অর্থনীতি-কৃষি ভর্তুকির নীতি পর্যালোচনা জরুরি by মাহবুব হোসেন
খাদ্য নিরাপত্তা গোটা বিশ্বের জন্যই উদ্বেগের বিষয়। একটা সময় ছিল, যখন উন্নত দেশগুলোতে প্রচুর উদ্বৃত্ত খাদ্য থাকত এবং উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত কোনো দেশে খাদ্যের ঘাটতি হলে সেখান থেকে সহজে জোগান আসত। আমাদের দেশেও প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বল্পমূল্য কিংবা বিনামূল্যে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় চাল-গম সরবরাহ করা হতো।
কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন। বিশ্ববাজারের ওপর নির্ভরতা যে দেশের যত বেশি, অস্থিতিশীল খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের বাজার তার জন্য তত সমস্যা সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের কৃষি ও খাদ্যনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এ বাস্তবতা বিবেচনায় রাখা চাই। আমাদের অবশ্যই চাল-আটা-ভোজ্যতেল-ডাল-চিনি প্রভৃতি পণ্যে যতটা সম্ভব স্বনির্ভরতার জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। একসময় আমরা এসব পণ্যে কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিলাম। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, আমাদের চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ এমনিতেই কম। ধান চাষের জমি বাড়ছে এবং এতে অন্যান্য ফসলের জন্য জমি কমে যাচ্ছে। আবার এ জমিতেই সড়ক নির্মাণ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানা স্থাপন করা হয়। তদুপরি বাড়ছে লোকসংখ্যা। এ কারণে জমি ক্রমাগত দুর্লভ হয়ে উঠছে। আমরা চাইলেই কৃষির সম্প্রসারণ করা যাবে না। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তাই জোর দিতে হবে দুটি বিষয়ের ওপর : এক. প্রযুক্তি ব্যবহার। দুই. কম সময়ে ফসল তোলা। একই জমিতে বছরে কয়েক ধরনের ফসল যাতে ফলানো যায়, সেটা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের কৃষিতে প্রতিবছর কিছু পরিমাণ অর্থ সরকার থেকে ভর্তুকি দেওয়া হয়। মোট বাজেটের তুলনায় এর পরিমাণ তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। বিভিন্ন মহল থেকে কৃষি খাতে ভর্তুকি বাড়ানোর দাবি করা হয়। অর্থমন্ত্রী তা রক্ষা করতে পারেন, এমন বলা যাবে না। বাজেটের আকার সীমিত হওয়াই এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা। সরকারের অনেক অগ্রাধিকার থাকায় ইচ্ছা থাকলেও কিছু করার থাকে না।
কৃষিতে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তার বড় অংশ ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক সার এবং অন্যান্য উপকরণ খাতে। উচ্চফলনশীল জাতের ধানের চাষ শুরুর পর থেকে জমিতে ইউরিয়া ও অন্যান্য সার ব্যবহার প্রতিবছর বেড়েছে। সেচের আওতাধীন জমিও বাড়ছে। আরও রয়েছে কীটনাশক ও অন্যান্য রাসায়নিকের ব্যবহার। আশির দশকে বাংলাদেশে নিজস্ব কারখানায় ইউরিয়া সারের উৎপাদন শুরু হয়। তখন দাম ছিল তুলনামূলক কম। তবে এ সারের ব্যবহার বাড়তে থাকায় প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিও করতে হচ্ছে। এটাও লক্ষণীয় যে, বিশ্ববাজারে এ পণ্যের দাম জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ_ তেলের দাম বাড়লে সারের দাম বাড়ে। অন্যদিকে, আমাদের সরকারের নীতি হচ্ছে কৃষকদের তুলনামূলক কম দামে সার সরবরাহ করা। এ কারণে তারা দুটি পদক্ষেপ নেয় : এক. বাজারে সারের বিক্রয়মূল্য বেঁধে দেওয়া। দুই. ভর্তুকি দেওয়া। কৃষি খাতের জন্য নির্ধারিত ভর্তুকির অর্থের বড় অংশই তাতে ব্যয় হয়ে যায়। এটাও লক্ষণীয় যে, ভর্তুকি বাবদ যে অর্থ দেওয়া হয়, তা সার ব্যবহারকারী ধনী-দরিদ্র