সুরঞ্জিতের পদত্যাগ

সারা জীবন 'বড় গলায়' কথা বলতে বলতে শেষ বেলায় এসে নিজেই 'ছোট' হয়ে গেলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। অর্থ কেলেঙ্কারির মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার 'দায় কাঁধে' নিয়ে গতকাল সোমবার রেলমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করলেন তিনি। গতকাল দুপুরে রেল ভবনে ১৮ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনে বিমর্ষ, বিরক্ত, হতাশ, ক্ষুব্ধ সুরঞ্জিত তাঁর পদত্যাগের ঘোষণা দেন।


নিজের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক তালুকদার টাকার বস্তাসহ বিজিবি সদর দপ্তরে আটক হওয়ার ঘটনায় তুমুল বিতর্কের মুখে 'পদত্যাগ মুহূর্তের ব্যাপার' মন্তব্য করেছিলেন সুরঞ্জিত। কিন্তু পরের দিনই আবার সুর পাল্টে তিনি বলেছিলেন, 'পদত্যাগের প্রশ্নই আসে না।' গত রবিবার রাতে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী তাঁকে গণভবনে ডেকে নিয়ে শাসিয়ে দেন এই বলে, 'হয় নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করুন, নইলে পদত্যাগ করুন।' কিন্তু সুরঞ্জিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া সেই সুযোগ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে পারলেন না। ধরে নেওয়া হচ্ছে, সে রকম সৎ সাহস তাঁর ছিল না বলেই পিছটান দিয়ে পদত্যাগ করলেন তিনি। আর সেই সঙ্গে শেষ হয়ে গেল প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতার সব বাগাড়ম্বর।
তবে তিনি অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই জড়িত নন বলে দাবি করেছেন। গতকাল রেলমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, 'গণতন্ত্রের স্বার্থেই আমি অব্যাহতি নিলাম।' তিনি তাঁর এই পদক্ষেপকে 'অনন্য উদাহরণ' হিসেবে দাবি করেন।
৫৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এই প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গত ২৮ নভেম্বর রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। স্বাধীনতার পর থেকে বেশির ভাগ সংসদেই সদস্য হন তিনি। শেখ হাসিনার গত সরকারে তিনি মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। দেড় দশক আগে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া সুরঞ্জিত দেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন। পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন কমিটির কো-চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করলেন। এর আগে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ পদত্যাগ করেন।
টাকার বস্তার এক সপ্তাহ : গত ৯ এপ্রিল রাতে সুরঞ্জিতের এপিএস ওমর ফারুক তালুকদারের গাড়িতে বিপুল পরিমাণ অর্থসহ রেলের দুজন কর্মকর্তা ধরা পড়ার ঘটনার পর অভিযোগ ওঠে, সুরঞ্জিত ওই রাতে তদবির করে তাঁদের ছাড়িয়ে আনেন। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। ঘটনার পরের দিন রেল ভবনে হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন করে সুরঞ্জিত রেলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। কিন্তু তাঁর এপিএসের প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বিরক্ত হন। তাড়াতাড়ি সংবাদ সম্মেলন শেষ করেন।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে সুরঞ্জিত বলেন, 'ওই ঘটনায় আমার সম্পৃক্ততা না থাকার পরও আমি অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি।' পরে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেবেন বলেও সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের এ সদস্য। ১৮ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনের বেশির ভাগ সময় তাঁকে বিমর্ষ দেখা যায়। তাঁর স্বভাবসুলভ বক্রহাসিমুখ আর দেখা যায়নি।
