সাময়িক প্রসঙ্গ-হরতালের রাজনীতিতে বাংলাদেশ by তারেক শামসুর রেহমান
বাংলাদেশ আবারও হরতালের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে। ৩৬ ঘণ্টার টানা হরতালের পর ৪৮ ঘণ্টার হরতালও পালিত হলো। বিরোধী চারদলীয় জোটের সঙ্গে এখন হরতালের রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে ইসলামী দলগুলো। তারাও হরতাল পালন করছে চলতি সপ্তাহে। সব মিলিয়ে রাজনীতি এখন উত্তপ্ত।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আলাপ-আলোচনার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী এখন সংবিধানের অংশ হয়ে যাওয়ার পর এ নিয়ে আলাপ-আলোচনার আদৌ কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। ইতিমধ্যে যুক্ত হয়েছে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনার চার্জশিট, যেখানে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান অন্যতম সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও অন্যতম আসামি। প্রচলিত নিয়মেই এখন তার অবর্তমানে বিচার হবে। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তিনি। এর আগে মানি লন্ডারিং মামলায় ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিচার হয়েছে। ছেলেদের নিয়ে মা খালেদা জিয়া যে এক ধরনের মনস্তাত্তি্বক টেনশনে আছেন, তা অস্বীকার করা যাবে না। এখন দেখতে হবে, এ টেনশন তাকে আন্দোলন থেকে বিচ্যুত করে কি-না!
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিসংবাদিত দুই নেত্রী। লাখ লাখ সমর্থক তাকিয়ে থাকেন তাদের দিকে। দুটি বড় দলেরও নেতৃত্ব দেন তারা। আমরা যৌথ নেতৃত্বের কথা বললেও, দুটি দলেই যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পরিবর্তিত রাজনীতির কারণে শেখ হাসিনার অবস্থান এখন ভালো। তিনি এখন প্রধানমন্ত্রী। দলের তথাকথিত সংস্কারবাদীদের অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়ে তিনি দলে ও সরকারে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি যখন সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন তাকে অতটা 'শক্ত' মনে হয়নি। কিন্তু এবার মনে হয়েছে। রাজনীতিতে তিনি পরিবর্তন আনতে চান, এনেছেনও। কিন্তু কতদূর যেতে পারবেন তিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিনি ছিলেন প্রবক্তা। ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনের পর তিনি বলতে গেলে এককভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে আন্দোলন করে গেছেন। সেদিন খালেদা জিয়া ছিলেন সরকারপ্রধান। তিনি রাজি ছিলেন না তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায়। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে তিনি রাজি হন এবং মাত্র ১৩ দিনের সংসদে (ষষ্ঠ সংসদ) সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। পরপর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আজ এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেল। আর বিএনপি চাচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের। এটি হরতালের অন্যতম একটি ইস্যু। বাস্তবতা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন (দশম ও একাদশ) 'নিরপেক্ষ' একটি সরকারের মাধ্যমে আয়োজন করা সম্ভব। এটা সংবিধানের কোনো অংশ হবে না। কিন্তু সংসদে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। সরকার এ ব্যাপারে সংসদে একটি প্রস্তাব আনতে পারে। অথবা শরিক দলের পক্ষ থেকেও যে কেউ এ ধরনের একটি প্রস্তাব আনতে পারে, যাতে সরকারের সমর্থন থাকবে। এটি একটি 'কমপ্রোমাইজিং ফর্মুলা', যা বিএনপিকে আস্থায় নেওয়ার এটি উদ্যোগ হতে পারে। তাতে করে অন্তত হরতালের রাজনীতি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব। এই 'নিরপেক্ষ সরকার'-এ কারা থাকবেন, কাঠামো কী হবে, তা বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করেই ঠিক করতে হবে। 'নিরপেক্ষ' সরকারের কাঠামোর ব্যাপারে সংসদের স্পিকারও একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। সুশীল সমাজকেও উৎসাহিত করা যেতে পারে একটি ফর্মুলা উপস্থাপন করতে; কিন্তু 'অন্তর্বর্তীকালীন' সরকারের যে ফর্মুলা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত উপস্থাপন করেছেন তা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কেননা ওই ফর্মুলা অনুযায়ী শেষ ৯০ দিন তো মহাজোট সরকারই ক্ষমতায় থেকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দলীয়ভাবে নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্ন উঠবে এবং সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়া যাবে না। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলা হচ্ছে। এখন পঞ্চদশ সংশোধনী বলে নির্বাচন কমিশনারদের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তা যথেষ্ট নয়। প্রসঙ্গত, বর্তমান সরকারই আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে সিইসি তথা নতুন কমিশনারদের নিয়োগ দেবে। সঙ্গত কারণেই তাই দলীয় আনুগত্যের প্রশ্ন উঠবে। সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের অবসরের পর রাজনীতি করার প্রবণতা বেড়েছে। তাদের অনেকেই বিশেষ করে বেসামরিক আমলারা ক্ষমতায় থাকার সময়ই একটি 'বিশেষ সম্পর্ক' গড়ে তোলেন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে। কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে কেউ নেতা-নেত্রীকে খুশি করেন। তারা যখন এ ধরনের সাংবিধানিক পদে নিয়োগ পান তখন তাদের 'আনুগত্য' নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান কাঠামোয় নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ_ এটা বলা যাবে না। অর্থের জন্য তাদের সরকারের মুখাপেক্ষী হতে হয়। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব 'ক্যাডার' তৈরি হয়নি, যারা নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে সরকারি প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। যতদিন পর্যন্ত না নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল থাকবে এবং আইন এদের নির্বাচন পরিচালনায় যথেষ্ট ক্ষমতা দেবে, আর্থিক স্বাধীনতা দেবে, সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের নিরপেক্ষ 'মেকানিজম' তৈরি হবে, ততদিন পর্যন্ত নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ইভিএম মেশিনও গ্রহণযোগ্য নয়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র তা ব্যবহৃত হয়নি। আমাদের দেশের নিরক্ষরতা, প্রযুক্তি না জানার ব্যর্থতা, ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত ব্যক্তিদের ভূমিকা ও সর্বোপরি 'প্রযুক্তি কারচুপি' নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। সিইসির 'অতি উৎসাহ' ইতিমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে তার সাম্প্রতিক বক্তব্য বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়াবে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এখন সংবিধানের অংশ। এটি নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে; কিন্তু এটি আর পরিবর্তন করা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে শুধু সংসদই পারে ১৬তম সংশোধনী এনে সংবিধানকে আবার আগের অবস্থানে নিয়ে যেতে; কিন্তু তাও খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। কেননা সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ায় (১৪২আ) পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে ৭(খ) যোগ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে_ 'এ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহাই কিছু থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথমভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয়ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয়ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের অনুচ্ছেদ ১৫০সহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলির বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।' সংবিধানে ৭(খ)-এর অন্তর্ভুক্তি এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে এবং সংবিধান সংশোধন কমিটির আসল উদ্দেশ্যকে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে। কেননা এর ফলে 'জাতির পিতা' শিরোনামের অনুচ্ছেদ ৪-এ যা কিছু সংশোধিত হয়েছে (ছবি প্রদর্শন), তাতে সংশোধনী আনা যাবে না। ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা, মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ইত্যাদি সংযুক্তি (অনুচ্ছেদ-১৫০.২) সংশোধন কঠিন হবে। এমনকি রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি জাতি হিসেবে বাঙালি ও নাগরিকতায় বাংলাদেশি বাতিল করা কিংবা 'আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' পুনঃস্থাপন করা সহজ হবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য 'জাতির পিতা', 'স্বাধীনতার ঘোষণা' ইত্যাদি প্রশ্নে জাতি এখনও বিভক্ত থেকে গেল। স্বাধীনতার বীর সৈনিকদের নিয়ে যে জাতি ৪০ বছর পরও বিতর্ক করে সে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কামুক্ত হওয়া যায় না।
