ঐতিহ্য-এ অপবাদের ইতি টানতে হবে by সাইফুদ্দীন চৌধুরী
খবরের কাগজ পড়তে গিয়ে দুটি সংবাদ আমাকে কেন যেন দারুণভাবে আকৃষ্ট করল। সংবাদ দুটির একটি চট্টগ্রামে, অপরটি ঢাকায় ইতিহাস নিয়ে আলোচনা সভা। ‘ডেইলি স্টার হেরিটেজ চট্টগ্রাম হিস্ট্রি কনফারেন্স’ নামে দুদিনের সম্মেলন হয়েছে চট্টগ্রামে এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এ বি এম হবিবুল্লাহর জন্মশতবার্ষিকী স্মরণানুষ্ঠান।
শেকড়সন্ধানী এসব অনুষ্ঠান বারবার আমাদের অতীতকে জানান দেয়। ইতিহাসই তো পথ দেখায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার। পরের সংবাদটি ছিল আমার জন্যই শুধু কেন, সবার জন্যই ছিল কষ্টের। শিক্ষকতা করি বলেই হয়তো আরেক সহকর্মী শিক্ষকের নৈতিক স্খলনে কষ্টটা বেশি পেয়েছি। দ্বিতীয় সংবাদটি ছিল ঢাকা বোর্ডের এইচএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র জালিয়াতির দায়ে দুই কলেজ-অধ্যক্ষ অভিযুক্ত হওয়ার খবর। সংবাদ দুটি ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের হলেও, আদতে উভয়ের মধ্যে আমি এক ধরনের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছি বলেই এই নিবন্ধ রচনা।
দক্ষিণ এশিয়ার গাঙ্গেয় ভূখণ্ডের ছোট্ট এই দেশটি আমাদের কাছে বড় বেশি গর্বের, অহংকারের। কিন্তু দুঃখজনক যে ইতিহাসের পাতা উল্টালেই এ দেশের মানুষ সম্পর্কে যখন নেতিবাচক তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপিত হতে দেখতে পাই, তখন সংগত কারণেই মনটা বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। ইতিহাস ঘুরে ঘুরেই এখানকার বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নানা দূষিত বিশেষণে বিশেষিত করেছে। প্রাচীন ধ্রুপদি সাহিত্য—ঐতরেয় আরণ্যক, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, মহাভারত, ভাগবত, আচারাঙ্গ সূত্র প্রভৃতিতে এখানকার অধিবাসী বাঙালিদের অনাচারি, ম্লেচ্ছ, ভ্রষ্ট, দস্যু, নিষ্ঠাহীন, অদীক্ষিত ইত্যাদি বলে অনেক দুর্নাম করা হয়েছে। ঐতরেয় আরণ্যকে বলা হয়েছে, এরা বয়াংসি অর্থাৎ পক্ষীবিশেষ। জৈন আচারাঙ্গ সূত্র গ্রন্থে লেখা আছে, মহাবীর যখন খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ধর্ম প্রচারের জন্য এ দেশে এসেছিলেন, তখন এখানকার লোকেরা তাঁকে আক্রমণ করেছিল এবং কুকুর দিয়ে তাড়া করেছিল। ওই সব গ্রন্থের একটিতে লেখা হয়েছে, যে ওই ম্লেচ্ছ দেশে যাবে, তাকে দেশে ফিরে গিয়ে অবশ্যই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এ দেশের পাল শাসকদের আমলে লেখা চর্যার গানেও বাঙালিরা অন্ত্যজ শ্রেণীভুক্ত ছিল। চর্যাকার ভুসুকুপা লিখেছিলেন:
অদঅ বঙ্গাল দেশ লুড়িউ।
আজ ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী /
এক ব্রাহ্মণ বাঙালি রমণীকে বিয়ে করে কীভাবে সমাজে নিম্নবর্গের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাঙালি হয়ে উঠল।
