ওয়াশিংটনের নির্দেশ অগ্রাহ্য করলেন ব্লাড
একাত্তরে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কেন্ট ব্লাড ২৫ মার্চের পরে বিপন্ন বাঙালিদের প্রতি গভীর
মমতা দেখিয়েছিলেন। ওয়াশিংটনের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে তিনি তাঁদের আশ্রয় দেন। এক স্কোয়াড বাঙালি পুলিশেরক
রাইফেল তিনি তাঁর বাসভবনের পেছনে মাটিতে পুঁতে রাখতে সহায়তা দেন।
মমতা দেখিয়েছিলেন। ওয়াশিংটনের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে তিনি তাঁদের আশ্রয় দেন। এক স্কোয়াড বাঙালি পুলিশেরক
রাইফেল তিনি তাঁর বাসভবনের পেছনে মাটিতে পুঁতে রাখতে সহায়তা দেন।
অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে তিনি
পুরোপুরি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। ১৯৮৯ সালে তিনি মার্কিন কথ্য ইতিহাসবিদ হেনরি প্রেখটকে দীর্ঘ
সাক্ষাৎকার দেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি চমকপ্রদ তথ্য দেন যে, পাকিস্তানি বাহিনী মার্কিন নাগরিকদের বাড়িতে ডাকাতি
করেছে। বন্দুকের মুখে এক মার্কিন নারীর ঘড়ি ছিনতাই করেছে। এমনকি একজন আক্রান্ত মার্কিন এক পাক
সেনাসদস্যকে গুলি করে হত্যা করেন। ব্লাডের মতে, ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পরপরই সংগঠিত গেরিলা আন্দোলন
দ্রুত দানা বাঁধে এবং তা ছড়িয়ে পড়ে। হেনরি প্রেখটের সাক্ষাৎকার অবলম্বনে ধারাবাহিক প্রতিবেদনটি লিখেছেন মিজানুর
রহমান খান
প্রেখট: ক্র্যাকডাউন আসলে কী ছিল? রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া এ ধরনের কিছু?
ব্লাড: ও, না না। ক্র্যাকডাউন ছিল ঢাকায় সামরিক সামর্থ্য রয়েছে এমন যেকোনো বাঙালি ইউনিট ধ্বংস করা। এর
মধ্যে ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস। তাদের কর্মকর্তারা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। কিন্তু সেনারা ছিল বাঙালি। আর ছিল
পুলিশ। তারা তাদের ব্যারাকে হামলা চালাল এবং সাধ্যমতো তাদের হত্যা করল।
প্রেখট: এবং এসবই বিনা উসকানিতে ঘটেছিল?
ব্লাড: একদম বিনা উসকানিতে ঘটেছিল। ছাত্ররা ওই সময় সভা-সমাবেশে সক্রিয় ছিল। তাই তাদের ওপরও হামলা
চলল। মেশিনগান মর্টার আঘাত হানল তাদের আবাসিক হলে। বিপুলসংখ্যক ছাত্রকে হত্যা করা হলো। আওয়ামী লীগের
সমর্থক সংবাদপত্র অফিসের সামনে ট্যাংক এল এবং ভবনটি ধ্বংস করা হলো।
প্রেখট: আর, আওয়ামী লীগের কী করল?
ব্লাড: খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য বিক্রি করতে যারা অস্বীকার করেছিল, সেসব বাজারও তারা ধ্বংস করল। বিশ্ববিদ্যালয়ে
তারা হিন্দু অধ্যাপকদের হত্যা করেছে। আমি দর্শনের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে জানতাম। তাঁর শরীরে কোনো
রাজনীতির লেশমাত্র ছিল না। আমি মনে করি তিনি শুধু একজন হিন্দু বলেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।
প্রেখট: আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের অবস্থা কী ছিল?
ব্লাড: মুজিবের মতো যাঁদেরই তারা পেয়েছে, তাঁদের গ্রেপ্তার করেছে। অন্যরা লুকিয়ে ছিলেন। অনেকেই পালাতে সক্ষম
হন।
প্রেখট: দূতাবাসের তৎপরতা কী ছিল? সামরিক কর্তৃপক্ষ কি আপনাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করেছিল? তারা কি আপনাদের
বাড়িতে থাকতে বলেছিল?
ব্লাড: কারফিউ ছিল। ৩৬ ঘণ্টার জন্য আমরা বের হতে পারিনি। আমরা রাতের বেলা ছাদে যেতাম এবং আমরা দেখতে
পেতাম লড়াই অব্যাহত রয়েছে। ট্যাংক ও মেশিনগানের গোলাবর্ষণ সহজেই শোনা যেত। দেখাও যেত। টেলিফোনের
সব লাইন কাটা হয়েছিল, যদিও পাকিস্তানিরা এ জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছিল। সৌভাগ্যবশত রেডিও
যোগাযোগ আমাদের ছিল। অফিস ও বাসা দুই স্থানেই ছিল। অন্তত তিন সপ্তাহ পর্যন্ত আমরা দূতাবাসের বাইরে যেতে
পারিনি। তিন সপ্তাহ বাদে তারা আমাকে একটি সামরিক টেলিফোনে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেয়।
ভাগ্যক্রমে আমাদের এখানে দূতাবাস থেকে ক্র্যাকডাউনের ঠিক একটু আগে একজন এয়ার অ্যাটাশে এসেছিলেন।
তাঁকে আমি ঢাকায় আসতে বলেছিলাম। তিনি থাকায় ২৫ মার্চ থেকে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সে বিষয়ে আমরা ভালো
রিপোর্ট করতে পেরেছিলাম। ওই সময় তিনি ছিলেন ঢাকায় একমাত্র মার্কিন সামরিক ব্যক্তি। ব্রিটিশদেরও দূরদর্শিতা
ছিল। তারাও একজন সামরিক ব্যক্তিকে ঢাকায় এনেছিল। সে কারণে যুদ্ধের প্রতিবেদন পাঠাতে তাদের পরামর্শ বেশ
সহায়ক হয়েছিল।
প্রেখট: এ সময় কি গেরিলা আন্দোলনকে সহায়তা দিতে ভারতীয়রা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল?
ব্লাড: না না। আমি মনে করি না যে তারা এর আগে সক্রিয় ছিল।
প্রেখট: ক্র্যাকডাউনের পর পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের দূতাবাস কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাল? আপনি আমাকে যা বলছেন
তখন দূতাবাসকেও জানিয়েছিলেন? তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
ব্লাড: তারা অবিশ্বাস করেছিল। তারা নিশ্চয়ই পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে বক্তব্য পেয়েছিল যে তেমন কিছুই ঘটেনি।
এবং তাদের এই অবিশ্বাস করার দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছুতেই ফুটে উঠেছিল। তাদের মন্তব্যে, ওয়াশিংটনে পাঠানো তাদের
বার্তায় যা ছিল খুবই হতাশাজনক। ডেপুটি চিফ অব মিশন ছিলেন সিড সোবার। আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম, এখনো
আছি। তিনি যখন প্রথম এলেন, সেটা আমি স্মরণ করতে পারি। এপ্রিলের শেষ দিকে পাকিস্তান সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে
নিল। আমি মুহূর্তেই নারী-শিশু এবং দরকারি নয় এমন কর্মচারীদের ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সিড
সোবারও বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ, কতিপয় বাঙালির কাছ থেকে তিনি শুনেছিলেন সত্যি তেমন কিছু ঘটেনি।
প্রাথমিক লড়াইটা টানা প্রায় দুই সপ্তাহ চলেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গেরিলাদের ভারত সীমান্ত পর্যন্ত ধাওয়া করে
নিল। গেরিলাদের কাছ থেকেই তারা সবচেয়ে সংগঠিত বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। আর তখনই একটি গেরিলা ধাঁচের
প্রতিরোধ ক্রমশ বেড়ে উঠল এবং তা ছড়িয়ে পড়ল। ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের আগেই বেশ কিছু বিদেশি জনগোষ্ঠীকে
ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। জাতিসংঘ, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান তাদের কমিউনিটিকে সরিয়ে নিয়েছিল।
প্রেখট: বিদেশিদের ওপর কি কোনো হামলা হয়েছিল?
ব্লাড: না। কিন্তু এই আশঙ্কা ছিল যে আমরা একটি গৃহযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছি। আমি প্রাথমিকভাবে দুই কারণে আমাদের
নাগরিকদের স্থানান্তরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলাম। এর একটা কারণ ছিল, আমি জানতাম পরিস্থিতি যদি আওয়ামী
লীগের নিয়ন্ত্রণে থাকে তাহলে মার্কিনদের কোনো বিপদ হবে না। তাদের সম্পর্কে মার্কিনদের অত্যন্ত উঁচু চিন্তাভাবনা
ছিল। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাব কেউ অনুভব করেনি। এ ছাড়া আমি অনুভব করেছিলাম যে আমরা যদি তাদের
স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিই, তাহলে তার অর্থ হবে আমরা একটি গৃহযুদ্ধ এবং একটি সংঘাতের অনিবার্যতা গ্রহণ করেছি।
আমাদের টিকে থাকা একধরনের সাক্ষ্য দেবে যে একটা শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির জন্য হয়তো কিছুটা সুযোগ অবশিষ্ট থাকবে।
প্রেখট: আপনার সহযোগী মার্কিনদের ঝুঁকিতে রাখার সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে আপনি কি বিব্রত ছিলেন?
ব্লাড: হ্যাঁ। সেটা ছিল খুবই গুরুতর দায়িত্বশীলতা। কারণ, আমাকে সিদ্ধান্ত দিতে হয়েছিল। তবে স্থানান্তরের বিষয়ে
মার্কিন কমিউনিটির কাছ থেকে আমি কোনো চাপের সম্মুখীন ছিলাম না।
প্রেখট: ওয়াশিংটনের মনোভাব কেমন ছিল? তারা কি চেয়েছিল যে আপনি এটা করবেন বা এটা করবেন না?
ব্লাড: না। আমাদের রাষ্ট্রদূত থাইল্যান্ডে গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। তিনি আমার কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন।
আমি তার মানে বুঝিনি। কিন্তু ক্র্যাকডাউনের পর পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে গেল। তখন ওয়াশিংটনের এটা বিশ্বাস
করতে কষ্ট হলো যে যখন গোটা পরিস্থিতি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কবজায় এল তখন মার্কিনদের বিপদে পড়ার
ঝুঁকি সৃষ্টি হলো। কিন্তু সেটাই ঘটেছিল।’
প্রেখট: এই বিপদ কার কাছ থেকে?
ব্লাড: পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে।
প্রেখট: ওহ, হ্যাঁ।
ব্লাড: আমি বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চাই। প্রথমেই বলব, পূর্ব পাকিস্তানে যেসব সেনা পাঠানো হয়েছিল, তারা
সেনাবাহিনীর নিয়মিত সদস্য ছিল না। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পাকিস্তানের এমন বাহিনী ছিল, যারা সম্মুখভাগে
যুদ্ধ করার সদস্য নয়। বহু ক্ষেত্রে ঢাকায় এসব সেনাসদস্য মার্কিনদের প্রতি বন্দুক তাক করেছিল। তারা এমন হুমকিও
দিয়েছিল যে তাদের অবিলম্বে হত্যা করা হবে। সে কারণেই আমি বলছি যে এই আধা শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা
আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াল। বহু ক্ষেত্রে ওই পাকিস্তানি সেনারা সন্ধ্যায় ব্যারাক ছেড়ে বেরিয়ে আসত এবং
মার্কিনদের বাড়িতে গিয়ে ডাকাতি করত। একটি ঘটনায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে এক মার্কিনের স্ত্রীর ঘড়ি কেড়ে নিল। অন্য
এক ঘটনায় এক মার্কিন আমার কাছে স্বীকার করলেন যে তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা
করেছিলেন। কারণ ওই সেনাটি তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল। তিনি ওই নিহত সেনাটিকে সমাধিস্থ করেন। এ ধরনের
ঘটনা ছিল গোড়াতেই। আমাদের কাছে বিপন্ন বাঙালি আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসছিলেন। বিশেষ করে হিন্দু বাঙালিরা
আমাদের কর্মচারীদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমরা সবাই যে যেভাবে পেরেছি, আশ্রয় দিয়েছি। আমি ওয়াশিংটন
থেকে একটি বার্তা পেলাম। তাতে বলা হয়েছে, তাঁরা শুনতে পেরেছেন আমরা এসব করে বেড়াচ্ছি। এসব যেন আমরা
না করি। আমি তাঁদের বললাম, আমরা সত্যি এসবই করছিলাম এবং তা অব্যাহতভাবে করে যাব। আমরা এসব
মানুষকে এড়াতে পারব না। তাঁরা রাজনৈতিক উদ্বাস্তু ছিলেন না। তাঁরা শুধুই দরিদ্র। অত্যন্ত নিম্নবর্গীয় মানুষ, অধিকাংশই
যাঁদের হিন্দু। তাঁরা অনেকেই শঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে তাঁরা শুধু হিন্দু বলেই তাঁদের হত্যা করা হবে।
প্রেখট: আপনার কি হিন্দু গৃহভৃত্য ছিল?
ব্লাড: আমাদের কয়েকজন ছিলেন। হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে আমাদের সঙ্গে অনেকেই ছিলেন। তাঁরা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে
কাজ করতেন, একত্রে বসবাস করতেন। সুতরাং সেটা ছিল আরেক ধরনের বিপদ। আমি মনে করি না যে আমি যদি
তখন নির্দেশ দিতাম যে এ ধরনের আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করো, তাহলে তারা আমার কথা শুনত। সেটা ছিল একান্তভাবেই
মানবিক বিষয়, যা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বাঙালি সতীর্থদের প্রতি আমাদের কর্মচারীদের সেটা ছিল স্বাভাবিক
সহযোগিতার হাত বাড়ানো। আমার আঙিনার সামনে এক স্কোয়াড বাঙালি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। কারণ,
ইতিপূর্বে আমার বিরুদ্ধে কতিপয় বামপন্থী গ্রুপ হত্যার হুমকি দিয়েছিল। আমার বাসভবন পাহারা দিতে পূর্ব পাকিস্তান
পুলিশের একটি ইউনিট পাঠানো হয়েছিল। লড়াই শুরু হলো। সংগত কারণেই তারা তাদের জীবনের হুমকি অনুভব
করল। একদিন তারা তাদের ইউনিফর্ম ও রাইফেল আমার বাসভবনের পেছনে মাটিতে পুঁতে রাখল। পরবর্তী সময়ে
এনসিও ইনচার্জ আমার কাছে এলেন। বললেন, লড়াই চলাকালে তিনি কিছুই করেননি। তিনি এখন রাইফেলগুলো
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কাছে তুলে দিতে চান। এবং অনুরোধ করেন যে যাতে আমি পুরো বিষয়টি খুলে বলতে তাঁর
সঙ্গে আর্মি ক্যাম্পে যাই। আমি তাঁর কথায় সায় দিলাম। রাইফেলগুলো নিকটস্থ পাকিস্তানি বাহিনীর ছাউনিতে নিয়ে
গেলাম। এবং তাঁদের শপথ করে বললাম কেন ও কোন প্রেক্ষাপটে রাইফেলগুলো আমার বাসার পেছনে পঁতে রাখা
হয়েছিল। আমি আশা করি, তিনি নিরাপদেই পরিত্রাণ পেয়েছিলেন।
যা হোক, শেষ পর্যন্ত আমি মার্কিন কমিউনিটিকে ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সময়টা হবে
একাত্তরের মধ্য এপ্রিল। ওয়াশিংটনের মেজাজ ছিল এ রকম যে, শুধু একবার মুখ ফুটে বলো। আর তখন তাদের সুর
হঠাৎ বদলে গেল। এখন বলছে, আমাদের একটু ভাবতে দাও। আপনি কি নিশ্চিন্ত যে এটা আপনি চান। আমি অবশ্যই
উল্লেখ করেছিলাম যে এখন আমাদের নাগরিক স্থানান্তরের একটা অর্থ দাঁড়াবে। পাকিস্তান সরকারের দাবি নড়বড়ে হবে।
কারণ, তারা তখন দাবি করছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের সবকিছুই শান্ত রয়েছে। সুতরাং মার্কিনদের যদি স্থানান্তর করা হয়
তাহলে তার অর্থ দাঁড়াবে যে আমরা পরিস্থিতি শান্ত মনে করছি না। কিন্তু আমি মত দিয়েছিলাম যে পাকিস্তানিদের এই
চিন্তা-ভাবনার চেয়ে মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াশিংটন শেষ পর্যন্ত সম্মত হলো। কিন্তু
পাকিস্তান সরকার চাপাচাপি শুরু করল। তারা বলল, ঢাকা থেকে মার্কিন নাগরিকদের প্রথমে যেতে হবে করাচি। আর
ব্যবহার করতে হবে পিআইএর বিমান। উদ্দেশ্য হলো, ঢাকা থেকে যে বিমান করাচি যাবে তারা ফেরার সময় আরও
সেনা নিয়ে আসবে। এটা ছিল আমাদের জন্য বেদনাদায়ক। কারণ, আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম মার্কিন নাগরিকদের
নিয়ে যাবে মার্কিন এয়ারফোর্সের বিমান। ঢাকা থেকে প্রথমে যাবে ব্যাংকক। মাত্র দুই ঘণ্টার পথ। আর সেখানে
আমাদের পরিবার-পরিজনের পুনর্মিলনীর পরিবেশও ভালো। কিন্তু ওয়াশিংটন পাকিস্তানের চাহিদা মেটাল। সুতরাং
মার্কিন নাগরিকদের স্ত্রী, সন্তান এবং দরকারি নয় এমন কর্মচারীদের শ্রীলঙ্কা হয়ে করাচিতে যেতে হলো। এমনই এক
দীর্ঘ রুট, যার সঙ্গে নিউইয়র্ক-লন্ডন রুট তুলনীয়। মার্কিন নাগরিকদের আবার যাতে কেউ শ্রীলঙ্কায় থেকে না যায় সে
শঙ্কাও তাদের ছিল। সে কারণে তারা পাসপোর্ট নিল। ফেরত দিল করাচিতে।’
প্রেখট: কেন তারা মার্কিন নাগরিকদের পশ্চিম পাকিস্তানে নিতে এতটা উতলা ছিল?
ব্লাড: এর কারণ, করাচি থেকে মার্কিন নাগরিকদের আবার যেতে হচ্ছিল তেহরান।
প্রেখট: তাদের এমন কী মাথাব্যথা ছিল যে তারা কে কোথায় যাবে না-যাবে?
ব্লাড: ওয়াশিংটন একমত হয়েছিল যে আমরা আমাদের নাগরিকদের স্থানান্তরের বিষয়টি ‘ইভাকুয়েশন’ বলতে পারব না।
বলতে হবে ‘থিনিং আউট’, মানে লোকজন কমিয়ে ফেলা। কিন্তু সেটা ছিল অবশ্যই ইভাকুয়েশন। যদি মার্কিন বিমান
ঢাকা উড়ে এসে তাদের নিয়ে যেত তাহলে সেটা দেখাত অন্য রকম। আর এখন তারা সবাইকে পাকিস্তানি বাণিজ্যিক
ফ্লাইটে নিল। যেন এটা স্বাভাবিক। তবে আমি নিশ্চিত নই যে কেন তারা এটা চেয়েছিল। করাচিতে এক রাত কাটিয়ে
যেত হতো তেহরানে। সে কারণে মার্কিন কমিউনিটি দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিল। এই সময়ে আমরা অনেক মার্কিন
নাগরিকের বাঙালি স্ত্রী-পরিজনকেও পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আমি টের পেয়েছিলাম, আমাদের সিদ্ধান্তে পাকিস্তানিরা খুব
সন্তুষ্ট ছিল না। আমি আমাদের মধ্যে একজনকে জানতাম, কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে তার দায় আমার ওপরই চাপাতেন।
কিন্তু আমাদের জনগণ ঢাকা ছাড়তে চেয়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল তাঁরা ক্রুদ্ধ হয়েছিল। ওয়াশিংটনে তখনো মনোভাব
ছিল পূর্ব পাকিস্তানে তেমন কিছুই ঘটছে না। অথচ ঢাকার মার্কিন নাগরিকদের চোখের সামনেই সবকিছু ঘটেছিল।
মার্কিন সরকার নৃশংসতার নিন্দা করেনি, সে কারণে তারা ক্রুদ্ধ ছিল। আমি অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে ওয়াশিংটনে তা
জানিয়েছিলাম। আমি জানতাম, ঢাকা থেকে যেসব নাগরিক চলে যাচ্ছিলেন, তাঁরা গিয়ে বসে থাকবেন না।
কংগ্রেসম্যানদের কাছে যাবেন, মিডিয়ার কাছে মুখ খুলবেন। তাঁদের আপনি এখানে আটকে রাখতে পারেন না।
প্রেখট: মার্কিন প্রেসের ভূমিকা কেমন ছিল? তারা কি কভার করছিল না?
ব্লাড: মার্কিন প্রেসের প্রতিনিধিরা ঢাকাতেই ছিল। বৈদেশিক সংবাদদাতাদের জড়ো করা হলো এবং তাঁদের বহিষ্কার করা
হলো। দিনটি ছিল ২৬ মার্চ। একজন ছিলেন পালিয়ে। আমরা তাঁকে লুকিয়ে রাখি। আমরা তাঁকে আমাদের বাড়িতেই
রেখেছিলাম, যাতে তাঁরা প্রতিবেদন পাঠাতে পারেন। তাঁরা সেটা করতে পেরেছিলেন।
প্রেখট: আপনি তাঁদের প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন?
