রাজনীতিতে আবার ফিরে আসব by সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গতকাল সোমবার রেল ভবনে ২০ মিনিটের এক সংবাদ সম্মেলনে তার পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। প্রথমে মৌখিক বক্তব্য রাখলেও পরে তিনি তার পদত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করে একটি লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন।
তিনি বলেছেন, এই সংকটকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি একটি দ্বন্দ্বের মুখোমুখি। তার ভাষায়, আমি কারও বোঝা হতে চাই না। আমি আমার দল, সরকার কিংবা দলের নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বোঝা হতে চাই না। আমার পদক্ষেপে যেন দল, সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়, সেটাই করতে চাই। সমুদ্র মন্থনে শুধু অমৃত ছিল না, বিষও ছিল। গণতন্ত্রে দুটিই হয়। আমি বিষ খেয়ে নীলকণ্ঠ হতে চাই।
সুরঞ্জিত সেনের আবেগপ্রবণ বিবৃতিটি আমরা পুরোপুরি প্রকাশ করলাম
আপনারা জানেন, আমাদের বাংলাদেশের গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে, বারবার পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে এবং গণতন্ত্রের শত্রুরা এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে কোনো ব্যক্তি নয়, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেই তারা ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত করেছে। একই ধারায় আমরা অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে আসার পরও সংসদ অকার্যকর করার জন্য একদল প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাই আমি এই ক্রান্তিলগ্নে, আমি আপনাদের সামনে দুটি কথা বলতে চাই, আমি আপনাদের সহযোগিতা কামনা করি। আপনারা জানেন যে, কয়েকদিন আগে ৯ এপ্রিলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের জাতীয় গণমাধ্যমে, সুশীল সমাজে, রাজনৈতিক মহলে এবং সর্বস্তরেই একটি নতুন বিতর্কিত অবস্থান দাঁড়িয়েছে। তাকে কেন্দ্র করে নানা কথা এসেছে এবং আপনারা জানেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার ইচ্ছায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে রেল মন্ত্রণালয় ভাগ করে তার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন। আমি সর্বান্তকরণে চেষ্টা করেছি রেলকে গতিশীল করার, রেলের নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনার, রেলের কালোবাজারে টিকিট বন্ধ করার এবং রেলটিকে পরিচ্ছন্ন করার। চেষ্টা করেছি রেলের নতুন লাইন, নতুন বগি এবং নতুন ইঞ্জিন এনে রেলকে আরও প্রসারিত করার। এই লক্ষ্যে একশ' বছরের ইতিহাসে এই সরকারই প্রথম হাজার হাজার অর্থ দিয়ে এই রেলকে প্রসারিত করার এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটি সচল রেল করার চেষ্টা করেছেন। আমি রেলমন্ত্রী হিসেবে আন্তরিকভাবে রেলকে সচল করার প্রয়াস চালিয়েছি। কিন্তু ওই ৯ এপ্রিলের ঘটনায় যেহেতু আমার পার্সোনাল স্টাফ এপিএস এবং একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাসহ রেলের আর একজন কর্মচারী নিয়োজিত ছিল, সুতরাং এই দায়িত্ব অবশ্যই আমাদের মন্ত্রণালয়ে বর্তায়। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের চলি্লশ বছরের গণতন্ত্রের ইতিহাসে গণতন্ত্রের কেবল সুবিধা ভোগই আমরা করেছি, কিন্তু গণতন্ত্রের সংকটে কেউ আত্মত্যাগ করতে আসিনি। আজকের সেই পরীক্ষার সম্মুখীন আমি নিজেই, জীবনের সায়াহ্নে এসে। যদিও আমি খুব দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, ওই ঘটনার সঙ্গে আমার পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তারপরও আমি আজকে গণতন্ত্রকে পরিশীলিত, পরিমার্জিত করার জন্য একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে চাইছি। অতীতেও আমি আমার জীবনে এ রকম অনেক সাহসী সিদ্ধান্ত কখনও নিঃসঙ্গভাবে নিয়েছি, কখনও আশপাশে বন্ধু-বান্ধব পেয়েছি। আজকে আমি নিঃসঙ্গভাবেই দায়িত্ব নিতে চাই। তাই আমি মনে করি রেলের এই কাজের, এই দুর্ঘটনার জন্য আমি প্রাথমিকভাবে চেষ্টা করেছি, আমার কিছু কর্তব্য আছে যে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। সেই কারণে আমি দুটি তদন্ত কমিটি করেছি এবং দুটি তদন্ত