ব্লাডের প্রতিবেদন অবিশ্বাস করে ওয়াশিংটন
একাত্তরে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কেন্ট ব্লাড পঁচিশে মার্চের গণহত্যার যে বিবরণ দিয়েছিলেন, তা বিশ্বাস করেনি ওয়াশিংটন। কিসিঞ্জারের ইচ্ছায় তাঁকে হয়রানিমূলক বদলি করা হয়েছিল। একাত্তরের জুনে তাঁকে ঢাকা ছাড়তে হয়।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে বিরল ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করার সুযোগ আছে, তবে ওই সময় সেটা ছিল অত্যন্ত বিরল। ভিন্নমতকে উৎসাহিত করতে আমেরিকান ফরেন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন চালু করেছিল ‘হার্টার পুরস্কার’। ১৯৬৯ সালে এর প্রচলন ঘটে। একাত্তরে তাঁর বিখ্যাত টেলিগ্রামের জন্য এ পুরস্কার পান ব্লাড। ওই পুরস্কার এ পর্যন্ত ৪০ জন পেয়েছেন। গত দুই বছরে কেউ পাননি। ঢাকায় তাঁর অপরাধ ছিল, ‘ওয়াশিংটন যেমনটা শুনতে চেয়েছিল, তেমন করে তিনি প্রতিবেদন পাঠাননি’। একাত্তরে তাঁর সঙ্গে ওয়াশিংটনের দূরত্ব বাড়ার কারণ সম্পর্কে ১৯৮৯ সালে কথ্য ইতিহাসবিদ হেনরি প্রেখটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্লাড বলেন, সেটা ছিল নিক্সন ও কিসিঞ্জার এবং তাঁদের লোকেরা আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। আমরা পরে সেটা দেখেছি। আমি ছিলাম প্রকৃতপক্ষে আমলাতন্ত্রের অংশ। আমরা ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে আবিষ্কার করলাম যে, পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রত্যেকেই একইভাবে তা অনুভব করছিলেন। হেনরি প্রেখটের সাক্ষাৎকার অবলম্বনে ধারাবাহিক প্রতিবেদনটি লিখেছেন মিজানুর রহমান খান
গতকালের পর
প্রেখট: কিন্তু আপনি যখন মাঠে থাকবেন, ওয়াশিংটনের অবস্থান আপনার জানার কথা নয়।
ব্লাড: আমরা সত্যিই মাঠে থেকে কিছুই জানতাম না। ওয়াশিংটন থেকে যখন কোনো মিশনে বার্তা আসে, তখন বোঝা যায় না যে সেটা আসলে কে লিখেছেন। আমি ওয়াশিংটনে আসার আগে পর্যন্ত বুঝতেই পারিনি যে এনইএ (নর্থইস্ট এশিয়া) এবং সরকারের অন্যত্র যাঁরা এ বিষয়ে কাজ করছিলেন, তাঁরা সবাই আমাদের মতোই ভাবছিলেন। আমাদের প্রতি তাঁদের জোরালো সমর্থন ছিল।
প্রেখট: মার্কিন স্বার্থে সংকট নিরসনের যেসব উপায় ছিল, সেগুলো আপনি কীভাবে দেখেছিলেন? আপনার ধারণা কী ছিল? সমস্যা যে সৃষ্টি হচ্ছিল, সেটা ঠিক কী নিয়ে? মার্কিন নাগরিক স্থানান্তর অথবা প্রতিবেদন তৈরি? আপনি কীভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন?
ব্লাড: আসলে খুব নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। কিন্তু ২৫ মার্চের পর আমরা যখন ক্র্যাকডাউন সম্পর্কে প্রতিবেদন পাঠাতে শুরু করি, তখন থেকেই বিষয়টির সূচনা ঘটে থাকবে। আমি স্বীকার করব যে, আমরা খুব খোলাখুলিভাবে প্রতিবেদন পাঠাচ্ছিলাম। কূটনৈতিক রীতিনীতির ছদ্মাবরণে আমরা কিছুই ঢাকতে চাই না। সেই রাতে সম্ভবত পাঁচ হাজার লোক হত্যার শিকার হয়েছিল। আমাদের কাছে সাক্ষ্য-প্রমাণও ছিল, যদিও এটা ঠিক যে আমার নিজের সামনে কাউকে খুন হতে দেখিনি। কিন্তু আমাদের যোগাযোগে ক্যাথলিক যাজকেরা ছিলেন। দেশজুড়েই তাঁরা ছিলেন। যখন হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে মেশিনগানের গুলি চলেছে, তখন তারা পালিয়ে ক্যাথলিক মিশনে আশ্রয় নেয়। আমরা আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য মার্কিন চিকিৎসকদের পাঠিয়েছিলাম। প্রকৃতপক্ষে, আমরা তাঁদের যেতে বলিনি। তাঁরা নিজে থেকে গিয়েছিলেন। সুতরাং মার্কিন প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ আমাদের প্রতিবেদনের উৎস ছিল।
প্রেখট: ওয়াশিংটনে তখন কী ঘটছিল? আপনার পাঠানো প্রতিবেদনগুলো পেয়ে তারা ঠিক কী করেছিল?