ব্লাড: হ্যাঁ, পাঠিয়েছিলাম। অন্য লোকের মেইল ওই সময় খুব বেশি পড়েছি। কারণ, ওই সময়ে বাণিজ্যিক ওয়্যারলেসের
ব্যবস্থা ছিল না। তবে আমাদের নিজস্ব যোগাযোগ সচল ছিল। আমরা পাকিস্তানি সুবিধাদির ওপর নির্ভর করিনি। সে
কারণে জাপানি, নেপালি ও অন্যরা আমাদের যোগাযোগব্যবস্থার ওপর নির্ভর করল। যেমন, নেপালিদের বার্তা আমি
পাঠালাম কাঠমান্ডুর মার্কিন দূতাবাসে, সেখান থেকে গেল নেপাল সরকারের কাছে, আবার একইভাবে তা ফিরে এল।
জাপানি ও কানাডীয়রাও এই সুবিধা পেয়েছে। চলবে
পুরোপুরি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন। ১৯৮৯ সালে তিনি মার্কিন কথ্য ইতিহাসবিদ হেনরি প্রেখটকে দীর্ঘ
সাক্ষাৎকার দেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি চমকপ্রদ তথ্য দেন যে, পাকিস্তানি বাহিনী মার্কিন নাগরিকদের বাড়িতে ডাকাতি
করেছে। বন্দুকের মুখে এক মার্কিন নারীর ঘড়ি ছিনতাই করেছে। এমনকি একজন আক্রান্ত মার্কিন এক পাক
সেনাসদস্যকে গুলি করে হত্যা করেন। ব্লাডের মতে, ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পরপরই সংগঠিত গেরিলা আন্দোলন
দ্রুত দানা বাঁধে এবং তা ছড়িয়ে পড়ে। হেনরি প্রেখটের সাক্ষাৎকার অবলম্বনে ধারাবাহিক প্রতিবেদনটি লিখেছেন মিজানুর
রহমান খান
প্রেখট: ক্র্যাকডাউন আসলে কী ছিল? রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া এ ধরনের কিছু?
ব্লাড: ও, না না। ক্র্যাকডাউন ছিল ঢাকায় সামরিক সামর্থ্য রয়েছে এমন যেকোনো বাঙালি ইউনিট ধ্বংস করা। এর
মধ্যে ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস। তাদের কর্মকর্তারা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। কিন্তু সেনারা ছিল বাঙালি। আর ছিল
পুলিশ। তারা তাদের ব্যারাকে হামলা চালাল এবং সাধ্যমতো তাদের হত্যা করল।
প্রেখট: এবং এসবই বিনা উসকানিতে ঘটেছিল?
ব্লাড: একদম বিনা উসকানিতে ঘটেছিল। ছাত্ররা ওই সময় সভা-সমাবেশে সক্রিয় ছিল। তাই তাদের ওপরও হামলা
চলল। মেশিনগান মর্টার আঘাত হানল তাদের আবাসিক হলে। বিপুলসংখ্যক ছাত্রকে হত্যা করা হলো। আওয়ামী লীগের
সমর্থক সংবাদপত্র অফিসের সামনে ট্যাংক এল এবং ভবনটি ধ্বংস করা হলো।
প্রেখট: আর, আওয়ামী লীগের কী করল?
ব্লাড: খাদ্য ও অন্যান্য পণ্য বিক্রি করতে যারা অস্বীকার করেছিল, সেসব বাজারও তারা ধ্বংস করল। বিশ্ববিদ্যালয়ে
তারা হিন্দু অধ্যাপকদের হত্যা করেছে। আমি দর্শনের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপককে জানতাম। তাঁর শরীরে কোনো
রাজনীতির লেশমাত্র ছিল না। আমি মনে করি তিনি শুধু একজন হিন্দু বলেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।
প্রেখট: আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের অবস্থা কী ছিল?
ব্লাড: মুজিবের মতো যাঁদেরই তারা পেয়েছে, তাঁদের গ্রেপ্তার করেছে। অন্যরা লুকিয়ে ছিলেন। অনেকেই পালাতে সক্ষম
হন।
প্রেখট: দূতাবাসের তৎপরতা কী ছিল? সামরিক কর্তৃপক্ষ কি আপনাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করেছিল? তারা কি আপনাদের
বাড়িতে থাকতে বলেছিল?
ব্লাড: কারফিউ ছিল। ৩৬ ঘণ্টার জন্য আমরা বের হতে পারিনি। আমরা রাতের বেলা ছাদে যেতাম এবং আমরা দেখতে
পেতাম লড়াই অব্যাহত রয়েছে। ট্যাংক ও মেশিনগানের গোলাবর্ষণ সহজেই শোনা যেত। দেখাও যেত। টেলিফোনের
সব লাইন কাটা হয়েছিল, যদিও পাকিস্তানিরা এ জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেছিল। সৌভাগ্যবশত রেডিও
যোগাযোগ আমাদের ছিল। অফিস ও বাসা দুই স্থানেই ছিল। অন্তত তিন সপ্তাহ পর্যন্ত আমরা দূতাবাসের বাইরে যেতে
পারিনি। তিন সপ্তাহ বাদে তারা আমাকে একটি সামরিক টেলিফোনে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেয়।
ভাগ্যক্রমে আমাদের এখানে দূতাবাস থেকে ক্র্যাকডাউনের ঠিক একটু আগে একজন এয়ার অ্যাটাশে এসেছিলেন।
তাঁকে আমি ঢাকায় আসতে বলেছিলাম। তিনি থাকায় ২৫ মার্চ থেকে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সে বিষয়ে আমরা ভালো
রিপোর্ট করতে পেরেছিলাম। ওই সময় তিনি ছিলেন ঢাকায় একমাত্র মার্কিন সামরিক ব্যক্তি। ব্রিটিশদেরও দূরদর্শিতা
ছিল। তারাও একজন সামরিক ব্যক্তিকে ঢাকায় এনেছিল। সে কারণে যুদ্ধের প্রতিবেদন পাঠাতে তাদের পরামর্শ বেশ
সহায়ক হয়েছিল।
প্রেখট: এ সময় কি গেরিলা আন্দোলনকে সহায়তা দিতে ভারতীয়রা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল?