কমিটিতে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারাও যাতে নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারে সে সুযোগ আমি সৃষ্টি করে দিয়েছি। অন্যথায় তারা কোর্টে গিয়ে এসব প্রসেসকে বন্ধ করে দিতে পারত, কারণ আমি নিজে একজন আইন প্রণেতা এবং আইনজীবী। এর প্রাথমিক অধ্যায় গতকাল শেষ হয়েছে। তারা জবাব দেওয়ার পরই আমাদের রেল কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রেলের খুবই উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা এবং একজন কমান্ড্যান্টকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং আমার যে পার্সোনাল স্টাফ তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তার সমস্ত কাগজপত্র আমি দুদককে পাঠিয়েছি। তারপরও প্রশ্ন আসছে। গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ এমনকি আমাদের দলেও দু'একজন ছাড়া এ ব্যাপারে কথা বলছেন যে তদন্ত প্রভাবমুক্ত হবে কি হবে না। অনেকেই মনে করেন, আমি রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকলে এই তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে। সুতরাং এ ব্যাপারে গণতন্ত্রের মাত্রাকে সৃদৃঢ় করার জন্য আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে। চলি্লশ বছরের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতি টেনে, গণতন্ত্রের মধ্যে আজকে আমি সেটুকু অবদান রেখেই বলতে চাই, আমার সম্পৃক্ততা না থাকার পরও যেহেতু রেলের সমস্ত সফলতা আমার ওপর বর্তায়, ব্যর্থতাও আমার ওপর বর্তায়। সে কারণে এই ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব নিয়ে আমি রেলের মন্ত্রী হিসেবে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে পারি এবং সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার পত্র আমি প্রেরণ করব। গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, আমাদের বিরোধী দল এবং সকল স্তরে সবার কাছেই যেন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ তদন্ত এবং সবাই যেহেতু এ ব্যাপারে শঙ্কামুক্ত হতে পারেননি সে বিষয়টি আমি বিবেচনায় নিয়েছি। তাছাড়া আমার বিবেক, গণতান্ত্রিক চেতনা, অতীতের সকল রাজনৈতিক ধারাবাহিতা_ এসব আমার স্বভাবসিদ্ধ বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া অনেক সুহৃদ, সাংবাদিক, শুভান্যুধায়ী সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আমার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। আমি সামগ্রিক বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমার অল্প সময়ের নবগঠিত মন্ত্রণালয় চালানোর অভিজ্ঞতায় অন্তত নতুন লাইন, নতুন বগি সংযোজন এবং সময়ানুবর্তিতা ও পরিচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে মৃতপ্রায় রেলের মধ্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করায় তারা যেমন প্রশংসা করেছেন, তেমনি আমার এই ব্যর্থতা নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। রাজনীতিতে আমি শৈশব থেকেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টির রাজনীতি করে আসছি। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে নিঃসঙ্গতার কথা আমি আগেই বলেছি। সকল পদক্ষেপই পুরস্কৃত, প্রশংসিত হয়েছি এমন নয়, তবে ইতিহাস বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আমার ভূমিকাকে কেউ অস্বীকার করতে পারেনি। আজকে এই সংকটকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমি একটি দ্বন্দ্বের মুখোমুখি। আমার সামনে কঠিন পথ। একটি যেনতেন প্রকারে সকল আলোচনা, সমালোচনাকে উপেক্ষা করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা। অন্যটি দল, সরকার এবং সরকারপ্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা, এরকম সুযোগ সবসময় সবার রাজনৈতিক জীবনে আসে না। কারণ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ইতিহাস সৃষ্টির দুঃসাহস অনেকেই দেখায় না। আমি অনেক ভেবেচিন্তে দ্বিতীয় পথ বেছে নেওয়াই শ্রেয় মনে করি। সুতরাং আমি উচ্চকণ্ঠে বলতে চাই, আমার দল, সরকার কিংবা দলের নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লায়াবিলিটি হতে চাই না, আমি কারও বোঝা হতে চাই না। আমার পদক্ষেপে যেন