৯ এপ্রিল রাতে ওমর ফারুকের সঙ্গে ৭০ লাখ টাকা পাওয়া যায়। পূর্বাঞ্চল রেলের জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও নিরাপত্তা কমান্ড্যান্ট এনামুল হকও ওই সময় একই গাড়িতে ছিলেন। গত রবিবার চাকরিচ্যুত করা হয় ওমর ফারুককে এবং ইউসুফ আলী মৃধা ও এনামুল হককে করা হয় সাময়িক বরখাস্ত। পাশাপাশি ওমর ফারুক ও তাঁর স্ত্রী মারজিয়া ফারহানার ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট) জব্দ করার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
উপায় না দেখে পদত্যাগ : বিএনপিসহ বিভিন্ন দল থেকে পদত্যাগের দাবি উঠলেও সুরঞ্জিত গত রবিবার বলেছিলেন, বিরোধী দল তাঁকে মন্ত্রীর পদ দেয়নি; তাই তাদের কথায় তিনি পদত্যাগ করবেন না। কিন্তু ওই দিন রাতেই গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। সেখানে গিয়ে দেখেন পরিস্থিতি এমন যে পদত্যাগ না করে কোনো উপায় নেই। গণভবনে যাওয়ার আগে সুরঞ্জিত ধরে নিয়েছিলেন হয়তো পদ রক্ষা করা যাবে। কিন্তু সেখান থেকে ফিরে তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের কাছে পরিস্থিতি অনুকূলে নয় বলে জানান। মধ্যরাতের মধ্যেই ঢাকা, সিলেট ও সুনামগঞ্জজুড়ে তাঁর পদত্যাগের খবর চাউর হয়ে যায়। রাতে সুনামগঞ্জ থেকে সুরঞ্জিতের এক অনুসারী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দাদার আর শেষরক্ষা হবে না। কাল পদত্যাগ করবেন।'
জানা গেছে, গতকাল সকালে জাতীয় সংসদ ভবনে নিজ দপ্তরে গিয়ে সুরঞ্জিত সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য ঠিক করেন। বিভিন্ন পয়েন্ট নোট করেন। বিচ্ছিন্ন কয়েকটি কাগজে নোটগুলো নিয়ে আসেন রেল ভবনে।
রেল ভবনে অপেক্ষা : গতকাল সকাল সাড়ে ১১টা থেকেই শুরু হয় অপেক্ষার পালা। তখন দেখা যায় রেল ভবনের সামনে, ভেতরে, মিলনায়তনে সর্বত্রই সাংবাদিকরা ছড়িয়ে আছেন। কেউ বসে আছেন, কেউ হাঁটছেন। কেউ দাঁড়িয়ে। মুখে মুখে প্রশ্ন, সুরঞ্জিত কী পদত্যাগ করবেন? এরই মধ্যে মন্ত্রিপরিষদের সভা শুরু হয়েছে সচিবালয়ে। যদি সুরঞ্জিত পদত্যাগ করেন, তাহলে সেখানে যাবেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, না, সেখানে তিনি যাননি। অপেক্ষায় যোগ হয় কৌতূহলের মাত্রা। পদত্যাগের সুর ভাসতে থাকে বাতাসে। মুখে মুখে রব ওঠে। সুরঞ্জিতের অনুসারীরা একেক জায়গায় বসে আছেন। তাঁদের মন ভালো নেই। সুরঞ্জিতের গাড়ির চালক হায়দারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এক অনুসারী জানতে পেরেছেন, তাঁরও মন ভালো নেই।
দুপুর ১টা ১২ মিনিট। রেল ভবন মিলনায়তন। মিলনায়তনে ঢুকলেন সুরঞ্জিত। তাঁকে ঘিরে ধরেছে অসংখ্য ক্যামেরা। আলোর ঝলকানি ওঠে চারদিকে। আলো নেই শুধু সুরঞ্জিতের চোখে-মুখে। পরনে তাঁর ক্রিম কালারের ওভারকোট ও সাদা পাঞ্জাবি। সুরঞ্জিত সব সময়ই হাসেন, অনেকটা বক্রহাসির মতো। কিন্তু গতকাল অত আলোর মধ্যেও তাঁর মুখ কালো।
সংবাদ সম্মেলন শুরু হলে সুরঞ্জিত বলেন, 'আজ আমি বেশি কথা বলতে পারব না। কোনো প্রশ্ন নেব না। প্রশ্নের উত্তরও দেব না।' এটা নতুন লাগে সাংবাদিকদের কাছে। কারণ, সুরঞ্জিত সাধারণত সংবাদ সম্মেলন শুরুর আগে রসালো কথা বলে থাকেন। গতকালের জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে সুরঞ্জিত বলেন, 'সহকারীর অর্থ কেলেঙ্কারির দায়দায়িত্ব একান্তই তাঁর; দল বা সরকারের নয়। ঘটনায় কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলেও গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করতে আমি এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।'