সব কৃষক সমহারে পেয়ে থাকেন। সরকার বিষয়টি ভিন্নভাবে বিবেচনা করতে পারে। আমাদের দেশে কৃষকদের মধ্যে দরিদ্রের সংখ্যাই বেশি। মোটামুটি এক কোটি কৃষক রয়েছেন, যাদের প্রত্যেকের জমির পরিমাণ এক একরের কম। সরকার তাদের প্রত্যেককে প্রতিবছর ২৫ কেজি করে ইউরিয়া সার বিনামূল্যে বিতরণ করতে পারে। তাতে বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী ভর্তুকি লাগবে ৭৫০ কোটি টাকার মতো। ৫০ কেজিদরে সার বিনামূল্যে দিলে অর্থের প্রয়োজন পড়বে দেড় হাজার কোটি টাকা। সরকার এটাও করতে পারে, ধনী-দরিদ্র সব কৃষককে ২৫ কেজি সার বিনামূল্যে দেবে। এর অতিরিক্ত সার যার যতটা প্রয়োজন পড়বে, বাজার থেকে তা কিনে নেবেন। এ অবস্থায় বাজারে সরকার আর দাম নির্ধারণ করে দেবে না। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা দেশ ও বিদেশের বাজার থেকে সার সংগ্রহ এবং খোলাবাজারে তা বিক্রি করবেন। বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়লে সার সংগ্রহ ও বিতরণকাজে যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মীকে বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে, তারও প্রয়োজন পড়বে না। এভাবে দেখা যাবে, ঢালাও ভর্তুকি দেওয়ার জন্য সরকারের যা ব্যয় পড়ে, তার তুলনায় কম ব্যয় হবে।
কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়ার জন্য সরকারের সামনে কিন্তু অনেক খাত পড়ে আছে। শুরুতেই জমির স্বল্পতা এবং কৃষিপণ্যের বিপুল চাহিদাজনিত কারণে উৎপাদন বাড়ানোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। কৃষকরা যাতে আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক চাষাবাদে আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারেন, সে জন্য এর সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ জন্য সরকারের অর্থ ব্যয় বাড়াতে হবে। কৃষকদের কাছে প্রযুক্তি বোধগম্য করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলও সরকারকে বাড়াতে হবে। সেচের জন্য অতীতে নদ-নদী-খালের পানির ব্যবহার হতো বেশি। তারপর এলো ভূগর্ভ থেকে পানি তোলার যন্ত্র। এর প্রভাবে উৎপাদন বেড়েছে, একই সঙ্গে ভূমিধসের শঙ্কা বেড়েছে। পরিবেশে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। এখন সব মহল থেকেই মাটির ওপরের অর্থাৎ নদী-খালের পানির ব্যবহার বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য কৃষকদের অর্থের জোগান দিতে পারে সরকার। রাসায়নিক সারে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তা এভাবে ভিন্নমুখী করা হতে থাকলে আখেরে অর্থনীতিরই বেশি লাভ। এখন সেচকাজে কৃষকরা নিজস্ব অর্থ ব্যয় করেন। ডিজেলে কিছু ভর্তুকি সরকার দিয়ে থাকে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তার পরিমাণ তেমন বেশি নয়। সেচের জন্য খাল-নদীর পানির ব্যবহার বাড়াতে হলে সরকারকে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ-সংস্কারের প্রতি অধিক মনোযোগ দিতে হবে। বড় বড় নদী ড্রেজিংয়ে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। তিস্তা ও গঙ্গা-কপোতাক্ষ ব্যারাজের মতো প্রকল্পও সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বছর পর সরকার ড্রেজার-বহরে নতুন কয়েকটি যন্ত্র সংগ্রহ করছে। কিন্তু খাল ও ছোট নদ-নদী সংস্কারের জন্য চাই ভিন্ন ধরনের প্রকল্প। এগুলোতে সারাবছর পানি থাকলে কৃষকদের সেচের জন্য ব্যয় কমে আসবে। এ খাতে সরকার ভর্তুকি জোগান দিলে সারের ওপর ভর্তুকির তুলনায় বরং বেশি লাভ এনে দিতে পারে। এলজিইডি ছোট ও বড় নদীর সংযোগস্থলে পানি সরবরাহ নিশ্চিত রাখার জন্য রাবার ড্যাম প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছোট নদীগুলোতে পানি ধরে রাখা। এতে কৃষকরা সারাবছর সেচের সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। এ ধরনের উৎস থেকে পানি ব্যবহারের জন্য সরকার ডিজেলে ভর্তুকি দেওয়ার কথা ভাবতে পারে। এখন বিপুলসংখ্যক কৃষকের নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও কার্ড রয়েছে। সরকারের এটাও জানার কথা, স্বল্প জমির মালিক কারা। জমির মালিকানা অনুযায়ী ভর্তুকির অর্থ বণ্টনের নিয়ম চালু করাই ভালো হবে।