দল, সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়, সেটাই করতে চাই। সেই লক্ষ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে আসার পর আমি তার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করি। সঙ্গত কারণে নববর্ষের পরদিন রোববার রাতে তিনি আমাকে সময় দিয়েছেন এবং ঘণ্টাকালব্যাপী একান্ত বৈঠকের সুযোগ দেওয়ায় তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সেখানে আমি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করি এবং তিনি এ বিষয়ে সানুগ্রহ সম্মতি দেন। এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে আমি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই। সমুদ্র মন্থনে শুধু অমৃত ছিল না, বিষও ছিল। গণতন্ত্রে দুটিই হয়। আমি বিষ খেয়ে নীলকণ্ঠ হতে চাই। সে লক্ষ্যে আমি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাতে চাই, রেলপথ মন্ত্রণালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে দেশবাসীকে স্বস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে আমি রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার মধ্য দিয়ে তদন্ত প্রভাবিত হওয়ার শঙ্কা, সংশয়, সন্দেহের অবসান ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে যেমন আমি বিজয়ী হয়েছি, তেমনি জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আজকের এই অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সততার আন্দোলনেও আমি বিজয়ী হবো। এই তদন্তের মাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে আবার রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারব। আমার স্বল্প সময়ে নতুন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্বচ্ছতা এবং গতিশীলতা আনতে গিয়ে যেভাবে হোঁচট খেয়েছি এর সকল ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব কেবল আমারই। আমার দল বা সরকার কিংবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নয়। আমার অব্যাহতি নেওয়ার মধ্য দিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কথিত সংকটের নিরসন হবে, এটাই আমার প্রত্যাশা। আমি আশা করি, এবার তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটিত হবে এবং বিষয়টি যুক্তিযুক্ত সময়ে নিষ্পত্তি হবে। আমি বিশ্বাস করি, তদন্ত প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত না করে যুক্তিসঙ্গত সময়ে শেষ করলে এ নিয়ে কারও রাজনীতি করার সুযোগ থাকবে না, রাজনৈতিক ইস্যুও সৃষ্টি হবে না। সবশেষে বলতে চাই, সবসময় গণমাধ্যমের সঙ্গে আমার খুব হৃদ্যতা ছিল এবং কখনও নিজেই কোনো সংবাদ সৃষ্টি করে সহায়তা করেছি, কখনও কখনও নিজেই সংবাদের শিরোনাম হয়েছি। আজ আবারও শিরোনাম হয়ে আপনাদের সহযোগিতা করলাম। আমি এখানে শুধু দুটি কথা বলতে চাই, এই সময়ের মধ্যে আমার রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারী, রেলের ইউনিয়ন এবং শ্রমিক লীগসহ রেলের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আমাকে সব কাজে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছেন, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। রেলের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী সৎ এবং নিষ্ঠাবান, তারা নিরলস পরিশ্রম করেন। কতিপয় দুর্নীতিবাজ লোকের জন্য মন্ত্রণালয়ের সকলের বদনাম করা ঠিক নয়। সুষ্ঠু, স্বচ্ছ তদন্তের স্বার্থে যেমন আমার রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত, তেমনি তদন্তের প্রাথমিক পর্যায় সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত গণমাধ্যমে আমি আর কোনো বক্তব্য না দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ আমার বক্তব্য দিয়ে তদন্ত কাজে আমি বিঘ্ন ঘটাতে চাই না। আমি আশা করি, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন হবে এবং সত্য উন্মোচিত হলে আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে আবারও রাজনীতিতে সোচ্চার হতে পারব। দেশ, সরকার ও দলের স্বার্থে আমার এই বিষয়টি সবাই বিবেচনায় নেবেন। আমি শুধু বলতে চাই, ৯ এপ্রিলের অনভিপ্রেত ঘটনা আমাকে হতচকিত করেছে। গণমাধ্যম, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ এবং আমাদের দলের মধ্যে কিছুসংখ্যক নেতা তদন্তের স্বার্থে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা আমার সমীচীন নয় মর্মে অভিমত দিয়েছেন, আমি তাদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি গণমাধ্যমকে বলতে চাই, আমি আজকে কোনো প্রশ্ন নেব না, প্রশ্নের জবাব দেব না, আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।
সুরঞ্জিত সেনের আবেগপ্রবণ বিবৃতিটি আমরা পুরোপুরি প্রকাশ করলাম
আপনারা জানেন, আমাদের বাংলাদেশের গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়েছে, বারবার পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে এবং গণতন্ত্রের শত্রুরা এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে কোনো ব্যক্তি নয়, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেই তারা ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত করেছে। একই ধারায় আমরা অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে আসার পরও সংসদ অকার্যকর করার জন্য একদল প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাই আমি এই ক্রান্তিলগ্নে, আমি আপনাদের সামনে দুটি কথা বলতে চাই, আমি আপনাদের সহযোগিতা কামনা করি। আপনারা জানেন যে, কয়েকদিন আগে ৯ এপ্রিলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের জাতীয় গণমাধ্যমে, সুশীল সমাজে, রাজনৈতিক মহলে এবং সর্বস্তরেই একটি নতুন বিতর্কিত অবস্থান দাঁড়িয়েছে। তাকে কেন্দ্র করে নানা কথা এসেছে এবং আপনারা জানেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার ইচ্ছায় যোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে রেল মন্ত্রণালয় ভাগ করে তার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন। আমি সর্বান্তকরণে চেষ্টা করেছি রেলকে গতিশীল করার, রেলের নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনার, রেলের কালোবাজারে টিকিট বন্ধ করার এবং রেলটিকে পরিচ্ছন্ন করার। চেষ্টা করেছি রেলের নতুন লাইন, নতুন বগি এবং নতুন ইঞ্জিন এনে রেলকে আরও প্রসারিত করার। এই লক্ষ্যে একশ' বছরের ইতিহাসে এই সরকারই প্রথম হাজার হাজার অর্থ দিয়ে এই রেলকে প্রসারিত করার এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটি সচল রেল করার চেষ্টা করেছেন। আমি রেলমন্ত্রী হিসেবে আন্তরিকভাবে রেলকে সচল করার প্রয়াস চালিয়েছি। কিন্তু ওই ৯ এপ্রিলের ঘটনায় যেহেতু আমার পার্সোনাল স্টাফ এপিএস এবং একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাসহ রেলের আর একজন কর্মচারী নিয়োজিত ছিল, সুতরাং এই দায়িত্ব অবশ্যই আমাদের মন্ত্রণালয়ে বর্তায়। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের চলি্লশ বছরের গণতন্ত্রের ইতিহাসে গণতন্ত্রের কেবল সুবিধা ভোগই আমরা করেছি, কিন্তু গণতন্ত্রের সংকটে কেউ আত্মত্যাগ করতে আসিনি। আজকের সেই পরীক্ষার সম্মুখীন আমি নিজেই, জীবনের সায়াহ্নে এসে। যদিও আমি খুব দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, ওই ঘটনার সঙ্গে আমার পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তারপরও আমি আজকে গণতন্ত্রকে পরিশীলিত, পরিমার্জিত করার জন্য একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে চাইছি। অতীতেও আমি আমার জীবনে এ রকম অনেক সাহসী সিদ্ধান্ত কখনও নিঃসঙ্গভাবে নিয়েছি, কখনও আশপাশে বন্ধু-বান্ধব পেয়েছি। আজকে আমি নিঃসঙ্গভাবেই দায়িত্ব নিতে চাই। তাই আমি মনে করি রেলের এই কাজের, এই দুর্ঘটনার জন্য আমি প্রাথমিকভাবে চেষ্টা করেছি, আমার কিছু কর্তব্য আছে যে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। সেই কারণে আমি দুটি তদন্ত কমিটি করেছি এবং দুটি তদন্ত কমিটিতে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারাও যাতে নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারে সে সুযোগ আমি সৃষ্টি করে দিয়েছি। অন্যথায় তারা কোর্টে গিয়ে এসব প্রসেসকে বন্ধ করে দিতে পারত, কারণ আমি নিজে একজন আইন প্রণেতা এবং আইনজীবী। এর প্রাথমিক অধ্যায় গতকাল শেষ হয়েছে। তারা জবাব দেওয়ার পরই আমাদের রেল কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রেলের খুবই উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা এবং একজন