ব্লাড: হ্যাঁ, আমি যেটা স্মরণ করতে পারি, আমাদের পাঠানো প্রতিবেদনগুলো তারা অবিশ্বাস করেছিল।
প্রেখট: আপনি আসলে এমন কিছুই ঢাকা থেকে পাঠাননি, যা তারা শুনতে চেয়েছিল।
ব্লাড: আপনি ঠিক বলেছেন।
প্রেখট: আপনার সেই ভিন্নমতের টেলিগ্রামের কথা বলুন। সেটা কি মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার আগে?
ব্লাড: হ্যাঁ। প্রকৃতপক্ষে আমাদের ১২ বা ১৩ জন কর্মকর্তা (উল্লেখ্য, ২০ জন তাতে সই দিয়েছিলেন) সেই বার্তার খসড়া তৈরি করেছিলেন। আমি খসড়া তৈরি করিনি। তাঁরা আমার কাছে এলেন এবং বললেন, ‘আমরা এই বিবৃতি পাঠাতে চাই।’ যুক্তরাষ্ট্র নৃশংসতার নিন্দা জানাতে পারেনি, সে জন্য আমরা ভীষণ মর্মাহত ছিলাম। তাঁরা প্রত্যেকেই এইড, ইউএসআইএর উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু যিনি আমার ডেপুটি ছিলেন, তিনি তাঁদের একজন ছিলেন না। তিনি ছিলেন ভীরু ও ভীতসন্ত্রস্ত। কিন্তু আমরা সবাই প্রত্যেকের মতামত সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। সুতরাং আমি সেই বিবৃতি পাঠাতে মনস্থ করলাম এবং পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু সেই বিবৃতির সঙ্গে আমি একটি সম্পূরক জোরদার বিবৃতি পাঠালাম। আমি তাতে বললাম, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে এই বিবৃতির খসড়া তৈরি করিনি। আমার কাছে এটা উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু এঁরাই আমার উত্তম কর্মকর্তা। তাঁরা যা বলেছেন আমি তা বিশ্বাস করি। আমি সম্পূর্ণভাবে তাঁদের ভাবাবেগ ধারণ করি।’ এরপর আমি ট্রান্সমিট করলাম। এখন আমার মনে পড়ে, আমরা গোপনীয় (সীমিত বিতরণ) লিখে পাঠিয়েছিলাম।
প্রেখট: হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, আপনি এটা লো-ক্ল্যাসিফিকেশন করেছিলেন, যাতে এটি ফাঁস হয়ে যায়।
ব্লাড: সেটা সত্যি নয়। সিক্রেট ছিল সর্বোচ্চ শ্রেণীকরণ, যেটা আমরা তখন ব্যবহার করতাম। উচ্চতর ছিল ‘এক্স ডিস’ মানে এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউশন। আমার অবশ্য সেটাই করা উচিত ছিল। আজ আমি তা স্বীকার করি। কিন্তু সেই সময়ে আমি সর্বোচ্চ ক্ল্যাসিফিকেশন করেছিলাম, কারণ সেটা করতেই আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, আমরা সেই বার্তা পশ্চিম পাকিস্তানের দূতাবাসসহ ওয়াশিংটন ও পাকিস্তানের অন্যান্য মিশনে পাঠিয়েছিলাম।
প্রেখট: দূতাবাসের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? তারা কি কোনো মন্তব্য করেছিল?