ভর্তুকির জন্য আরও কিছু খাত সরকার বিবেচনা করতে পারে। যেমন_ উপকূল এলাকায় লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধানের চাষ শুরু হয়েছে। কোথাও কোথাও সূর্যমুখী ফুলের চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ থেকে যে তেল পাওয়া যায়, তা কোলেস্টেরলমুক্ত হওয়ায় বাজারে সয়াবিন তেলের চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হয়। অনেক এলাকায় চাষিরা সরিষার তেলের ঘানি ব্যবহার করে সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল বের করে নিতে পারছেন। এ ধরনের উদ্যোগে সরকার সহায়তা দিলে ভোজ্যতেলের ওপর বিদেশনির্ভরতা কমবে। চিনিও একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হতে পারে। আখের চাষ এখন আর কৃষকদের জন্য লাভজনক বিবেচনা হয় না। আমরা দেখেছি, সুগার বিট উৎপাদনে আখের চেয়ে সময় কম দরকার পড়ে, কিন্তু উৎপাদন হয় বেশি। এখন সরকার দুটি কাজ করতে পারে : এক. সুগার বিট চাষে আগ্রহী কৃষকদের আর্থিক ও প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়া এবং দুই. সুগার বিট থেকে চিনি আহরণের জন্য কারখানা স্থাপন। উভয় ক্ষেত্রেই সরকারের দিক থেকে ভর্তুকি জোগানোর দাবি সঙ্গত।
কৃষি গবেষণাও সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাত। নিরন্তর গবেষণা এবং তার সুফল কৃষিতে কাজে লাগানোর বিকল্প নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন কৃষি নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে। তার সুফল আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য আমাদের মিড লেভেলের গবেষকদের উপযুক্ত স্থানগুলোতে পাঠানো দরকার। কোথায় পিএইচডি করা আমাদের জন্য বেশি লাভ, সেটাও বুঝতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ও পরিবেশের সঙ্গে মিল রয়েছে_ এমন দেশ বাছাই করা গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোর তুলনায় আমাদের মতো আর্থ-সামাজিক ও জলবায়ুর মিল ফিলিপাইনে অনেক বেশি। আমাদের এখানে যেসব কৃষিপণ্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, সেগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষিতে এখন নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে। গবেষণায় তার প্রতিও জোর দেওয়া চাই। কোথায় কী কাজ হচ্ছে, সেটা জানার চেষ্টা করতে হবে। ধান ও আলুর জিনরহস্য অন্য দেশে উদ্ভাবন হয়েছে। আমাদের এখন প্রয়োজন এ উদ্ভাবন কাজে লাগানোর জন্য এখানে সুযোগ সৃষ্টি। আর আমাদের বিজ্ঞানীরাই করেছেন পাটের জিনরহস্য উন্মোচন। এর সুফল যাতে দ্রুত কাজে লাগানো যায়, সে জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণাকাজে জোগাতে হবে অর্থ।
সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে টেস্ট কৃষি প্লট চালুর জন্যও সহায়তা দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি বড় প্লটের নানা অংশে চাষ হবে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য। কৃষকরা তা দেখে এবং উপযোগিতা জেনে নিয়ে নিজের পছন্দের ফসল ও চাষাবাদের পদ্ধতি বেছে নেবেন।