কমান্ড্যান্টকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং আমার যে পার্সোনাল স্টাফ তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তার সমস্ত কাগজপত্র আমি দুদককে পাঠিয়েছি। তারপরও প্রশ্ন আসছে। গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ এমনকি আমাদের দলেও দু'একজন ছাড়া এ ব্যাপারে কথা বলছেন যে তদন্ত প্রভাবমুক্ত হবে কি হবে না। অনেকেই মনে করেন, আমি রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকলে এই তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে। সুতরাং এ ব্যাপারে গণতন্ত্রের মাত্রাকে সৃদৃঢ় করার জন্য আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে। চলি্লশ বছরের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতি টেনে, গণতন্ত্রের মধ্যে আজকে আমি সেটুকু অবদান রেখেই বলতে চাই, আমার সম্পৃক্ততা না থাকার পরও যেহেতু রেলের সমস্ত সফলতা আমার ওপর বর্তায়, ব্যর্থতাও আমার ওপর বর্তায়। সে কারণে এই ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব নিয়ে আমি রেলের মন্ত্রী হিসেবে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে পারি এবং সেই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার পত্র আমি প্রেরণ করব। গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, আমাদের বিরোধী দল এবং সকল স্তরে সবার কাছেই যেন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ তদন্ত এবং সবাই যেহেতু এ ব্যাপারে শঙ্কামুক্ত হতে পারেননি সে বিষয়টি আমি বিবেচনায় নিয়েছি। তাছাড়া আমার বিবেক, গণতান্ত্রিক চেতনা, অতীতের সকল রাজনৈতিক ধারাবাহিতা_ এসব আমার স্বভাবসিদ্ধ বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া অনেক সুহৃদ, সাংবাদিক, শুভান্যুধায়ী সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আমার দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। আমি সামগ্রিক বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমার অল্প সময়ের নবগঠিত মন্ত্রণালয় চালানোর অভিজ্ঞতায় অন্তত নতুন লাইন, নতুন বগি সংযোজন এবং সময়ানুবর্তিতা ও পরিচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে মৃতপ্রায় রেলের মধ্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করায় তারা যেমন প্রশংসা করেছেন, তেমনি আমার এই ব্যর্থতা নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। রাজনীতিতে আমি শৈশব থেকেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টির রাজনীতি করে আসছি। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে নিঃসঙ্গতার কথা আমি আগেই বলেছি। সকল পদক্ষেপই পুরস্কৃত, প্রশংসিত হয়েছি এমন নয়, তবে ইতিহাস বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আমার ভূমিকাকে কেউ অস্বীকার করতে পারেনি। আজকে এই সংকটকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমি একটি দ্বন্দ্বের মুখোমুখি। আমার সামনে কঠিন পথ। একটি যেনতেন প্রকারে সকল আলোচনা, সমালোচনাকে উপেক্ষা করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা। অন্যটি দল, সরকার এবং সরকারপ্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে নতুন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা, এরকম সুযোগ সবসময় সবার রাজনৈতিক জীবনে আসে না। কারণ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ইতিহাস সৃষ্টির দুঃসাহস অনেকেই দেখায় না। আমি অনেক ভেবেচিন্তে দ্বিতীয় পথ বেছে নেওয়াই শ্রেয় মনে করি। সুতরাং আমি উচ্চকণ্ঠে বলতে চাই, আমার দল, সরকার কিংবা দলের নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর লায়াবিলিটি হতে চাই না, আমি কারও বোঝা হতে চাই না। আমার পদক্ষেপে যেন দল, সরকার এবং প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়, সেটাই করতে চাই। সেই লক্ষ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশে আসার পর আমি তার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করি। সঙ্গত কারণে নববর্ষের পরদিন রোববার রাতে তিনি আমাকে সময় দিয়েছেন এবং ঘণ্টাকালব্যাপী একান্ত বৈঠকের সুযোগ দেওয়ায় তার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সেখানে আমি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করি