গণতন্ত্রের পথঘাট by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

গণতন্ত্রে পথঘাট যে মোটেই মসৃণ নয়, বরং আগাগোড়াই এবড়োখেবড়ো ও বিঘ্নসংকুল, সেটা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে। পৃথিবীজুড়ে মানুষ সেটা বুঝতে পারছে, বুঝতে হচ্ছে আমাদেরও। কিন্তু আসল সমস্যাটা কী? সেটা কোথায়? গণতন্ত্রের জন্য এত যে আকাঙ্ক্ষা, তাকে আনার ব্যাপারে এমন যে সাধ্যসাধনা, তবু গণতন্ত্র আসে না কেন? বলা যাবে


এবং বলা হয়, বলা প্রসঙ্গত নয় যে গণতন্ত্রের পথে বাধা ও বিঘ্ন একটা নয়, অনেকটা। যেমন পরমতসহিষ্ণুতার অভাব। পরমতসহিষ্ণুতা তো গণতন্ত্রের একটি প্রাথমিক শর্ত। আমরা কেউ কাউকে সহ্য করব না, ঝগড়া-ফ্যাসাদ লাগিয়েই রাখব- এ রকম অবস্থা হলে গণতন্ত্র তো আসবে না। তার সামনে বিপদ আছে এমনটা বুঝে সে পালাবে এবং ওই যে সহিষ্ণুতার অভাব, তার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত, এতেও কোনো সন্দেহ নেই। বলা যায়, জড়িত হচ্ছে সংস্কৃতি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি না থাকলে গণতন্ত্র যে পাওয়া যাবে- এ বড়ই দুরাশা। আর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ব্যাপারটাও সোজা জিনিস নয়; কোনো কিছুর লেজ নয় সে, আস্ত দেহ বটে; কিন্তু প্রাণিদেহের লেজের মতোই অসরল ও চঞ্চল। তাকে সোজা করাও কঠিন। কেননা সংস্কৃতির ভেতর শিক্ষা, সভ্যতা, ইতিহাস, ধর্ম, ভাষা, এমনকি প্রকতিও রয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়তে হলে তাই অনেক কিছুতেই হাত দিতে হবে। আমাদের দেশের নিজেদের সংস্কৃতি তো অবশ্যই অগণতান্ত্রিক। হবে না কেন? এখানে মানুষ দরিদ্র, অদৃষ্টবাদী, অশিক্ষা ও কুশিক্ষায় নিমজ্জিত, উদাসীন, বিশ্বাসী হয়েও অবিশ্বাসী, বেশ ভালো রকমের চরমপন্থী ইত্যাদি ইত্যাদি। গণতান্তিক সংস্কৃতির জন্য যা যা উপাদান আবশ্যক, তার প্রায় সবটাই এখানে অনুপস্থিত।
অন্য সব বিঘ্নের কথা না হয় বাদই দিলাম। তাদের অধিকাংশই অত্যন্ত গভীর ও দুরপনেয়; খুবই সহজ যে ব্যাপার অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, সেটাই নিয়ে বিতর্ক। অভাব হলো সদিচ্ছার। সদিচ্ছা থাকলেই ভোটের আয়োজন যথার্থ হতে পারে। তবে কেবল সদিচ্ছা থাকাটাই যে যথেষ্ট, তেমনটাও ভাবা যাচ্ছে না। কেউ কেউ বলছেন।
ভোট গ্রহণের না হয় আদর্শ ব্যবস্থাপনা কায়েম করা গেল, এমনকি অকল্পনীয় রকমের সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন ঘটে গেল, তাহলেই কি আমরা গণতন্ত্র পেয়ে যাব? নির্বাচিত সরকার কি স্বৈরাচারী হয় না? আর সেই সরকার যদি বিপুল ভোটে জয় হয়, তাহলে জনমতকে সে কিভাবে পদদলিত করতে পারে, তার দৃষ্টান্ত দেখার জন্য আমাদের নিজেদের দেশের দিকে তাকাতে হবে কেন। আধুনিক গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে গৌরবান্বিত যে গ্রেট ব্রিটেন, সেখানেই কি আমরা তা অনায়াসে দেখতে পাব না? ইরাকে গিয়ে মানুষ মারার সরকারি কাজটা ব্রিটেনের অধিকাংশ মানুষই পছন্দ করেনি, তাই বলে টনি ব্লেয়ারের কি কোনো অসুবিধা হয়েছিল তাঁর তৎপরতা চালাতে?
না, নির্বাচন মানেই যে গণতন্ত্র, নির্বাচিত সরকার মানেই যে গণতান্ত্রিক- এমন কথা কেউ বলবে না, বলার উপায় নেই। নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র খুবই সম্ভব ঘটনা এবং তেমন স্বৈরতন্ত্র নিজেকে বৈধ বলে বিশ্বাস করে দাম্ভিকতায় অনির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। হিটলার, মুসোলিনি- এঁরা অনির্বাচিত ছিলেন না। হ্যাঁ, গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন দরকার, কিন্তু নির্বাচনের আভা দেখেই গণতান্ত্রিক সূর্যোদয়ের প্রত্যাশা করাটা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। গণতন্ত্রের জন্য আরো অনেক কিছু দরকার। সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার, সেটাকে বুঝতে ও চিনতে হলে অর্ধসত্য দ্বারা বিভ্রান্ত হব না- এ রকমের একটি মনোভাব আবশ্যক। আর ওই যে অত্যাবশ্যক উপাদানটাকে চিহ্নিত করা, সে কাজ মোটেই জটিল থাকবে না, বরং খুবই সরল ও সহজ হয়ে যাবে, যদি গণতন্ত্র জিনিসটা কী সেটা পরিষ্কার করে নিই। একেবারেই অল্প কথায় বলতে গেলে বলা যাবে, গণতন্ত্র হলো সেই রকমের ব্যবস্থা, যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য রয়েছে। কেবল অধিকার নয়, সুযোগেরও। সমান অধিকারের কথা সংবিধানে লেখা থাকলে চলবে না, তাকে কার্যক্ষেত্রে প্রতিফলিত হতে হবে। গণতন্ত্র কেবল রাষ্ট্রের ব্যাপার নয়, সমাজেরও ব্যাপার বৈকি। অধিকার ও সুযোগের সাম্য যদি সমাজে না থাকে, তাহলে রাষ্ট্রে তাকে পাওয়া যাবে না, আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা আছে, তারা যদি সাম্যের ওই আদর্শে বিশ্বাসী না হয়, তারা যদি লালন-পালন ও প্রয়োগ ঘটায় বৈষম্যের, তাহলে সমাজে সাম্য থাকবে না। কেননা রাষ্ট্র ও সমাজ পরস্পরের অনুপ্রবিষ্ট বৈকি।
গণতন্ত্রের জন্য অনেক কিছু চাই। কিন্তু অন্য সবই হচ্ছে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। গণতন্ত্রের প্রাণ থাকে ওই এক জায়গাতেই, আর সেটা হলো সাম্য। সাম্য যেখানে যত কম, গণতন্ত্রের পথঘাট সেখানে তত বেশি বিঘ্নসংকুল। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলতে যা বুঝি, তাতে বহু ও নানা উপাদান থাকা অত্যাবশ্যক; কিন্তু ওটাই মেরুদণ্ড, যেটা না থাকলে অন্য সব কিছু ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য, তা যেমনভাবেই তাদের জড়ো করা এবং সাজানো হোক না কেন। আর এই যে সাম্য, তা কোনো এক জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, একে ব্যাপ্ত হতে হবে সর্বত্র, রাষ্ট্রে ও সমাজে তো বটেই, পরিবারেও। গণতন্ত্র এক ও অবিভাজ্য; তাকে টুকরো টুকরো করা যায় না কিংবা আলাদাভাবে যে পাওয়া যাবে তাও নয়। গণতন্ত্রের এমন বিবরণ শুনলে মনে হতে পারে, কোনো কল্পলোকের কথা বলছি বুঝি। তা প্রকৃত গণতন্ত্রের একটা আদর্শ বটে; এবং তাকে বাস্তবায়ন করতে হলে মানুষে-মানুষে বৈষম্য কমাতে হবে বৈকি। বৈষম্য যত কমবে, গণতন্ত্রও তত এগিয়ে আসবে। উল্টোটা করলে ঘটবে বিপরীত ঘটনা।
বাংলাদেশে বৈষম্য বৃদ্ধি এবং গণতন্ত্রে আগমন-সম্ভাবনা যে পরস্পরবিরোধী, তা প্রমাণিত হচ্ছে। আমাদের যেসব বিজ্ঞ বন্ধু বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে, যদি সদিচ্ছা থাকে, তাঁরা কার সদিচ্ছার কথা ভাবছেন, সেটা পরিষ্কার হয় না। ভোটারদের সদিচ্ছার ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহেরই অবকাশ নেই, তাঁরা তো চাইবেনই যথার্থ প্রতিনিধি নির্বাচন করতে। সমস্যা হচ্ছে ভোট প্রার্থীদের নিয়ে। গণ্ডগোল এঁরাই পাকান। প্রার্থীরা প্রার্থী হয়েছেন বা হচ্ছেন জনগণের সেবা করার নির্মল আদর্শবোধ থেকে নয়, ক্ষমতা ও টাকা দুটোই লাভ করবেন- এ আশাতেই। ভোটযুদ্ধ আসলে টাকার যুদ্ধ, তার চেয়ে কম কিছু নয়, বেশিও কিছু নয়। ভয়ংকর এই যুদ্ধে সদিচ্ছার জন্য কোনো জায়গাজমিন খোলা নেই, এখানে সবটাই বদিচ্ছা। কোটিপতি না হলে এ যুদ্ধে কেউ নামতে সাহস পায় না, জেতা তো অনেক দূরের কথা। গণতন্ত্র এখানে বঞ্চিত জনগণের অধিকার নয়, ধনাঢ্যদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সম্পত্তি বটে। ধনবৈষম্যের বাস্তবতা বাংলাদেশের নির্বাচনে যেমন নির্লজ্জভাবে উন্মোচিত হয়ে পড়ে, তেমনটা অন্য কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
এই যে ধনী ব্যক্তিরা যাঁরা দাঁড়ান, তাঁদের কেউ নির্বাচিত হন, কেউ হন না; যাঁরা হন তাঁরা উল্লাস করেন, যাঁরা হন না তাঁরা নির্বাচিতদের টেনে নামানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এঁরা এক দলের লোক নন, কিন্তু এক শ্রেণীর লোক বটে। আর সেটি হচ্ছে দেশের শাসকশ্রেণী। শাসকশ্রেণীই শাসন করে, অন্যরা সেখানে ঢুকতে পারে না। এই শ্রেণী এদল-ওদলে বিভক্ত, তাঁদের রাজনৈতিক পোশাক আলাদা, আওয়াজ ভিন্ন, কিন্তু আসলে সবাই তাঁরা এক, তাঁরা শাসক। বাংলাদেশের সামনে এখন নানা সমস্যা। দারিদ্র্য, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, বেকারত্ব, বিনিয়োগের অভাব- সব কিছুই মস্ত মস্ত সমস্যা বটে। গণতন্ত্রের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক যে বৈষম্য, দেশের শাসকশ্রেণী তার যেমন প্রতিনিধি, তেমনি রক্ষাকর্তা। পুঁজিবাদীরাই গণতন্ত্রের নামে বাগাড়ম্বর করে থাকে। পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রধান নিয়ন্ত্রক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন দায়িত্ব নিয়েছে সারা পৃথিবীকে গণতান্ত্রিক করে ছাড়বে। যেখানে গন্ধ পাবে গণতন্ত্র নেই, সেখানেই গিয়ে হানা দেবে। ধনী দেশের কথা আলাদা। মধ্যপ্রাচ্যে এমন দেশ আছে, যেখানে কোনো ধরনের গণতন্ত্র নেই। কোথাও রয়েছে রাজতন্ত্র, কোথাও বা একনায়কতন্ত্র। সেসব দেশ মাফ পেয়ে যাবে, কিন্তু আফগানিস্তান বা ইরাকের মতো বৈরীভাবাপন্ন দেশের জন্য কোনো ক্ষমা নেই, সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে তবে ছাড়বে (তা তো করেছেও)।
শাসকশ্রেণী আগেও ছিল। সেটা বিদেশি। তার জায়গায় স্বদেশি শাসক পাওয়া গেল। পরিবর্তন এটাই। এতটুকুই। একেই বলা হলো স্বাধীনতা। আমরা যখন ব্রিটিশ শাসনে ছিলাম, ব্রিটেনে তখন নির্বাচন হতো, একদল ক্ষমতা থেকে সরে যেত, আরেক দল ক্ষমতায় আসত, কিন্তু তাতে উপমহাদেশের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটত না। পাকিস্তান আমলেও দেখেছি, শাসকের দল বদল হয়েছে, কখনো রাজনীতিকরা শাসন করেছেন, কখনো আমলারা; কখনো বা সামরিক বাহিনীই নিয়ে নিয়েছে সব ক্ষমতা, এমনকি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীরা রাষ্ট্রক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে স্থান পেয়েছেন; কিন্তু সেসব ঘটনায় শাসক-শাসিতের সম্পর্কে কোনো রকমের বদল দেখা যায়নি, এবং শাসকশ্রেণীর যে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী চরিত্র, তাতেও বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। স্বাধীন তো হলো, কিন্তু গণতন্ত্রের তো খবর নেই। খবর না থাকার কারণ তো বোঝাই যায়। সেটা হলো এই যে, পুরনো শাসকরা চলে গেছেন, কিন্তু তার জায়গায় নতুন যাঁরা এসেছেন, তাঁরা ওই আগের শাসকদের মতোই। দৃষ্টিভঙ্গিতে পুঁজিবাদী। শাসক বদলেছে, শাসন বদলায়নি; হাকিম গেছে, হুকুম রেখে গেছে পেছনে। এই শাসকশ্রেণী পুরনো বৈষম্য কেবল যে টিকিয়ে রেখেছে তা নয়, তাকে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে তুলেছে। এমন অবস্থার ভেতরে বিজ্ঞ লোকেরা যখন বলেন, নির্বাচনব্যবস্থায় সংস্কার, সিভিল সোসাইটির সক্রিয় ভূমিকা, ক্ষুদ্রঋণের বিস্তার, এনজিওদের কর্মকাণ্ডের প্রসার ইত্যাদির মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্র আনবেন, তখন তাঁদের সরলতা দেখে সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে যেতে হয়। এঁরা কি বোঝেন না যে আসল সমস্যা হচ্ছে সেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাই- দারিদ্র্য, মানুষকে যা নিরাশ্রয় করছে, ধনী-দরিদ্র-নির্বিশেষ সবাইকে করে তুলছে বিচ্ছিন্ন ও ভোগবাদী, প্রসার ঘটাচ্ছে মৌলবাদের এবং নিরন্তর বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে বৈষম্যের?
পুঁজিবাদের পক্ষে প্রকৃত গণতন্ত্রের জন্য পথ করে দেওয়াটা আসলেই একটা স্বভাববিরুদ্ধ কাজ। কেননা পুঁজিবাদের প্রাথমিক কর্তব্যই হচ্ছে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি করা। চাপের মুখে পড়ে পুঁজিবাদ বড়জোর যা করতে পারে তা হলো ছাড় দেওয়া। ছাড় সে দিয়েছেও, কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ পুঁজিবাদকে নিয়ে হয়েছে। কিন্তু কল্যাণ রাষ্ট্র মানেই যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়, তা এখন পরীক্ষিত সত্য। সর্বাগ্রে প্রয়োজন হলো বৈষম্য নিরসনের তথা সমাজ পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন। এর কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের পথঘাট অমসৃণই রয়ে যাবে সমাজে, যদি মৌলিক পরিবর্তন না ঘটে, যদি না সাম্য আসে অধিকার ও সুযোগের।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.