ব্লাড: না না। আমি মনে করি না যে তারা এর আগে সক্রিয় ছিল।
প্রেখট: ক্র্যাকডাউনের পর পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের দূতাবাস কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাল? আপনি আমাকে যা বলছেন
তখন দূতাবাসকেও জানিয়েছিলেন? তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
ব্লাড: তারা অবিশ্বাস করেছিল। তারা নিশ্চয়ই পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে বক্তব্য পেয়েছিল যে তেমন কিছুই ঘটেনি।
এবং তাদের এই অবিশ্বাস করার দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছুতেই ফুটে উঠেছিল। তাদের মন্তব্যে, ওয়াশিংটনে পাঠানো তাদের
বার্তায় যা ছিল খুবই হতাশাজনক। ডেপুটি চিফ অব মিশন ছিলেন সিড সোবার। আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম, এখনো
আছি। তিনি যখন প্রথম এলেন, সেটা আমি স্মরণ করতে পারি। এপ্রিলের শেষ দিকে পাকিস্তান সরকার নিষেধাজ্ঞা তুলে
নিল। আমি মুহূর্তেই নারী-শিশু এবং দরকারি নয় এমন কর্মচারীদের ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সিড
সোবারও বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ, কতিপয় বাঙালির কাছ থেকে তিনি শুনেছিলেন সত্যি তেমন কিছু ঘটেনি।
প্রাথমিক লড়াইটা টানা প্রায় দুই সপ্তাহ চলেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গেরিলাদের ভারত সীমান্ত পর্যন্ত ধাওয়া করে
নিল। গেরিলাদের কাছ থেকেই তারা সবচেয়ে সংগঠিত বাধার সম্মুখীন হয়েছিল। আর তখনই একটি গেরিলা ধাঁচের
প্রতিরোধ ক্রমশ বেড়ে উঠল এবং তা ছড়িয়ে পড়ল। ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের আগেই বেশ কিছু বিদেশি জনগোষ্ঠীকে
ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। জাতিসংঘ, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান তাদের কমিউনিটিকে সরিয়ে নিয়েছিল।
প্রেখট: বিদেশিদের ওপর কি কোনো হামলা হয়েছিল?
ব্লাড: না। কিন্তু এই আশঙ্কা ছিল যে আমরা একটি গৃহযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছি। আমি প্রাথমিকভাবে দুই কারণে আমাদের
নাগরিকদের স্থানান্তরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলাম। এর একটা কারণ ছিল, আমি জানতাম পরিস্থিতি যদি আওয়ামী
লীগের নিয়ন্ত্রণে থাকে তাহলে মার্কিনদের কোনো বিপদ হবে না। তাদের সম্পর্কে মার্কিনদের অত্যন্ত উঁচু চিন্তাভাবনা
ছিল। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাব কেউ অনুভব করেনি। এ ছাড়া আমি অনুভব করেছিলাম যে আমরা যদি তাদের
স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিই, তাহলে তার অর্থ হবে আমরা একটি গৃহযুদ্ধ এবং একটি সংঘাতের অনিবার্যতা গ্রহণ করেছি।
আমাদের টিকে থাকা একধরনের সাক্ষ্য দেবে যে একটা শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির জন্য হয়তো কিছুটা সুযোগ অবশিষ্ট থাকবে।
প্রেখট: আপনার সহযোগী মার্কিনদের ঝুঁকিতে রাখার সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে আপনি কি বিব্রত ছিলেন?
ব্লাড: হ্যাঁ। সেটা ছিল খুবই গুরুতর দায়িত্বশীলতা। কারণ, আমাকে সিদ্ধান্ত দিতে হয়েছিল। তবে স্থানান্তরের বিষয়ে
মার্কিন কমিউনিটির কাছ থেকে আমি কোনো চাপের সম্মুখীন ছিলাম না।
প্রেখট: ওয়াশিংটনের মনোভাব কেমন ছিল? তারা কি চেয়েছিল যে আপনি এটা করবেন বা এটা করবেন না?
ব্লাড: না। আমাদের রাষ্ট্রদূত থাইল্যান্ডে গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। তিনি আমার কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন।
আমি তার মানে বুঝিনি। কিন্তু ক্র্যাকডাউনের পর পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে গেল। তখন ওয়াশিংটনের এটা বিশ্বাস
করতে কষ্ট হলো যে যখন গোটা পরিস্থিতি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কবজায় এল তখন মার্কিনদের বিপদে পড়ার
ঝুঁকি সৃষ্টি হলো। কিন্তু সেটাই ঘটেছিল।’
প্রেখট: এই বিপদ কার কাছ থেকে?