এবং তিনি এ বিষয়ে সানুগ্রহ সম্মতি দেন। এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে আমি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চাই। সমুদ্র মন্থনে শুধু অমৃত ছিল না, বিষও ছিল। গণতন্ত্রে দুটিই হয়। আমি বিষ খেয়ে নীলকণ্ঠ হতে চাই। সে লক্ষ্যে আমি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাতে চাই, রেলপথ মন্ত্রণালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে দেশবাসীকে স্বস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে আমি রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার মধ্য দিয়ে তদন্ত প্রভাবিত হওয়ার শঙ্কা, সংশয়, সন্দেহের অবসান ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, সামাজিক ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনে যেমন আমি বিজয়ী হয়েছি, তেমনি জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী আজকের এই অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সততার আন্দোলনেও আমি বিজয়ী হবো। এই তদন্তের মাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে আবার রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারব। আমার স্বল্প সময়ে নতুন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে স্বচ্ছতা এবং গতিশীলতা আনতে গিয়ে যেভাবে হোঁচট খেয়েছি এর সকল ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব কেবল আমারই। আমার দল বা সরকার কিংবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নয়। আমার অব্যাহতি নেওয়ার মধ্য দিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কথিত সংকটের নিরসন হবে, এটাই আমার প্রত্যাশা। আমি আশা করি, এবার তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটিত হবে এবং বিষয়টি যুক্তিযুক্ত সময়ে নিষ্পত্তি হবে। আমি বিশ্বাস করি, তদন্ত প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত না করে যুক্তিসঙ্গত সময়ে শেষ করলে এ নিয়ে কারও রাজনীতি করার সুযোগ থাকবে না, রাজনৈতিক ইস্যুও সৃষ্টি হবে না। সবশেষে বলতে চাই, সবসময় গণমাধ্যমের সঙ্গে আমার খুব হৃদ্যতা ছিল এবং কখনও নিজেই কোনো সংবাদ সৃষ্টি করে সহায়তা করেছি, কখনও কখনও নিজেই সংবাদের শিরোনাম হয়েছি। আজ আবারও শিরোনাম হয়ে আপনাদের সহযোগিতা করলাম। আমি এখানে শুধু দুটি কথা বলতে চাই, এই সময়ের মধ্যে আমার রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারী, রেলের ইউনিয়ন এবং শ্রমিক লীগসহ রেলের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আমাকে সব কাজে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়েছেন, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। রেলের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী সৎ এবং নিষ্ঠাবান, তারা নিরলস পরিশ্রম করেন। কতিপয় দুর্নীতিবাজ লোকের জন্য মন্ত্রণালয়ের সকলের বদনাম করা ঠিক নয়। সুষ্ঠু, স্বচ্ছ তদন্তের স্বার্থে যেমন আমার রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত, তেমনি তদন্তের প্রাথমিক পর্যায় সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত গণমাধ্যমে আমি আর কোনো বক্তব্য না দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ আমার বক্তব্য দিয়ে তদন্ত কাজে আমি বিঘ্ন ঘটাতে চাই না। আমি আশা করি, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন হবে এবং সত্য উন্মোচিত হলে আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে আবারও রাজনীতিতে সোচ্চার হতে পারব। দেশ, সরকার ও দলের স্বার্থে আমার এই বিষয়টি সবাই বিবেচনায় নেবেন। আমি শুধু বলতে চাই, ৯ এপ্রিলের অনভিপ্রেত ঘটনা আমাকে হতচকিত করেছে। গণমাধ্যম, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ এবং আমাদের দলের মধ্যে কিছুসংখ্যক নেতা তদন্তের স্বার্থে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা আমার সমীচীন নয় মর্মে অভিমত দিয়েছেন, আমি তাদের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি গণমাধ্যমকে বলতে চাই, আমি আজকে কোনো প্রশ্ন নেব না, প্রশ্নের জবাব দেব না, আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ।
No comments