জগন্নাথ হলের সেইসব দিন-রাত্রি by অভিরাম ভৌমিক

১৯৭১ সাল। তখন আমার বয়সই বা কত_ ১৮ বা ১৯। ১৯৭০ সালের শেষ ভাগে নিরেট গ্রামের এক ছেলে সম্মান ক্লাসে পড়ার মানসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদে ভর্তি হয়েছি। আমি তখন জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র, কিন্তু সুনির্দর্িষ্ট রুম নেই। তাই আমরা ১১ জন থাকি অ্যাসেমবি্ল হাউসের ১১ নম্বর কক্ষে।


১ মার্চ থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম হচ্ছিল। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের একটি রাজনৈতিক দলের ভোটযুদ্ধে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর আগ্রাসী রূপ প্রতিভাত হচ্ছিল। শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের ছাত্র হিসেবে আমরাও আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি। সংসদ না বসার সিদ্ধান্তে অগি্নগর্ভ হয়ে ওঠে ঢাকা। ২ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভা লোকে লোকারণ্য। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তারা যেন একেকটি অগি্নস্ফুলিঙ্গ। ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী_ এ চারজন যেন ছাত্র রাজনীতিতে চারটি স্তম্ভ। তারা ২ মার্চ কলাভবনে সভা করে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে সবুজ জমিনে হলুদ বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা ওড়ালেন। তখন আমিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত ছাত্র জমায়েত হয়েছিলাম সেই কলাভবনের সামনে। একে একে মার্চ মাসের ৪, ৫, ৬ তারিখ কাটল মিছিল, স্লোগান আর আলোচনা সভায় যোগ দিয়ে।
অবশেষে এলো ৭ মার্চ, ১৯৭১। আগের কয়েক দিন থেকেই গুঞ্জন চলছিল, রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আমরা যারা সক্রিয় রাজনীতি করি না কিন্তু তখনকার রাজনৈতিক অবস্থায় নিজেকে রাজনৈতিক কর্মী ভাবতে শুরু করছি, তারা যেন নতুন জীবনে প্রাণের উচ্ছলতা অনুভব করছিলাম। তাই ৭ মার্চ ভোরবেলায় মিছিল করে রেসকোর্সে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। সকাল ৯টার মধ্যেই পেঁৗছে যাই সভাস্থলে। বেলা ক্রমেই বাড়তে থাকলে উত্তেজনা আর স্লোগানে মুখরিত হতে থাকে এলাকা। স্থানীয় নেতা, ছাত্রনেতা, সংসদ সদস্য_ বক্তারা বক্তব্য দিয়ে যেন আরও জমিয়ে তোলেন। অপরাহ্নে এলেন সদলবলে বঙ্গবন্ধু। তিনি সভাস্থলে বেশিক্ষণ বসেন নি। আজও আমার মনের মণিকোঠায় ভেসে ওঠে তার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বক্তৃতা_ 'এবারের সংগ্রাম... স্বাধীনতার সংগ্রাম'। এখনও যখনই শুনি মাইক বা ক্যাসেটে সেই বক্তৃতা, তখনই আপ্লুত হই এ ভেবে যে, এমনই মহতী সভায় সশরীরে উপস্থিত থেকে শুনেছি এমন কালশ্রেষ্ঠ বক্তৃতা_ সত্যিই আমি ভাগ্যবান। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শেষ হলে মিছিলের শহরে পরিণত হয় ঢাকা।