মুসলমান ঐতিহাসিকেরাও এ দেশের বাঙালিদের নিন্দা করতে ছাড়েননি। সপ্তদশ শতকের ঐতিহাসিক গোলাম হোসায়ন সলীম তাঁর রিয়াজউস সালাতীনে বাঙালিদের সংগ্রামবিমুখ, দুশ্চরিত্র, শঠ, ঋণ পরিশোধে অনিচ্ছুক বলে বদনাম করেছেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ-খ্যাত উইলিয়াম কেরি তো তাঁর বইয়ে লিখেইছেন, বাঙালিরা সব প্রবঞ্চক, বাচাল, নৈতিকতাবিবর্জিত মানুষ। রবীন্দ্রনাথও আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সাত কোটি বাঙালি মানুষ হয়নি—এ তো সেদিনের কথা।
বাঙালিদের নিয়ে ইতিহাসের সব কথা কি শতভাগ সত্য? তা হয়তো নয়। সত্য না হওয়ার পেছনে যুক্তি অনেক আছে। ইতিহাসবেত্তা ও পর্যটকদের কেউ কেউ তাঁদের লেখায় বাঙালিদের প্রশংসাও করেছেন। এঁরা অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। অতিথি আপ্যায়নে বাঙালিদের জুড়ি মেলা ভার। তার পরও স্বীকার করে নিতে হবে বাঙালির নৈতিক স্খলনের অপবাদে সত্যতা কিছুটা রয়েছেই, যার উত্তরাধিকার আমরা এখনো বয়ে চলেছি। গুপ্তহত্যা, ছিনতাই, রাহাজানি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, তঞ্চকতা আর প্রবঞ্চনা করে অন্যের সম্পদ জবরদখল করার কারণে এ দেশের মানুষ নিত্যদিন সংবাদের শিরোনাম হয়। দেশের বাইরের চিত্র তো আরও ভয়াবহ। অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে বাঙালিরা। ওই সব অভিবাসীর অনেকেই দণ্ড ভোগ করেছে এবং করছে। গুরুতর অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ায় কঠোর শাস্তি ভোগ করছে, অনেক ক্ষেত্রে শাস্তির পরিসমাপ্তি ঘটছে প্রাণদণ্ডের মধ্য দিয়ে।
বাঙালি হিসেবে আমাদের মুখ দেখানোর কোনোই উপায় থাকে না, যখন দেখি আকাশপথে কিংবা জলপথে বিদেশে পণ্য সরবরাহ নিয়ে দুঃখজনক খবর বেরোয়। একবার খবর বেরুল চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে বিদেশগামী জাহাজের কনটেইনারগুলোয় গলদা চিংড়ির ওজন বৃদ্ধির জন্য রপ্তানি পণ্য চিংড়ির মধ্যে লৌহ-শলাকা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কনসাইনমেন্টের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী পণ্য না পাঠানোয় বিদেশ থেকে ফেরত এসেছে অনেক চালান। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, অনেক সময়ই বিদেশে পণ্য রপ্তানির ধারা অব্যাহত রাখতে ভর্তি কনটেইনারের পাশাপাশি শূন্য কনটেইনার পাঠানো হয়। বিদেশিরা একে এক ধরনের প্রতারণা হিসেবে মনে করে। এসব নানা কারণেই বোধকরি বিশ্বের দুর্নীতির সূচকে আমাদের দেশের নাম ওপরের সারিতে অবস্থানের যোগ্যতা অর্জন করেছে।
এক লাখ ৪৩ হাজার ৯৯৮ কিলোমিটার আয়তনের এই ছোট্ট দেশটির চার দশকের অর্জন তো নেহাত কম নয়। বড় অর্জন হলো পৃথিবীর মানচিত্রে মাত্র নয় মাস যুদ্ধ করেই স্থান করে নেওয়া। শান্তির জন্য নোবেল পেয়েছে এ দেশেরই এক কৃৎবিদ্য ব্যক্তি। ক্রিকেট-বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে এ দেশের উদ্যমী তরুণ খেলোয়াড়েরা। আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষার হয়েছে আন্তর্জাতিকায়ন।
সর্বনিম্ন মজুরিতে তৈরি বস্ত্র যখন দেশের পোশাকশিল্পে ব্র্যান্ড-স্বীকৃতি পেতে চলেছে, তখন তার অধিবাসীদের তো স্বভাবের ত্রুটি দূর করতেই হবে। পাঠকপ্রিয় একটি সংবাদপত্র বেশ কিছুদিন থেকে নিজেদের বদলে দেওয়ার কথা বলছে। তারা কি অতীত ঘেঁটেঘুঁটেই আমাদের জন্য এই বার্তা প্রচার করছে?
