চরাচর-হারিয়ে যাওয়া গ্রাম by সাইফুল ইসলাম
মানুষ একসময় খাদ্যের সন্ধানে দলবদ্ধভাবে ঘুরে বেড়াত সারা পৃথিবীতে। খুব সম্ভব সে সময়ই একেকটি দল ভালো জলবায়ু-প্রকৃতি-মাটি পেয়ে এ দেশে গড়ে তোলে একেকটি গ্রাম। পরিবারগুলোর আলাদা আলাদা বাড়ি হলেও সে সময় গ্রামে রাখা হতো একটি বারোয়ারি ভূমি_যাকে বলা হতো চণ্ডীমণ্ডপ, হরিসভা, ভগবানগোলা, পঞ্চায়েত ইত্যাদি।
এই বারোয়ারি ভূমিকে ঘিরেই আবর্তিত হতো গ্রামের মানুষ; পরিচালিত হতো সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। এখানেই বসত বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষে মেলা। যে মেলায় প্রদর্শনী এবং বেচাকেনা হতো কুটির শিল্প। বসত জারি, সারি, পালাগানের আসর। ঢাক-কাঁসরের আওয়াজে মুখরিত থাকত পুরো আঙিনা। নিজেদের রচিত যাত্রা, পালা, ধুয়াগান প্রচারের সুযোগ পাওয়া যেত এখানেই। পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকেও আসত বিভিন্ন যাত্রাপালার দল। এভাবেই সৃষ্টি হতো বাঙালির নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য। গ্রামে কোনো বিরোধ দেখা দিলে এখানেই বসত বৈঠক, মীমাংসা করে নিত পরস্পরের বিরোধ। ওই বারোয়ারি ভূমিই ছিল গ্রামের আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার কাব্য, আবার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুও। সে সময় বাংলার প্রতিটি গ্রাম ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাজনা নেওয়া ছাড়া রাষ্ট্রের কোনো কর্তৃত্ব খাটত না এসব গ্রামের ওপর। ১৭৫৭ সালে ইস্টইন্ডিয়া কম্পানি দখল করে নেয় এ দেশ। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী চেয়েছে দেশের ওপর রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব, কেন্দ্রীভূত শাসন কাঠামো। ফলে ইংরেজ শাসনামলেই বাংলার গ্রামগুলোর ওপর শুরু হয় 'নাক গলানো'। কখনো খাজনা আদায়, কখনো নীল চাষ, কখনো বা উন্নয়নের নামে চলতে থাকে এই নাক গলানো। আর গ্রামে তখন থেকেই শুরু হয় ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে বিরোধ। ভেঙে পড়তে থাকে স্বাভাবিক নিয়মে গড়ে ওঠা গ্রামীণ শাসন কাঠামো। হারিয়ে যেতে থাকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সেই বারোয়ারি স্থানটিও। থেমে যেতে থাকে গ্রামবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত সংস্কৃতিচর্চা। জারি, সারি, পালাগান থেকে হারিয়ে যেতে থাকে ঐক্য ও মানবতার সুর। বিধিনিষেধের বেড়াজালে পড়ে এবং স্বার্থের সংঘাতে শিল্পী-কুশলীরা পরিণত হয় কলের পুতুলে। শুরু হয় আরোপিত সংস্কৃতিচর্চা। গ্রামের ক্ষমতা বিভক্ত হয়ে পড়ে ছোট ছোট কেন্দ্রে। এসব ছোট ছোট কেন্দ্রের মিলিত হওয়ার স্থানও প্রভাবশালীদের বাড়ির কাছারি ঘর অথবা বৈঠকখানা হিসেবে রূপ লাভ করে। টুটে যেতে থাকে আ@ি@@@ক বন্ধন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ গঠনের মধ্য দিয়ে ইংরেজরা যখন এ দেশের মানুষকে রাজনীতি শেখাতে শুরু করে, তখন গ্রামের এই বিরোধ স্থায়ী রূপ নেয়। গ্রামের বিবদমান গোষ্ঠীগুলো ঠাঁই নেয় এ দুটি দলে, যে ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে। গ্রামের মানুষের এই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ যতটা না আদর্শিক, তার চেয়ে অনেক বেশি পারিবারিক অথবা ব্যক্তিগত। হরিসভা-চণ্ডীমণ্ডপ-পঞ্চায়েতকে বিদায় দেওয়ার পর গ্রামের বিভক্ত ক্ষমতাকে যারা কাছারি ঘর ও বৈঠকখানায় ঠাঁই দিয়েছিল, তারাও ধীরে ধীরে সরে আসতে থাকে গ্রাম থেকে। অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে কাছারি ঘরগুলোও। ৫০ বছর আগেও যে কাছারি ঘর বা বৈঠকখানাগুলো গ্রামে শোভা পেত, তা এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যেগুলো এখনো টিকে আছে, তা-ও অব্যবহারে জীর্ণদশা। কারণ এখন গ্রামের ক্ষমতা নিয়ে আসা হয়েছে শহরে, কোথাও কোথাও খোদ রাজধানীতে। তাই তো গ্রামের মানুষ শহরে ছুটছে বিরোধ মীমাংসার জন্য নেতার কাছে, গান গাইতে রেডিও-টেলিভিশনে, কবিতা লিখতে খবরের কাগজে। যারা এখনো পড়ে আছে গ্রামে, তারা ভুলে গেছে জারি-সারি-পালাগান বাঁধতে, আনন্দ করতে, স্বপ্ন দেখতে। ফলে গ্রাম হয়ে পড়েছে নিষ্প্রাণ। যদি কেউ স্বপ্ন দেখেও, তবে তা হয়ে পড়ে ধার করা কোনো স্বাপি্নকের দেখানো স্বপ্নে_যেন এ দেশে কোনো স্বাপি্নক দার্শনিক কখনোই ছিলেন না।
সাইফুল ইসলাম
সাইফুল ইসলাম
No comments