হলে যখন ফিরি তখন রাত ১০টা। একটা অজানা আতঙ্কে রাত কাটলেও ৮ ও ৯ মার্চ ঢাকায় থেকে ১০ তারিখ হল ছেড়ে চলে যাওয়ার তাগিদ আসে গ্রামের বাড়িতে থাকা বাবা-মায়ের তরফ থেকে। তাই তো 'আবার আসিব ফিরে এই জগন্নাথ হলে, যদি থাকে নসিবে' বলে বিদায় নিলাম মার্চের ১১ তারিখ। এরপর আর ফেরা হয়নি ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির আগে। মনে হলো ভুতুড়ে বাড়ি আর সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা ইট-পাথরের কয়েকটি দালান। ভীরু ভীরু মনে ছোট একটা গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম মেইন হলে। উত্তর বাড়ি, দক্ষিণ বাড়ি, অ্যাসেমবি্ল হাউস সবই আছে_ নেই তার উচ্ছলতা। কেন যেন মনে হলো, দেখে আসি অ্যাসেমবি্ল হাউসের দোতলায় ১১ নম্বর কক্ষ। (উল্লেখ্য, ওই কক্ষটি ভেঙে পড়ে ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে, যাতে অনেক ছাত্রের প্রাণহানি ঘটে।)
ঘরে ঢোকার আগে ভাবছিলাম আমাদের রেখে যাওয়া বই, পোশাক, বিছানা, টিনের বাক্স সবই সারি সারি যেভাবে রেখে গেছি সেভাবেই আছে। কিন্তু ঘরে ঢুকে আঁতকে উঠলাম। কালো হয়ে আছে পুরো ছাদ আর দেয়াল। গুলির চিহ্ন বিভিন্ন জায়গায়। থাকতে পারিনি, ছুটে চলে এলাম নিচে। খুঁজতে লাগলাম পরিচিত মুখ, কাউকেই পেলাম না। হঠাৎ দেখা রাখাল চন্দ্র দাসের সঙ্গে, রুম বয় হিসেবেই যে পরিচিত। তার কাছে জগন্নাথ হলে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় সহযোগীদের যে বীভৎস অত্যাচার, হত্যা, নির্যাতন আর লুটের কাহিনী শুনলাম, তা এখন সর্বজনশ্রুত ও স্বীকৃত।
ক্রমে ক্রমে এলো সত্য, চিত্ত, ছিদাম, ধীরেনসহ আরও অনেকে। তারা জানাল, সেই রাতে হলে এসেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৫৭ ব্রিগেড, যার পরিচালনায় ছিল ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবার আর লে. কর্নেল তাজ। ২৫-২৬ মার্চ, ১৯৭১-এর রাত আনুমানিক ১টা থেকে ৩টার মধ্যে ১৮ পাঞ্জাবি রেজিমেন্ট, ২২ বেলুচ রেজিমেন্ট ও ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের গণহত্যাকারী সৈন্যরা সেই রাতে হলে থাকা ছাত্র মৃণাল কান্তি বোস, মনোরঞ্জন বিশ্বাস, ননী গোপাল ভৌমিক, সত্যরঞ্জন দাশ, কার্তিক শীল, নিরঞ্জন হালদার, সুজিত দত্ত, ভবতোষ ভৌমিক প্রমুখ এবং হলের কর্মচারী রাখাল চন্দ্র রায়, দুঃখীরাম মণ্ডল, সুনীল ও প্রিয়নাথ রায়সহ আরও অনেককে ডেকে হলের মাঠে সারি সারি দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করেছে। আর যারা সেই রাতে হলে ছিল কিন্তু ভাগ্যক্রমে মারা যায়নি_ তাদেরই ২৬ মার্চ দুপুরে কবর খুঁড়তে বাধ্য করে এবং মৃত দেহগুলো গণকবরে মাটিচাপা দেওয়ার জন্য অস্ত্রের মুখে নির্দেশ দেয়। আজ যেখানে একটি স্মৃতিসৌধ দাঁড়িয়ে আছে, তারই কাছে সেই গণকবরের পাশে সজল নেত্রে কাহিনী শুনে ধীরপায়ে সেদিনের মতো বিদায় নিলাম হল থেকে।
তবে সবচেয়ে যা আমাকে মর্মবেদনা দিয়েছে তা হলো, আমরা যে ১১ জন ছিলাম ১১ নম্বর কক্ষে, তাদের মধ্যে তিনজন নাকি সে রাতে প্রাণ দিয়েছে। অজানা, স্মৃতিবিচ্যুত সেই ভাগ্যহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে যাচ্ছি আজ অবধি। এমন বীভৎস স্মৃতি যেন আর না আসে কারও জীবনে।
 

No comments

Powered by Blogger.