কৃষিতে ভর্তুকির অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার নিয়ে আমাদের এখন নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। সার ও অন্যান্য উপকরণে সরকার দরিদ্র কৃষকদের ভর্তুকি দিতেই পারে। মঙ্গাপ্রবণ এলাকা, চর, উপকূল এলাকা সরকারের জন্য বাড়তি মনোযোগের বিষয় হতে পারে। তবে ঢালাওভাবে ভর্তুকি না দিয়ে সরকারকে অগ্রাধিকার চিহ্নিত করতে হবে। বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যচিত্র ভালো নয়। অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলেও মনে হয় না। জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকায় উন্নত দেশগুলো এখন বায়োফুয়েলে মনোযোগ বাড়াচ্ছে। এতে সেসব দেশ থেকে সস্তায় খাদ্য কেনার সুযোগ ক্রমেই সীমিত হবে। এখন আমাদের জোর দিতে হবে নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার প্রতি। ভর্তুকিনীতিও হতে হবে এর সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে। শুধু কিছু অর্থ বিতরণ করাই যথেষ্ট নয়, আমাদের সীমিত সামর্থ্য থেকে নিয়ে আসতে হবে সর্বোত্তম রিটার্ন।
ড. মাহবুব হোসেন : অর্থনীতিবিদ এবং প্রধান নির্বাহী, ব্র্যাক
আমাদের কৃষিতে প্রতিবছর কিছু পরিমাণ অর্থ সরকার থেকে ভর্তুকি দেওয়া হয়। মোট বাজেটের তুলনায় এর পরিমাণ তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। বিভিন্ন মহল থেকে কৃষি খাতে ভর্তুকি বাড়ানোর দাবি করা হয়। অর্থমন্ত্রী তা রক্ষা করতে পারেন, এমন বলা যাবে না। বাজেটের আকার সীমিত হওয়াই এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা। সরকারের অনেক অগ্রাধিকার থাকায় ইচ্ছা থাকলেও কিছু করার থাকে না।
কৃষিতে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তার বড় অংশ ব্যবহার করা হয় রাসায়নিক সার এবং অন্যান্য উপকরণ খাতে। উচ্চফলনশীল জাতের ধানের চাষ শুরুর পর থেকে জমিতে ইউরিয়া ও অন্যান্য সার ব্যবহার প্রতিবছর বেড়েছে। সেচের আওতাধীন জমিও বাড়ছে। আরও রয়েছে কীটনাশক ও অন্যান্য রাসায়নিকের ব্যবহার। আশির দশকে বাংলাদেশে নিজস্ব কারখানায় ইউরিয়া সারের উৎপাদন শুরু হয়। তখন দাম ছিল তুলনামূলক কম। তবে এ সারের ব্যবহার বাড়তে থাকায় প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিও করতে হচ্ছে। এটাও লক্ষণীয় যে, বিশ্ববাজারে এ পণ্যের দাম জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ_ তেলের দাম বাড়লে সারের দাম বাড়ে। অন্যদিকে, আমাদের সরকারের নীতি হচ্ছে কৃষকদের তুলনামূলক কম দামে সার সরবরাহ করা। এ কারণে তারা দুটি পদক্ষেপ নেয় : এক. বাজারে সারের বিক্রয়মূল্য বেঁধে দেওয়া। দুই. ভর্তুকি দেওয়া। কৃষি খাতের জন্য নির্ধারিত ভর্তুকির অর্থের বড় অংশই তাতে ব্যয় হয়ে যায়। এটাও লক্ষণীয় যে, ভর্তুকি বাবদ যে অর্থ দেওয়া হয়, তা সার ব্যবহারকারী ধনী-দরিদ্র সব কৃষক সমহারে পেয়ে থাকেন। সরকার বিষয়টি ভিন্নভাবে বিবেচনা করতে পারে। আমাদের দেশে কৃষকদের মধ্যে দরিদ্রের সংখ্যাই বেশি। মোটামুটি এক কোটি কৃষক রয়েছেন, যাদের প্রত্যেকের জমির পরিমাণ এক একরের কম। সরকার তাদের প্রত্যেককে প্রতিবছর ২৫ কেজি করে ইউরিয়া সার বিনামূল্যে বিতরণ করতে পারে। তাতে বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী ভর্তুকি লাগবে ৭৫০ কোটি টাকার মতো। ৫০ কেজিদরে সার বিনামূল্যে দিলে অর্থের প্রয়োজন পড়বে দেড় হাজার কোটি টাকা। সরকার এটাও করতে পারে, ধনী-দরিদ্র সব কৃষককে ২৫ কেজি সার বিনামূল্যে দেবে। এর অতিরিক্ত সার যার যতটা প্রয়োজন পড়বে, বাজার থেকে তা কিনে নেবেন। এ অবস্থায় বাজারে সরকার আর দাম নির্ধারণ করে দেবে না। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা দেশ ও বিদেশের বাজার থেকে সার সংগ্রহ এবং খোলাবাজারে তা বিক্রি করবেন। বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়লে সার সংগ্রহ ও বিতরণকাজে যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মীকে বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে, তারও প্রয়োজন পড়বে না। এভাবে দেখা যাবে, ঢালাও ভর্তুকি দেওয়ার জন্য সরকারের যা ব্যয় পড়ে, তার তুলনায় কম ব্যয় হবে।
