলে যান।
প্রত্যক্ষদর্শী এক সাংবাদিক জানান, সকাল সাড়ে ৯টায় প্রেস ক্লাবের উল্টো দিকে বিএমএ ভবনের সামনে বিআরটিসির একটি বাস নিখিলকে চাপা দেয়। বাসটি তার পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। গুরুতর অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তার ডান পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কেটে ফেলেন। পরে গুরুতর অবস্থায় তাকে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়।
পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শাহ আলম সমকালকে বলেন, বাসের চাপায় নিখিলের ডান পা ভেঙে জুতার মধ্যে ঢুকে যায়। প্রাণ বাঁচাতে তার ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। বাঁ পায়েও গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। আপাতত তিনি আশঙ্কামুক্ত।
গতকাল পঙ্গু হাসপাতালে নিখিলকে দেখতে যান কালের কণ্ঠের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন। এ সময় সহকর্মীরা হাসপাতালে জড়ো হন। নিখিলকে দেখতে গিয়ে অনেকের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে।
তোপের মুখে তথ্যমন্ত্রী : সাংবাদিকদের শান্ত করতে বিকেলে তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ ঘটনাস্থলে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা তখন তাকে প্রেস ক্লাবের ভেতর সরিয়ে নেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নিখিলের চিকিৎসায় যা প্রয়োজন সরকার সবকিছু করবে। এরই মধ্যে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এদিকে বিক্ষুব্ধ সাংবাদিকদের শান্ত করতে গতকাল বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে হেনস্থা হন বিআরটিসির চেয়ারম্যান মেজর (অব.) এমএম ইকবাল। বিআরটিসির চেয়ারম্যান জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভরত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় এমএম ইকবাল নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও সাংবাদিকদের দাবি_ চালককে গ্রেফতার করতে হবে। সাংবাদিকরা তাদের বিভিন্ন দাবির বিষয় তুলে ধরেন। একপর্যায়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে বিআরটিসি চেয়ারম্যানের বাকবিতণ্ডা হয়। এরই এক পর্যায়ে শুরু হয় টানাহেঁচড়া ও হৈ-হুল্লোড়।
তথ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থলে পেঁৗছার ঠিক আগে সমবেত সাংবাদিকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন বিএফইউজের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী, সাবেক মহাসচিব আলতাফ মাহমুদ, ডিইউজের (একাংশ) সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর সূর্য, ডিআরইউর সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম তপু, মাহমুদুর রহমান খোকন, ডিআরইউর সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহেদ চৌধুরী প্রমুখ।
নিখিলের চিকিৎসার দায়ভার সরকারের : বাসচাপায় পঙ্গু হওয়া সাংবাদিক নিখিল ভদ্রকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দিয়েছেন, নিখিল ভদ্রের চিকিৎসার সব দায়ভার সরকারের। উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে নিখিলকে বিদেশে নেওয়া হবে। নিখিলকে দেখতে হাসপাতালে যান প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা জেআর মোদাচ্ছের আলী।
চার সদস্যের কমিটি : নিখিল ভদ্র পঙ্গু হওয়ার ঘটনায় চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। বুধবার সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুসারে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিআরটিসি, বিআরটিএ এবং সাংবাদিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। প্রেস ক্লাবের সামনে অতি দ্রুত ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে। এ ছাড়া সড়ক বিভাগ (রোড ডিভাইডার) তৈরি করা হবে। প্রেস ক্লাবের সামনে কোনো ধরনের বাস কাউন্টার না রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বৈঠকে যোগাযোগমন্ত্রী বলেন, দোষী চালককে তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। সাংবাদিক নিখিল ভদ্রের উন্নত চিকিৎসার জন্য ব্যক্তিগতভাবেও দায়ভার গ্রহণ করব।
যোগাযোগমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএফইউজের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী, ডিইউজের (একাংশ) সভাপতি আবদুস শহিদ, ডিইউজের (একাংশ) সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর সূর্য, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মজিদ, ডিআরইউর সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.