বাঙালি বদলাবেই, তবে কবে, কখন, কীভাবে—শুধু সেই অপেক্ষায় এখন থাকা।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক ও অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com
দক্ষিণ এশিয়ার গাঙ্গেয় ভূখণ্ডের ছোট্ট এই দেশটি আমাদের কাছে বড় বেশি গর্বের, অহংকারের। কিন্তু দুঃখজনক যে ইতিহাসের পাতা উল্টালেই এ দেশের মানুষ সম্পর্কে যখন নেতিবাচক তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপিত হতে দেখতে পাই, তখন সংগত কারণেই মনটা বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। ইতিহাস ঘুরে ঘুরেই এখানকার বাঙালি জনগোষ্ঠীকে নানা দূষিত বিশেষণে বিশেষিত করেছে। প্রাচীন ধ্রুপদি সাহিত্য—ঐতরেয় আরণ্যক, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, মহাভারত, ভাগবত, আচারাঙ্গ সূত্র প্রভৃতিতে এখানকার অধিবাসী বাঙালিদের অনাচারি, ম্লেচ্ছ, ভ্রষ্ট, দস্যু, নিষ্ঠাহীন, অদীক্ষিত ইত্যাদি বলে অনেক দুর্নাম করা হয়েছে। ঐতরেয় আরণ্যকে বলা হয়েছে, এরা বয়াংসি অর্থাৎ পক্ষীবিশেষ। জৈন আচারাঙ্গ সূত্র গ্রন্থে লেখা আছে, মহাবীর যখন খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ধর্ম প্রচারের জন্য এ দেশে এসেছিলেন, তখন এখানকার লোকেরা তাঁকে আক্রমণ করেছিল এবং কুকুর দিয়ে তাড়া করেছিল। ওই সব গ্রন্থের একটিতে লেখা হয়েছে, যে ওই ম্লেচ্ছ দেশে যাবে, তাকে দেশে ফিরে গিয়ে অবশ্যই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এ দেশের পাল শাসকদের আমলে লেখা চর্যার গানেও বাঙালিরা অন্ত্যজ শ্রেণীভুক্ত ছিল। চর্যাকার ভুসুকুপা লিখেছিলেন:
অদঅ বঙ্গাল দেশ লুড়িউ।
আজ ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী /
এক ব্রাহ্মণ বাঙালি রমণীকে বিয়ে করে কীভাবে সমাজে নিম্নবর্গের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাঙালি হয়ে উঠল।
মুসলমান ঐতিহাসিকেরাও এ দেশের বাঙালিদের নিন্দা করতে ছাড়েননি। সপ্তদশ শতকের ঐতিহাসিক গোলাম হোসায়ন সলীম তাঁর রিয়াজউস সালাতীনে বাঙালিদের সংগ্রামবিমুখ, দুশ্চরিত্র, শঠ, ঋণ পরিশোধে অনিচ্ছুক বলে বদনাম করেছেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ-খ্যাত উইলিয়াম কেরি তো তাঁর বইয়ে লিখেইছেন, বাঙালিরা সব প্রবঞ্চক, বাচাল, নৈতিকতাবিবর্জিত মানুষ। রবীন্দ্রনাথও আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সাত কোটি বাঙালি মানুষ হয়নি—এ তো সেদিনের কথা।