হরতাল কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। আবার সরকারের কঠোর মনোভাবও কোনো সমাধানের পথ তৈরি করে দেবে না। আলোচনাই একমাত্র সমাধান। পৃথিবীর বড় বড় সমস্যা আলোচনার টেবিলেই সমাধান হয়েছে। 'বিচার মানি কিন্তু তালগাছ আমার'_ এই মানসিকতাও পরিবর্তন করতে হবে। সংশোধিত সংবিধানকে সামনে রেখেই এবং উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করেই দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা এ মুহূর্তে জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে 'হরতালের যে রাজনীতি' শুরু হয়েছে তাতে জনমত যদি রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে চলে যায়, আমি অবাক হব না।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া, বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবিসংবাদিত দুই নেত্রী। লাখ লাখ সমর্থক তাকিয়ে থাকেন তাদের দিকে। দুটি বড় দলেরও নেতৃত্ব দেন তারা। আমরা যৌথ নেতৃত্বের কথা বললেও, দুটি দলেই যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পরিবর্তিত রাজনীতির কারণে শেখ হাসিনার অবস্থান এখন ভালো। তিনি এখন প্রধানমন্ত্রী। দলের তথাকথিত সংস্কারবাদীদের অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়ে তিনি দলে ও সরকারে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি যখন সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন তাকে অতটা 'শক্ত' মনে হয়নি। কিন্তু এবার মনে হয়েছে। রাজনীতিতে তিনি পরিবর্তন আনতে চান, এনেছেনও। কিন্তু কতদূর যেতে পারবেন তিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিনি ছিলেন প্রবক্তা। ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনের পর তিনি বলতে গেলে এককভাবেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে আন্দোলন করে গেছেন। সেদিন খালেদা জিয়া ছিলেন সরকারপ্রধান। তিনি রাজি ছিলেন না তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায়। কিন্তু গণআন্দোলনের মুখে তিনি রাজি হন এবং মাত্র ১৩ দিনের সংসদে (ষষ্ঠ সংসদ) সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। পরপর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায় অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আজ এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেল। আর বিএনপি চাচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের। এটি হরতালের অন্যতম একটি ইস্যু। বাস্তবতা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন (দশম ও একাদশ) 'নিরপেক্ষ' একটি সরকারের মাধ্যমে আয়োজন করা সম্ভব। এটা সংবিধানের কোনো অংশ হবে না। কিন্তু সংসদে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। সরকার এ ব্যাপারে সংসদে একটি প্রস্তাব আনতে পারে। অথবা শরিক দলের পক্ষ থেকেও যে কেউ এ ধরনের একটি প্রস্তাব আনতে পারে, যাতে সরকারের সমর্থন থাকবে। এটি একটি 'কমপ্রোমাইজিং ফর্মুলা', যা বিএনপিকে আস্থায় নেওয়ার এটি উদ্যোগ হতে পারে। তাতে করে অন্তত হরতালের রাজনীতি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব। এই 'নিরপেক্ষ সরকার'-এ কারা থাকবেন, কাঠামো কী হবে, তা বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করেই ঠিক করতে হবে। 'নিরপেক্ষ' সরকারের কাঠামোর ব্যাপারে সংসদের স্পিকারও একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। সুশীল সমাজকেও উৎসাহিত করা যেতে পারে একটি ফর্মুলা উপস্থাপন করতে; কিন্তু 'অন্তর্বর্তীকালীন' সরকারের যে ফর্মুলা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত উপস্থাপন করেছেন তা ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কেননা ওই ফর্মুলা অনুযায়ী শেষ ৯০ দিন তো মহাজোট সরকারই ক্ষমতায় থেকে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দলীয়ভাবে নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্ন উঠবে এবং সে ক্ষেত্রে বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়া যাবে না। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বলা হচ্ছে। এখন পঞ্চদশ সংশোধনী বলে নির্বাচন কমিশনারদের সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তা যথেষ্ট নয়। প্রসঙ্গত, বর্তমান সরকারই আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে সিইসি তথা নতুন কমিশনারদের নিয়োগ দেবে। সঙ্গত কারণেই তাই দলীয় আনুগত্যের প্রশ্ন উঠবে। সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের অবসরের পর রাজনীতি করার প্রবণতা বেড়েছে। তাদের অনেকেই বিশেষ করে বেসামরিক আমলারা ক্ষমতায় থাকার সময়ই একটি 'বিশেষ সম্পর্ক' গড়ে তোলেন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে। কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে কেউ নেতা-নেত্রীকে খুশি করেন। তারা যখন এ ধরনের সাংবিধানিক পদে নিয়োগ পান তখন তাদের 'আনুগত্য' নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান কাঠামোয় নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ_ এটা বলা যাবে না। অর্থের জন্য তাদের সরকারের মুখাপেক্ষী হতে হয়। নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব 'ক্যাডার' তৈরি হয়নি, যারা নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে সরকারি প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। যতদিন পর্যন্ত না নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল থাকবে এবং আইন এদের নির্বাচন পরিচালনায় যথেষ্ট ক্ষমতা দেবে, আর্থিক স্বাধীনতা দেবে, সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের নিরপেক্ষ 'মেকানিজম' তৈরি হবে, ততদিন পর্যন্ত নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। ইভিএম মেশিনও গ্রহণযোগ্য নয়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র তা ব্যবহৃত হয়নি। আমাদের দেশের নিরক্ষরতা, প্রযুক্তি না জানার ব্যর্থতা, ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত ব্যক্তিদের ভূমিকা ও সর্বোপরি 'প্রযুক্তি কারচুপি' নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। সিইসির 'অতি উৎসাহ' ইতিমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে তার সাম্প্রতিক বক্তব্য বিতর্কের মাত্রা আরও বাড়াবে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এখন সংবিধানের অংশ। এটি নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে; কিন্তু এটি আর পরিবর্তন করা যাবে না। বাস্তবতা হচ্ছে শুধু সংসদই পারে ১৬তম সংশোধনী এনে সংবিধানকে আবার আগের অবস্থানে নিয়ে যেতে; কিন্তু তাও খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। কেননা সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ায় (১৪২আ) পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে ৭(খ) যোগ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে_ 'এ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহাই কিছু থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথমভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয়ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলী সাপেক্ষে তৃতীয়ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের অনুচ্ছেদ ১৫০সহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলির বিধানাবলী সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।' সংবিধানে ৭(খ)-এর অন্তর্ভুক্তি এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে এবং সংবিধান সংশোধন কমিটির আসল উদ্দেশ্যকে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে। কেননা এর ফলে 'জাতির পিতা' শিরোনামের অনুচ্ছেদ ৪-এ যা কিছু সংশোধিত হয়েছে (ছবি প্রদর্শন), তাতে সংশোধনী আনা যাবে না। ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা, মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ইত্যাদি সংযুক্তি (অনুচ্ছেদ-১৫০.২) সংশোধন কঠিন হবে। এমনকি রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি জাতি হিসেবে বাঙালি ও নাগরিকতায় বাংলাদেশি বাতিল করা কিংবা 'আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' পুনঃস্থাপন করা সহজ হবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য 'জাতির পিতা', 'স্বাধীনতার ঘোষণা' ইত্যাদি প্রশ্নে জাতি এখনও বিভক্ত থেকে গেল। স্বাধীনতার বীর সৈনিকদের নিয়ে যে জাতি ৪০ বছর পরও বিতর্ক করে সে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কামুক্ত হওয়া যায় না।
হরতাল কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। আবার সরকারের কঠোর মনোভাবও কোনো সমাধানের পথ তৈরি করে দেবে না। আলোচনাই একমাত্র সমাধান। পৃথিবীর বড় বড় সমস্যা আলোচনার টেবিলেই সমাধান হয়েছে। 'বিচার মানি কিন্তু তালগাছ আমার'_ এই মানসিকতাও পরিবর্তন করতে হবে। সংশোধিত সংবিধানকে সামনে রেখেই এবং উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করেই দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা এ মুহূর্তে জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে 'হরতালের যে রাজনীতি' শুরু হয়েছে তাতে জনমত যদি রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে চলে যায়, আমি অবাক হব না।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments