বিস্তৃত অন্ধকার ও একটি হরতাল by লুৎফর রহমান রনো

প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য শিক্ষা বা জ্ঞানার্জন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। 'ফরজ' তো তা-ই, যা অবশ্য করণীয় অর্থাৎ বাধ্যতামূলক। মানুষের জীবন পশুর জীবনের চেয়ে আলাদা করে রেখেছে যে বিষয়টি, তা হলো শিক্ষা। পশু জন্ম নেয়, বড় হয় ও মরে যায়_আজীবন তার প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করার জন্য লড়তে হয়।


জৈব প্রবৃত্তির বাইরে পশুর অন্য কিছু থাকে না। তাই একে বলা হয় পশুপ্রবৃত্তি। এ পশুপ্রবৃত্তির সীমাবদ্ধতা ভেঙে মানুষের জীবনে যুক্ত হয়েছে আরো অনেক উপাদান। যেগুলোকে বলতে পারি মানবীয় গুণাবলি (দোষও থাকতে পারে)। আর এ গুণাবলি অর্জন বা পশুস্তর থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। অনেকেই বলে থাকেন, কোরআনে বিধৃত হয়েছে সম্পূর্ণ জীবনবিধান। কিন্তু কোরআন বুঝতে হলে বা ইসলামের তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে অবশ্যই ব্যাপক শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে বলেই মুসলিম নর-নারীর প্রতি ফরজ করা হয়েছে শিক্ষা। কোরআন পড়ে যেতে পারাই মুসলমানের জন্য শিক্ষা নয়। কিছু অশিক্ষিত মানুষ বলে থাকেন, কোরআন শিক্ষাই মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক। কোরআন দেখে বা না দেখে পড়ে যাওয়ার কথাই তাঁরা বলেন। প্রকৃত অর্থে কোরআন শিক্ষা হলো কোরআনের গূঢ়ার্থ বোঝা। কিন্তু কোরআনের মর্ম বুঝতে হলে জীবন ও জগতের গতি-প্রকৃতি, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আন্তঃসম্পর্ক ও কার্যকারণ ইত্যাদি বুঝতে হবে। এ জন্য নিরলস শিক্ষা, চিন্তা বা জ্ঞানচর্চার প্রয়োজন। তাই কোরআনে একাধিকবার ব্যক্ত হয়েছে জ্ঞানীদের মর্যাদার কথা এবং বলা হয়েছে, কোরআনের তাৎপর্য বোঝার এখতিয়ার আছে শুধু জ্ঞানীদের। জ্ঞানসমুদ্র মন্থন করে অর্জন করতে হয় কোরআন বোঝার মতো প্রয়োজনীয় 'ইলম' বা জ্ঞান। এ জন্য হাদিসে আছে, 'জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাও।'
সুদূর চীন দেশ অর্থাৎ দেশ-দেশান্তরের কথাই বলা হয়েছে। হায়, কী দুর্ভাগ্য এ দেশের। আমাদের ইসলামী বক্তা বা জ্ঞানদানকারীদের অধিকাংশই স্কুল-কলেজ পর্যন্ত যাননি, তাঁদের অন্তরে জ্ঞানার্জনের কোনো চিন্তা-চাহিদাও নেই_এ জন্য তাঁরা মনে করেন, নিজেরা যা জানেন-বোঝেন, তা-ই চূড়ান্ত জানা। আর যে জন মনে করে তার জানাই চূড়ান্ত, সে যে কি পরিমাণ নির্বোধ আর অন্ধ_তা তো সহজেই বোধগম্য। যা-ই হোক, এমন ইসলামী জ্ঞানীরা আমাদের দেশে ইসলামের ধারক-বাহক হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। যে কারণে সাধারণ মুসলমান প্রকৃত ইসলামের আলো থেকে বঞ্চিত থেকে গেছে। তাই কাটেনি সাম্প্রদায়িক ঘোর, অমানবিক কুসংস্কার, আর এ জন্যই এখনো এ দেশে দুর্বিনীত নারী নির্যাতন। আমাদের আরো হতাশা ও আশঙ্কার বিষয় যে এসব অন্তঃসারশূন্য, তমশাচ্ছন্ন মানুষ শুধু ইসলাম শিক্ষার দায়িত্ব নয়, রাজনীতিতেও তাদের অংশীদারিত্ব দাবি করছে, মিছিল-মিটিং করছে, 'ইসলামবিরোধী' কাজে বাধা দিচ্ছে_এমনকি সরকারের বিভিন্ন আইন ও জনহিতকর জরুরি সংস্কারকে 'ইসলামবিরোধী' বলে জনসাধারণের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এ দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ বংশপরম্পরায় মুসলমান। সরকারে যাঁরা আছেন তাঁরাও মুসলমান, দেশে আরো অন্য বিখ্যাত ইসলামী জ্ঞানী-গবেষক আছেন। যাঁরা বিভিন্ন দেশে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন, শিক্ষকতাও করছেন_তাঁরা বলছেন, বর্তমান সরকারের আলোচিত নারী উন্নয়ননীতির মধ্যে ইসলামবিরোধী কোনো কিছু নেই। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। ওরা হরতাল ডাকল।
মূল বিষয়টা কিন্তু ইসলাম রক্ষা নয়, রাজনৈতিক চাল। ধরা যাক, একটি বিষয় লেখা হয়েছে, তাতে ইসলামবিরোধী কিছু আছে নাকি সঠিক নীতিমালা হয়েছে; তা যদি সবাই মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও কোরআন-কিতাব বের করে এক জায়গায় বসে ঠিক করা গেল না, বা একত্রে বসে আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করল না, তা হলে কি বলা যায় তারা ইসলামের স্বার্থে এসব করছে! ইসলাম কোনো 'নেতা' বা গোষ্ঠীর সম্পত্তি নয়। 'ইসলাম গেল' বলে যখন যা খুশি করবে যে কেউ_তা চলতে পারে না। সরকারকে কঠোর হতে হবে। হাইকোর্ট যেমন ফতোয়া সম্পর্কে যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন, তেমনি ইসলাম ধর্ম নিয়ে রাজনৈতিক দল করার বিষয়েও একটি নির্দেশনা থাকা দরকার। কোন মানের-মাপের ইসলামী জ্ঞান থাকলে ইসলামের জন্য রাজনীতি করতে পারবে তারও বিধান থাকা চাই। গ্রামগঞ্জে-পাড়াগাঁয়ে অশিক্ষিত মাতবর-মৌলভীরা ফতোয়া জারি করে নারীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে বলেই হাইকোর্ট ফতোয়া দেওয়ার অধিকার সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। এটারও বিরোধিতা করছে হরতালকারীরা। তাহলে তারা কি মনে করে, যে কেউ ফতোয়া দিতে পারে? কোনো দেশ এমন আছে পৃথিবীতে? কোনো আইন এমন আছে কোরআনে, যে কেউ বিচারক হয়ে যেতে পারে, আর ইচ্ছা করলেই 'ফতোয়া' দিয়ে পাথর ছুড়ে মানুষ মেরে ফেলতে পারে?
একবিংশ শতকের এক দশক পার হয়ে গেছে। কালের বিচারে মানব সভ্যতার মানদণ্ডে আমাদের দেশের অশিক্ষিত দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্পষ্টত মানবসভ্যতা থেকে এখনো বিচ্ছিন্ন থেকে গেছে বললে বেশি বলা হবে না। আর এ শুধুই উলি্লখিত ধর্মান্ধ অশিক্ষিত ধর্মবাজদের কবল থেকে মুক্ত করা যাচ্ছে না বলে। ধর্মশিক্ষার যেমন আধুনিকায়ন দরকার, তেমনি ধর্মশিক্ষকদের শিক্ষা-দীক্ষার মানদণ্ড নির্ধারণ জরুরি। তা না হলে অন্ধকার কেবল গাঢ় হতে থাকবে। আমরা অন্ধকার থেকে উত্তরণ চাই। তাই সরকারের সুদৃঢ় পদক্ষেপ কামনা করছি।
লেখক : সাংবাদিক
ronokk1969@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.