ব্লাড: তারা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে অন্য মিশনগুলোর কাছ থেকে বিবৃতিটি প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিল। আমি মনে করতে পারি না যে দূতাবাস কিছু বলেছিল কি না। সেই সময়ের রাষ্ট্রদূত এবং আমার মধ্যে কখনো কোনো কথা-কাটাকাটি হয়নি।
প্রেখট: তখন রাষ্ট্রদূত ছিলেন ফারল্যান্ড। যত দূর জানি, তিনি রূঢ় কথা বলার লোক নন। নম্র স্বভাবের ভদ্রলোক।
ব্লাড: তিনি কিন্তু প্রয়োজনে যথেষ্ট কঠোর হতে পারতেন। আর ছিলেন সিড সোবার। আমরা দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম, ওই বিবৃতিটি যখন তাদের পাঠাব, তখন তাদের পছন্দ হবে না।
প্রেখট: যা-ই হোক, আপনি যদি এত ভাবনাচিন্তা করতেন তাহলে ওই বার্তা পাঠাতে পারতেন না।
ব্লাড: সেই সময়ে ভিন্নমতের বার্তা যে এভাবে পাঠানো যায়, সে সম্পর্কে সবে আমরা কিছু কথাবার্তা শুনছিলাম।
প্রেখট: সুতরাং দূতাবাস থেকে আপনি কোনো প্রতিক্রিয়া পাননি। ওয়াশিংটনের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? কেউ কি বলেছিল, আপনি ঠিক কিংবা ভুল?
ব্লাড: আমরা সংবাদপত্র পাওয়া শুরু করলাম। যখন সেটা ফাঁস হলো। তার আগেই আমরা জানতাম, এটা ফাঁস হয়ে গেছে। এর কয়েক সপ্তাহ পর আমি ভাবতে শুরু করলাম, আমার মনে হয়, নিজ থেকেই বদলির প্রস্তাব করা উচিত।
প্রেখট: আপনাকে যে বদলি করা হবে, সে কথা কে প্রথম বলেছিল?
ব্লাড: সিড সোবার হতে পারেন। কিন্তু সেটা বোধগম্য ছিল। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
ব্লাড স্পষ্ট করেছেন যে তিনি বদলির কথা নিজ থেকে বলেননি। তাঁকে প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছিল এবং তিনি সেটা করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য: ‘দীর্ঘদিন ছুটি নিয়ে বাড়িতে যাইনি। তাই আমি লম্বা ছুটির দরখাস্ত করলাম। আমার অবশ্য তাড়া ছিল না, আমি মধ্য জুন পর্যন্ত থাকলাম। আমি জানতাম আমাকে যেতে হবে।’
এসব সত্ত্বেও ঢাকা ছেড়ে যেতে তাঁর মন সায় দেয়নি। পরিস্থিতি তাঁর জন্য ‘কৌতূহলোদ্দীপক’ ছিল। সব দেশই তখন ঢাকা মিশনের স্টাফ-সংখ্যা কাটছাঁট করেছিল; মার্কিন মিশনে সংখ্যা কমিয়ে প্রায় ১৩ জন করা হয়েছিল। ব্লাড লিখেছেন, ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার ঢাকা ত্যাগ করেন তাঁর সঙ্গেই। ইরানি মিশনপ্রধানকে থামানো হলো। পাকিস্তানিরা যুক্তি দেখাল, তিনি গৃহবন্দী থাকা ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এটা তাদের পছন্দ হয়নি। তারা ইরানের শাহের নজরে এনেছিল, তখন তেহরান তাকে তলব করে। ব্লাড আরও বলেছেন, ‘আমি অবশ্য ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারের সঙ্গে দুবার দেখা করি। কিন্তু সেটা মার্কিন সরকারের নির্দেশে। কলকাতায় পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনার একইভাবে গৃহবন্দী ছিলেন। আমাদের কনসাল জেনারেল কিংবা তাঁর কোনো স্টাফ তাঁকে দেখতে গিয়েছে, প্রয়োজনীয় টুকিটাকি সরবরাহ করেছে। সেটা ছিল আদান-প্রদানের বিষয়। সুতরাং দুটি উপলক্ষে আমি ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারের সঙ্গে দেখা করি। তিনি ছিলেন একজন ভালো বন্ধু।’