বাঙালিদের নিয়ে ইতিহাসের সব কথা কি শতভাগ সত্য? তা হয়তো নয়। সত্য না হওয়ার পেছনে যুক্তি অনেক আছে। ইতিহাসবেত্তা ও পর্যটকদের কেউ কেউ তাঁদের লেখায় বাঙালিদের প্রশংসাও করেছেন। এঁরা অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। অতিথি আপ্যায়নে বাঙালিদের জুড়ি মেলা ভার। তার পরও স্বীকার করে নিতে হবে বাঙালির নৈতিক স্খলনের অপবাদে সত্যতা কিছুটা রয়েছেই, যার উত্তরাধিকার আমরা এখনো বয়ে চলেছি। গুপ্তহত্যা, ছিনতাই, রাহাজানি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, তঞ্চকতা আর প্রবঞ্চনা করে অন্যের সম্পদ জবরদখল করার কারণে এ দেশের মানুষ নিত্যদিন সংবাদের শিরোনাম হয়। দেশের বাইরের চিত্র তো আরও ভয়াবহ। অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে বাঙালিরা। ওই সব অভিবাসীর অনেকেই দণ্ড ভোগ করেছে এবং করছে। গুরুতর অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ায় কঠোর শাস্তি ভোগ করছে, অনেক ক্ষেত্রে শাস্তির পরিসমাপ্তি ঘটছে প্রাণদণ্ডের মধ্য দিয়ে।
বাঙালি হিসেবে আমাদের মুখ দেখানোর কোনোই উপায় থাকে না, যখন দেখি আকাশপথে কিংবা জলপথে বিদেশে পণ্য সরবরাহ নিয়ে দুঃখজনক খবর বেরোয়। একবার খবর বেরুল চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে বিদেশগামী জাহাজের কনটেইনারগুলোয় গলদা চিংড়ির ওজন বৃদ্ধির জন্য রপ্তানি পণ্য চিংড়ির মধ্যে লৌহ-শলাকা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। কনসাইনমেন্টের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী পণ্য না পাঠানোয় বিদেশ থেকে ফেরত এসেছে অনেক চালান। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, অনেক সময়ই বিদেশে পণ্য রপ্তানির ধারা অব্যাহত রাখতে ভর্তি কনটেইনারের পাশাপাশি শূন্য কনটেইনার পাঠানো হয়। বিদেশিরা একে এক ধরনের প্রতারণা হিসেবে মনে করে। এসব নানা কারণেই বোধকরি বিশ্বের দুর্নীতির সূচকে আমাদের দেশের নাম ওপরের সারিতে অবস্থানের যোগ্যতা অর্জন করেছে।
এক লাখ ৪৩ হাজার ৯৯৮ কিলোমিটার আয়তনের এই ছোট্ট দেশটির চার দশকের অর্জন তো নেহাত কম নয়। বড় অর্জন হলো পৃথিবীর মানচিত্রে মাত্র নয় মাস যুদ্ধ করেই স্থান করে নেওয়া। শান্তির জন্য নোবেল পেয়েছে এ দেশেরই এক কৃৎবিদ্য ব্যক্তি। ক্রিকেট-বিশ্বে চমক সৃষ্টি করেছে এ দেশের উদ্যমী তরুণ খেলোয়াড়েরা। আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষার হয়েছে আন্তর্জাতিকায়ন।
সর্বনিম্ন মজুরিতে তৈরি বস্ত্র যখন দেশের পোশাকশিল্পে ব্র্যান্ড-স্বীকৃতি পেতে চলেছে, তখন তার অধিবাসীদের তো স্বভাবের ত্রুটি দূর করতেই হবে। পাঠকপ্রিয় একটি সংবাদপত্র বেশ কিছুদিন থেকে নিজেদের বদলে দেওয়ার কথা বলছে। তারা কি অতীত ঘেঁটেঘুঁটেই আমাদের জন্য এই বার্তা প্রচার করছে?
বাঙালি বদলাবেই, তবে কবে, কখন, কীভাবে—শুধু সেই অপেক্ষায় এখন থাকা।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক ও অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com
No comments