ব্লাড: পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে।
প্রেখট: ওহ, হ্যাঁ।
ব্লাড: আমি বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চাই। প্রথমেই বলব, পূর্ব পাকিস্তানে যেসব সেনা পাঠানো হয়েছিল, তারা
সেনাবাহিনীর নিয়মিত সদস্য ছিল না। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পাকিস্তানের এমন বাহিনী ছিল, যারা সম্মুখভাগে
যুদ্ধ করার সদস্য নয়। বহু ক্ষেত্রে ঢাকায় এসব সেনাসদস্য মার্কিনদের প্রতি বন্দুক তাক করেছিল। তারা এমন হুমকিও
দিয়েছিল যে তাদের অবিলম্বে হত্যা করা হবে। সে কারণেই আমি বলছি যে এই আধা শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা
আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াল। বহু ক্ষেত্রে ওই পাকিস্তানি সেনারা সন্ধ্যায় ব্যারাক ছেড়ে বেরিয়ে আসত এবং
মার্কিনদের বাড়িতে গিয়ে ডাকাতি করত। একটি ঘটনায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে এক মার্কিনের স্ত্রীর ঘড়ি কেড়ে নিল। অন্য
এক ঘটনায় এক মার্কিন আমার কাছে স্বীকার করলেন যে তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা
করেছিলেন। কারণ ওই সেনাটি তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল। তিনি ওই নিহত সেনাটিকে সমাধিস্থ করেন। এ ধরনের
ঘটনা ছিল গোড়াতেই। আমাদের কাছে বিপন্ন বাঙালি আশ্রয়ের জন্য ছুটে আসছিলেন। বিশেষ করে হিন্দু বাঙালিরা
আমাদের কর্মচারীদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমরা সবাই যে যেভাবে পেরেছি, আশ্রয় দিয়েছি। আমি ওয়াশিংটন
থেকে একটি বার্তা পেলাম। তাতে বলা হয়েছে, তাঁরা শুনতে পেরেছেন আমরা এসব করে বেড়াচ্ছি। এসব যেন আমরা
না করি। আমি তাঁদের বললাম, আমরা সত্যি এসবই করছিলাম এবং তা অব্যাহতভাবে করে যাব। আমরা এসব
মানুষকে এড়াতে পারব না। তাঁরা রাজনৈতিক উদ্বাস্তু ছিলেন না। তাঁরা শুধুই দরিদ্র। অত্যন্ত নিম্নবর্গীয় মানুষ, অধিকাংশই
যাঁদের হিন্দু। তাঁরা অনেকেই শঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে তাঁরা শুধু হিন্দু বলেই তাঁদের হত্যা করা হবে।
প্রেখট: আপনার কি হিন্দু গৃহভৃত্য ছিল?
ব্লাড: আমাদের কয়েকজন ছিলেন। হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে আমাদের সঙ্গে অনেকেই ছিলেন। তাঁরা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে
কাজ করতেন, একত্রে বসবাস করতেন। সুতরাং সেটা ছিল আরেক ধরনের বিপদ। আমি মনে করি না যে আমি যদি
তখন নির্দেশ দিতাম যে এ ধরনের আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করো, তাহলে তারা আমার কথা শুনত। সেটা ছিল একান্তভাবেই
মানবিক বিষয়, যা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বাঙালি সতীর্থদের প্রতি আমাদের কর্মচারীদের সেটা ছিল স্বাভাবিক
সহযোগিতার হাত বাড়ানো। আমার আঙিনার সামনে এক স্কোয়াড বাঙালি পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। কারণ,
ইতিপূর্বে আমার বিরুদ্ধে কতিপয় বামপন্থী গ্রুপ হত্যার হুমকি দিয়েছিল। আমার বাসভবন পাহারা দিতে পূর্ব পাকিস্তান
পুলিশের একটি ইউনিট পাঠানো হয়েছিল। লড়াই শুরু হলো। সংগত কারণেই তারা তাদের জীবনের হুমকি অনুভব
করল। একদিন তারা তাদের ইউনিফর্ম ও রাইফেল আমার বাসভবনের পেছনে মাটিতে পুঁতে রাখল। পরবর্তী সময়ে
এনসিও ইনচার্জ আমার কাছে এলেন। বললেন, লড়াই চলাকালে তিনি কিছুই করেননি। তিনি এখন রাইফেলগুলো
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কাছে তুলে দিতে চান। এবং অনুরোধ করেন যে যাতে আমি পুরো বিষয়টি খুলে বলতে তাঁর
সঙ্গে আর্মি ক্যাম্পে যাই। আমি তাঁর কথায় সায় দিলাম। রাইফেলগুলো নিকটস্থ পাকিস্তানি বাহিনীর ছাউনিতে নিয়ে
গেলাম। এবং তাঁদের শপথ করে বললাম কেন ও কোন প্রেক্ষাপটে রাইফেলগুলো আমার বাসার পেছনে পঁতে রাখা
হয়েছিল। আমি আশা করি, তিনি নিরাপদেই পরিত্রাণ পেয়েছিলেন।
যা হোক, শেষ পর্যন্ত আমি মার্কিন কমিউনিটিকে ঢাকা থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সময়টা হবে
একাত্তরের মধ্য এপ্রিল। ওয়াশিংটনের মেজাজ ছিল এ রকম যে, শুধু একবার মুখ ফুটে বলো। আর তখন তাদের সুর
হঠাৎ বদলে গেল। এখন বলছে, আমাদের একটু ভাবতে দাও। আপনি কি নিশ্চিন্ত যে এটা আপনি চান। আমি অবশ্যই
উল্লেখ করেছিলাম যে এখন আমাদের নাগরিক স্থানান্তরের একটা অর্থ দাঁড়াবে। পাকিস্তান সরকারের দাবি নড়বড়ে হবে।
কারণ, তারা তখন দাবি করছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের সবকিছুই শান্ত রয়েছে। সুতরাং মার্কিনদের যদি স্থানান্তর করা হয়
তাহলে তার অর্থ দাঁড়াবে যে আমরা পরিস্থিতি শান্ত মনে করছি না। কিন্তু আমি মত দিয়েছিলাম যে পাকিস্তানিদের এই
চিন্তা-ভাবনার চেয়ে মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ওয়াশিংটন শেষ পর্যন্ত সম্মত হলো। কিন্তু
পাকিস্তান সরকার চাপাচাপি শুরু করল। তারা বলল, ঢাকা থেকে মার্কিন নাগরিকদের প্রথমে যেতে হবে করাচি। আর
ব্যবহার করতে হবে পিআইএর বিমান। উদ্দেশ্য হলো, ঢাকা থেকে যে বিমান করাচি যাবে তারা ফেরার সময় আরও
সেনা নিয়ে আসবে। এটা ছিল আমাদের জন্য বেদনাদায়ক। কারণ, আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম মার্কিন নাগরিকদের
নিয়ে যাবে মার্কিন এয়ারফোর্সের বিমান। ঢাকা থেকে প্রথমে যাবে ব্যাংকক। মাত্র দুই ঘণ্টার পথ। আর সেখানে
আমাদের পরিবার-পরিজনের পুনর্মিলনীর পরিবেশও ভালো। কিন্তু ওয়াশিংটন পাকিস্তানের চাহিদা মেটাল। সুতরাং
মার্কিন নাগরিকদের স্ত্রী, সন্তান এবং দরকারি নয় এমন কর্মচারীদের শ্রীলঙ্কা হয়ে করাচিতে যেতে হলো। এমনই এক
দীর্ঘ রুট, যার সঙ্গে নিউইয়র্ক-লন্ডন রুট তুলনীয়। মার্কিন নাগরিকদের আবার যাতে কেউ শ্রীলঙ্কায় থেকে না যায় সে
শঙ্কাও তাদের ছিল। সে কারণে তারা পাসপোর্ট নিল। ফেরত দিল করাচিতে।’
প্রেখট: কেন তারা মার্কিন নাগরিকদের পশ্চিম পাকিস্তানে নিতে এতটা উতলা ছিল?