তাঁর বার্তাটি কী করে ফাঁস হয়েছিল, তিনি বাঙালি রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন কি না, এ প্রশ্নের জবাবে ব্লাড ‘না’ বলেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘তাঁরা তখন মৃত কিংবা পলাতক ছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। কারণ, সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিল যে আমরা তাঁদের গ্রহণ করেছিলাম। টিক্কা খানকে গভর্নর করে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল। এর আগে বেলুচিস্তানে তাঁর নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে সবাই অবগত ছিলেন। যখন তাঁকে শপথবাক্য পাঠ করানো হলো, সেই অনুষ্ঠানে যেতে আমি অস্বীকৃতি জানালাম। আমি একজন কনিষ্ঠ কর্মকর্তাকে পাঠালাম। আমি জানতাম, টিক্কা খান আমাকে ডাকবেন। কিন্তু আমি তাতে সাড়া দিইনি। এক দুপুরে আমি তখন সবে অফিসের কাজ শেষ করেছি। এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন এলেন। তাঁর কাছে রিভলবার ছিল। তিনি জিপ থেকে নামলেন। আমার কাছে এলেন। বললেন, “আপনাকে গভর্নর সঙ্গে করে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে বলেছেন।” সুতরাং আমি তাঁর সঙ্গে গেলাম। আমাদের মধ্যে প্রীতিপ্রদ আলোচনা হলো। পরদিন সংবাদপত্রে খবর ছাপা হলো, আমেরিকান কনসাল জেনারেল গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু আমি সেটা করেছিলাম বন্দুকের মুখে (হাসি)।’
আর্চার ব্লাড জুনে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। তিনি যখন ওয়াশিংটনে গেলেন, তখন তাঁকে কেমন অভ্যর্থনা দেওয়া হয়েছিল। উত্তরে ব্লাড বলেছেন, ‘সিসকো অসন্তুষ্ট ছিলেন।’ উল্লেখ্য, সিসকোর পুরো নাম ড. যোসেফ জন সিসকো। বাংলাদেশের পুরো যুদ্ধের সময় এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার পরেও কিসিঞ্জারের অন্যতম দক্ষিণ হস্ত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি অবসর নেন। ২০০৪ সালে মারা যান। ব্লাড বলেন, ‘সিসকো আমাকে বার্তা ফাঁস করার জন্য অভিযুক্ত করলেন। কিংবা অন্তত আমি সেটাকে লো-ক্ল্যাসিফিকেশন করেছিলাম বলে উল্লেখ করলেন। নিক ভ্যালটস ও আরউইনের সঙ্গে দেখা করার একটা ব্যবস্থা করে দিলেন। আরউইন তখন ছিলেন ডেপুটি সেক্রেটারি। তিনি যথেষ্ট বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন ভারতীয় হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সম্পর্কে আমার কী ধারণা। নিক বলেছিলেন, “তোমার উচিত এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলা”।’
ব্লাড আরও যোগ করলেন, ‘এই দুজনের সঙ্গে কথা বলে আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম। এরপর আমি ছুটি কাটাতে কলারাডোয় ফিরে যাই। আমি স্ত্রীর সঙ্গে যোগ দিই। আমি অনুমান করি, তখনই হাওয়ার্ড শেপার্ড আমাকে টেলিফোন করেন। তিনি জানালেন আমাকে হার্টার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। পুরস্কার নিতে আমি যেন ওয়াশিংটনে ফিরে আসি। সেটা ছিল আসলে আমার জ্যেষ্ঠদের তরফে আমার কর্তব্য পালনের প্রতি একটা স্বীকৃতি। পরে আমি কথা বলেছিলাম ক্রিস ভ্যান হোলেনের সঙ্গে। তিনি আমাকে সহায়তা দিয়েছিলেন। এ সময় আমি আমার সম্পর্কিত দক্ষতা প্রতিবেদনের অনুলিপি পাই। সিড সোবার সেটা লিখেছিলেন। তাতে দুটি বিষয় আমাকে বিচলিত করে। একটি ছিল, মার্কিন সরকার কর্তৃক পরিস্থিতি মোকাবিলার বিষয়ে আমি ঢাকার মার্কিন কমিউনিটিকে উৎসাহিত করেছিলাম। অবশ্যই সেটা সত্য ছিল না। আমি বললাম, সেটা ছিল এমন একটা অবস্থা, যা প্রত্যেকেই উপলব্ধি করেছিলেন। আমার কাউকে উৎসাহ দেওয়ার দরকার ছিল না। উৎসাহ দেওয়ার বিষয়ে আমি কিছুই করিনি। আমি তাঁদের সঙ্গে একাত্ম ছিলাম। কিন্তু উৎসাহ দিইনি। আমার কথা শুনে ক্রিস ও জো সিসকো কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু ক্রিস নাক গলালেন। তিনি একটি সম্পূরক পর্যালোচনা বিবৃতি লিখেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল, ‘আমি ওয়াশিংটনের সঙ্গে যথাযথ আচরণ করিনি। আমি তার প্রতিবাদ করেছিলাম।’
