শুভ জন্মদিন, বাংলাদেশ by শিখ্তী সানী

আজ ২৬ মার্চ, ২০১১। ১৯৭১ সালের এই দিনে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের। সেই বাংলাদেশের বয়স আজ ৪০। শুভ জন্মদিন, বাংলাদেশ। সেই ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অর্জিত হয় স্বাধীনতার সূর্য।


এ পথ আমাদের জন্য সহজ ছিল না। ২৫ মার্চ মাঝরাতের পর পাকিস্তানি সেনারা শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট। সারা দেশ পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপ আর লাশের পাহাড়ে। হত্যাযজ্ঞ চলেছে অফিস, কারখানা, বাড়িঘর, পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সবখানে।
সাত মার্চেই ছিল দিকনির্দেশনা। দেশ রক্ষার জন্য প্রস্তুত হলো সবাই। যুদ্ধ চলল প্রতিটি ফ্রন্টে। কেউ অস্ত্র হাতে, কেউ সেবকের বেশে, কেউ লেখনীর মাধ্যমে, কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে অংশ নিল এই বাঁচা-মরার লড়াইয়ে।
যারা আজ তরুণ, যাদের বয়স চল্লিশের নিচে, তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। কিন্তু রক্তের টান কি এড়ানো যায়? তরুণেরা নানাভাবে জেনে নিতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসে ১৯৫২ ও ১৯৭১ সাল দুটি যে অমর মহাকাব্যের সৃষ্টি করেছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হয় আজকের তরুণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে সে রকমই কয়েক তরুণ-তরুণীর দেখা পাই। কীভাবে ওরা মুক্তিযুদ্ধের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে, জানতে চাই। অমিত বলে, ‘আমি এখন মুক্তিযুদ্ধের বই সংগ্রহ করছি। পড়ছি। আমার ভালো লাগে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বর্ণনা পড়তে। ইদানীং এ রকম বেশ কিছু বই আমার হাতে এসেছে।’
জলি বলল, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দেখার চেষ্টা করি। অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী সিনেমাটা আমার খুব ভালো লেগেছিল। আগুনের পরশমণি দেখে আবেগে আপ্লুত হয়েছি।
নদী ইন্টারনেটে দক্ষ। ও বিভিন্ন দেশের গণহত্যার বিষয়ে পড়াশোনা করেছে। জেনোসাইড নামের একটি সাইট পেয়েছে, যেখানে এই ভূখণ্ডে সংঘটিত গণহত্যারও বিশদ বিবরণ আছে।। নদী বলল, ‘ঠান্ডা মাথায় যারা একটি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল, তাদের ক্ষমা নেই। মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু আমি গর্ব করে বলতে পারি, এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের দেখি। আমাদের কালে এই আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে যুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারি। এখনো যে দালালরা জীবিত আছে, তাদের প্রতি ঘৃণা জানাতে পারি।
অমিত জানায়, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যেতে ভালো লাগে। যখনই যাই, মনে হয় নতুন কিছু জানলাম, শিখলাম।
আমরা চলে যাই শহীদ মিনার এলাকায়। পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক বৃদ্ধ। জহির উদ্দিন তাঁর নাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করি একাত্তরের কথা। মানুষটি একটু দাঁড়ান। তারপর বলেন, ‘তোমরা চুকনগরের কথা শুনিছ? একই দিনে সেখানে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে গুলি কইরে হত্যা করিছিল পাকিস্তানি আর্মিরা। আমি সেই দিন দূর থিকে সেই গুলির শব্দ শুনিছি। পাকিস্তানিরা চইলে গেলে সেই লাশগুলান দেখিছি। সে যে কী অনুভূতি, বলার মতো নয়।’
আমার সামনে দিয়ে চলে যান জহির উদ্দিন। গণহত্যা নিয়ে লেখা কিছু বইয়ে পেয়ে যাই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চুকনগরের কথা। এই নৃশংসতার কথা ভাবতে গেলে শরীর অবশ হয়ে যেতে চায়।
ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে গিটার বাজিয়ে গান করছিল কয়েক বন্ধু। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ওরা। ওরা গাইছিল, ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে...’। খুব নিচু গলায় গাইছিল ওরা। কিন্তু তাতেও সুরেলা কণ্ঠের কারণে আশপাশের মানুষ একটু দাঁড়াচ্ছিল ওদের কাছে। ওরা কোথায় পড়ে জেনে নিয়ে চলতে থাকি পথ। ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। দেশের গান করছে এ সময়ের তরুণের দল। ভালো লাগবে না কেন?
সত্যিই হয়তো স্বচক্ষে দেখা হয়নি একাত্তর, কিন্তু বই পড়ে, তথ্যচিত্র দেখে, মুক্তিযোদ্ধাদের সংস্পর্শে এসে এখনো অনুভব করা যায় একাত্তর। অনুভব করা যাবে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম পর্যন্ত।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মানেই অসংখ্য গল্প। সত্যি গল্প। যেগুলো বাস্তবতাকে ম্লান করে দেয়। ৪০টি বছর পেরিয়ে গেছে। গল্পগুলো মরে যায়নি, হারিয়ে যায়নি। রক্তাক্ত হয়ে আজও অশ্রুসজল করে দেয় আমাদের চোখ, বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মাপকাঠিতে তাদের বিচার সম্ভব নয়, এত দিন পরও হঠাৎ করে গল্পগুলো আমাদের স্পর্শ করে; মনে করিয়ে দেয় কী ঘটেছিল একাত্তরে! দেখিয়ে দেয় স্বাধীন দেশে পতাকা ওড়ানোর বাসনা পূরণে কতটা মূল্য দিতে হয় রক্ত দিয়ে। বিশ্বকাপ উপলক্ষে অলিগলি, পাড়া-মহল্লা, অফিস-আদালতে উড়ছে লাল-সবুজ বাংলাদেশের পতাকা। গালে-মুখে আঁকিয়ে প্রাণে দেশের নামকে ধারণ করে আমরা সোল্লাসে নেমেছিলাম উৎসব-উদ্দীপনায়। খুব সহজ ছিল না এ অধিকার অর্জনের পথটি। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তিনটি খেলায় জয়ী হয়েছে, একটুর জন্য উঠতে পারেনি কোয়ার্টার ফাইনালে। তাতে কী হয়েছে? সামনে আসবে বিজয়। বাংলাদেশের পতাকা আজ উঁচিয়ে ধরতে পারছি, সেটাই বড় কথা। কতটা মূল্য চুকিয়ে আজ বিজয় উৎসবে আমরা নেমেছি, তার একটা হিসাবই হোক না এই স্বাধীনতা দিবসে। শ্রদ্ধা রইল সব শহীদ, শহীদ পরিবার এবং মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত সব নারীর প্রতি।

No comments

Powered by Blogger.