ব্লাড: এর কারণ, করাচি থেকে মার্কিন নাগরিকদের আবার যেতে হচ্ছিল তেহরান।
প্রেখট: তাদের এমন কী মাথাব্যথা ছিল যে তারা কে কোথায় যাবে না-যাবে?
ব্লাড: ওয়াশিংটন একমত হয়েছিল যে আমরা আমাদের নাগরিকদের স্থানান্তরের বিষয়টি ‘ইভাকুয়েশন’ বলতে পারব না।
বলতে হবে ‘থিনিং আউট’, মানে লোকজন কমিয়ে ফেলা। কিন্তু সেটা ছিল অবশ্যই ইভাকুয়েশন। যদি মার্কিন বিমান
ঢাকা উড়ে এসে তাদের নিয়ে যেত তাহলে সেটা দেখাত অন্য রকম। আর এখন তারা সবাইকে পাকিস্তানি বাণিজ্যিক
ফ্লাইটে নিল। যেন এটা স্বাভাবিক। তবে আমি নিশ্চিত নই যে কেন তারা এটা চেয়েছিল। করাচিতে এক রাত কাটিয়ে
যেত হতো তেহরানে। সে কারণে মার্কিন কমিউনিটি দারুণভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিল। এই সময়ে আমরা অনেক মার্কিন
নাগরিকের বাঙালি স্ত্রী-পরিজনকেও পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আমি টের পেয়েছিলাম, আমাদের সিদ্ধান্তে পাকিস্তানিরা খুব
সন্তুষ্ট ছিল না। আমি আমাদের মধ্যে একজনকে জানতাম, কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে তার দায় আমার ওপরই চাপাতেন।
কিন্তু আমাদের জনগণ ঢাকা ছাড়তে চেয়েছিল। এর প্রধান কারণ ছিল তাঁরা ক্রুদ্ধ হয়েছিল। ওয়াশিংটনে তখনো মনোভাব
ছিল পূর্ব পাকিস্তানে তেমন কিছুই ঘটছে না। অথচ ঢাকার মার্কিন নাগরিকদের চোখের সামনেই সবকিছু ঘটেছিল।
মার্কিন সরকার নৃশংসতার নিন্দা করেনি, সে কারণে তারা ক্রুদ্ধ ছিল। আমি অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে ওয়াশিংটনে তা
জানিয়েছিলাম। আমি জানতাম, ঢাকা থেকে যেসব নাগরিক চলে যাচ্ছিলেন, তাঁরা গিয়ে বসে থাকবেন না।
কংগ্রেসম্যানদের কাছে যাবেন, মিডিয়ার কাছে মুখ খুলবেন। তাঁদের আপনি এখানে আটকে রাখতে পারেন না।
প্রেখট: মার্কিন প্রেসের ভূমিকা কেমন ছিল? তারা কি কভার করছিল না?
ব্লাড: মার্কিন প্রেসের প্রতিনিধিরা ঢাকাতেই ছিল। বৈদেশিক সংবাদদাতাদের জড়ো করা হলো এবং তাঁদের বহিষ্কার করা
হলো। দিনটি ছিল ২৬ মার্চ। একজন ছিলেন পালিয়ে। আমরা তাঁকে লুকিয়ে রাখি। আমরা তাঁকে আমাদের বাড়িতেই
রেখেছিলাম, যাতে তাঁরা প্রতিবেদন পাঠাতে পারেন। তাঁরা সেটা করতে পেরেছিলেন।
প্রেখট: আপনি তাঁদের প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন?
ব্লাড: হ্যাঁ, পাঠিয়েছিলাম। অন্য লোকের মেইল ওই সময় খুব বেশি পড়েছি। কারণ, ওই সময়ে বাণিজ্যিক ওয়্যারলেসের
ব্যবস্থা ছিল না। তবে আমাদের নিজস্ব যোগাযোগ সচল ছিল। আমরা পাকিস্তানি সুবিধাদির ওপর নির্ভর করিনি। সে
কারণে জাপানি, নেপালি ও অন্যরা আমাদের যোগাযোগব্যবস্থার ওপর নির্ভর করল। যেমন, নেপালিদের বার্তা আমি
পাঠালাম কাঠমান্ডুর মার্কিন দূতাবাসে, সেখান থেকে গেল নেপাল সরকারের কাছে, আবার একইভাবে তা ফিরে এল।
জাপানি ও কানাডীয়রাও এই সুবিধা পেয়েছে। চলবে
No comments