ব্লাডের অন্যতম সহকর্মী অ্যান্ড্রু আই কিলগোর (১৯৬৭-৭০ সালে ঢাকায় পলিটিক্যাল অফিসার ছিলেন) ২০০৪ সালে লিখেছেন, ভিন্নমত প্রদর্শনের মাশুল তিনি দিয়েছিলেন। চাকরিজীবনে সে ক্ষতি কখনো পূরণ হয়নি। আফগানিস্তান ও ভারতে তিনি দুবার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ কিসিঞ্জার তাঁকে রাষ্ট্রদূত হতে দেননি। ব্লাড চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন, যাকে তিনি বলেছিলেন ‘স্ব-আরোপিত নির্বাসন’। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার মতে, ব্লাড বলেছিলেন, ‘আমি আমার ভিন্নমতের মূল্য শোধ করেছি। কিন্তু আমার সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। কারণ, ভুল ও শুদ্ধের সীমারেখাটা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট।’ চলবে
গতকালের পর
প্রেখট: কিন্তু আপনি যখন মাঠে থাকবেন, ওয়াশিংটনের অবস্থান আপনার জানার কথা নয়।
ব্লাড: আমরা সত্যিই মাঠে থেকে কিছুই জানতাম না। ওয়াশিংটন থেকে যখন কোনো মিশনে বার্তা আসে, তখন বোঝা যায় না যে সেটা আসলে কে লিখেছেন। আমি ওয়াশিংটনে আসার আগে পর্যন্ত বুঝতেই পারিনি যে এনইএ (নর্থইস্ট এশিয়া) এবং সরকারের অন্যত্র যাঁরা এ বিষয়ে কাজ করছিলেন, তাঁরা সবাই আমাদের মতোই ভাবছিলেন। আমাদের প্রতি তাঁদের জোরালো সমর্থন ছিল।
প্রেখট: মার্কিন স্বার্থে সংকট নিরসনের যেসব উপায় ছিল, সেগুলো আপনি কীভাবে দেখেছিলেন? আপনার ধারণা কী ছিল? সমস্যা যে সৃষ্টি হচ্ছিল, সেটা ঠিক কী নিয়ে? মার্কিন নাগরিক স্থানান্তর অথবা প্রতিবেদন তৈরি? আপনি কীভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন?
ব্লাড: আসলে খুব নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। কিন্তু ২৫ মার্চের পর আমরা যখন ক্র্যাকডাউন সম্পর্কে প্রতিবেদন পাঠাতে শুরু করি, তখন থেকেই বিষয়টির সূচনা ঘটে থাকবে। আমি স্বীকার করব যে, আমরা খুব খোলাখুলিভাবে প্রতিবেদন পাঠাচ্ছিলাম। কূটনৈতিক রীতিনীতির ছদ্মাবরণে আমরা কিছুই ঢাকতে চাই না। সেই রাতে সম্ভবত পাঁচ হাজার লোক হত্যার শিকার হয়েছিল। আমাদের কাছে সাক্ষ্য-প্রমাণও ছিল, যদিও এটা ঠিক যে আমার নিজের সামনে কাউকে খুন হতে দেখিনি। কিন্তু আমাদের যোগাযোগে ক্যাথলিক যাজকেরা ছিলেন। দেশজুড়েই তাঁরা ছিলেন। যখন হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে মেশিনগানের গুলি চলেছে, তখন তারা পালিয়ে ক্যাথলিক মিশনে আশ্রয় নেয়। আমরা আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য মার্কিন চিকিৎসকদের পাঠিয়েছিলাম। প্রকৃতপক্ষে, আমরা তাঁদের যেতে বলিনি। তাঁরা নিজে থেকে গিয়েছিলেন। সুতরাং মার্কিন প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ আমাদের প্রতিবেদনের উৎস ছিল।
প্রেখট: ওয়াশিংটনে তখন কী ঘটছিল? আপনার পাঠানো প্রতিবেদনগুলো পেয়ে তারা ঠিক কী করেছিল?
ব্লাড: হ্যাঁ, আমি যেটা স্মরণ করতে পারি, আমাদের পাঠানো প্রতিবেদনগুলো তারা অবিশ্বাস করেছিল।
প্রেখট: আপনি আসলে এমন কিছুই ঢাকা থেকে পাঠাননি, যা তারা শুনতে চেয়েছিল।
ব্লাড: আপনি ঠিক বলেছেন।
প্রেখট: আপনার সেই ভিন্নমতের টেলিগ্রামের কথা বলুন। সেটা কি মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার আগে?