তিনি নানা কথার প্যাঁচে সংবাদ সম্মেলনের ১৩ মিনিটের মাথায় অব্যাহতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। সংবাদ সম্মেলনে সুরঞ্জিতের সঙ্গে ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফজলে কবির ও রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আবু তাহের।
সংবাদ সম্মেলনের পুরোটা সময়েই অনেক চেষ্টা করেও সাংবাদিকরা কোনো প্রশ্নই করতে পারেননি। কোনো সুযোগ না দিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তড়িঘড়ি উঠে চলে যান।
তার আগে এপিএসের টাকাসহ ধরা পড়ার ঘটনাপ্রবাহ প্রসঙ্গে সুরঞ্জিত বলেন, 'আপনারা জানেন, আমরা বারবার পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছি। এখন সংসদীয় গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। সংসদ অকার্যকর করার জন্য এসব চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, '৯ এপ্রিলের ঘটনায় সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমে নানা কথা এসেছে। বুদ্ধিজীবী মহল ও আমার দলের কয়েকজন ছাড়া বেশির ভাগই প্রশ্ন করেছেন, আমি দায়িত্বে থাকলে তদন্ত প্রভাবমুক্ত থাকবে কি না।... গণতন্ত্রের মাত্রাকে আরো শক্তিশালী করতে এ ঘটনায় আমার দায়িত্ব নিতে হবে।... এ ঘটনায় আমার সম্পৃক্ততা না থাকার পরও আমি অব্যাহতির সিদ্ধান্ত নিয়েছি।' তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা তাঁর 'যাত্রাবিরতি' উল্লেখ করে বলেন, 'নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে রাজনীতিতে স্বচ্ছভাবে ফিরে আসব।'
তিনি বলেন, 'এই মন্ত্রণালয়ের সাফল্য ও ব্যর্থতা আমার ওপর বর্তায়। আমার সম্পৃক্ততা না থাকার পরও আমি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলাম।' দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আজকে এই সংকটময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'রবিবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছি। ঘণ্টাখানেক বৈঠক করেছি। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অব্যাহতির অনুমতি চাই। তিনি তাতে সানুগ্রহ অনুমতি দেন।'
তিনি বলেন, 'আমি আমার জীবন সায়াহ্নে এসে এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছি। বিষ পানে নিজে নীলকণ্ঠ হয়েছি।' তিনি আরো বলেন, 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে সততার আন্দোলনে আমি বিজয়ী হব। রেলে গতিশীলতা আনতে গিয়ে আমি হোঁচট খেয়েছি। আমি আশা করি, আমার এই অব্যাহতির পর রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংকট শেষ হবে।' তদন্ত দীর্ঘায়িত না করে সমস্যার আশু সমাধান তিনি আশা করেন।
তিনি বলেন, 'আমি সাংবাদিকদের অনেক সময় সংবাদ শিরোনাম দিয়েছি। আমাকে নিয়ে অনেক সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। আজও আমি আপনাদের সংবাদ শিরোনাম দিলাম।'
সুরঞ্জিত বলেন, 'আমার দায়িত্ব পালনকালে রেলওয়ের কর্মচারী-কর্মকর্তা, ট্রেড ইউনিয়নের কর্মচারীরা সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। রেলওয়ের বেশির ভাগ কর্মকর্তা সৎ। কিছু কর্মকর্তা দুর্নীতিবাজ।'
রেল ভবন থেকে বিদায় : সংবাদ সম্মেলনের পর রেল ভবনের ষষ্ঠ তলার সভাকক্ষে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বিদায়ী বৈঠক করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সেখানে তিনি গত কয়েক মাসে অর্জিত রেলের গতি ধরে রাখার জন্য কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানান। অন্যদিকে কর্মকর্তারা বিদায় জানান তাঁদের পাঁচ মাসের মন্ত্রীকে। বিকেল ৩টায় কালো রঙের একটি জিপে করে রেল ভবন ত্যাগ করেন সুরঞ্জিত। রেল ভবন থেকে সুরঞ্জিত তাঁর জিগাতলার বাসার দিকে যান। বিকেলে তাঁর অনুসারীরা সেখানে ভিড় করেন।

No comments

Powered by Blogger.