কৃষিতে ভর্তুকি দেওয়ার জন্য সরকারের সামনে কিন্তু অনেক খাত পড়ে আছে। শুরুতেই জমির স্বল্পতা এবং কৃষিপণ্যের বিপুল চাহিদাজনিত কারণে উৎপাদন বাড়ানোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। কৃষকরা যাতে আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক চাষাবাদে আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারেন, সে জন্য এর সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এ জন্য সরকারের অর্থ ব্যয় বাড়াতে হবে। কৃষকদের কাছে প্রযুক্তি বোধগম্য করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলও সরকারকে বাড়াতে হবে। সেচের জন্য অতীতে নদ-নদী-খালের পানির ব্যবহার হতো বেশি। তারপর এলো ভূগর্ভ থেকে পানি তোলার যন্ত্র। এর প্রভাবে উৎপাদন বেড়েছে, একই সঙ্গে ভূমিধসের শঙ্কা বেড়েছে। পরিবেশে পড়ছে বিরূপ প্রভাব। এখন সব মহল থেকেই মাটির ওপরের অর্থাৎ নদী-খালের পানির ব্যবহার বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য কৃষকদের অর্থের জোগান দিতে পারে সরকার। রাসায়নিক সারে যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তা এভাবে ভিন্নমুখী করা হতে থাকলে আখেরে অর্থনীতিরই বেশি লাভ। এখন সেচকাজে কৃষকরা নিজস্ব অর্থ ব্যয় করেন। ডিজেলে কিছু ভর্তুকি সরকার দিয়ে থাকে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তার পরিমাণ তেমন বেশি নয়। সেচের জন্য খাল-নদীর পানির ব্যবহার বাড়াতে হলে সরকারকে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ-সংস্কারের প্রতি অধিক মনোযোগ দিতে হবে। বড় বড় নদী ড্রেজিংয়ে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। তিস্তা ও গঙ্গা-কপোতাক্ষ ব্যারাজের মতো প্রকল্পও সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বছর পর সরকার ড্রেজার-বহরে নতুন কয়েকটি যন্ত্র সংগ্রহ করছে। কিন্তু খাল ও ছোট নদ-নদী সংস্কারের জন্য চাই ভিন্ন ধরনের প্রকল্প। এগুলোতে সারাবছর পানি থাকলে কৃষকদের সেচের জন্য ব্যয় কমে আসবে। এ খাতে সরকার ভর্তুকি জোগান দিলে সারের ওপর ভর্তুকির তুলনায় বরং বেশি লাভ এনে দিতে পারে। এলজিইডি ছোট ও বড় নদীর সংযোগস্থলে পানি সরবরাহ নিশ্চিত রাখার জন্য রাবার ড্যাম প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছোট নদীগুলোতে পানি ধরে রাখা। এতে কৃষকরা সারাবছর সেচের সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। এ ধরনের উৎস থেকে পানি ব্যবহারের জন্য সরকার ডিজেলে ভর্তুকি দেওয়ার কথা ভাবতে পারে। এখন বিপুলসংখ্যক কৃষকের নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও কার্ড রয়েছে। সরকারের এটাও জানার কথা, স্বল্প জমির মালিক কারা। জমির মালিকানা অনুযায়ী ভর্তুকির অর্থ বণ্টনের নিয়ম চালু করাই ভালো হবে।
ভর্তুকির জন্য আরও কিছু খাত সরকার বিবেচনা করতে পারে। যেমন_ উপকূল এলাকায় লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধানের চাষ শুরু হয়েছে। কোথাও কোথাও সূর্যমুখী ফুলের চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ থেকে যে তেল পাওয়া যায়, তা কোলেস্টেরলমুক্ত হওয়ায় বাজারে সয়াবিন তেলের চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হয়। অনেক এলাকায় চাষিরা সরিষার তেলের ঘানি ব্যবহার করে সূর্যমুখীর বীজ থেকে তেল বের করে নিতে পারছেন। এ ধরনের উদ্যোগে সরকার সহায়তা দিলে ভোজ্যতেলের ওপর বিদেশনির্ভরতা কমবে। চিনিও একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হতে পারে। আখের চাষ এখন আর কৃষকদের জন্য লাভজনক বিবেচনা হয় না। আমরা দেখেছি, সুগার বিট উৎপাদনে আখের চেয়ে সময় কম দরকার পড়ে, কিন্তু উৎপাদন হয় বেশি। এখন সরকার দুটি কাজ করতে পারে : এক. সুগার বিট চাষে আগ্রহী কৃষকদের আর্থিক ও প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়া এবং দুই. সুগার বিট থেকে চিনি আহরণের জন্য কারখানা স্থাপন। উভয় ক্ষেত্রেই সরকারের দিক থেকে ভর্তুকি জোগানোর দাবি সঙ্গত।
কৃষি গবেষণাও সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাত। নিরন্তর গবেষণা এবং তার সুফল কৃষিতে কাজে লাগানোর বিকল্প নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন কৃষি নিয়ে প্রচুর কাজ হচ্ছে। তার সুফল আমাদের কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য আমাদের মিড লেভেলের গবেষকদের উপযুক্ত স্থানগুলোতে পাঠানো দরকার। কোথায় পিএইচডি করা আমাদের জন্য বেশি লাভ, সেটাও বুঝতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ও পরিবেশের সঙ্গে মিল রয়েছে_ এমন দেশ বাছাই করা গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোর তুলনায় আমাদের মতো আর্থ-সামাজিক ও জলবায়ুর মিল ফিলিপাইনে অনেক বেশি। আমাদের এখানে যেসব কৃষিপণ্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, সেগুলোকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষিতে এখন নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে। গবেষণায় তার প্রতিও জোর দেওয়া চাই। কোথায় কী কাজ হচ্ছে, সেটা জানার চেষ্টা করতে হবে। ধান ও আলুর জিনরহস্য অন্য দেশে উদ্ভাবন হয়েছে। আমাদের এখন প্রয়োজন এ উদ্ভাবন কাজে লাগানোর জন্য এখানে সুযোগ সৃষ্টি। আর আমাদের বিজ্ঞানীরাই করেছেন পাটের জিনরহস্য উন্মোচন। এর সুফল যাতে দ্রুত কাজে লাগানো যায়, সে জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণাকাজে জোগাতে হবে অর্থ।
সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে টেস্ট কৃষি প্লট চালুর জন্যও সহায়তা দিতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি বড় প্লটের নানা অংশে চাষ হবে বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য। কৃষকরা তা দেখে এবং উপযোগিতা জেনে নিয়ে নিজের পছন্দের ফসল ও চাষাবাদের পদ্ধতি বেছে নেবেন।
কৃষিতে ভর্তুকির অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার নিয়ে আমাদের এখন নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। সার ও অন্যান্য উপকরণে সরকার দরিদ্র কৃষকদের ভর্তুকি দিতেই পারে। মঙ্গাপ্রবণ এলাকা, চর, উপকূল এলাকা সরকারের জন্য বাড়তি মনোযোগের বিষয় হতে পারে। তবে ঢালাওভাবে ভর্তুকি না দিয়ে সরকারকে অগ্রাধিকার চিহ্নিত করতে হবে। বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যচিত্র ভালো নয়। অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে বলেও মনে হয় না। জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকায় উন্নত দেশগুলো এখন বায়োফুয়েলে মনোযোগ বাড়াচ্ছে। এতে সেসব দেশ থেকে সস্তায় খাদ্য কেনার সুযোগ ক্রমেই সীমিত হবে। এখন আমাদের জোর দিতে হবে নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার প্রতি। ভর্তুকিনীতিও হতে হবে এর সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে। শুধু কিছু অর্থ বিতরণ করাই যথেষ্ট নয়, আমাদের সীমিত সামর্থ্য থেকে নিয়ে আসতে হবে সর্বোত্তম রিটার্ন।
ড. মাহবুব হোসেন : অর্থনীতিবিদ এবং প্রধান নির্বাহী, ব্র্যাক
No comments