ব্লাড: হ্যাঁ। প্রকৃতপক্ষে আমাদের ১২ বা ১৩ জন কর্মকর্তা (উল্লেখ্য, ২০ জন তাতে সই দিয়েছিলেন) সেই বার্তার খসড়া তৈরি করেছিলেন। আমি খসড়া তৈরি করিনি। তাঁরা আমার কাছে এলেন এবং বললেন, ‘আমরা এই বিবৃতি পাঠাতে চাই।’ যুক্তরাষ্ট্র নৃশংসতার নিন্দা জানাতে পারেনি, সে জন্য আমরা ভীষণ মর্মাহত ছিলাম। তাঁরা প্রত্যেকেই এইড, ইউএসআইএর উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু যিনি আমার ডেপুটি ছিলেন, তিনি তাঁদের একজন ছিলেন না। তিনি ছিলেন ভীরু ও ভীতসন্ত্রস্ত। কিন্তু আমরা সবাই প্রত্যেকের মতামত সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। সুতরাং আমি সেই বিবৃতি পাঠাতে মনস্থ করলাম এবং পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু সেই বিবৃতির সঙ্গে আমি একটি সম্পূরক জোরদার বিবৃতি পাঠালাম। আমি তাতে বললাম, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে এই বিবৃতির খসড়া তৈরি করিনি। আমার কাছে এটা উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু এঁরাই আমার উত্তম কর্মকর্তা। তাঁরা যা বলেছেন আমি তা বিশ্বাস করি। আমি সম্পূর্ণভাবে তাঁদের ভাবাবেগ ধারণ করি।’ এরপর আমি ট্রান্সমিট করলাম। এখন আমার মনে পড়ে, আমরা গোপনীয় (সীমিত বিতরণ) লিখে পাঠিয়েছিলাম।
প্রেখট: হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, আপনি এটা লো-ক্ল্যাসিফিকেশন করেছিলেন, যাতে এটি ফাঁস হয়ে যায়।
ব্লাড: সেটা সত্যি নয়। সিক্রেট ছিল সর্বোচ্চ শ্রেণীকরণ, যেটা আমরা তখন ব্যবহার করতাম। উচ্চতর ছিল ‘এক্স ডিস’ মানে এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউশন। আমার অবশ্য সেটাই করা উচিত ছিল। আজ আমি তা স্বীকার করি। কিন্তু সেই সময়ে আমি সর্বোচ্চ ক্ল্যাসিফিকেশন করেছিলাম, কারণ সেটা করতেই আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি, আমরা সেই বার্তা পশ্চিম পাকিস্তানের দূতাবাসসহ ওয়াশিংটন ও পাকিস্তানের অন্যান্য মিশনে পাঠিয়েছিলাম।
প্রেখট: দূতাবাসের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? তারা কি কোনো মন্তব্য করেছিল?
ব্লাড: তারা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে অন্য মিশনগুলোর কাছ থেকে বিবৃতিটি প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিল। আমি মনে করতে পারি না যে দূতাবাস কিছু বলেছিল কি না। সেই সময়ের রাষ্ট্রদূত এবং আমার মধ্যে কখনো কোনো কথা-কাটাকাটি হয়নি।
প্রেখট: তখন রাষ্ট্রদূত ছিলেন ফারল্যান্ড। যত দূর জানি, তিনি রূঢ় কথা বলার লোক নন। নম্র স্বভাবের ভদ্রলোক।
ব্লাড: তিনি কিন্তু প্রয়োজনে যথেষ্ট কঠোর হতে পারতেন। আর ছিলেন সিড সোবার। আমরা দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম, ওই বিবৃতিটি যখন তাদের পাঠাব, তখন তাদের পছন্দ হবে না।
প্রেখট: যা-ই হোক, আপনি যদি এত ভাবনাচিন্তা করতেন তাহলে ওই বার্তা পাঠাতে পারতেন না।
ব্লাড: সেই সময়ে ভিন্নমতের বার্তা যে এভাবে পাঠানো যায়, সে সম্পর্কে সবে আমরা কিছু কথাবার্তা শুনছিলাম।
প্রেখট: সুতরাং দূতাবাস থেকে আপনি কোনো প্রতিক্রিয়া পাননি। ওয়াশিংটনের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? কেউ কি বলেছিল, আপনি ঠিক কিংবা ভুল?
ব্লাড: আমরা সংবাদপত্র পাওয়া শুরু করলাম। যখন সেটা ফাঁস হলো। তার আগেই আমরা জানতাম, এটা ফাঁস হয়ে গেছে। এর কয়েক সপ্তাহ পর আমি ভাবতে শুরু করলাম, আমার মনে হয়, নিজ থেকেই বদলির প্রস্তাব করা উচিত।
প্রেখট: আপনাকে যে বদলি করা হবে, সে কথা কে প্রথম বলেছিল?
ব্লাড: সিড সোবার হতে পারেন। কিন্তু সেটা বোধগম্য ছিল। কিন্তু তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
ব্লাড স্পষ্ট করেছেন যে তিনি বদলির কথা নিজ থেকে বলেননি। তাঁকে প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছিল এবং তিনি সেটা করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য: ‘দীর্ঘদিন ছুটি নিয়ে বাড়িতে যাইনি। তাই আমি লম্বা ছুটির দরখাস্ত করলাম। আমার অবশ্য তাড়া ছিল না, আমি মধ্য জুন পর্যন্ত থাকলাম। আমি জানতাম আমাকে যেতে হবে।’
এসব সত্ত্বেও ঢাকা ছেড়ে যেতে তাঁর মন সায় দেয়নি। পরিস্থিতি তাঁর জন্য ‘কৌতূহলোদ্দীপক’ ছিল। সব দেশই তখন ঢাকা মিশনের স্টাফ-সংখ্যা কাটছাঁট করেছিল; মার্কিন মিশনে সংখ্যা কমিয়ে প্রায় ১৩ জন করা হয়েছিল। ব্লাড লিখেছেন, ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার ঢাকা ত্যাগ করেন তাঁর সঙ্গেই। ইরানি মিশনপ্রধানকে থামানো হলো। পাকিস্তানিরা যুক্তি দেখাল, তিনি গৃহবন্দী থাকা ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। এটা তাদের পছন্দ হয়নি। তারা ইরানের শাহের নজরে এনেছিল, তখন তেহরান তাকে তলব করে। ব্লাড আরও বলেছেন, ‘আমি অবশ্য ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারের সঙ্গে দুবার দেখা করি। কিন্তু সেটা মার্কিন সরকারের নির্দেশে। কলকাতায় পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনার একইভাবে গৃহবন্দী ছিলেন। আমাদের কনসাল জেনারেল কিংবা তাঁর কোনো স্টাফ তাঁকে দেখতে গিয়েছে, প্রয়োজনীয় টুকিটাকি সরবরাহ করেছে। সেটা ছিল আদান-প্রদানের বিষয়। সুতরাং দুটি উপলক্ষে আমি ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনারের সঙ্গে দেখা করি। তিনি ছিলেন একজন ভালো বন্ধু।’
তাঁর বার্তাটি কী করে ফাঁস হয়েছিল, তিনি বাঙালি রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন কি না, এ প্রশ্নের জবাবে ব্লাড ‘না’ বলেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘তাঁরা তখন মৃত কিংবা পলাতক ছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। কারণ, সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিল যে আমরা তাঁদের গ্রহণ করেছিলাম। টিক্কা খানকে গভর্নর করে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল। এর আগে বেলুচিস্তানে তাঁর নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে সবাই অবগত ছিলেন। যখন তাঁকে শপথবাক্য পাঠ করানো হলো, সেই অনুষ্ঠানে যেতে আমি অস্বীকৃতি জানালাম। আমি একজন কনিষ্ঠ কর্মকর্তাকে পাঠালাম। আমি জানতাম, টিক্কা খান আমাকে ডাকবেন। কিন্তু আমি তাতে সাড়া দিইনি। এক দুপুরে আমি তখন সবে অফিসের কাজ শেষ করেছি। এক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন এলেন। তাঁর কাছে রিভলবার ছিল। তিনি জিপ থেকে নামলেন। আমার কাছে এলেন। বললেন, “আপনাকে গভর্নর সঙ্গে করে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে বলেছেন।” সুতরাং আমি তাঁর সঙ্গে গেলাম। আমাদের মধ্যে প্রীতিপ্রদ আলোচনা হলো। পরদিন সংবাদপত্রে খবর ছাপা হলো, আমেরিকান কনসাল জেনারেল গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু আমি সেটা করেছিলাম বন্দুকের মুখে (হাসি)।’
আর্চার ব্লাড জুনে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। তিনি যখন ওয়াশিংটনে গেলেন, তখন তাঁকে কেমন অভ্যর্থনা দেওয়া হয়েছিল। উত্তরে ব্লাড বলেছেন, ‘সিসকো অসন্তুষ্ট ছিলেন।’ উল্লেখ্য, সিসকোর পুরো নাম ড. যোসেফ জন সিসকো। বাংলাদেশের পুরো যুদ্ধের সময় এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার পরেও কিসিঞ্জারের অন্যতম দক্ষিণ হস্ত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি অবসর নেন। ২০০৪ সালে মারা যান। ব্লাড বলেন, ‘সিসকো আমাকে বার্তা ফাঁস করার জন্য অভিযুক্ত করলেন। কিংবা অন্তত আমি সেটাকে লো-ক্ল্যাসিফিকেশন করেছিলাম বলে উল্লেখ করলেন। নিক ভ্যালটস ও আরউইনের সঙ্গে দেখা করার একটা ব্যবস্থা করে দিলেন। আরউইন তখন ছিলেন ডেপুটি সেক্রেটারি। তিনি যথেষ্ট বন্ধুভাবাপন্ন ছিলেন। তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন ভারতীয় হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা সম্পর্কে আমার কী ধারণা। নিক বলেছিলেন, “তোমার উচিত এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলা”।’
ব্লাড আরও যোগ করলেন, ‘এই দুজনের সঙ্গে কথা বলে আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম। এরপর আমি ছুটি কাটাতে কলারাডোয় ফিরে যাই। আমি স্ত্রীর সঙ্গে যোগ দিই। আমি অনুমান করি, তখনই হাওয়ার্ড শেপার্ড আমাকে টেলিফোন করেন। তিনি জানালেন আমাকে হার্টার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। পুরস্কার নিতে আমি যেন ওয়াশিংটনে ফিরে আসি। সেটা ছিল আসলে আমার জ্যেষ্ঠদের তরফে আমার কর্তব্য পালনের প্রতি একটা স্বীকৃতি। পরে আমি কথা বলেছিলাম ক্রিস ভ্যান হোলেনের সঙ্গে। তিনি আমাকে সহায়তা দিয়েছিলেন। এ সময় আমি আমার সম্পর্কিত দক্ষতা প্রতিবেদনের অনুলিপি পাই। সিড সোবার সেটা লিখেছিলেন। তাতে দুটি বিষয় আমাকে বিচলিত করে। একটি ছিল, মার্কিন সরকার কর্তৃক পরিস্থিতি মোকাবিলার বিষয়ে আমি ঢাকার মার্কিন কমিউনিটিকে উৎসাহিত করেছিলাম। অবশ্যই সেটা সত্য ছিল না। আমি বললাম, সেটা ছিল এমন একটা অবস্থা, যা প্রত্যেকেই উপলব্ধি করেছিলেন। আমার কাউকে উৎসাহ দেওয়ার দরকার ছিল না। উৎসাহ দেওয়ার বিষয়ে আমি কিছুই করিনি। আমি তাঁদের সঙ্গে একাত্ম ছিলাম। কিন্তু উৎসাহ দিইনি। আমার কথা শুনে ক্রিস ও জো সিসকো কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু ক্রিস নাক গলালেন। তিনি একটি সম্পূরক পর্যালোচনা বিবৃতি লিখেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল, ‘আমি ওয়াশিংটনের সঙ্গে যথাযথ আচরণ করিনি। আমি তার প্রতিবাদ করেছিলাম।’
ব্লাডের অন্যতম সহকর্মী অ্যান্ড্রু আই কিলগোর (১৯৬৭-৭০ সালে ঢাকায় পলিটিক্যাল অফিসার ছিলেন) ২০০৪ সালে লিখেছেন, ভিন্নমত প্রদর্শনের মাশুল তিনি দিয়েছিলেন। চাকরিজীবনে সে ক্ষতি কখনো পূরণ হয়নি। আফগানিস্তান ও ভারতে তিনি দুবার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ কিসিঞ্জার তাঁকে রাষ্ট্রদূত হতে দেননি। ব্লাড চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন, যাকে তিনি বলেছিলেন ‘স্ব-আরোপিত নির্বাসন’। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার মতে, ব্লাড বলেছিলেন, ‘আমি আমার ভিন্নমতের মূল্য শোধ করেছি। কিন্তু আমার সামনে কোনো বিকল্প ছিল না। কারণ, ভুল ও শুদ্ধের সীমারেখাটা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট।’ চলবে
No comments